somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোপনে সে আমায় ভালোবাসে- পর্ব ৮ - নুরুন নাহার লিলিয়ান

২৫ শে এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


আগের পর্বের লিঙ্ক
গোপনে সে আমায় ভালোবাস৭ - নুরুন নাহার লিলিয়ান

গোপনে সে আমায় ভালোবাসে-নুরুন নাহার লিলিয়ান
পর্ব -৮
আসাদ খাবার আনতে যাওয়ার পর কিছু বিশেষ মুহূর্ত আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। আমার দু-চোখ তখনও অশ্রুসিক্ত! বালিশ কান্নায় ভেসে উঠেছে।আমার তখনও জ্ঞান ছিল কিনা মনে নেই। তবে অভিনন্দন আমাকে আড়কোলা করে নিচে নামছে।এই দৃশ্যটা অদ্ভুত ভাবে আমার দু-চোখের পাতায় লেগে আছে।আমি কিছুতেই ভুলতে পারছিলাম না । একটা মানুষের স্পর্শ, একটা মানুষের গায়ের গন্ধ সময় আর পরিস্থিতিতে কতো ভিন্ন হয়ে যায়।
গভীর করে দাগ কেটে যাওয়া মানুষটা হয়তো পাল্টে যায় পরিস্থিতির কারণে। কিন্তু বুকের ভেতরটার তোলপাড়, স্পন্দন ভুলতে না পারার যন্ত্রণা কি নিয়ন্ত্রণ করা যায়! তবুও অনুভূতি ও বাস্তবতার অদ্ভুত যুদ্ধের ভেতর দিয়ে একটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে যায় একটা জীবন ।
আমি একটা গভীর ঘোরে ছিলাম৷ আমার পার্থিব মনন ব্যাখ্যাতীত হয়ে পড়ে। তখন জীবন ও মৃত্যু এক সাথে দেখেছিলাম। জীবন ও মৃত্যু একসাথে দেখার অনুভূতি অভিজ্ঞতা সবার পক্ষে শেয়ার করা কঠিন। আমার পক্ষে ও ভীষণ রকম কঠিন। আমি কোনদিন বোঝাতে পারবো না অভিনন্দন আমাকে কোলে নিয়ে এতো গুলো সিঁড়ি পার হচ্ছে। আমার ভেতরে অদ্ভুত ভাবে পদ্মার অথৈজল আর স্রোতের ধাক্কা এসে লাগছিল। আমি দিকশূন্য হয়ে ভেসে যাচ্ছি।নদীর গভীর তলদেশের অতলান্তে হারিয়ে যাচ্ছি।
তারপর আবার মনেহচ্ছিল আমি মরে গিয়েও বেঁচে উঠছি।আমি একটা গভীরতম স্বপ্নে হারিয়ে যাচ্ছি। একটা ভয়ংকর জীবন থেকে প্রিয় মানুষের হাত ধরে হারিয়ে যাচ্ছি। একটা মৃত মানুষ জীবন পাওয়ার স্বপ্নে বিভোর।
।অভিনন্দন আমার মৃত লাশটা নিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করছে কোথাও হারিয়ে যেতে। আমাকে নিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকতে।
বিমূর্ত একটা ভাবনা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। আমিও ঘুমের ঘোরে কিংবা আতংকিত হয়ে অভিনন্দনকে জাপটে ধরে থাকি। যে করেই হোক আমাকে বাঁচতে হবে। আমার স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। আমি কেন সে সময়ে এসব ভেবেছিলাম আমার এখনকার জীবনে নানা রকম অনুভূতি আর প্রশ্ন এসে ভর করে।
আসাদের সন্তান নিজের শরীরে ধারন করে আমি আমার প্রাক্তন প্রেমিকের হতে চেয়েছিলাম। তাঁকে নিয়ে নতুন আরেকটা জীবন গড়তে চেয়েছিলাম। আমি অভিনন্দনকে যতোই ভালোবাসি না কেন আমি তো তখন গর্ভে থাকা একটি শিশুর মা। সমাজে দায়িত্বশীল একজন ব্যক্তির স্ত্রী। আমি কেন এমন সব ভাবনাকে প্রশ্র‍য় দিয়েছিলাম। মানুষ কেন জানি তাঁর জীবনের সব চাওয়া পাওয়ার ব্যাখ্যা দিতে পারে না। সব আচরণের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারে না।
অভিনন্দনের ভালোবাসায় যতোই ডুবতে চাই না কেন বাস্তবতা আর আর ভালোবাসার মানুষটার ও নিরাপত্তার কথা আমার ভাবা উচিত। তাঁর ও আমাদের মান সম্মানের কথা ভাবা উচিত। আমি সব কিছুই জানতাম তারপরও তাঁর প্রতি আমার প্রথম যৌবনের একটা গভীরতম অনুভূতি মনের কোথাও বিধৃত হয়ে আছে।
পৃথিবীতে কতো শত নরনারী একান্ত ভালোবাসায় ঘর বাঁধে কয়জন তা টিকিয়ে রাখতে পারে। একটা পোড়ামন হয়তো অনেকেরই থাকে কিন্তু সবাই তা প্রকাশ করেনা।
চোখের সামনে একটা মানব বসতি অথৈ জলে ভেসে গেল। ডুবে গেল শত শত মানুষের স্বপ্ন। বহুদিনের জীবন জীবীকা।শত শত ঘরহীন মানুষের বিলাপে নদী তীর ভারী হয়ে উঠেছে। সহায় সম্বল হারিয়ে মানুষ গুলো পাগল প্রায়!
আমার বুকের ভেতরটা তোলপাড় হচ্ছিল। আমি প্রচন্ড ঘামছিলাম। আমার একটা কথাই শুধু মনে হচ্ছিল আমার গর্ভে একটা হৃদস্পন্দন। আমার হৃদপিণ্ডটা অসহায় অবস্থায়!এক টুকরো মাংসপিণ্ড তখন আমার পুরো পৃথিবী।। আমার যেভাবেই হোক এই অনাগত প্রাণটাকে বাঁচাতে হবে।
প্রচুর মানুষ এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছে। আসাদের হাতেও অনেক জিনিসপত্র।
আমার মনে হল আচ্ছা আসাদ ও তো আমাকে কোলে করে নামাতে পারতো। কিংবা আমাকে কোলে করে নামানোর জন্য অভিনন্দনকে গালমন্দ করতো।
কী অদ্ভুত আসাদের মতো রাগী মানুষটা কী নির্বিকার ভাবে পুরো বিষয়টাকে মেনে নিয়েছে।
মানুষ বড় অভিমানী, রাগী,জেদী, অহংকারী কিন্তু পরিস্থিতি তার এই সকল বিষয়কে তুচ্ছ করে দেয়। যখন সবাই জিনিসপত্র সরাতে সরাতে জলোচ্ছ্বাস আর ভাঙন তীব্র হয়ে উঠে তখন নিজে বেঁচে থাকা আর আপনজনদের বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়।আমরা মারাত্মক ভয়ংকর একটা পরিস্থিতি পার করেছি। এ যেন নতুন করে জীবন পাওয়া।আমাদের সবার নতুন জীবন।
ঘন্টা খানিক পর আসাদ ফিরে আসে। আশেপাশের কোন দোকানেই নাকি খাবার পাওয়া যাচ্ছিল না। বেশির ভাগ দোকানই বন্ধ। অনেক খোঁজাখুজির পর নাকি রুটি সবজি ও ডিম ভাজি পেয়েছে। আসাদ খাবার নিয়ে রুমে ঢুকতেই আমি উঠে বসলাম।
আসাদ তখন নতুন নোকিয়া মোবাইল কিনেছে। ওর মোবাইলে সারা দেশ থেকে একের এক কল আসছে।আমরা নিরাপদ আছি কিনা খোঁজ খবর নিচ্ছে। আমি খাবার গুলো প্যাকেট থেকে বের করে প্লেটে দিচ্ছিলাম। এমন সময়ে অভিনন্দন রুমে ঢুকলো। ছোট একটা রুম। সেখানে সংসারের জিনিসপত্রে ঠাসা। কোথাও ঠিক মতো বসার জায়গা নেই।
সে রুমে ঢুকেও যেন অপ্রস্তুত। আসলে আমাদের খোঁজ খবর নিতে আসছে। আর কোন কিছুর প্রয়োজন আছে কিনা তা জানার জন্য।
আসাদের কানে মোবাইল। সে অভিনন্দন কে দেখে হাতের ইশারায় বসতে বলল।
আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছিল না। আমি তো এমনিতেই অসাড় হয়ে ছিলাম। অভিনন্দনকে দেখে যেন আরও জমে যাচ্ছি।।
সমগ্র বর্ষার জল যেন আমারই গৃহকোণে। আমি মাথা তুলে তাকাতে পারছিলাম না। বুকের ভেতরটা ধুক ধুক করছিল। কেমন একটা লজ্জা আমাকে আবিষ্ট করে রাখলো। আমি আড় চোখে তাকিয়ে দেখি অভিনন্দন ও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
যে মানুষটাকে কয়েকঘন্টা আগে জাপটে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছিলাম এখন যেন সে যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করছে। কী অদ্ভুত মানুষের মন। কেমন এক অদ্ভুত গোপন টানাপোড়েন! বুকের ভেতর জমে থাকা মায়ার পাহাড়! ইচ্ছে করলেই সে পাহাড়কে স্পর্শ করা যায় না।
আমি নীরবে বিছানার জামা কাপড় সরিয়ে রাখলাম। কিছুটা জায়গা করে দিলাম যেন সে বসতে পারে।অভিনন্দন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে। আমার দিকে তাকায় না। আমি সুযোগ খুঁজছিলাম যেন ও একবার আমার দিকে তাকায়। আমি উঠে বসলাম। টুকটাক কাজ করার উছিলায় ওর দিকে বার বার তাকাচ্ছিলাম। কিন্তু অভিনন্দন কিছুতেই আমার দিকে তাকায় না।
এরমধ্যে একজন স্টাফ খুব হন্তদন্ত হয়ে এল। এসেই নিজের বুক চাপড়ে কাঁদতে লাগলো
" স্যার আমার মাইয়াডারে পাইতাছি না! সবাই কইতাছে ও নাকি তলায়া গেছে। "
এখনও মনে পড়লে সমস্ত শরীর হীম হয়ে যায়। শিরা উপশিরায় রক্ত প্রবাহ থেমে যায়।আমরা আঁতকে উঠলাম। কারন তখন ও অফিশিয়ালি শোনা যায়নি কারও স্বজন হারিয়ে গেছে।কোন কিছু না বলেই লোকটার কাঁধে হাত রেখে অভিনন্দন বাইরে বেরিয়ে গেল।
লোকটাকে বলল," চলো আমার সাথে। দেখি ডুবুরিরা, পুলিশ আর ফায়ারসার্ভিস লোকেরা কি বলে!"
ওরা বাইরে চলে গেল। আসাদ তখনও কি যেন মোবাইলে কথা বলছে।আমি আসাদের দিকে আর অভিনন্দনের দিকে তাকাই। আচমকা দেখি অভিনন্দন আমার দিকে গভীরতম মমতায় এক পলক তাকিয়েই নিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। আমি স্থির হয়ে যাই। আমার শরীরের ভেতরের স্পন্দন দ্রুত বেগে চলতে শুরু করে।
তখন আমি আমার বুকের মধ্যে জমে থাকা কান্নার পাহাড়টা ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়ার শব্দ শুনতে পাই। জমাটি পাহাড় ভাঙার শব্দ আমাকে অসহায় অস্থির করে তোলে। আমার সমগ্র অনুভূতি ও বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করি।
ভেঙে পড়া পাহাড়ের কোটি কোটি টুকরো কুড়াতে কুড়াতে একটা অচেনা সময়ের পথে ক্ষুদ্র জীবনটা প্রবাহিত হয়।
নিজেকে নিজের কাছে কেমন অসহায় আর অচেনা লাগে। আমি অনুভব করি গভীর নোনাজল আমার চিবুক ছুঁয়ে গেছে। আমি আমাকে বাঁচিয়ে রাখতে চোখের জলের দাগ মুছে ফেলি। বুকের কোথাও তখন শচীন গুপ্তার গান বাজতে থাকে...
এবার আমি আমার থেকে আমাকে বাদ দিয়ে
অনেক কিছু জীবন এ যোগ দিলাম
ছোটো যতো আপন ছিলো বাহির করে দিয়ে
ভুবন টারে আপন করে নিলাম
সবার হরষে হাসি বেদনে কাঁদি
বাধান প্রিয়রে মুক্তির জলে বাঁধি
সবই হারায়ে আবার সবই কিছু যে পেলাম...
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ৩:১৫
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×