এক বই পাগলের আখ্যান
---------------------------
আমার বই পড়া শুরু যখন আমি ক্লাস টু-তে পড়ি, বরিশাল উদয়নে। ভাইয়া তখন রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজে পড়ছে। হোস্টেলে থাকে। আর বাসায় ফিরে আসার সময় আমার জন্য বই নিয়ে আসে। ডায়মন্ড কমিকসের রত্ন। চাচা চৌধুরী, পিংকি, বিল্লু, রমণ, ফ্যান্টম, হী ম্যান, ডায়নামাইট, অগ্নিপুত্র অভয়। সেই হল শুরু। ঐ সময় আব্বা ছিলেন বরিশালের এডিসি - জেনারেল। আমার জন্মদিন উপলক্ষে যে গ্র্যান্ড পার্টি দেওয়া হল তাতে উপহার পেলাম লাল কাভারের সম্পূর্ণ সুকুমার রায় শিশু সমগ্র, এখন পর্যন্ত আমার জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠতম উপহার। ৩৪ টা দেশের রূপকথা নিয়ে সাজানো বই, চুক আর গেক, ইশকুল আর ময়ূখ চৌধুরীর ভয়ংকর শিকার কাহিনী। এসময় থেকেই পড়া শুরু টিনটিন, এসটেরিক্স। ভাইয়ার সংগ্রহ থেকে খুঁজে বের করে পড়া সেরা সন্দেশ। নেশা ধরাতে আর কীইবা লাগে।
ক্লাস ফাইভে আমি তখন ঢাকায়। কাকলি হাই স্কুলে পড়ি। পুরোদমে চলছে তিন গোয়েন্দা, গোয়েন্দা রাজু, তিন বন্ধু পড়া। থাকি মোহাম্মদপুর রাজিয়া সুলতানা রোডে। আর, গল্পের বইয়ের দোকানটা ছিল তাজমহল রোডের কাছাকাছি। ইসলামিয়া লাইব্রেরি (ধন্যবাদ, করুণাধারা-কে!)। একা যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। সেই আমি একদিন পেস্ট্রি কেনার টাকা বাঁচিয়ে না বলে বই কিনতে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি বাসার সামনে পুলিশের গাড়ি, আম্মুর মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। সবাই যখন আমাকে প্রশ্ন করতে ব্যস্ত, আমার মাথায় ঘুরছে এখনই তিন গোয়েন্দার বইটা লুকাতে হবে কেউ দেখে ফেলার আগেই। তা না হলে বই ছিঁড়ে ফেলবে, বৃথা যাবে এত পরিশ্রম।
এইট-নাইনে ধরলাম রানা, কুয়াশা, ওয়েস্টার্ন, কিশোর ক্লাসিক। পড়লাম কিশোর হরর, রোমাঞ্চকর সিরিজ। এর মধ্যে খোঁজ মিলল নানাবাড়ি আর দাদাবাড়ির বিশাল লাইব্রেরির। পড়া শুরু হল রবীন্দ্র, নজরুল, শরত, বিভূতি, বঙ্কিম - ক্লাসিকের মাঝে আমার পদচারণ। মনে আছে, এক আত্মীয়র বাসায় গিয়ে গল্পের বই পড়া শুরু করেছি। রাতের দাওয়াত ছিল। খাওয়া দাওয়া শেষ, রাত দশটা বাজে, বই শেষ হচ্ছে না, কেউ উঠতেও পারছে না বাসায় যাওয়ার জন্য। আরেক বাসায় বেড়াতে এসেছি, কান ধরে যে টেনে তুলবে তাও পারছে না। আমি পড়ে যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। বাসায় গিয়ে ধোলাই না হয় খেলাম, কিন্তু বই তো আগে শেষ করি - নাকি? এভাবে শেষ করেছিলাম বিশ্বনবী আর হাতেম তাঈ - আপুর এক বান্ধবীর বাসায়। আমার এই বই প্রেম দেখে যিনি আমাকে বই দুটো গিফটই করে দেন।
ইন্টারে এসে শুরু হল পাগলামি। দুই বছরে আঠারো দিন ক্লাস করাকে পাগলামি ছাড়া আর কীইবা বলা যায়। টেস্ট পরীক্ষায় হ্যাট্রিক গোল্লা পাওয়ার পরও পরীক্ষা দিতে দেওয়ার কারণে আজীবন কৃতজ্ঞতা সরকারি বিজ্ঞান কলেজের প্রতি। তা, কি করেছি এই দুই বছরে? দুটো কাজ, সারা ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে অকারণ ঘুরেছি বন্ধুদের সাথে। আর, পাবলিক লাইব্রেরি-বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র-গণগ্রন্থাগার চষে ফেলেছি। শুরু হল হিমু পড়া। আহ, উন্মাতাল সব দিন। মাঝে মাঝে মনে হতো খালি পায়ে বের হয়ে যাই বাসা থেকে, হলুদ পাঞ্জাবী নাহয় নাই থাকলো। মিসির আলি পড়ে ঝিম মেড়ে বসে থাকা। যুক্তির মাঝে মুক্তি খোঁজা। কবি পড়ে পাগল হয়ে যাওয়া। জাফর ইকবালের হাকারবিন, আমার বন্ধু রাশেদ, কপোট্রনিক সুখ দুঃখ, পৃ, টুকি ও ঝাঁয়ের অদ্ভুতুড়ে অভিযানের কাহিনী।
সুনীলের আত্মপ্রকাশ আর যুবক যুবতী-রা পড়া শেষে একঘণ্টা বই হাতে বসে থাকা। কি পড়লাম এটা আমি? বনফুলের ছোট গল্প, সত্যজিতের ফেলুদা, শঙ্কু, তারিণীখুড়ো, সুনীলের কাকাবাবু, আশুতোষের পারাপার, শীর্ষেন্দুর অদ্ভুতুড়ে সিরিজ, সমরেশের আট কুঠুরি নয় দরজা। সে এক অদ্ভুত সময়। মনে ও মননে আমাকে আজকের আমি করে তোলা অসাধারণ সব বই। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠচক্রে অনুবাদের সাথে আত্মীয়তা শুরু, তার আগে অবশ্য সেবার কিশোর ক্লাসিক সব পড়া শেষ। গণগ্রন্থাগারে ইংরেজি বই পড়ার পাঠ শুরু। এইচ এস সি ইংরেজি পরীক্ষার আগের দিন, আব্বা দেখতে আসলেন আমার প্রস্তুতি কেমন। দেখলেন হাতে এলিয়েস্টার ম্যাকলিনের বই। আমি আস্বস্ত করলাম এই বলে যে এটা ইংরেজি বই। কাজেই প্রস্তুতি পুরদমেই চলছে। ততদিনে, আব্বাও বুঝে গেছেন আমি বাঁ কানে শুনি ও ডান কান দিয়ে বের করে দিই উপদেশবাক্য, কিংবা হয়তো আমাকে নিয়ে আশা করাই ছেঁড়ে দিয়েছেন। কাজেই সেখানেই ঘটনার সমাপ্তি।
ভার্সিটিতে এসে শুরু হল তালিকা ধরে ধরে পড়া। মানিক পড়া হয় নাই। এক বসায় উপন্যাস সমগ্র শেষ করে উঠলাম। জহির রায়হান পড়ি নাই। এক টানে সব বই পড়লাম। বিমল কর ভালো লেখেন? আচ্ছা দেখি তো। বুদ্ধদেব গুহ, আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী, বাণী বসু, সুচিত্রা ভট্টাচার্য। এদিকে সৈয়দ মোস্তফা সিরাজ, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শওকত উসমান, সৈয়দ মুজতবা আলি, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন।
এরপর ধরল কবিতার ভূতে। জীবনানন্দ তখন আমার কাছে কবিতার শেষ কথা। এখনও। পড়লাম সুকান্ত, মধুসূদন, গুণ, সাহা, শামসুর রহমান, রুদ্র, আবুল হাসান, কাদরী, হেলাল হাফিজ। ওপার বাংলা থেকে সুনীল, শক্তি, বসু, সমর, জয় গোস্বামী, অমিয়, বিষ্ণু, শঙ্খ ঘোষ।চাকরিতে ঢুকলাম। টাকা আসলো হাতে। আর বই কেনা বেড়ে গেলো অস্বাভাবিক। স্বভাব পালটে তখন প্রবন্ধ পড়ি, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতির উপর লেখা বই পড়ি। বিদেশি ম্যাগাজিন (যা ভাবছেন তা নয়!) ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, নেচার, রিডার্স ডাইজেস্ট কিনে ঘর ভর্তি করে ফেলেছি। প্রতি মাসে দশ-পনেরো হাজার টাকার বই কিনতাম। এভাবে চলেছে যতদিন সংসারের জোয়াল কাঁধে চেপে বসে নি। এখনও যখন বাসা পাল্টাই, বউ অসহ্য হয়ে যায়। ২০-২৫ টা বস্তা ভর্তি থাকে শুধু আমার গল্পের বইয়ে।
এখন একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নই আমি। জীবনের হাতে শিকল পড়া, বন্দী। কিন্তু যেই এক জীবন কাটালাম বই পড়ে, এরকম একটা জীবন কাটানোর জন্য সর্বশক্তিমানের কাছে আমৃত্যু কৃতজ্ঞতা জানানোটাও কম হয়ে যায়।
আগের প্যাঁচালটাও এইখানে গিয়া পইড়া ফ্যালান!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে এপ্রিল, ২০১৯ বিকাল ৫:০১