সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় ‘সবুজের আগ্নেয় প্রপাত’। বইটির ভুমিকা লেখেছিলেন কবি আফজল চৌধুরী।
অপ্রাসঙ্গিকী
আপাততঃ নিজের সম্পর্কে কিছুই বলার নেই আমার। বরং এই গ্রন্থ প্রকামের ব্যাপারে যাঁরা আমাকে নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন তাঁরা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়।
‘সবুজের আগ্নেয় প্রপাত’র মূল্যবান ভূমিকা লিখেছেন বাংলা সাহিত্যে ষাট দশকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আফজাল চৌধুরী। তিনি আমার পরম শ্রদ্ধাভাজন।
তাছাড়া এই গ্রন্থ প্রকামের ব্যাপারে যাঁদের কাছ থেকে আমি বিশেষ সহযোগিতা পেয়েছি তাঁরা হচ্ছেন, জনাব তজম্মুল, জনাব মোহাম্মদ আবদুন নূর, জনাব আতাউর রহমান, জনাব আবদুল মজিদ, জনাব আজির উদ্দিন, জনাব আবদুল কাদির।
এঁদের সকলেরই কাছে আমি ঋণী।
পরিশেষে পান্না লাল চৌধুরী, বাবলা রঞ্জন দে ও জয়নাল আবেদীনের আন্তরিকতাও উল্লেখ্যযোগ্য।
নিজাম উদ্দীন সালেহ
১লা সেপ্টেম্বর, ১৯৭৭
শিবগঞ্জ, সিলেট।
বিপন্ন মধ্যযুগ
“Keep in view the glories of past
and see the movvow in the mirror of today”
যে দীপ্ত মশাল হাতে এশিয়ার দুর্দম পথিক
চিরেছিলো একদিন পৃথিবীর ঘোর অন্ধকার,
যে আলোর বিকিরণে নিষ্পেষিত রোমান-গথিক
শোষিত সা¤্রাজ্যে থেমে গিয়েছিলো রিক্ত হাহাকার;
যে আদর্শ বুকে নিয়ে একদিন সমৃদ্ধ আদম
যোজন যোজন পথ দিয়েছিলো অনায়াসে পাড়ি,
কালের মোহিনী রূপে মজে তারা আজিকে বেদম
কৃতঘœ পশুর মতোটান দেয় ধরে তার নাড়ি।
যে ঈমান বুকে নিয়ে শংকাহীন দুর্ধর্ষ আরব
হিমাদ্রী শিখর থেকে সাহারার মরুর গভীরে,
বিপুল ভূখন্ডব্যাপী তুলেছিলো তৌহিদের রব;
পান্ডুর শতকে হায় সভ্যতার সবস্তিহীন ভীড়ে
যুগের যে বাতি আজ উপেক্ষিতÑতার সে অম্লান
আলোতেই মিশে আছে আমাদের অস্তিত্ব-সম্মান।
শতাব্দীর ইতিহাস
আমার মায়ের কাছে এক বৃদ্ধা ভিখারিণী রোজ
লাঠিতে নির্ভর করে দেহখানা আসে হেঁটে হেঁটে,
চোখের তারকা তার বাষ্পাচ্ছন্নÑদিগন্তে বিলীন;
আসে সে জড়িয়ে গায়ে ছিন্ন ধূতি ধূলোয় মলিন,
যা কিছুখাবার পায় খায় তাÑই ধীরে ধীরে চেটে;
শোকর গোজারী করে অতঃপর শেষ হলে ভোজ।
কখনো ঘোলাটে চোখে তার যেনো বিদ্যুৎ চমকায়
হৃদয়ে হাতড়ে ফেরে কখনো সে বিগত অতীত,
করুণ দু’চোখে তার ফুটে যত রাজ্যের বিস্ময়ঃ
ইতস্ততঃ শব্দপুঞ্জ, স্বপ্নময় শৈশব-কৈশোর,
পঞ্চাশের মন্বন্তর, ঝরে যাওয়া জীর্ণ খগো ঘর,
সংসারের সুখযাত্রা, তারপর নিঃশব্দে বিলয়;
সবি যেনো তার বুকে গেড়ে আছে শক্ত এক ভিত,
প্রাচীন বটের মতো সুবিশাল শাখা প্রশাখায়।
প্রত্যহ আসে সে দখি শ্রান্তক্লান্ত, ক্ষুধার বিশ্বস্ত ক্রীতদাস,
মনে হয় এ-ই বুঝি বাংলার শতাব্দীর পুরো ইতিহাস।
জাগ্রত আফ্রিকা
নির্মম শোষণে ক্লিষ্ট আফ্রিকার শিথিল শয়ান
টুঁটে গেছে যেনোÑগাঢ় অন্ধকার রাত্রির গভীরে
সময়ের ডাক শুনি ঃ আজ তাকে দিতে হবে স্থান
সভ্যতার চারুশীর্ষে, মুক্তপ্রাণ মানুষের ভিড়ে।
ঘুমের রজনীচিরে শোনা যায় আলোর চিৎকার
অযুত কাফ্রীর কন্ঠে; কারাগার, বুটের আওয়াজ,
শ্বেতাঙ্গ প্রভূর স্পষ্ট বর্ণবাদী বৈষম্য-বিকার
সমস্ত ছাপিয়ে ওফে সেই স্বর; ঝরে যেনো বাজ।
অসংখ্য সুন্দর মনে বিপ্লবের রক্তিম সুরুজ
গভীর প্রত্যয়ে জলে, সেই তেজে দীপ্ত মহাদেশ;
স্বপ্নের ;িগন্তে ক্রমে চূর্ণ হয় মেঘের গম্বুজ,
চেতনার নীলে দেখি সত্য আর ন্যায়ের উন্মেষ।
জাগ্রত জনতা যেনো আফ্রিকার তাতানো ইস্পাত
ক্রমেই আসন্ন করে আধিপত্য শক্তির নিপাত।
নিষ্ক্রান্ত আলোর ধ্বনি
পৃথিবী তখন ছিলো হীনমন্য, ইন্দ্রিয় তোরণে
আত্মাহীন অসহায়, গাছের সবুজ লতা-পাতা
ভীষণ শীতার্ত হয়ে ঝরে যেতো বসন্তের বনে
মানুষ ভক্তি ভরে রচেছিলো প্রেতাত্মার গাথা।
সহসা আল্লার নূর নেমে এলে সাহারার তীরে
পবিত্র সত্তার স্পর্শে কেঁপে ওফে নিষ্করূণ মরু
হেজাজ সিনাই আর কেনানের শিলার গভীরে
উত্তপ্ত বালির বুকে ছায়া মেলে বিশ্বাসের তরু।
রূপালী তরঙ্গ খেলে শাত-ইল-আরবের জলে
চাঁদের দিনার ভেঙ্গে দীপ্ত করে সনেত্যর কৃপাণঃ
প্রেরিত প্রণতিলীলা তৌহিদের অখন্ড বিধান
হেরার জ্যোতিতে জ্বলে, রন্ধ্রহীন রিক্ত কোলাহলে
পবিত্র আত্মার বাণী রটে যায়; বিষম তরাসে
দিগন্তে আঁধার ছিঁেড়, ইসলামের জয়ধ্বনি ভাসে।
আদমের স্বপ্ন
কী প্রত্যাশা ফটেছিলো তোমার এ করুণ দু’চোখে
আল্লাহ্র আদেশ পেয়ে; বায়তুল মামুরের ভিতে
কী শিহর বয়েছিলো ইটে-কাঠে বিচ্ছেদের শোকে
যখন নিক্ষিপ্ত হলে পলকেই তুমি পৃথিবীতে!
কী হতাশা এঁকেছিল তোমার এ বিষাদিত মনে
নিষিদ্ধ ফলের ঘ্রাণ, মুহূর্তের বিভ্রমের স্মৃতি
(বেহেস্ত যখন স্বপ্ন!) ঃ বিধাতার অঙ্গুলী হেলনে
সহসা উদ্্গত এই জীবনের তিক্ত পরিণতি!
সামনে সংসার নদী। তীরে কাঁপে ইব্লিসের সেনা
বিক্ষুব্ধ তরঙ্গ দেখে; শূন্যে ওড়ে অপ্সরীর শাড়ী!
হয়ত তখন তুমি চেয়েছিলে যদি যেতো কেনা
পৃথিবীর বিনিময়ে বেহেস্তের হৃত ঘর বাড়ী,
হয়তো বা ভেবেছিলে সেই খরনদী দিয়ে পাড়ি
জান্নাত আবার পেতেÑশোধিতে এ জীবনের দেনা।
মনুমেন্ট
সহসা আকাশ জুড়ে শুরু হয় বিদ্যুতের খেলা
বজ্রের প্রণবনাদে কেঁপে ওঠে হিরোশিমাবাসী
সূর্যের তরল ধারা হমে যায় ভোরের সুরেলা
সোনালী বাতাসে যেনো প্রেতাত্মার ভাসে অট্টহাসি।
বিধ্বস্ত নগরীদেহে ইট-কাঠ সহ¯্র লাশের
হাঁড়ের জঞ্জাল ক্রমে রচে যায় মৃত্যুর পাহাড়
জল্লাদ আঁধার চিরে চাঁদ ওঠে আহত হাঁসের
হলুদ চোখের মতো সকরুণÑক্লান্তিতেÑঅসাড়
সমৃদ্ধ স্বর্গপুরী লুপ্ত প্রায় ধ্বংশের তিমিরে
দু’লাখ সজীব দেহ হারিয়েছে মুহূর্তেই প্রাণ
পৃথিবীর জনপদে তারা আর আসবে কি ফিরে
মৃত্যুর শিয়রে জলে দেখবে কি শান্তির কৃপাণ!
শান্তি-উদ্যানে আজো ঝড় ওঠে মৃতদের শোকে
বিশ্বের বিবেক কাঁদে মুখ গুঁজে হিরোশিমা বুকে।
(পারমানবিক বোমা বিস্ফোরণে ১৯৪৫ সালে বিধ্বস্ত হিরোশিমা নগরীর দৃশ্যানুভবে রচিত)
প্যালেস্টাইন
(প্যালেস্টাইনের নির্যাতিত মানুষের প্রতি)
কী গভীর ষড়যন্ত্র ভূমধ্যের শান্ত নোনা জলে
সৃষ্টি হয় প্রতিদিনÑ ফেনায়িত হয়ে স্তরে স্তরে
ঠাঁই নেয় অতঃপর সিনায়ের পবিত্র প্রান্তরে;
যেখানে আল্লার নূর ওঠেছিলো একদিন জলে,
মূসার অন্তর্দৃষ্টি খুলে গিয়ে উর্ধ্বে সপ্তাকাশে
ফুটেছিলো বেহেস্তের কামিনীর মতোন সুবাসে;
ঈসার পবিত্র হাত ল্যাসারের নির্জীব কবর
ছুঁয়েছিলো কৃপাভরে; বিধাতার আরোগ্য-মহিমা
নেমেছিলো দীর্ণ করে বেদুঈন প্রজাদের খিমা
শত শত ক্ঠুদগ্ধ মানুষের দেহের ওপর।
কী আশ্চর্য চক্রজাল প্রসারিত হয় প্রতিদিন,
সংখ্যালঘু মানুষের আর্তনাদে জলপাইয়ের বন
মুহূর্মুহু কেঁপে ওঠে; অভিশপ্ত মেধা ও মনন
সংঘর্ষে রক্তাপ্লুত শাশ্বতরে করে দিন দিন;
বিকৃত ইহুদীবাদ সিন্দাবাদ নাবিকের কাঁধে
সোয়ার বুড়োর মতো জেঁকে বসে, চক্রান্তের ফাঁদে
পা বাড়ায় দিকভ্রান্ত মানুষেরা মুষিকের মতো;
তাদের রক্তাক্ত বুকে তৌহিদের অন্তিম স্পন্দন
থেমে আসেÑমুছে যায় অতিক্রান্ত দিনের স্পন;
পেছনের দিকে চেয়ে অশ্রু পাচে মুমূর্ষু শাশ্বত।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:২২