একমনে হেঁটে চলছে অন্ধ ষাঁড়টা। সফেদ চামড়ার আস্তরণে ধূলো-ময়লার কারুকাজ। তার হাড় জিরজিরে শরীরে ক্লান্তি ও বয়সের প্রগাঢ়তা। সামান্য বিশ্রাম নেয়ার সময় নেই। ঘানির বিচ্ছিরি ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দের ছন্দায়িত দ্যোতনা মাঝে মাঝে বিচ্যুত হয় বাতাসে শিস কাটা লাঠির সপাং বাড়িতে। আর্তনাদ করেনা অবোধ পশুটা। দ্রুত পা চালিয়ে যায়। একমনে হেঁটে চলে মনিবের নির্দেশিত পথে। সাথে সাথে ঘানিতে পিষতে থাকে সর্ষে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে সূক্ষ্ণ তেলের রেখা। জলপতনের নিস্তব্ধতায় জমা হয় আকাঙ্ক্ষিত পাত্রে।
‘আচ্ছা, গরুদের কি গা ঘামে’? মনে মনে নিজেকেই প্রশ্ন করে কাদের মিয়া। গরুর শরীরে রোমকূপ নেই তা সে ভালো করেই জানে। জানে মানে সে বিজ্ঞানের ছাত্র নয়। স্কুলে বায়োলজি বইয়ের পাতা উল্টানোর সৌভাগ্য তার কখনো হয়নি। মানবদেহ অধ্যায়ের প্রজননতন্ত্রের ছবি দেখে সে অবাক বিস্ময়ে কখনো ঢোক গেলেনি। তার যুক্তি খুব সাধারণ। ‘ওই রকম মোটা চামড়া দিয়া ঘাম বাইর হওয়ার কতা না। তাইলে মনে হয় সব মুতের সাথে বাইর হয়া যায়’। মুহূর্তেই গরুর হলদের চনার কথা মনে পড়ে তার। সকালে উঠে যে রঙের প্রস্রাব সে নিজেও করে। সাত পাঁচ ভাবতে গিয়ে অনুভব করে তার নিজের শরীরই ভিজে একসা। কায়িক শ্রমী মানুষ, তার গা তো ঘামবেই। আলগোছে কাঁধের গামছাটা তুলে নিয়ে নিজের শ্রান্ত শরীরে দু’দন্ড বাতাস জোটানোর চেষ্টা করে সে। কাল্পনিক হাতপাখার ভঙ্গিতে হাত নাড়তে গিয়ে মনে পড়ে যায় একটা জনপ্রিয় গানের কলি, ‘তোমার হাতপাখার বাতাসে/প্রাণ জুড়িয়ে আসে’।
কাদের মিয়ার রিকশাটা একটা প্রকান্ড শিমুল গাছের ছায়ায় রাখা। চালকের সিটের ওপর একটা পা তুলে অন্যটা রিকশার পা দানিতে রাখতে তার খুব ভালো লাগে। এই ভঙ্গিতে বসার ফলে তার রোমশ উরুর অনেকটাই অনাবৃত হয়ে পড়েছে। রিকশা করে যাওয়া একটা চশমা পরা মেয়ে তার দুই উরুর ফাঁকে ভ্রুকুটি নিয়ে তাকিয়ে নিমেষে চোখ ফিরিয়ে নেয়। কাদের নির্বিকার। ‘যুইতমত পাইলে মাগিরে সাপের মণি দেখাইতাম’। মনে মনে হেসে ওঠে কাদের। উঠে দাঁড়িয়ে আলুথালু লুঙ্গিটাকে শক্ত গিঁটের আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলতে চায়। হু হট হট। সাদা ষাঁড়টার মালিক পরিমল পোদ্দারের আওয়াজে তার দিকে তাকায় কাদের। পরিমল একমনে গরুটাকে ঠেঙ্গিয়েই চলছে। অদৃশ্য কোন ক্ষেতে যেন ধারালো লাঙ্গল চালিয়ে যাচ্ছে। কাদেরের মনে হয় পরিমল আসলে ঘানির মালিক নয় বরং শর্ষে ক্ষেতের কৃষক। ঘর-বাড়ি,ক্ষেত-ফসল হারিয়ে বৃত্তাকার একটা চাষের জমিতে নিয়ত শর্ষে ফলিয়ে চলছে।
এদিকে শর্ষে গুঁড়ো হতে থাকে। ঘানিভাঙ্গা তেলের নিঃসঙ্গ প্রবাহের নৈঃশব্দে বিকেল ঘনিয়ে আসে। আকাশে আবিরের উচ্ছ্বলতা পরিমলকে দীপাবলির কথা মনে করিয়ে দেয়। রঙের উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে সেদিন পরিমল তার কৌমার্য হারিয়েছিল। বিধবা সীতা মামীর উপোস শরীরে ঝাপিয়ে পড়ে নিভিয়েছিলো প্রথম যৌবনের সুতীব্র অনল। মনে আছে, সে বিকেলে পুরনো তক্তপোষে এতটাই ক্যাঁচ ক্যাঁচ আওয়াজ হচ্ছিলো যে মামী তার শীৎকার থামিয়ে পরিমলের কানে উগরে দিয়েছিলো একটা শব্দ। ‘আস্তে, আস্তে’।
তারপর অনেক বসন্ত পেরিয়ে গেছে। প্রাণোচ্ছ্বল পরিমল বিবর্তিত হয়েছে নির্জীব ঘানিওয়ালায়। সর্ষের ঝাঁঝ তার যেন তার যৌবনের সবটা ঘাতক আর্সেনিকের মতো ধীরে ধীরে গিলে ফেলেছে। বয়স সফেদ সাক্ষী রেখে গেছে তার উসকোখুসকো চুল-দাঁড়িতে। বাড়িতে ফেরার কথা ভাবে পরিমল। আড়চোখে দেখে নেয় কাদের মিয়ার অবস্থান। কাদের ব্যাটার উপস্থিতি তার মনে সংশয়ের জন্ম দেয়। প্রতিদিন একই সময় একটা লোক এক জায়গায় কাটালে তা সম্ভবত যে কারো সংবেদী মনে সন্দেহের সৃষ্ট করবে। কাদেরের ব্যাপারটা হয়তো সে পর্যন্তই থাকতো। তবে একদিন ঘরের পেছনে কাদেরের অপসৃয়মান ছায়া তার চিরচরিত জীবনযাত্রায় হঠাৎ বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিলো। পা চালিয়ে ঘরে ঢুকে পরিমল আবিষ্কার করেছিল আলুথালু শাড়ি গোছাচ্ছে তার স্ত্রী মালতি রানী। তারপরও কাদেরেরা সাহস পায়। সাহস পায় পরিমলরা হিন্দু বলে। বিবমিষায় খাবি খায় পরিমল। একদলা থুথু উগরে নিজের অসহায়ত্ব ঘর্মাক্ত শরীর থেকে বের করে দিতে চায়। বিকেলের রোদ আচমকা বিলীন হতে শুরু করে। গোধূলির আড়ম্বর প্রথম সঙ্গমে উপগত কিশোরের শিশ্নের মতো হঠাৎ নেতিয়ে পড়ে। ষাঁড়টার রশি হাতে আঁকড়ে মাথা নিচু করে ঘরের চৌকাঠ পেরোয় পরিমল। এমন সময় প্রকৃতিও টুপ করে নিজের জরায়ুতে ঢুকিয়ে নেয় ক্লান্ত সূর্যকে।
বসার পিঁড়িটা তুলে ঘেয়ো কালো কুকুরটার দিকে সর্বশক্তিতে ছুড়ে মারে মালতি রানী। চোখে বেদনার ছাপ তুলে একটানা কেঁউ কেঁউ করে ডাকতে ডাকতে ত্রিসীমানার ওপারে হারিয়ে যায় নির্বাক জীবটা। ‘বালের কুত্তা, ফির ডেগত মুখ দিবু’? গজ গজ করতে বলে মালতি। কুপি জ্বালিয়ে রান্নার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। এমন সময় ক্ষুধার্ত কুকুরটা এসে হাড়িতে রাখা পান্তা গিলতে আরম্ভ করে। তাই মালতির এত খেদ। মালতির বয়স ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। পরিমলের সাথে সাত পাকে বাঁধা পরার সময় তার বয়স ছিলো পনের। তার মানে জীবনের অর্ধেক কাটিয়ে ফেলেছে প্রায় দ্বিগুণ বয়সী স্বামীর সাথে। মালতি হাড়ির ঢাকনা সরিয়ে অগ্লুপাতের মতো উথলে ওঠা ফেনের প্রবাহ প্রশমিত করে। তারপর কুপিটা মুখের কাছে এনে কমলা আগুনের শিখার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকে। এমন আগুন তার ভেতরও যে আছে সেটা এক জানতো! কাদের তার জীবনে না আসলে হয়তো নিজের এই দিকটা অনাবিষ্কৃত থেকে যেত মালতির কাছে।
মালতি আজ চুলে তেল দিয়েছে। স্বামী ঘানিওয়ালা, তার মানে অবশ্য এই নয় যে সে ইচ্ছেমতো তেল ব্যবহার করতে পারে। যেকোন বুড়োই তার যৌবনবতী স্ত্রীর সামান্য পরিচর্যাকে সন্দেহের চোখে দেখে। ঘানিওয়ালা পরিমল পোদ্দারও তার ব্যতিক্রম নয়।
সর্ষের তেল মালতির চুল ছাপিয়ে কপালে চিকচিকে আর্দ্রতা ছড়িয়েছে। মলিন শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেঁচিয়ে তাই মুছে ফেলে সে। নিজেকে ঘানির বলদ ছাড়া কোন কিছুই মনে হয়না তার। পরিমলের সংসারে না আছে সচ্ছলতা না আছে সুখ। পরিমল তাকে বারদুয়েক পোয়াতি করলেও মা হওয়া হয়নি মালতির। এজন্য পরিমলকেই দায়ী মনে হয় তার। তাছাড়া বছর কয়েক ধরে পরিমলের জৈবিক অভিলাষে ভাটার টান পড়েছে। বাইরের কোন মাগির দিকে চোখ পড়েছে কিনা কে জানে!
কাশির দমকে কাঁপতে কাঁপতে পরিমল বাড়ির আঙ্গিনায় প্রবেশ করে। দেশের এই অংশটাতে শীত একটু আগেই বয়ে আনে উত্তুরে হাওয়া। যত্নের সাথে ষাঁড়টাকে আধভাঙ্গা গোয়ালটায় বেঁধে ফেলে এগোয় হাত-পা ধোয়ার জন্য। মালতির সাথে তার একবার চোখাচোখি হয়। অনুচ্চারিত শব্দবিনিময়ে পারস্পরিক বিরক্তির নির্লপ্ত বিনিময় হয়। পরিমল একবার ঘরে ঢুকে আবার বেরিয়ে আসে তারপর হনহনিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
‘বালের মরদ’! মুখোভঙ্গির বিকৃতি ঘটে মালতির। কৈশোরের উদ্দাম কল্পনার বিস্তার নিঃসঙ্গ মাকড়শার শতছিন্ন জালের মতো প্রায়দৃশ্য সুতোর ঠুনকো বাঁধনে আটকে আছে। মালতি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই সূত্রের মূলোৎপাটনের। আক্ষেপে নিজেকে ঘানির ষাঁড়টার মতো নির্বোধ মনে হয় তার। ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দের আবডালে ষাঁড়টা তাও ছন্দের সুর শুনতে পায়। ক্ষয়িষ্ণু অপরাহ্নে পায় গোয়ালে ঢোকার প্রেরণা। একটু ভূষি-খড়ের গন্ধ পেলে তার সমহিত অভিব্যক্তিতে প্রচ্ছন্ন সুখের অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনের গভীরে ঈর্ষার দ্বীপ জেগে ওঠে মালতির। পরিমল ষাঁড়টার উপর নির্ভরশীল। সে জন্য তার সীমাবদ্ধ সামর্থের পূর্ণাংগ ইস্তেমাল করতে তার দ্বিধা নেই। মালতির সম্ভবত আর কিছু পাওয়ার নেই। অভিমানে শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হয়ে ওঠে তার। মলিন শাড়ির পাতলা গাঁথুনিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার সুডৌল বুক কামারের হাপরের মতো ওঠা-নামা করে অদৃশ্য কোন দর্শকের জন্য সৌন্দর্য বিলিয়ে যায়। ঝিঁঝি ডাকা সন্ধ্যার প্রায়ন্ধকার আবছায়ায় মুক্তির সুতীব্র ইচ্ছে জেগে ওঠে মালতির মনে । কাদেরও বলছিল সেদিন। নিজের প্রিয়তমাকে এখন আর কারো বিছানায় দেখতে রাজি নয় এই নাছোড়বান্দা প্রেমিক। উবু হয়ে মালতির ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলেছিল, ‘আইসো হামরা পলে যাই’। মালতি উদগত আবেগ সংযত করে স্পিকটি নট হয়ে ছিল সেদিন। নাকি কাদেরের চুমুর দমক তার রা কেড়ে নিয়েছিল তা বোঝা শক্ত। আজ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে মালতি। কাদেরের সাথে পালাতে হবে তাকে। চুপচাপ মড়ার মতো একটা বৃদ্ধ লোকের পাশে আর শুতে রাজি নয় সে। লাশের সাথে সহবাসে তার ঘেন্না ধরে গেছে।
ষাঁড় কাদেরের খুব পছন্দ। আসলে যে কোন লিঙ্গধারী প্রাণীই তার পছন্দ। মাদি কুকুরের চেয়ে মর্দা কুকুর তার ভালো লাগে। মাদী কুকুরের ফুলে ওঠা স্তন দেখলে কেন যেন ভাত খাওয়ার রুচি হারিয়ে ফেলে সে। সঙ্গমরত ষাঁড়ের মতো উন্মত্ত হওয়ার বাসনা তার আছে।। জীবনের প্রথম হস্তমৈথুনের তাড়না তার এসে ছিল প্রকান্ড একটা ষাঁড়ের পাশবিক সঙ্গম চাক্ষুষ করার পর। মালতির শরীর যেমন তাকে টানে তেমনি টানে পরিমলের ষাঁড়। রিকশায় রডতালা মেরে নিশ্চিন্ত হয় কাদের। মালতি যে কোন সময় এসে পড়বে। একটা দেড় টাকা দামের সিগারেট ধরিয়ে সে তার প্রেয়সীর জন্য অপেক্ষা করে। নিজেকে লুইচ্চা কৃষ্ণের মতো মনে হয় তার। জলভরা কলসির ভারে নুয়ে পরা রাধার নিতম্বের দুলুনি দেখাতে যার গাছে ওঠার প্রয়োজন নেই। রিকশায় ঠিক মতো তালা মারলেই হলো। রাধা আপনে আপ কাছে চলে আসবে। যাত্রার দুষ্ট উজিরের অট্টহাসির নির্বাক এক সংস্করণ তার ঠোঁটে ফুটে ওঠে।
মালতি গোছগাছ শেষ করে ফেলেছে। নেয়ার মতো খুব বেশি কিছু তার নেই। কাপড়-চোপড় ছাড়া জমানো খুচরো সাত/আটশো টাকার সম্বল শাড়ির খুঁটে বেঁধে নিয়ে মায়াময় চোখে চারপাশটা দেখে নেয় বোবা অনুভবে। এই বাড়ির উঠোন-চুলা-রান্নাঘরের কাদার প্রলেপে তার অনেক স্মৃতি মিশে আছে। ঘুণে খাওয়া চৌকিতে আছে অনেক স্বপ্নের অবশেষ। মালতির চোখ ছলছল করে। নিমেষে পরিমলের পান খাওয়া দাঁতের হাসি তার মনে ভেসে ওঠে। কোন ভুল হচ্ছে না তো? নিজেকে বেশ্যাবাড়ির মাসির মতো নির্লজ্জ মনে হয় তার। তারপর গোয়ালে বাঁধা ষাঁড়টার দড়ির গিঁট খুলতে থাকে। তার কৃষ্ণ বাঁশি না বাজাতে জানলেও চলবে তবে ষাঁড় তার লাগবেই!
[email protected]