"এই সাইদুর এক কাপ চুম্মা দাও তো ! সেই সকাল থেকে চুম্মা খাই না ! "
মেয়েটি খুব বাজ কণ্ঠে কথাটা বলল । আমার মতো আর ও অনেকেই ঘুরে তাকাল । আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না । আসলেই কথাটা ঠিক শুনেছি কিনা । কারন আমি যখন বেশি ভাবাবেগ বা ফুরফুরে মেজাজে থাকি তখন এক কানে কম শুনি । আর যখন অনেক চিন্তায় অথবা গুরুত্বপূর্ণ ভাবাবস্থায় থাকি তখন একটু বেশি শুনে ফেলি । এই ধরেন তিন কান কাজ করে ।
আমি আমার বাম কান আঙ্গুল ঢুকিয়ে একটু ঝাঁকানি দিয়ে দেখি । কানের অবস্থা ঠিক আছে । একটু দীর্ঘশ্বাস দিয়ে নিজের মুড বুঝার চেষ্টা করি । তিন কানে ও শুনিনি ।
তারপর ও দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকি । আমিও সাইদুরকে ডাকলাম । কারন যে সাইদুর আমার সামনে সে তের চৌদ্দ বছর বয়সী একটি কিশোর ছেলে । আমি ওকে এক কাপ দুধ চা দিতে বললাম । কিন্তু পাশের বাজখাই গলার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেললাম কয়েক সেকেন্ডে । খুব মোলায়েম কণ্ঠে বললাম ," সাইদুর এক কাপ আদা চা দাও তো । দুধ চা খাব না "
এই কয়েক মুহূর্তে আমি বুঝলাম আমার সম্বিৎ ফিরেছে । আসলে পাশের মেয়েটি চুম্মা না চা বোধহয় খেতে চেয়েছে । কিন্তু আমি এমন শুনলাম কেন ?
আমি চায়ের জন্য অপেক্ষা করি । মেয়েটির গায়ে আধ পুরনো একটি চেক শার্ট । কোমর থেকে নিচ একটি ছেড়া জিন্স প্যান্ট দ্বারা আবৃত । তবে এই সাধারন আধুনিক ড্রেসটা মেয়েটির কণ্ঠ , বসার ধরন , কথা বলার ধরন সব মিলিয়ে ভীষণ রকম অশ্লীল মনেহল । মেয়েটির মুখে সিগারেট । জিন্স প্যান্টের উপরের অংশে আপত্তিকর জায়াগাটা ছেড়া । খুব ফর্সা না হলেও তাঁর চামড়া জিন্স ভেদ করে উঁকি দিচ্ছিল । মেয়েটির পাশের ছেলেটির সাজ পোশাক আবার আমাদের গ্রামের বাড়ির কামলাদের মতো । মেয়েটি আধা খেয়ে সিগারেট দেয় । ছেলেটি তা অতি যত্নে ফুঁ দিয়ে ধোঁয়ার সুখ সেবন করে ।
ছেলেটি খুব ভদ্র কায়দায় সিগারেট ফুঁকলেও মেয়েটি কিছুক্ষণ পর পর চিৎকার করে বলছে " এই সাইদুর ! কথা শোন না কেন ? চা টা দাও না কেন ?"
এতক্ষণে আমার আদা চা এল । দাঁড়ানোর জায়গা নেই কোথাও । পুলিশ ভাই বোনদের দল ও আছে । অনেকেই নিজেদের সাথে কথা বলছে চা বিস্কুট খাচ্ছে ।
দলে দলে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজন মেয়েটির দিকে বার বার তাকাচ্ছে ।মেয়েটি ইচ্ছে করেই চিৎকার দিয়ে কথা বলছে যেন সবাই তাঁর দিকে তাকায় । সে কিছুটা সফল ও হয়েছে ।
আমার চা প্রায় অর্ধেক তখন ।মেয়েটি আবার ও চিৎকার করে চা চাইল ।
সাইদুর এবার উত্তর দিল ।
--"মামা এখান থেকে উঠেন । আপনি নিয়মিত বাকি খান । আপনারে চা দিয়ন যাইব না । "
মেয়েটি বাজ কণ্ঠে আবার ধমকায় ," এই সাইদুর । তুই কিন্তু বেয়াদব হইয়া গেছস ! এখানে ব্যবসা করাইয়া দিমু । চা দেয়।"
সাইদুর পাশের মুরুব্বির সাথে কিছু একটা বলল ফিসফিস করে । মনেহয় ভদ্রলোক ওর বাবা ,চাচা বা মালিক ।
তারপর কঠিন কণ্ঠে ,"
আমি বেয়াদ্দব না ।আপনারা উডেন তো । যারা টেকা দিয়া চা খায় তাদের বইতে দেন । "
মেয়েটি এবার মোলায়েম কণ্ঠে ," তুই আজকে বেশি বেয়াদবি করলি । ভাল হইয়া যা ।"
সাইদুর কাপে কাপে চা ঢালতে ঢালতে ঘাড় ফিরিয়ে বলে ," আপনে ভাল হইয়া যান ।"
মেয়েটি পাশের ছেলেটির হাত ধরে টেনে তুলে নিল । তারপর রাগে কটকট করতে করতে সিগারেট মুখে নিয়ে বেরিয়ে গেল ।যেমন অভিজাত ভঙ্গিতে হাক ডাক করতে করতে সিগারেট নিয়ে বসেছিল । যাওয়ার সময় একদম লাজুক লতা ।
বিকেল চারটার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি 'র এক কোনের দৃশ্য গল্প । সাইদুর খুব ব্যস্ত কাপে কাপে চা ঢালা নিয়ে । চুলার প্রচণ্ড তাপে গ্যাসের আগুন জ্বলছে । সাইদুরের মেজাজ জ্বলছে । কিন্তু খুব দৃঢ় সাইদুরের কণ্ঠ ।
" এক কাপ চা কিন্না খাওনের মুরদ নাই । আবার বেনসন সিগারেট মুখে লইয়া ম্যাম সাজে । ফকিন্নি হালায় । এরা কাম করলে দেশটা পালটাইয়া যাইতো ।মাইন্সের ডা খায় আবার ফুটানি মারায় "
সে একটা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে ।
সাইদুর চা কিংবা চুম্বন কিছুই দেয়নি । বরং একটা শিক্ষা দিয়েছে ।একটি প্রতিবাদের শিক্ষা ।
এই সমাজে অনেকেই দামি বেনসন খায় । আভিজাত্য প্রকাশ করে অন্যের পরিশ্রমের ঘামে । সাদা গ্লাসে লাল মদ খায় । কার ও মানব রক্ত শুষে । অন্যের দেহ বিসর্জনের নিজেদের জীবন খোঁজা ।
মিথ্যার সহস্র বেসাতি ঘরে কেবল একজন সত্যিকারের মানুষ থাকে । ঠিক পথে পাওয়া সাইদুরের মতো ।
সাইদুর একটা জীবন । সাইদুর একটা গল্প । সাইদুর একটা বাংলাদেশ ।
আজকাল জীবনের শিক্ষা পথে ঘাটে জীবন যুদ্ধরত মানুষের কাছেই পাওয়া যায় । দামি দামি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পাওয়া কঠিন ।গতকাল আমি বইমেলায় যাচ্ছিলাম ।বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস গুলোতে প্রচুর নারী ধুমাপায়ী বেরেছে । কিছু সময় চোখ ধরে যায় চির চেনা নারীর সুন্দর সিগারেটের ধোঁয়ায় বিলীন হয় ।
আমি আদা চায়ের সাথে একটা গল্প নিয়ে বইমেলার দিকে এগুতে লাগলাম । কিন্তু পেছনে মেয়েটি এবং ছেলেটির গল্পটা রয়ে গেল ।
#বইমেলায় যেতে যেতে
#নুরুন নাহার লিলিয়া
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:৪৭