somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বাঙলার লোকসংস্কৃতির কিংবদন্তি বাউল শিল্পী হাসন রাজার ১৬০তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা

২১ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৩৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাঙলার লোকসংস্কৃতির কিংবদন্তির মরমী কবি এবং বাউল শিল্পী হাসন রাজা। বাংলাদেশে দর্শনচেতনার সাথে মরমী সঙ্গীতের এক অসামান্য সংযোগ ঘটিয়েছেন হাসন রাজা। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি ছিলেন লালন শাহ্‌ এর প্রধান পথিকৃৎ। এর সাথে দুদ্দু শাহ্‌, পাঞ্জ শাহ্‌, পাগলা কানাই, রাধারমণ দত্ত, আরকুম শাহ্‌, জালাল খাঁ এবং আরো অনেকে। তবে দর্শনচেতনার নিরিখে লালনের পর যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ নামটি আসে, তা হাসন রাজার। হাসন রাজা ভালো বাংলা লিখতে পারতেন না । তাই তিনি মুখে মুখে গান রচনা করতেন। তিনি গানের কথা বলে যেতেন আর তার নায়েব তা লিখে নিতেন কাগজে। পরে তিনি সেই গানে সুরারোপ করতেন। ১৮৫৪ সালের আজকের এইদিনে জন্মগ্রহন করেন হাসন রাজা। মরমী শিল্পী হাসন রাজার ১৬০তম জন্মবার্ষিকী আজ। বাঙলার লোকসংস্কৃতির কিংবদন্তি বাউল শিল্পী হাসন রাজার ১৬০তম জন্মবার্ষিকীতে ফুলেল শুভেচ্ছা।


(হাসন রাজার জন্ম ও বংশ পরিচয়)
হাসন রাজা ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর বৃহত্তর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ শহরের নিকটবর্তী সুরমা নদীর তীরে লক্ষণছিরি (লক্ষণশ্রী) পরগণার তেঘরিয়া গ্রামে বিখ্যাত জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পৈত্রিক বাড়ি সিলেটের বিশ্বানাথের রামপাশা গ্রামে। সিলেটে আসার আগে তাঁরা দক্ষিণবঙ্গের যশোর জেলার অধিবাসী ছিলেন।হাসন রাজার পূর্বপুরুষেরা হিন্দু এবং অয্যোধ্যার অধিবাস ছিলেন। তাঁদেরই একজন বীরেন্দ্রচন্দ্র সিংহদেব মতান্তরে বাবু রায় চৌধুরী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী ছিলেন প্রতাপশালী জমিদার। হাসন রাজা তাঁর ত্রিতীয় পুত্র। হাসন রাজার প্রকৃত নাম দেওয়ান হাসন রেজা চৌধুরী । পরবর্তী সময় তিনি হাসন রাজা নামে পরিচিতি ও খ্যাতি লাভ করেন। সিলেটে তখন আরবী-ফার্সির চর্চা খুব প্রবল ছিল। সিলেটে ডেপুটি কমিশনার অফিসের নাজির আবদুল্লা বলে এক বিখ্যাত ফার্সি ভাষাভিজ্ঞ ব্যক্তির পরামর্শ মতে তাঁর নামকরণ করা হয়- হাসন রাজা। বহু দলিল দস্তাবেজে হাসন রাজা আরবি অক্ষরে নাম দস্তখত করেছেন- হাসান রাজা। হাসন দেখতে সুদর্শন ছিলেন। অধিকাংশ বিশেষজ্ঞের মতে তিনি কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেননি। তবে বংশের নিয়মানুসারে তিনি প্রথমে আরবী এবং পরে বাংলা ভাষায় পাঠ শুরু করেন। হাসন রাজা যে যুগে জন্মেছিলেন সে যুগে মুসলমান সমাজে ইংরেজি শিক্ষার তত প্রচলন না থাকায় বিদ্যালয়ের পড়াশুনায় তিনি বেশিদুর অগ্রসর হতে পারেন নি। তবে তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। নিজে আধুনিক শিক্ষায় বেশি অগ্রসর হতে না পারলেও শিক্ষা প্রসারে তিনি উদার হাতে সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতেন। সুনামগঞ্জের প্রধান ক’টি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠাকল্পে তাঁর অফুরন্ত দান ছিল। এর মধ্যে সুনামগঞ্জ জুবিলী হাই স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্য জায়গা প্রদান উল্লেখযোগ্য। উত্তারিধাকার সূত্রে বিশাল ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন হাসন রাজা। প্রথম যৌবনে তিনি সৌখিন, ভোগবিলাসী এবং রমণী সম্ভোগে রত ছিলেন। প্রতিবছর বিশেষ করে বর্ষাকালে নৃত্য-গীতের ব্যবস্থাসহ তিনি নৌকায় চলে যেতেন এবং বেশ কিছুকাল ভোগ-বিলাসের মধ্যে নিজেকে নিমজ্জিত করে দিতেন। এর মধ্যেই বিশেষ বিশেষ মুহুর্তে তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন। এসব গানে জীবনের অনিত্যতা সম্পর্কে, ভোগ-বিলাসের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে নিজেকে স্মরন করিয়ে দিয়েছেন। তিনি তার এক গানে নিজেই উল্লেখ করেছেনঃ "সর্বলোকে বলে হাসন রাজা লম্পটিয়া"


হাসন রাজা পাখি ভালোবাসতেন। 'কুড়া' ছিল তার প্রিয় পাখি। (কুড়া (Haliaeetus leucoryphus), কুড়ল, কুড়োল বা কোঁড়ল অ্যাক্সিপিট্রিডি (Accipitridae) গোত্র বা পরিবারের অন্তর্গত একটি বৃহদাকায় ঈগল)। এর ইংরেজী নাম Pallas's Fish Eagle, Pallas's Sea-eagle, Band-Tailed Fish-eagle, বা Ring-tailed Fishing Eagle। সে হিসেবে অনেক সময় এ প্রজাতিটিকে পলাশ মেছো ঈগল, পালাসি কুড়া ঈগল বা নির্ভেজাল প্যালাসেস ফিশ ঈগল নামে অভিহিত করা হয়। বাংলাদেশে স্থানভেদে একে ব-ওল, কুররা ও কুরর নামেও ডাকা হয়। এ ছাড়াও তিনি ঘোড়া পুষতেন। তাঁর প্রিয় দুটি ঘোড়ার নাম ছিল জং বাহাদুর এবং চান্দমুশকি। মোটকথা, সৌখিনতার পিছনেই তাঁর সময় কাটতে লাগলো। আনন্দ বিহারে সময় কাটানোই হয়ে উঠলো তাঁর জীবনের একমাত্র বাসনা। তিনি প্রজাদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। এ ভাবে অত্যাচারী আর নিষ্ঠুর রাজা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে হাসন রাজা দাপটের সঙ্গে জমিদারী চালাতে লাগলেন। কিন্তু এক আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শন হাসন রাজার জীবন দর্শন আমূল পরিবর্তন করে দিল। হাসন রাজার মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগলো। তাঁর চরিত্রে এলো এক সৌম্যভাব। বিলাস প্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন। ভুল ত্রুটিগুলো শুধরাতে শুরু করলেন। জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দিলেন। শুধু বর্হিজগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন। বিষয়-আশয়ের প্রতি তিনি নিরাসক্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর মনের মধ্যে এলো এক ধরনের উদাসীনতা। এক ধরনের বৈরাগ্য। সাধারণ মানুষের খোঁজ-খবর নেয়া হয়ে উঠলো তাঁর প্রতিদিনের কাজ। আর সকল কাজের উপর ছিল গান রচনা। তিনি আল্লাহ্‌র প্রেমে মগ্ন হলেন। তাঁর সকল ধ্যান ধারণা গান হয়ে প্রকাশ পেতে লাগলো। সেই গানে তিনি সুরারোপ করতেন এ ভাবেঃ
“লোকে বলে বলেরে, ঘর বাড়ী ভালা নায় আমার
কি ঘর বানাইমু আমি, শূন্যের-ই মাঝার
ভালা করি ঘর বানাইয়া, কয় দিন থাকমু আর
আয়ন দিয়া চাইয়া দেখি, পাকনা চুল আমার।”


(হাসন রাজার বাড়ি)
এভাবে এক আধ্যাত্নিক স্বপ্ন-দর্শন হাসন রাজার জীবন দর্শন আমূল পরিবর্তন করে দিল। হাসন রাজার মনের দুয়ার খুলে যেতে লাগলো। তাঁর চরিত্রে এলো এক সৌম্যভাব। বিলাস প্রিয় জীবন তিনি ছেড়ে দিলেন। ভুল ত্রুটিগুলো শুধরাতে শুরু করলেন। জমকালো পোশাক পড়া ছেড়ে দিলেন। শুধু বর্হিজগত নয়, তার অন্তর্জগতেও এলো বিরাট পরিবর্তন।জীব-হত্যা ছেড়ে দিলেন। কেবল মানব সেবা নয়, জীব সেবাতেও তিনি নিজেকে নিয়োজিত করলেন। ডাকসাইটে রাজা এককালে 'চন্ড হাসন' নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু এবার তিনি হলেন 'নম্র হাসন'।এরপর তার সকল বিষয় সম্পত্তি বিলিবন্টন করে দিয়ে দরবেশ-জীবন যাপন করেন। তাঁর উদ্যোগে হাসন এম.ই. হাই স্কুল, অনেক ধর্ম প্রতিষ্ঠান, আখড়া স্থাপিত হয়।


মানবতা ও সাম্য দর্শনে বিশ্বাসী হাসন রাজা ১৯২২ সালের ৬ ডিসেম্বর ৬৭ বছর বয়সে মৃত্যুৃবরণ করেন। মৃত্যুর পরে সুনামগঞ্জের লক্ষণশ্রী গ্রামে (মায়ের কবরের পাশে, যে কবরখানা মৃত্যুর পুর্বেই তিনি নিজে প্রস্তুত করেন) তাকে সমাহিত করা হয়। আজ এই এ মহান সঙ্গীত সাধকের ১৬০তম জন্মবার্ষিকী। জন্মদিনে তাঁকে স্মরন করছি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×