“ভাইয়া, তাড়াতাড়ি আসেন” ...
বুঝতে পারলাম না কাহিনী কি!!
এমন না যে মহারাণী অনেকক্ষণ ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। তাহলে এরকম আকুল আবেদনের মানে কি?
তবে হ্যাঁ, কিডনী পার হয়ে বহির্মুখী নাইট্রোজেন-বর্জ্যের আগ্রাসনে, মাঝেমধ্যে আমাদের কণ্ঠেও শৌচাগারের রুদ্ধদ্বারের সামনে এইরূপ ব্যাকুল আবেদন শোনা যায়। বিশেষ করে ‘থাকবো নাকো বদ্ধ করে’ সংকল্প করে ফেলা পশ্চাৎমুখী দ্রব্যাদি তো এরচেয়েও সংকটাপন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।
মেয়ের নাম টি-রেক্স, আমার জুনিয়র।
সঙ্গত কারণেই আসল নাম বলা গেলো না। তবে জুনিয়র মেয়েটার সাথে ঘুরাঘুরি হচ্ছিলো ভালই।
টি-রেক্স নামটা আমারই দেয়া, মোবাইলেও এই নামে সেভ করা। আসলে ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্টে হঠাৎ করেই একদম উপরের দিকে চলে এসেছে মেয়েটা, তাই কিছুটা নিরাপত্তার খাতিরে আর কিছুটা ঢং করেই এটা করা। এর সাথে মেয়েটার আকৃতিগত কিংবা চারিত্রিক সাদৃশ্য নেই বললেই চলে।
ওদিকে সাম্প্রতিককালেই আমার অন্তঃকরণে বয়ে গেছে প্রলয়ঙ্কারী এক ঘূর্ণিঝড়। আর আঙুলের ফাঁকে কলমের বদলে জায়গা করে নিয়েছে তামাকদণ্ড।
জনৈকা নারীর মানসিক অবস্থাও অনেকটা এরকমই।
ও অসম্ভব মিষ্টি আর আদুরে একটা মেয়ে। সিনিয়র-জুনিয়র সম্পর্কটার বাইরেও আমাদের মধ্যে অনেকদিন ধরেই কিছু একটা আছে। তবে ঐ ‘কিছু একটা’র ব্যাকরণগত সংজ্ঞা কিংবা পরিণতি নিয়ে আমি কখনই তেমন চিন্তিত না। চিন্তা করার সময় হয়েছে জানি, কিন্তু জোর করে নিজের সাথে অদ্ভুত খেলা খেলতে খেলতে এখন তাতেই বোধ হয় নেশা হয়ে গেছে।
যাইহোক, টিউশনি শেষ করে ওর সাথে দেখা করার কথা ছিল। ব্যাকুল ডাক শুনে আমি দ্রুত রিকশা নিলাম। জায়গামত নামলাম, নেমে দেখি সে হুড তুলে রিকশায় বসে আছে। অবাক কাণ্ড, কারণ ও সারাক্ষণ ছটফট করে, রিকশায় চুপচাপ বসে থাকার মত মেয়ে ও না।
আরও অবাক হলাম, যখন আমাকে দেখে ও বললো, ভাইয়া রিকশায় উঠেন।
নাহ, এবার মান-ইজ্জতের প্রশ্ন। রিকশায় হুড তুলে ঘোরার মত অন্তরঙ্গতা তো আমাদের হয়নি। কিন্তু আবারও মেয়েটার ব্যাকুল আহবান। কি আর করা, ডাইনে বায়ে দেখে রিকশায় উঠে পড়লাম। হুড তুলে চাপাচাপি করে বসতে হলো।
আসল কাহিনী বুঝলাম তারপরেই।
ও কালো রঙের খুব সুন্দর একটা ড্রেস পড়ে ছিল। আমার স্বল্প জ্ঞান নিয়ে এযুগের ললনাদের পোশাক-নামকরণের জটিলতায় যেতে চাচ্ছিনা। তবে নিঃসন্দেহে আধুনিক দামি ড্রেস। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু সমস্যা হলো, জামাটার পিঠের দিকের যেই চেইনটা, আসার পথে কোনওভাবে সেটা নষ্ট হয়ে গেছে। এজন্যই রিকশায় হুড তুলে বসে অতি কষ্টে ও নিজেকে আড়াল করে রেখেছে। রিকশা থেকে নামলেই শেষ।
ধরণী দ্বিধা হও।
এরকম বিব্রতকর অবস্থায় কি করতে হয় আমার জানা ছিল না। শক্ত করে সোজা হয়ে বসে আছি আমি। ঘাড় ঘুরিয়ে ও নিজে দেখতে পাচ্ছে না পিঠের দিকে কাপড়ের কি অবস্থা, আমি যে দেখবো লজ্জায় সেটাও পারছি না ঠিকমত। হাত দেয়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। আবার ওকে রেখে রিকশা থেকে নামাও সম্ভব না। কারণ মেয়েদের শরীর ফাঁক-ফোকড় দিয়ে দেখেই এখনও অভ্যস্ত ঢাকার লোলুপ ছেলেরা। আকর্ষণীয় মেয়েটার বিপদে পড়া অবস্থার সুযোগ নিতেই বা তারা ছাড়বে কেন?
বেশ খানিকক্ষণ পর সেফটিপিন নামক একটা সম্ভ্রব-রক্ষাকারী বস্তুর কথা মাথায় আসলো তার। কমবেশি প্রতিটা মেয়ের ব্যাগে যে সেফটিপিন থাকে এটাও ঐদিনই জানলাম। কিন্তু এরপর সবচেয়ে কঠিন কাজটা পড়লো আমার উপর। সেফটি পিন দিয়ে চেইনের দুই প্রান্ত কয়েক জায়গায় আটকে দিতে হবে।
আমার হার্টবিট তখন বাড়া শুরু করেছে। কিন্তু উপায় কি? সুতরাং চলন্ত রিকশাতেই কাজে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলাম।
ভয়াবহ কঠিন কাজ। এমনিতেই ল্যাবে আমার প্র্যাকটিকাল হাত ভালো না। তার উপর ইলেকট্রিকাল যন্ত্রপাতি তো না, মহার্ঘ্য নারীদেহের উপর রীতিমতো সুঁই এর প্র্যাকটিকাল।
দুইবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম, সেফটিপিন দিয়ে আঁটসাঁট দুইটা প্রান্ত ফুটিয়ে আটকানো নিঃসন্দেহে দুনিয়ার কঠিন কাজগুলোর মধ্যে একটা। ওদিকে মাঝখানে ওর অসম্ভব মসৃণ উন্মুক্ত পিঠ কাজটাকে আরো কঠিন করে দিচ্ছিলো।
আমার অপারগতা বুঝতে খুব অল্প সময়ই লাগলো মেয়েটার। তবে নতুন আইডিয়া পাওয়া গেলো। পিঠের দিকে চেইনের অংশটা ওড়না দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। কিন্তু এখানেও সেফটিপিন, পিঠের দিকে কাপড়ের সাথে ওড়নার কয়েকজায়গায় আটকে দিতে হবে।
এর মধ্যে হুটহাট পিঠের দিকের সরু একফালি কাপড় কয়েকবার আমার দৃষ্টি-সংযমের ভীষণ পরীক্ষা নিয়ে ফেলেছে। আর অনবরত ঐ পরীক্ষা দিতে দিতে আমি ততক্ষণে মোটামুটি বিরক্ত।
তবে হ্যাঁ, মিশন এবার সাকসেসফুল। ওর সুন্দর পিঠ অক্ষত রেখে কয়েকজায়গায় সেফটিপিন দিয়ে ওড়না আর পিঠের কাপড়টা সফলভাবে এফোঁড়-ওফোঁড় করতে পারলাম। তারপর ভদ্রস্থ অবস্থায় ওকে নিয়ে রিকশা থেকে নামলাম। কোথাও বসা যেতে পারে এইবার। আমার নার্ভাস গলাটাও শুকিয়ে কাঠ, ওটাও একটু ভিজিয়ে নেয়া উচিত।
একটা রেস্টুরেন্টে বসলাম, আমি এবং টি-রেক্স। পরিস্থিতি ততক্ষণে কিছুটা স্বাভাবিক। হার্টবিট নর্মাল না হলেও কমের দিকে। তাই রিকশার ব্যাপারটা নিয়ে হাসাহাসি করারও চেষ্টা করলাম একবার। আর ও আমাকে অনেকবার থ্যানক্স দিয়ে নিজেও কিছুটা লজ্জাও পেলো এবার।
এভাবে টুকটাক গল্প-গুজব করে ঘণ্টাখানেক পার হলো, ওখান থেকে চলে আসবো কিছুক্ষণের মধ্যেই। তার আগেই হঠাৎ করে এক পলকে আমাদের মধ্যে অনেক বড় একটা দেয়াল ধাক্কা দিয়ে ভেঙে ফেললো মেয়েটা, একদম হঠাৎ করেই।
পাশ থেকে আমার গালে আস্তে করে একবার ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো।
হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। আক্ষরিক অর্থেই মুখ হা করে তাকালাম মেয়েটার দিকে। কি ছিল এটা?
আমার খোঁচা খোঁচা গালে মা-বোন ছাড়া কোনও রমণীর ঠোঁটের স্পর্শ এই প্রথম।
মাথা ঘুরিয়ে চারিদিকে দেখলাম। দুইটা মেয়ে খুব আনন্দ নিয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বাকিদেরও এই দৃশ্য মিস করার কথা না।
তবে হতভম্ব ভাব কাটতে কাটতে প্রথমেই মাথায় আসলো, এখন গালের লিপস্টিকের দাগ মুছতে হবে। এই অবস্থায় বাসায় ফিরলে আর দেখতে হবে না।
জিজ্ঞেস করলাম ওকে। ও দেখেই বললো, গাল ঠিকই আছে, কারণ এটা ম্যাট লিপস্টিক।
নতুন জিনিস শিখলাম আমি। শিক্ষার দেখি তো আসলেই কোনও বয়স কিংবা সময় নেই। দোলনা থেকে কবর, এমনকি পাতলা দুইটা ঠোঁটের ভেতরেও শিক্ষা। নাহলে সারাজীবন রোমান্টিক নাটক-সিনেমায় নায়কের গালে লিপস্টিকের দাগ দেখে অভ্যস্ত আমি, এর বাইরেও কিছু হতে পারে ধারণাই ছিল না!!
যাহোক, ইলেকট্রিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ গাল থেকে শুরু করে হার্ট পর্যন্ত এই তড়িৎ-প্রবাহ কখনও পড়ানো হয় নি, তবুও বুঝতে পারলাম এটা। তাছাড়া আমার সুপরিবাহী গালের রেজিস্টেন্স ওর ঠোঁটের জন্য যথেষ্ট ছিল না কখনই। তাই শর্ট সার্কিট হয়ে পরের কয়েকদিন ওর সাথে কোনও যোগাযোগ করলাম না।
তবে সত্যি বলতে কি, হাল-আমলে চুমু খাওয়ার ব্যাপারটা খুব বড় কিছু না হওয়ারই কথা। অনেকেই হাই-হ্যালো করার চেয়ে গালে চুমু খাওয়াটাকে স্বাভাবিক মনে করতেই পারে। কিন্তু আমি একটু ব্যাকডেটেড কিনা। তাই তো ঐদিনের ঘটনাকে আমি আমার অমসৃণ গালের ভার্জিনিটি হারানো হিসেবেই মনে করি এখনও।
ইউরোপে একটা সময় সামাজিক অবস্থান অনুযায়ী চুম্বন নির্ধারিত ছিল। সমমর্যাদার একজনই পারতো আরেকজনের ঠোঁটে চুম্বন করতে। পদের পার্থক্য বাড়ার সাথে সাথে ঠোঁট থেকে দূরত্ব বাড়তো। নিচের পদের হলে তার চুমুর জন্য বরাদ্দ ছিল গাল, কপাল, হাত থেকে শুরু করে ক্রমান্বয়ে পা পর্যন্ত।
মাঝের দিকের বিস্তারিত অবশ্য ভালোমত জানি না। সুতরাং ঐ লাইনে চিন্তা না করাই নিরাপদ!!
তো যা বলছিলাম, ইউরোপীয় সেই প্রথা অনুযায়ী, ঐদিন পর্যন্ত মেয়েটা আমার নিচের পদমর্যাদায়ই ছিল। আক্ষরিক অর্থেও অবশ্য জুনিয়র হিসেবে ওর তাই হওয়ার কথা।
কিন্তু... ঐ যে বললাম, দেয়ালটা ভেঙে গিয়েছিল সেদিন। তাই আমার শর্ট সার্কিট ঠিক হয়ে এরপর দুইজনের সমমর্যাদায় আসতে খুব বেশি সময় লাগে নি।
ঐ গল্প আরেকদিন।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই অক্টোবর, ২০১৫ বিকাল ৪:০৭