- তুমি বড় হয়ে কি হতে চাও?
- সায়েন্টিস্ট।
থুতনীতে হাত দিয়ে কিংবা গাল টিপে প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞেস করলে বজ্রকঠিন কণ্ঠে এই উত্তরই দিতাম আমি অনেকদিন পর্যন্ত। ‘সায়েন্টিস্ট’ হলে খুব সহজেই বইয়ে নাম উঠিয়ে বিখ্যাত হওয়া যায়। তাছাড়া একটা বিশাল ঘরে অনেক অনেক যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ করা যায়। যন্ত্রপাতি যখন হাতের কাছেই থাকবে, তাহলে নিশ্চয়ই একটার সাথে আরেকটা জোড়া দিলেই নতুন কিছু একটা বানিয়েও ফেলা যেতে পারে।
আমার কোন একটা বইয়ে সুন্দর করে লিস্ট বানানো ছিলঃ ডিনামাইট, এক্স-রে, টেলিস্কোপ, স্টিম ইঞ্জিন, বাল্ব, টেলিভিশন, এরোপ্লেন-এইসবের লিস্ট, আবিষ্কারকের নামসহ। খুব সম্ভবত সেই লিস্ট মুখস্ত করতে করতেই আমিও ‘গেলিভিশন’ কিংবা ‘ডিনাফাইট’ আবিষ্কারের নেশায় কাটিয়ে দিয়েছিলাম ক্লাস সেভেন-এইট পর্যন্ত।
ইংরেজি এ থেকে ডব্লিউ পর্যন্ত তেইশটা অ্যালফাবেট বাদ দিয়ে উইলিয়াম রন্টগেন কেন ‘এক্স’ রে বানাতে গেলেন এটা নিয়েও অনেকদিন পর্যন্ত দুশ্চিন্তায় ছিলাম। কাউকে জিজ্ঞাসও করতাম না; তাহলে যদি আমার ‘সায়েন্টিস্ট’ হওয়ার আগেই সে ‘এ-রে’ কিংবা ‘বি-রে’ বানিয়ে ফেলে।
আমার যাবতীয় খেলনা গাড়ি, রোবট, পিস্তল এইসব ভেঙে গেলে মনে মনে ভীষণ খুশি হতাম আমি। আম্মার কাছে কান্নাকাটি করে নতুন খেলনা আদায় করা যাবে নিশ্চয়ই। আর তারপর হাতুড়ি দিয়ে নির্মম-প্রহারের পর ভেতর থেকে বের করে আনতাম লাইট, মোটর আর চুম্বক, সেই সাথে চিকন চিকন তার। কিন্তু চিকন তারে কি আর আমার চলবে? বড় সায়েন্টিস্ট হতে হলে লাগবে মোটা মোটা বড় কারেন্টের তার। তাই ইলেকট্রিশিয়ান আসলে প্রতিবার একটা দুইটা তার সরিয়ে ফেলতাম আস্তে করে। ওদিকে ড্রয়িং রুমের ঘড়ি থেকেও হুটহাট ব্যাটারি উধাও হয়ে যেত।
আর এইসব আমদানী দ্রুতই পৌঁছে যেত আমার ‘গোপন-বাক্সে’।
তারপর একদিন আমার গোপন বাক্সের যাবতীয় উপকরণসহ ধরা খেলাম আম্মার কাছে। প্রমাণসহ আসামী হয়ে দাঁড়িয়ে আছি মাইর কিংবা বকার অপেক্ষায়। কিন্তু আমার মসৃণ থুতনীতে আদর করে চলে গেলো আম্মা, কিছুই বললো না। ঘটনার আকস্মিকতা কাটতে না কাটতেই শুনতে পেলাম আব্বাকে বলছে, তোমার ছেলে তো বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ার হবে।
এরপর...
পদ্মা-মেঘনায় পানি বইলো অনেক। শৈশব-কৈশোর পার করতে করতেই এসি কারেন্টের মতই সাইন ওয়েভে সমুদ্র তরঙ্গ বইলো আটলান্টিক থেকে বঙ্গোপসাগরে। আমার মাথাও বাদ গেলো না সেই উত্থাল-পাতাল তরঙ্গ থেকে। একটা মেয়ের মাইক্রোওয়েভে আটকা পড়ে গেলাম।
ততদিনে কিভাবে কিভাবে সেই গর্বিত মায়ের ভবিষ্যৎ ইঞ্জিনিয়ার-পুত্র ইলেকট্রিকালেই এসে জুটেছে, তার উপর সেই মেয়েটার সাথেই। আর মিস মাইক্রোওয়েভ এরই মধ্যে সিস্টেমের বারোটা বাজিয়ে ফেলেছেন।
‘গোপন বাক্স’ এখনও খাটের তলায় রেখে আসা শৈশবের সাথেই আছে; ইলেকট্রিকাল তারও এখন আর ইলেকট্রিশিয়ানের কাছ থেকে নিতে হয় না। বরং ইলেকট্রনিক্স ল্যাবে এই তারের প্যাচ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ছটফট করি। তারপর আবার এই তারেই পা বেঁধে পড়ে যাই প্রতি বছরে দুইবার। আর প্রতিটা হোঁচটের সমানুপাতে কমতে থাকে দশমিকের পরের একটা সংখ্যা।
সব মিলিয়ে পনেরো বছর আগে ইলেকট্রিশিয়ানের কাছ থেকে সরানো কারেন্টের তার প্যাচাতে প্যাচাতে লুপ হয়ে গেছে এখন।
এবং অনাবিষ্কৃত অসংখ্য আবিষ্কারের জনক এক সায়েন্টিস্টের জীবনে সেই লুপ এখন গলায় ফাঁস হয়ে পরার অপেক্ষায়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




