বাংলার নারী আন্দোলনের অগ্রদূত, লেখিকা, শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন এর জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
নারীদের স্বাতন্ত্র ও অনুকরণীয় পরিচিতি প্রতিষ্ঠার জন্য যিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন তিনি মুসলিম নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়া শুধু একজন সমাজ সংস্কারক বা কর্মী ছিলেন না। তিনি ছিলেন একজন অসাধারন সাহিত্যিক। নবনূর, সওগাত, মোহাম্মদী ইত্যাদি সাহিত্যপত্রে তাঁর বঙ্গগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ ও রসরচনা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সব ধরনের লেখাতেই ফুটে উঠেছে নারীদের সমস্যার কথা। তিনি বলেন, "মেয়েদের এমন শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে, যাহাতে তাহারা ভবিষ্যৎ জীবনে আদর্শ গৃহিণী, আদর্শ জননী এবং আদর্শ নারীরূপে পরিচিত হইতে পারে।" মাত্র ৫২ বছরের ব্যবধানে ১৮৮০ সালের এই দিনে তার জন্ম এবং ১৯৩২ সালের একই দিনে তার মৃত্যু হয়। ক্ষন জন্মা এই মহিয়সী বাঙ্গালি সাহিত্যিক, নারী আন্দোলনের অগ্রদূত ও সমাজ সংস্করক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম-মৃত্যুবাষিকীতে আমাদের শুভেচ্ছা ও গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুরের পায়রাবন্দ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের সম্ভ্রান্ত ভূস্বামী ছিলেন। তাঁর মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরানী। রোকেয়ার দুই বোন করিমুননেসা ও হুমায়রা, আর তিন ভাই যাদের একজন শৈশবে মারা যায়। তৎকালীন মুসলিম সমাজব্যবস্থা অনুসারে রোকেয়া ও তাঁর বোনদের বাইরে পড়াশোনা করতে পাঠানো হয়নি, তাদেরকে ঘরে আরবী ও উর্দু শেখানো হয়। তবে রোকেয়ার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবের আধুনিকমনস্ক ছিলেন। তিনি রোকেয়া ও করিমুননেসাকে ঘরেই গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শেখান। ১৮৯৬ সালে ১৬ বছর বয়সে ভাগলপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট উর্দুভাষী ও বিপত্মীক সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন বেগম রোকেয়া। বিয়ের পর তিনি 'বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন' নামে পরিচিত হন। তাঁর স্বামী মুক্তমনা মানুষ ছিলেন, রোকেয়াকে তিনি লেখালেখি করতে উৎসাহ দেন। স্বামীর উৎসাহ ও প্রেরণায় বাংলা ও ইংরেজী উত্তমরুপে আয়ত্ত করেন এবং একটি স্কুল তৈরির জন্য অর্থ আলাদা করে রাখেন। ১৯০৯ সালে সাখাওয়াত হোসেন মৃত্যুবরণ করেন। অল্প বয়সেই স্বামীর মৃত্যু হওয়ায় বেগম রোকেয়া সম্পূর্ণ একা হয়ে হয়ে পড়েন। এ সময় তিনি সমাজসেবা ও সমাজে নারীশিক্ষা বিস্তারে মনোনিবেশ করেন।
সৈয়দ সাখাওয়াত হেসেনের মৃত্যুর পাঁচ মাস পর স্বামীর জন্মস্থান ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল' নামে একটি মেয়েদের স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯১০ সালে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলার ফলে স্কুল বন্ধ করে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং ১৯১১ সালের ১৫ই মার্চ তিনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল পুণরায় চালু করেন। প্রাথমিক অবস্থায় এখানে ছাত্রী ছিল মাত্র ৮ জন। চার বছরের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৮৪-তে। ১৯৩০ সালের মাঝে এটি হাই স্কুলে পরিণত হয়। স্কুল পরিচালনা ও সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রোকেয়া নিজেকে সাংগঠনিক ও সামাজিক কর্মকান্ডে ব্যস্ত রাখেন। ১৯১৬ সালে তিনি মুসলিম বাঙালি নারীদের সংগঠন আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন সভায় তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯২৬ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত বাংলার নারী শিক্ষা বিষয়ক সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন।
১৯০২ সালে পিপাসা নামে একটি বাংলা গল্পের মধ্য দিয়ে সাহিত্যজগতে পদার্পণ করেন বেগম রোকেয়া। তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রচনা Sultana’s Dream। যার অনূদিত রূপের নাম সুলতানার স্বপ্ন। এটিকে বিশ্বের নারীবাদী সাহিত্যে একটি মাইলফলক ধরা হয়। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থগুলি হলঃ পদ্মরাগ, অবরোধবাসিনী, মতিচুর। তাঁর প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাসের মধ্য দিয়ে তিনি নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা আর লিঙ্গসমতার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেছেন। হাস্যরস আর ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের সাহায্যে পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীর অসম অবস্থান ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর রচনা দিয়ে তিনি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন, ধর্মের নামে নারীর প্রতি অবিচার রোধ করতে চেয়েছেন, শিক্ষা আর পছন্দানুযায়ী পেশা নির্বাচনের সুযোগ ছাড়া যে নারী মুক্তি আসবে না - তা বলেছেন।
(বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র, পায়রাবন্দ, রংপুর)
রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্মরণে বাংলাদেশ সরকার একটি গণউন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে পৈতৃক ভিটায় ৩ দশমিক ১৫ একর ভূমির ওপর নির্মিত হয়েছে বেগম রোকেয়া স্মৃতি কেন্দ্র। এতে অফিস ভবন, সর্বাধুনিক গেস্ট হাউজ, ৪ তলা ডরমেটরি ভবন, গবেষণা কক্ষ, লাইব্রেরি ইত্যাদি রয়েছে। স্মৃতিকেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের শিশু ও মহিলা বিষয়ক মন্ত্রণালয়
(রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়)
২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর বাংলাদেশের ৭ম বিভাগ হিসেবে রংপুর বিভাগের একমাত্র পুর্ণাঙ্গ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে 'রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়' রতিষ্ঠিত হয়। অতঃপর ২০০৯ সালে 'নারী জাগরণের অগ্রদূত' হিসেবে তাঁর নামকে স্মরণীয় করে রাখতে বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়। এছাড়াও, মহিয়সী বাঙালি নারী হিসেবে বেগম রোকেয়ার অবদানকে চীরস্মরণীয় করে রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের আবাসনের জন্য "রোকেয়া হল" নামকরণ করা হয়। ১৯৩২ সালের ৯ই ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া মৃত্যুবরণ করেন। সেসময় তিনি ‘নারীর অধিকার’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখছিলেন।
(বেগম রোকেয়ার জন্ম-শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে (১৮৮০-১৯৩২) ১৯৯০ সালের ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দু'টি স্মারক ডাক টিকেট প্রকাশ করে)
উনবিংশ শতাব্দীর খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক, বাঙ্গালী নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের ১৩৪তম জন্ম ও ৮২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। বাঙ্গালি সাহিত্যিক, নারী আন্দোলনের অগ্রদূত ও সমাজ সংস্করক বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের জন্ম-মৃত্যুবাষিকীতে আমাদের শুভেচ্ছা ও গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে
তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন
ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না
সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন
লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা
ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।
মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন
জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না
নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন
দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে
বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন