somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

২২ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১২:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানবাধিকার মানুষের জন্মগত অধিকার। এই অধিকার লংঘনের সুযোগ কারো নেই। একজন মানুষ পৃথিবীতে মানুষ হিসাবে এই অধিকার চুাড়ান্তভাবে ভোগ করার অধিকারী। জাতিসংঘ সনদ দ্বারা এই অধিকার স্বীকৃত। প্রতি বৎসর ১০ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাপী বিশ্ব মানবাধিকার দিবস আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্যাপনের মাধ্যমে মানবাধিকারের চুড়ান্ত স্বীকৃতিকে মানুষের জন্য সার্বজনীন করা হয়। এই মানবাধিকার বিশ্বের কোন দেশ, গোষ্টী, দল, জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এটি বিশ্বব্যাপী সকল জাগতিক সম্পর্কের সীমানা পেরিয়ে সকল মানুষের চিরন্তন অধিকার রক্ষায় আপোষহীন। মানবাধিকারের ক্ষেত্র ব্যাপক। মৌলিক অধিকার মানবাধিকারের একটি অংশমাত্র। এই মানবাধিকারের বর্তমান আইনগত উৎস জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ কর্তৃক ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা ও আন্তর্জাতিক আইন। এই অধিকার সর্বজনীন, শ্বাশত, সহজাত ও চিরন্তন । কোন মৌলিক সীমারেখা দ্বারা এটি সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি সরকার ও ব্যক্তি উভয়ের বিরুদ্ধে কার্যকর করা যায়। মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি আশরাফুল মাখলুকাত হিসাবে মানুষ যেসব অপরিহার্য অধিকার নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন তাই মানবাধিকার। তাই প্রকৃত এবং শ্বাশত এই অধিকার হরণ করলেই তা হয় মানবাধিকার লংঘন, সমগ্র মানব সমাজের জন্য অবমাননাকর। বাংলাদেশের রাষ্ট্র বিজ্ঞানী অধ্যাপক এমাজউদ্দীনের মতে মানবাধিকারকে সাতটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে তুলে ধরা যায়ঃ- [এক] এই অধিকার এমন যা শুধু মানবের, অন্য কোন জীবের নয়। [দুই] মানবাধিকার সার্বজনীন। দল-মত-ধর্ম-জাতি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সবার। [তিন], মানবাধিকার সবার জন্য সমান। কারো কম কারো বেশী এই অধিকার এক্ষেত্রে অচল। [চার] মানবাধিকার বংশ মর্যাদা কর্তৃক অথবা সম্পদের নিরিখে নির্ধারিত হতে পারে না। [পাঁচ] এ অধিকার আদায়যোগ্য এবং রাষ্ট্রকর্তৃক বলবৎ যোগ্য। [ছয়] বিশ্বের সর্ব স্থানে সকল সময়ের জন্যে, সকল মানুষের প্রাপ্য এই অধিকার। [সাত] এই অধিকার কেউ কাউকে দেয় না অথবা এর প্রাপ্তি কারো দয়ার উপর নির্ভরশীল নয়।
আধুনিককালে মানবাধিকারের ব্যাপ্তি এতই বেশী যে, এই অধিকারের সীমানা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয় বরং রাষ্ট্রের সামষ্টিক বিষয়ে, সামগ্রিক কর্মকান্ডের প্রতিটি দিক ও বিভাগের সাথে মানবাধিকারকে অবিচ্ছেদ্য মনে করা হয়। তাই অর্থনৈতিক শোষণ, রাজনৈতিক নিপীড়ন ও সাংস্কৃতিক গোলামী হতে মানবতার মুক্তি আধুনিক মানবাধিকারের মূল সুর।

উপরোক্ত মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই মূলত:

১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণা জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র গ্রহণ করেন এবং মানবাধিকার সংরক্ষনে অঙ্গীকার বদ্ধ হন। বিশ্লেষকদের মতে মানবাধিকারের এই দলিলটি বিশ শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দলিল। কেননা এই দলিলের মাধ্যমে বিশ্বের সকল মানুষের অধিকারের কিছু দাবী আন্তর্জাতিক আইনের কাঠামোয় স্বীকৃতি লাভ করে বিধিবদ্ধ হয়েছে। মূলত: ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্টে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে পৃথিবীর ইতিহাসের মানবাধিকার লংঘনের যে মহা ধ্বংসযজ্ঞ আমেরিকা চালায় তার প্রতিক্রিয়ার সূত্র ধরে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠা ও পরে ১৯৪৮ সালে ১০ ডিসেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের তত্ত্বাবধানে সাবর্জনীন মানবাধিকার সংরক্ষনের যাত্রা শুরু হয়। তবে অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় আজ থেকে ষাট বৎসর পূর্বে বিশ্বে সার্বজনীন মানবাধিকারের স্বীকৃতি এলেও তখন যে নাজুক অবস্থা বিশ্বে বিদ্যমান ছিল আজও তার তেমন পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। তখন ও যেভাবে মানবাধিকার দেশে দেশে লংঘিত হয়েছে এখনো তেমনিভাবে দ্বিধাহীনচিত্তে লংঘিত হচ্ছে।
বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো অপেক্ষাকৃত দূর্বল দেশগুলোর মানবাধিকার সংরক্ষনে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন উপদেশ ও নীতিমালা পেশ করছে বটে কিন্তু নিজ দেশ এবং ভিন্ন দেশে তাদের দ্বারা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লংঘনের যে ভয়াবহ বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়ছে তা অনেক বেশী ভয়ংঙ্কর ও মারাত্মক। মূলত: মানবাধিকার ঘোষনার প্রেক্ষাপটে বিশ্ব ১৯৪৮ সালে যেমন ছিল ২০১০ সালেও তেমন রয়েছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়ে অবস্থার অবনতি হয়েছে। সুতরাং এমতাবস্থায় বিশ্বব্যাপী ১০ ডিসেম্বর মানবাধিকার দিবস পালন মানবাধিকারকে উপহাস ছাড়া আর কি হতে পারে?

মানবাধিকারের গোড়ার কথাঃ

আধুনিক সভ্যতায় মানবাধিকার অধিকতর গুরুত্ব পেলেও এর ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন। গ্রীক দার্শনিকদের চিন্তাধারায় মানবাধিকার উম্মেচিত হয়েছিল যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। গ্রীক দার্শনিক এ্যারিস্টোটেল, প্লেটো, প্রমুখের দর্শন তত্ত্বে মানবকল্যান এবং এই জন্য উপস্থাপিত নীতিমালা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। রোমান আইন ছিল মানব সভ্যতার অন্যতম গর্ব। রোমান আইন শাস্ত্রবিদ সিসেরো, পলিবিয়াসদের প্রাকৃতিক আইনের ব্যাখ্যায় মানুষের অধিকারের চিত্র ফুটে উঠে। আধুনিক আইন বিজ্ঞান যে রোমান আইনের আধুনিকতম সংরক্ষন এই কথা সব আধুনিক আইনবিদ স্বীকার করতে বাধ্য। রোমান যুগে প্লেবিয়ানদের অত্যচার ও নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্য জুরিস্টরা নতুন আইন প্রবর্তন করেন। বিশেষ করে দাস শ্রেনী সহ সমাজের নিম্ন শ্রেনীর মানুষের অত্যান্ত শোচনীয় অবস্থার মুক্তির জন্য সম্রাট জাষ্টিনিয়ানের মানবতাবাদী আইন প্রনয়ন মানবাধিকারের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়।

সপ্তম শতাব্দীতে ইসলামের বদৌলতে প্রকৃত মানবাধিকারের গোড়াপত্তন হলেও কালের পরিক্রমায় দশম শতাব্দীতে এসে ইসলামের শ্বাশত মানবাধিকার সনদগুলো স্মৃতির পাতায় ঝাপসা হয়ে যায়। মানবাধিকারের ক্ষেত্রে ইসলামের প্রকৃত মর্মবাণী ভিন্ন ব্যাখ্যায় ভিন্ন আংগিকে উপস্থাপিত হয়ে ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এই প্রবন্ধের সমাপনীতে ইসলামের স্বর্ণযুগে মানবাধিকারের সার্বজনীন যে মৌলিক ঘোষণা তার একটি বিবরণ তুলে ধরার আশায় এই অনুচ্ছেদে সেটি এড়িয়ে গেলাম।

দ্বাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে রেনেসাঁর যুগ থেকে মানবাধিকারের ধারণাটি শক্তিশালী হয়ে উঠে। নতুন রেনেসাঁর চিন্তা প্রবাহে ভীষণভাবে প্রণোদিত হয়ে রাজনৈতিক দার্শনিকরা একদিকে রাজশক্তির প্রচন্ডতা এবং অন্যদিকে খ্রীষ্টীয় চার্চের পোপদের সর্বগ্রাসী নিয়ন্ত্রন থেকে মানুষের মুক্তির উপায় খুঁজতে লাগলেন। এই ধারাবাহিকতায় বৃটেনে ১২১৫ সালের Magna Carta কে মৌলিক অধিকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিহাস সৃষ্টিকারী সনদ বলে মনে করা হয়। কিন্তু সাধারণ জনগনের সাথে এর কোন সম্পর্কই ছিল না। কারণ এটা Barons দের স্বার্থ সংরক্ষনে রাজার সাথে কৃত একটি চুক্তি ছিল। এরপর মৌলিক মানবাধিকার আন্দোলনের সুচনা ঘটে বৃটেনের রাজা কনরাড যখন একটি ফরমান বলে parliament এর ক্ষমতা নির্ধারন করেন। ১৩৫৫ সালে একে বৃটিশ পার্লামেন্টে Megna carta স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং বিনা বিচারে কাউকে সম্পত্তি হতে উচ্ছেদ, শাস্তি প্রদান বা মৃত্যুদন্ড দেয়া নিষিদ্ধ করা হয়। চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দীতে ম্যাকিয়াভেলির স্বৈরতন্ত্রের জয়জয়কারে মানবাধিকার আন্দোলন কিছুটা ঝিমিয়ে যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে এই আন্দোলন পুণরায় চাঙ্গা হয় এবং যার ফলশ্রূতিতে ১৬২৮ সালের Pitition of Rights ১৬৭৯ সালের arbitrary arrest বা detention জনগণকে নিরাপত্তা দেয়। ১৬৮৯ সালে Bill of Rights মানবাধিকারের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসাবে বিবেচিত হয়। লর্ড এবটোনের ভাষায় এটি ইংরেজ জাতির মহত্তম অবদান। এ প্রসঙ্গেElder William Pitt বলেন Megna carta the pitition of Rights and the Bill of Rights are the Bible of the British constitution.
উপরোক্ত আইন দ্বারা মৌলিক অধিকারকে সুনির্দিষ্ট করে দেয়া হয়। এবং Ges 1. trail by jury 2. freedom from (i) cruel punishment, 2. excessive fine, 3. excessive bail ইত্যাদি নিশ্চিত করা হয়। ১৭৭৬ সালে আমেরিকায় vurginia তে সেখানকার বিপ্লবীরা Bill of Rights পাশ করে। এতে বলা হয় all man are by nature fully free and independent and have certain rights namely.
• The enjoyment of life and liberty.
• Acquiring of possessing property.
• Obtaining hapiness

একই বৎসরে স্বাধীনতার ঘোষণাপপত্রে আরো যুক্ত হয়-
• Freedom of speech and press.
• Speedy and fair trail
• Free exerciese of religion

১৭৮৯ সালে ফ্রান্সেthe declaration of rights of man গৃহীত হয় সেখানে বলা হয় men are born and remain free and equal in rights. উনবিংশ এবং বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বের দেশে দেশে এ জাতীয় ঘোষণাকে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রবণতা আরো স্স্পুষ্ঠ রূপ ধারণ করে। ১৯৪০ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে H.G Wales তার New World order গ্রন্থে মানবাধিকারের একটি সনদ ঘোষনার পরামর্শ দেন। তারই ধারাবাহিকতায় জাতি সংঘ ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ ঘোষণা করেন।
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ঘোষিত মানবাধিকার সনদের স্বরুপ:
১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বর সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা সর্বশেষ বিশ্ব মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই ঘোষনার ৩০টি অনুচ্ছেদের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে মানবের মর্যাদা সম্পর্কে এই ধারা মতে সকল মানুষ জন্মগতভাবে স্বাধীন ও সমান। প্রত্যেক মানুষের মর্যাদা এবং অধিকার সমান। সকলেরই রয়েছে বিবেক এবং বিবেচনা শক্তি। কাজ কর্মে তারা পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ প্রতিষ্ঠা করবেন। ৩-২১ অনুচ্ছেদ ১৯টিতে ঘোষণা করা হয়েছে নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার। ২২-২৭ অনুচ্ছেদ ৬টিতে ঘোষণা করা হয়েছে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার, এবং ২৮-২৯ এ ২টিতে ঘোষণা করা হয়েছে অধিকারের অপরদিক যে দায়িত্ব তার বিবরণ।
মানবাধিকার সনদের ৮ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে সংবিধান বা আইন কর্তৃক প্রদত্ত মৌলিক অধিকার লংঘিত হলে এখতিয়ার সম্পন্ন জাতীয় বিচারালয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের কার্যকর বিচারালয়ের মাধ্যমে প্রত্যেক মানুষের কার্যকর প্রতিকার পাবার অধিকার থাকবে। মোদ্দা কথা, ব্যক্তির যে স্বতন্ত্র সত্ত্বা রয়েছে,রাষ্ট্র বা অন্য কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের এই স্বতন্ত্র সত্ত্বা ক্ষুন্ন করার ক্ষমতা নেই। সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি যে অনন্য ও অতুলনীয় এবং চুক্তি ও বিবেক বিচারে যে অপূর্ব তা সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

দেশে দেশে বিপর্যস্ত মানবাধিকার :


মানবধিকার নিয়ে দেশে দেশে আজ জোরালো শ্লোগান উঠেছে । মানবাধিকারের জন্য জাতিসংঘের সর্বজনীন ঘোষণার অনুসরণ ও আনুকুল্যে গড়ে উঠেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ভাবে অসংখ্য মানবাধিকার সংগঠন। যে সংগঠনগুলোর পৃষ্ঠপোষক অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্র ও ব্যক্তিবর্গ। মানবাধিকার সংগঠন গুলো মানবাধিকার রক্ষার অভিভাবক সেজে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগে মাঝে মাঝে বক্তব্য বিবৃতি দেন। তাদের বক্তব্য বিবৃতি কার্যত জনমত গঠন কিংবা জনমতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে সক্ষম হলেও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে কোন ভূমিকা পালন করতে পেরেছে কিনা সেটি নতুন আরেক গবেষনার বিষয়। বাস্তবিক পক্ষে ঘোষণাপত্র কি মানবজাতিকে নির্যাতন,উৎপীড়ন, দমন,স্বৈরাচার,একনায়কত্ব ও ফ্যাসিবাদের হিং¯্র ছোবল থেকে মুক্তি দান করে স্বাধীন পরিবেশে নি:শ্বাস নেওয়ার এবং নিজেদের অধিকার ভোগের সুযোগ করে দিতে পেরেছে? এই ঘোষণা পত্রের বাস্তব অবস্থা এবং জাতিসংঘের অসহায় অবস্থার কথা আজ দেশে দেশে প্রমানিত সত্য হিসাবে প্রতীয়মান। ১৯৪৫ সালে যে উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তা ছিল বিশ্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শোষন ,লাঞ্ছনা,গুঞ্ছনা,যুদ্ধ,নির্যাতন বন্ধ করে বিশ্ব ব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা কিন্তু সেটি আজ দেশে দেশে ব্যর্থতায় পর্যুবসিত হয়েছে। মানবাধিকার রক্ষায় অভিভাবত্বকারী দেশগুলো মানবাধিকার লংঘনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী দায়ী। বিশেষ করে বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো যারা জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ভোট ও ভেটো প্রদানের মাধ্যমে ধরাকে সরাজ্ঞান করার শক্তি রাখে তাদের খামখেয়ালী পূর্ণ মনোভাব ও ছোট ছোট রাষ্ট্র গুলোর উপর প্রভুত্ব করার বাসনা জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য ব্যাহত করেছে। আর তাদের ইচ্ছা পূর্ণ করতে গিয়ে মানবাধিকার হচ্ছে লুণ্ঠিত । মানবাধিকার সংগঠন গুলো শক্তিহীন এবং বড় বড় রাষ্ট্র গুলোর তল্পিবাহক হয়ে যাওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানবাধিকার সংগঠন গুলো হয়ে পড়েছে অকার্যকর। তাদের না আছে মানবিক বিপর্যয় ঠেকানোর ক্ষমতা না আছে আইনগত বাধ্যবাধকতা পালন করানোর যোগ্যতা। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার সনদ ও তার ব্যতিক্রম নয়। আজকের বিশ্বে মানবিক বিপর্যয়ের সবচেয়ে বেশী শিকার বিশ্বের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলো । শক্তিধর দেশগুলোর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ হস্তক্ষেপে ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলো অসহায়। একটু চিন্তা করলে দেখা যাবে মানবিক বিপর্যয় দেশে দেশে বহুমাত্রিক এবং বহু উপায়ে সংঘটিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও প্রত্যক্ষ হামলা,নির্যাতন,অবরোধ,যুদ্ধের মাধ্যমে মানবধিকার লংঘন ও লুণ্ঠন করা হচ্ছে আবার কোথাও কোথাও আভ্যন্তরীন হস্তক্ষেপ এই অধিকারকে আরো বেশী প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এক গবেষনায় দেখা গেছে বিশ্বের কয়েকটি শক্তিধর দেশের কথা বাদ দিলে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে সন্ত্রাসের মাধ্যমে মানবধিকার হরন করা হচ্ছে । একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে সাক্ষ্য প্রমানহীন অভিযোগে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ আমেরিকার পক্ষ হতে আফগানিস্তানের উপর সর্বাতœক যুদ্ধ ঘোষণা ও হামলায় সেটিই প্রমানিত হয়েছে । শুধুমাত্র একজন ওসামা বিন লাদেনকে ধরার নামে একটি রাষ্ট্রকে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলা ও লাখ লাখ বেসামরিক লোকসহ নারী-পুরুষ ও শিশুকে হত্যা মানবাধিকার লংঘনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই যুদ্ধে পুরো আফগানিস্তান মৃত্যুপুরীতে পরিনত হয়। ২৬ নভেম্বর ২০০১ সালে শুধু কুন্দুজের কিল্লা জঙ্গী ঘাটিতে পুড়িয়ে মারা হয় ৩৬০০ বন্দীকে যেটি মানবাধিকার লংঘনের নজিরবিহীন ঘটনা। ২০০১ সালে দশ বৎসর পূর্বে যে যুদ্ধ শুরু হয়েছিল আজও সেই যুদ্ধ চলমান কবে নাগাদ সেই যুদ্ধ শেষ হবে বলা মুশকিল । এর মাধ্যমে কি প্রমানিত হয়না ছোট ছোট রাষ্ট্রগুলোর ব্যাপারে এখনো জোর যার মুল্লুক তার নীতি অব্যাহত আছে। আজ আফগানিস্তানের অসংখ্য মানুষ মানবেতর জীবন-যাপন করছে অথচ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ মানবতাহীন এই যুদ্ধকে বৎসরের পর বৎসর নীরব সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে। ২০০৪ সাল হতে আমেরিকার উদ্যোগে ইরাক যুদ্ধ আজ মানবাধিকার লংঘনের সর্বশেষ সীমাটিও অতিক্রম করে চলেছে। পারমানবিক অস্ত্র রাখার মিথ্যা অভিযোগে ইরাককে আজ ধ্বংস করে দেয়া হলো। যুদ্ধের মাধ্যমে ইরাকের প্রতিরক্ষা ও প্রশাসন নিজেদের করায়ত্ব করতে পারলেও এখনো পর্যন্ত ইরাক থেকে কোন পারমানবিক [ রাসায়নিক] অস্ত্র আমেরিকা উদ্ধার করতে পারেনি। আমেরিকা নিয়মিত পারমানবিক অস্ত্র তৈরী ও সংরক্ষন করে চলেছে আর ইরাকে তা না থাকা সত্বেও মিথ্যা অজুহাতে ইরাক কে ধ্বংসের রাজ্যে পরিনত করা হয়েছে। ইরাক যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক লোকসহ নারী-পুরুষ ও শিশু মারা গেছে এবং এখনো প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে এই ক্ষেত্রে শুধু মানবাধিকার নয় আমেরিকা আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতির সীমা লংঘন করেছে অথচ বলার কেউ নেই। ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনসহ অসংখ্য উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গকে বিচারের নামে মিথ্যা প্রহসনে মৃত্যুদন্ড দিয়েছে। আতœপক্ষ সমর্থন কিংবা উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ না দিয়ে মানবাধিকার লংঘন করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা নামমাত্র মাঝে মাঝে বক্তব্য-বিবৃতি দিলেও কার্যকর কোন উদ্যোগ কি নিতে পেরেছে? এই ভাবে বৎসরের পর বৎসর মানবাধিকার লংঘন হবে আর বিশ্ব বিবেক নীরব দর্শকের ভুমিকা পালন করবে কারন ক্ষমতাধর দেশগুলোর কাছে মানবাধিকারের সংজ্ঞা একটু ব্যতিক্রম । দীর্ঘ আট দশকেরও বেশী সময় ধরে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল মুসলিম রাষ্ট্র ফিলিস্তিনের উপর সর্বাতœক জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে আসছে সেখানে আজ মানবাধিকার চরমভাবে লংঘিত অথচ ক্ষদ্ররাষ্ট্র ইসরাইল আমেরিকার আসকারা পেয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন খবরের কাগজে ফিলিস্তিনী নারী-পুরুষের রক্তাক্ত লাশ ,শিশুদের নিথর দেহ বিশ্ব বিবেককে নাড়া দিতে সক্ষম হলেও এখনো অনিশ্চিত কবে তারা পাবে মানবাধিকারের সামান্যটুকু অধিকার । বিশ্বব্যাপী নিরপরাধ মুসলমানদের রক্তে আজ মানবাধিকার লংঘিত,মানবতা নিষ্পেষিত অথচ যারা তা ঘটাচ্ছে তারা আধুনিক সভ্যতার রক্ষক হিসাবে পরিচিত। কাশ্মীরি মুসলমানরা অর্ধশতাব্দী ধরে স্বাধীনতার সংগ্রাম করলেও তারা তাদের সেই স্বাধীনতাতো পায়নি উল্টা আজ তারা প্রতিনিয়ত লাঞ্চিত ও বঞ্চিত । নিরপরাধ কাশ্মীরি মুসলমান নারীও শিশুদের রক্তেও যেন মানবাধিকার জাগ্রত হয়না। নির্যাতিত নারী ও শিশুদের কানফাটা আর্তনাদ যেন তাদের বধির কর্ণকুহরে পৌঁছাতে পারেনা। চীনের উইঘুর মুসলমানদের নৃশংস হত্যা করা হয়, দেশ থেকে বের করে দেয়া হয় প্রতিনিয়ত অথচ তাদের যেন দেখার কেউ নেই । আরাকানের মুসলমানরা আজ রিপুজি। সেখানে স্বৈরশাসক তাদেরকে নিজ মাতৃভুমি থেকে বিতাড়ন করেছে। তারা থাকা খাওয়ার অধিকার বঞ্চিত। প্রতিবাদ করলে চলে হত্যা ও গ্রেফতারের নিষ্ঠুর নির্যাতন। ভারতের হায়দ্রাবাদ আর গুজরাটের মুসলমানরা সংখ্যালঘু হিসাবে নির্যাতিত হয় বার বার। পুড়ে মারা হয় তাদের, লুঠ করা হয় স্বর্বস্ব, দখল করা হয় ধর্মীয় প্রার্থনাগার মসজিদ। গুয়েন্তানামো কারাগারে যুদ্ধবন্ধীদের সাথে মার্কিন সৈন্যদের অত্যাচার ও নির্যাতন শুধু মানবাধিকার নয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতিকেও লংঘন করেছে। আজ এই ভাবে বিশ্বব্যাপী শক্তিধর দেশগুলোর অত্যাচারে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র দেশগুলো এবং দেশের অভ্যন্তরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলো তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে মুসলিম দেশ গুলোর প্রতি এই অমানবিক কার্যক্রম অব্যাহত গতিতে বেড়ে চলেছে।

মানবাধিকার পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনঃ-

মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার অনুকূলে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার আওতায় বিশ্বের প্রতিটি দেশে গড়ে উঠেছে জাতীয় মানবাধিকার সংগঠন। এই মানবাধিকার সংস্থা হতে পারে সরকারী তত্ত্বাবধানে অথবা বিশ্বব্যাপী কোন সংস্থার অধীনে গড়ে ওঠা স্বতন্ত্র সংগঠন।মানবাধিকার সংস্থাগুলো নির্যাতিত, অধিকার হারা বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ঝুঁকিপূর্ণ নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। সুতরাং এই মানবাধিকার সংস্থাগুলো কোন ব্যাক্তির নয়, নয় কোন গোষ্ঠি, ধর্ম ও বর্ণের। তারা স্বাধীন স্বতন্ত্র মুক্তচিন্তা ও বিশ্বাসের। কোন দেশ কিংবা দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন তাদের উদ্দেশ্য ও কাজ নয়। তারা দেশ ও দলের উর্ধ্বে।মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রত্যয়ী। আমরা বিশ্বাস করি বর্তমান বিশ্বের সমাজ বাস্তবতায় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দায়িত্বের পরিধি অনেক বিস্তৃত এবং ঝুঁকিপূর্ণ।

বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কাজের অংশ হিসেবে বাংলাদেশেও গড়ে উঠেছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বাংলাদেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ন ইস্যুতে মানবাধিকার সংরক্ষন এবং কোথাও লংঘন হলে তার প্রতিকারের জন্য এই সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং আগামী দিনেও রাখবেন এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন দেশের প্রতিটি মানুষের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখবেন এবং ঝুঁকি নিয়ে মানবাধিকার লংঘনের বিরুদ্ধে লড়বেন।প্রয়োজনে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা নিজস্ব স্বকীয়তা ঠিক রেখে সাধারন মানুষকে সম্পৃক্ত করে তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেন।বর্তমান বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন সেই কাজটিই করবেন এমনটি আমাদের প্রত্যাশা। বাংলাদেশের জাতীয় ও সমাজ জীবনের প্রতিটি স্তরে মানবাধিকার লংঘনের যে চিত্র আজ দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করছেন মানবাধিকার সংগঠন হিসাবে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঈিতে তার ব্যাপারে কথা বলা কমিশনের অবশ্যই উচিত। কিন্তু সেই কাজটি তারা করতে পেরেছে কিনা আজ মানবাধিকার দিবস পালনের প্রেক্ষাপটে তা আলোচনার দাবী রাখে। তাদের এমন কোন কাজ করা বা এমন কিছু বলা উচিত নয় যেগুলো তাদের মর্যাদা ও কাজ কে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে। মানবাধিকার সংস্থার কর্তা ব্যক্তিরা কোন দলের এজেন্ডা বাস্তবায়নের পক্ষে সাফাই গেয়ে যাবেন তা আমরা কখনো আশা করতে পারিনা। গত ২৮ অক্টোবর ২০১০ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড:মিজানুর রহমান বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বলেছেন- বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে ধীর গতিতে এগুচ্ছে, আমরা আশা করেছিলাম যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকার খুব দ্রুত গতিতে দৌড়াবে কিন্তু আমরা দেখলাম সরকার হামাগুড়ি দিয়েও চলতে পারছেনা। তিনি বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এ ক্ষেত্রে বলা যায় যে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মানবাধিকার বিষয়ক সরকারী বেসরকারী সেমিনারে আলোচনা করবেন অথবা মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কোন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করবেন। কিন্তু তিনি সেটি না করে একটি জনবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক সংগঠন বাসদের আলোচনা সভায় গিয়ে রাজনৈতিক ব্যক্তির মত গতানুগতিক সাফাই গাইলেন। তিনি আরো বললেন “৭৩” সালের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুন্যাল আর্ন্তজাতিক মানদন্ডে উত্তীর্ণ। যেখানে আর্ন্তজাতিক বিচার আদালতের সাবেক অনেক বিচারক ও কৌশলী এই ট্রাইব্যুন্যালের অনেক গুলো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং এই রকম ট্রাইব্যুন্যাল গঠনের এখতিয়ার বর্তমান সরকারের আছে কিনা সেই ব্যাপারে দ্বিমত পোষন করেছেন সেখানে তিনি জোর দিয়ে বলেছেন ট্রাইব্যুন্যাল আর্ন্তজাতিক মানের।এ ক্ষেত্রে তিনি নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুন্যাল ও টোকিও ট্রাইব্যুন্যালের কথা বলেছেন। অথচ এই ট্রাইব্যুন্যালগুলোর বিচার কার্যক্রমে পৃথিবীর অনেকগুলো দেশের সম্পৃক্ততা ছিল। বিচারক নিয়োগ তদন্ত কার্যক্রম ও সাক্ষ্য পদ্ধতির উপাদানগুলোও ছিল ব্যতিক্রম যেটি বাংলাদেশে গঠিত ট্রাইব্যুন্যালে মানা হয়নি। এখানে ট্রাইব্যুন্যাল গঠন, বিচারক নিয়োগ, তদন্ত কমিটি ও আইনজীবি প্যানেল সবকিছুই তাদের দলীয় সুত্রে গাঁথা। সুতরাং এ রকম বক্তব্য দেয়ার আগে তার উল্লেখিত ট্রাইব্যুন্যালদ্বয় এবং বর্তমান বাংলদেশে গঠিত ট্রাইব্যুন্যালের মধ্যে সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য ভালোভাবে খুঁজে দেখা দরকার ছিল। তাছাড়া বর্তমান যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিষয়টি একটি বির্তকিত রাজনৈতিক ইস্যু অতএব তিনি রাজনৈতিক দলের মত সুরে সুর মিলিয়ে এই বক্তব্য না দিয়ে পারতেন। বরং তিনি বলতে পারতেন যুদ্ধাপরাধের বিচার যাতে অবশ্যই স্বচ্ছ ও আর্ন্তজাতিক মানের হয় সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। স্বাধীনতার ৪০ বছর পর যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে গিয়ে কেউ যেন অন্যায় ভাবে শাস্তি ও হয়রানির স্বীকার না হয় সে বিষয়ে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তাহলে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে যথার্থ ভূমিকা পালন হত বলে আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু তিনি একবারের জন্যও সেই বিষয়টি বলতে পারলেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো সরকারের মত যে কোন ভাবে এই যুদ্ধাপরাধের বিচার হলে যথেষ্ট। তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে । তিনি এই বক্তব্য দেওয়ার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে ১ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল তাদের আইনের ১২টি ধারা সংশোধন করেন। যুদ্ধাপরাধ আইনের ধারার সংশোধন করে যুদ্ধাপরাধের তদন্ত চলাকালে কমিশন চাইলে যে কোন ব্যক্তিকে আটক রাখতে পারবেন। যেটি আগে ছিল তদন্তে দোষী প্রমানিত হলে কিংবা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেলে তাকে গ্রেফতার করতে পারবেন। মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ২৮ শে অক্টোবর যে আইনকে আন্তর্জাতিক মানে উত্তীর্ণ ও স্বয়ং সম্পূর্ণ বললেন মাত্র পাঁচ দিনের মধ্যে সেই আইনকে সংশোধন করে তদন্তে অভিযোগ না পাওয়া একজন মানুষকে আটকানোর যে নীল নকশা তৈরী করল জনাব মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এটিকে কোন মানবাধিকারের সংজ্ঞায় বিবেচনা করবেন। তাই আমরা মণেকরি যুদ্ধাপরাধ বিচার নিয়ে এটি মানবাধিকার কমিশনের মূলনীতির সম্পুর্ণ স্ববিরোধী বক্তব্য। মানবাধিকার কমিশন সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থেকে বিষয়টি পর্যবেক্ষন করতে পারেন। এখানে কারো মানবাধিকার লংঘন হলে জোর প্রতিবাদ করতে পারেন। ড. মিজানুর রহমান সাহেব হয়তো বলবেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় যারা বিরোধিতা করেছেন, হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন তাদের বিচারের কথা বলা ন্যায়সংগত, আমিও এক মত । কিন্তু মানবাধিকারের যারা রক্ষক তাদের কে শুধু একটা বিষয় মানলে হয়না অপরাধীর অধিকার নিয়েও তাদের কথা বলতে হয় কারন প্রত্যেক অপরাধীও মানুষ। অপরাধকারী যত হীন ও নীচু অপরাধ করুক । মানুষ হিসেবে মানবাধিকার পাওয়ার অধিকার কিন্তু তাদের আছে সে কথাটি বেমালুম ভুলে যাওয়া উচিত নয়।তদন্তদল পর পর দুই বার পিরোজপুর ঘুরে এসেও কোন অভিযোগ না পাওয়া সত্ত্বেও তাকে আটক রাখার জন্য নতুন আইনের সংশোধন করা কতটুকু যৌক্তিক ? এর মাধ্যমে কি প্রমানিত হয় না যুদ্ধাপরাধ বিচার ব্যক্তি-স্বার্থ চরিতার্থ করার নামান্তর । তা ছাড়া ছোটকাল থেকে শুনেছি ‘পাপীকে নয় পাপকে ঘৃনা কর’ মনে হয় এই নীতিবাক্যটি মানবাধিকার সনদের মূলনীতি। কিন্তু বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন যেন তার বিপরীত নীতি গ্রহন করেছেন। কমিশনের অন্যান্য কর্মকর্তা ব্যক্তিদের বিষয়টি ভেবে দেখার অনুরোধ জানাব। বাংলাদেশের এমন অনেক গুরুতর অপরাধ আছে যে গুলোর ব্যাপারে এই কমিশন গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা পালন করতে পারে। যে ২৮ অক্টোবর তিনি বাসদের আলোচনা সভায় গেলেন সেদিনটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক দিন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার রাজপথে প্রকাশ্য দিবালোকে ৭ জন মানুষকে সাঁপের মত পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সেটি কোন মানবাধিকারের মধ্যে পড়ে? যারা তাদেরকে হত্যা করল তাদের বিচার হলোনা, হয়তো বাংলার মাটিতে বিচার হওয়ার আর সম্ভাবনা নেই। ক্ষমতার জোরে বর্তমান সরকার জামায়াতের দায়ের করা সে মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। আপনি সে বিষয়টিতে কোন মন্তব্য করবেন ?
যে দেশে হাজারও খুন হয় আর ফাঁসির আসামী রাষ্ট্রীয় ভাবে ক্ষমা পায় ও মামলা প্রত্যাহার করে নেয়া হয় সেই সমস্ত খুনের ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে আপনি কোন মানবাধিকার দিয়ে সান্তনা দিবেন? যে কারণে প্রকাশ্য দিবালোকে সাপের মত পিটুনী খেয়ে খেয়ে গত সেপ্টেম্বরে জীবন দেন নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নুর বাবু, তার সন্তানরা হয়েছে এতিম আর স্ত্রী হয়েছে বিধবা। আর সরকারী মন্ত্রীরা এই ঘটনাকে নিয়ে করল জঘন্য মিথ্যাচার, যেখানে মানবধিকার গুমরে কাঁদে।
হায়রে মানবাধিকার হায়রে ক্ষমতা । হাজারও মানবতাহীন সমস্যার আবর্তে বাংলাদেশ আজ জর্জরিত। দেশে পানি নেই, গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই, অনাহারে- অর্ধাহারে মানুষ দিন কাটায়। শীতের মৌসুমে হাজার হাজার মানুষ প্রচন্ড শীতে কোঁকাতে কোঁকাতে মরবে তাদের অধিকার কে নিশ্চিৎ করবে? বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে হাজার হাজার রোগী সুচিকিৎসার অভাবে মারা যাচ্ছে প্রতিদিন, শয্যার অভাবে ভর্তি হতে পারেনা হাজারো রোগী সে সমস্ত মানুষগুলোর জন্য মানবাধিকার সংস্থার ভাবা উচিৎ। শুধু বক্তব্য-বিবৃতি নয় বাস্তব কিছু পদক্ষেপ কি নেয়া যায়না ? শুধু অন্যের আয়োজিত দলীয় আলোচনা সভায় বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে মানবাধিকার রক্ষার কতটুকু দায়িত্ব পালন হবে ? ঝোঁপ বুঝে কোপ মারার নীতি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর পরিত্যাগ করা প্রয়োজন।মানবাধিকারের সংজ্ঞায় সেটি পড়েনা। দেশের কারাগারগুলো আজ স্বৈরাচারের বন্দীশালা, রিমান্ডের নামে মানুষদের ধরে নিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় বর্বর নির্যাতন করে স্বীকারোক্তি আদায়ের পদ্ধতি কখনো মানবাধিকার সংস্থাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনা। সরকারী আইন শৃংখলা বাহিনী কর্তৃক মানুষ গুম করে পরবর্তীতে হত্যা করার মত জঘন্য প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে মানবাধিকার কমিশনের জোরালো ভুমিকা থাকা উচিত। ক্রসফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যা আইনের কোন ধারা সমর্থন করেনা, যা অহরহ বাংলাদেশে ঘটছে। বাংলাদেশের সীমান্তে ভারতীয় বি এস এফ বাহিনী প্রতিনিয়ত নিরপরাধ বাংলাদেশীদের হত্যা করা এবং ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে মানবধিকার লংঘন অব্যাহত রেখেছে। এ জন্য জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিশ্ব মানবাধিকার সংগঠন গুলোর সমন্বয়ে কোন প্রতিকার করতে পেরেছে কি ? আজ দেশের মানুষের মানবাধিকার ফিরিয়ে দিতে এই কমিশনের জোরালো ভূমিকা পালন করা শুধু উচিৎ নয় বরং কর্তব্য ও প্রাপ্ত দায়িত্বের অংশ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ডিসেম্বর, ২০১০ রাত ১২:২৩
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×