
গত দেড় দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে বিষয়টি সবচেয়ে লক্ষণীয়, তা হলো মুক্তিযুদ্ধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের প্রশ্নে বিএনপির নিরবতা। এক সময়ের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হয়েও তারা এই স্পর্শকাতর বিষয়গুলোতে স্পষ্ট অবস্থান না নিয়ে অনেকটাই আত্মরক্ষামূলক ভূমিকা নিয়েছিল। এর ফলে শুধু আওয়ামী লীগ নয়, সাধারণ মানুষের মনেও তাদের দেশপ্রেম ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল।
বর্তমানে বিএনপি যে অবস্থান নিয়েছে—স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে স্পষ্টভাবে জাতির পাশে দাঁড়ানো, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতি সমর্থন জানানো, এবং একাত্তরের বিরোধিতাকারীদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ—তা যদি তারা গত ১৫ বছর আগেই শুরু করতো, তাহলে হয়তো দেশের রাজনৈতিক চিত্র ভিন্ন হতো। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকার অন্যতম একটি কারণই ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে তাদের অস্পষ্টতা, যা আওয়ামী লীগ সফলভাবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে।
আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বিএনপির নীরবতা ও দ্বিধান্বিত অবস্থান সেই প্রচেষ্টাকে সহজ করে দেয়। ফলে রাজনৈতিকভাবে এক ধরনের ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়, যেখানে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি কিংবা সংশ্লিষ্ট প্রশ্নে নিরুত্তর থাকা মানেই সন্দেহভাজন হয়ে যাওয়া।
বর্তমান সময়ে বিএনপি যেভাবে জাতীয় স্বার্থ, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিষয়ে কথা বলছে, তা অনেকের দৃষ্টিতে ইতিবাচক। তবে এই অবস্থানকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছেন কেউ কেউ। বিশেষ করে আগামী জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবে কোনঠাসা করতে এবং আওয়ামী লীগের ‘ভোটব্যাংক’ আকর্ষণ করতেই এ ধরনের আচরণ করছে বলে অনেকে মনে করছেন। এটি সত্য হলেও, এই কৌশল দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হতে পারে যদি বিএনপি নিজেদের অবস্থানকে আন্তরিকভাবে বজায় রাখে।
আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় দেখা যাচ্ছে, শুধু উন্নয়ন কিংবা অর্থনীতি নয়—দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয় স্বার্থ ও মূল্যবোধ-ভিত্তিক রাজনীতি এখনও গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ এখনও প্রশ্ন করে, আপনি একাত্তরের পক্ষে ছিলেন কি না? আপনি স্বাধীনতার স্বপক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন কি না? এই প্রশ্নগুলো পাশ কাটিয়ে এখন আর বড় রাজনীতি সম্ভব নয়।
বিএনপির জন্য এখন সময় এসেছে—এই ইতিবাচক অবস্থানকে কৌশল হিসেবে নয়, বরং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা হিসেবে দেখানোর। অতীতের নীরবতা কাটিয়ে নতুন করে জাতির কাছে দায়বদ্ধতার বার্তা দেওয়ার এটাই উপযুক্ত সময়। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা হোক মতাদর্শের, হোক উন্নয়নের, হোক জাতির ইতিহাসের সঠিক উত্তরাধিকারের প্রশ্নে—তবেই বাংলাদেশে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও পরিপক্ব গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২৫ রাত ১১:০৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



