somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

অজ্ঞ বালক
আমি আসলে একজন ভীষণ খারাপ মানুষ। তবে ভালো মানুষের মুখোশ পড়ে দুর্দান্ত অভিনয় করতে পারি বলে কেউ কিছু বুঝতে পারে না। সে হিসাবে আমি একজন তুখোড় অভিনেতাও বটে!!!

মহাভারত - দ্বিতীয় অংশ: জনক-জননীরা (২)

১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৩৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"রাজা জন্মেজয়, আপনার বংশে সর্বদাই পিতার কর্মফলের মূল্য সন্তানদের পরিশোধ করতে হয়েছে।"

১০ - মৎস্য-কুমারী

সত্যবতী কিন্তু কোন সাধারণ জেলে-কন্যা ছিলেন না। তার পিতার নাম ছিল উপরিচর। একদিন শিকার করবার সময় উপরিচর একটি গাছের ছায়ায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন, এমন সময় না চাইতেই তার বীর্যপাত হয়ে গেলো। উপরিচর এই বীর্যটুকু নষ্ট করতে চাইলেন না। তিনি এই বীর্যটুকুকে একটি পাতায় মুড়ে কাছেই ডালে বসা থাকা একটি পাখিকে বললেন তার স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিয়ে আসতে যাতে করে তিনি এই বীর্য থেকে সন্তান জন্ম দিতে পারেন।

পাখিটি যখন সেই পাতার টুকরোটা নিয়ে উড়ে যাচ্ছিল, একটি বাজপাখি এসে তাকে আক্রমণ করলো। সেই সময় পাতার টুকরোটি পাখির মুখ থেকে খসে পড়ে গেলো নদীতে যেখানে একটা মাছ সেটি বীর্যসহ গিলে ফেলল। এই মাছটি কিন্তু আসলে একজন অপ্সরা ছিল আগের জন্মে। সৃষ্টি-দেব ব্রহ্মা অপ্সরা গিরিকাকে অভিশাপ দিয়েছিলেন যে সে মাছ হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেবে এবং যতদিন না সে কোন মানবসন্তান জন্ম দিচ্ছে ততদিন পর্যন্ত তার শাপমুক্তি ঘটবে না।

কিছুদিন পর, জেলেরা মাছ ধরার সময় একটি মাছের পেটের ভেতর যমজ দুই মানব-শিশু খুঁজে পেল। একজন ছেলে, আরেকজন মেয়ে। তারা এই যমজ শিশু দুইজনকে উপরিচরের কাছে নিয়ে আসলো। উপরিচর ছেলে সন্তানটিকে নিজের কাছে রাখলেও মেয়েটিকে জেলেদের কাছে দিয়ে দিলেন। জেলেদের রাজা মেয়েটিকে নিজের মেয়ের মত আদর-যত্নে বড় করতে থাকলেন। সেই মেয়েটিই হলো সত্যবতী, কিন্তু সকলেই তাকে মৎস্যগন্ধা বলে উপহাস করতো। করবে নাই বা কেন, সত্যবতীর গা থেকে মাছের প্রচণ্ড আঁশটে গন্ধ বের হতো।

সত্যবতী পথিকদের গঙ্গা নদী পার করে দিতেন নৌকায় করে। একদিন তার নৌকায় উঠলেন ঋষি পরাশর। নৌকা যখন মাঝ-নদীতে তখন ঋষি পরাশর বলে উঠলেন যে তিনি সত্যবতীর গর্ভে নিজের সন্তানের জন্ম দিতে চান। সত্যবতী জানতেন যে ঋষিদের কথা অমান্য করা অসম্ভব তাও তিনি বলে উঠলেন, "কিন্তু, কি করে সেটা সম্ভব, মহাত্মন? আমি এখন আপনার সাথে রমণ করলে, সকলেই তা দেখতে পাবে। এমনিতেই আমি একজন জেলের মেয়ে ব্যতীত আর কেউ নই। বিয়ে না করেই আপনার সন্তান ধারণ করলে কেউ তো আমাকে পরে বিয়েই করবে না। আমি না থাকবো কুমারী, না হবে আমার সংসার।"

"চিন্তা করো না," পরাশর সত্যবতীকে আশ্বস্ত করলেন। তার ক্ষমতাবলে তিনি নৌকাটিকে একটি কুয়াশার দ্বারা সৃষ্টি করা পর্দার আড়ালে ঢেকে ফেললেন। "আমার ক্ষমতাবলে তুমি এই মুহূর্তেই সন্তান জন্ম দেবে এবং আমার সন্তানের জন্ম হওয়া মাত্র তুমি আবার তোমার কুমারিত্ব ফিরে পাবে। সেই সাথে আমার দেয়া আশীর্বাদের ফলে তোমার দেহ থেকে এই মাছের আঁশটে গন্ধ চলে যাবে। সেই জায়গায় তোমার শরীর থেকে বের হবে এমন এক গন্ধ যা যেকোনো পুরুষকে মোহাবিষ্ট করে ফেলবে।"

নৌকা নদীর অপর পারে পৌঁছানোর আগেই সত্যবতী কুমারী থেকে প্রেমিকা, প্রেমিকা থেকে মা, আর মা থেকে আবার কুমারী কন্যায় রূপান্তরিত হয়ে গেলেন। তার গায়ের মাছের গন্ধ সরে গিয়ে সেখানে জায়গা করে নিলো কস্তূরীর মতন অদ্ভুত সুন্দর এক গন্ধ। তার গর্ভজাত সন্তান ঋষি পরাশরের আশ্রমে বড় হতে থাকলো। তার নাম হল, কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। নদী দ্বীপে জন্ম নেয়া কৃষ্ণবর্ণ শিশু। এই শিশুই এককালে ব্যাস নামে সুবিখ্যাত হবেন। লিখবেন মহাভারত।

সত্যবতীর গায়ের গন্ধে আর অপ্সরা গিরিকা থেকে পাওয়া রূপের ঝলকে প্রেমে পরা রাজা শান্তনু তাকে রানী করে হস্তিনাপুরের প্রাসাদে নিয়ে আসলেন। গঙ্গার গর্ভজাত সুযোগ্য বংশধরের ত্যাগ করা সিংহাসনের উপর এখন দাবী থাকবে সত্যবতীর সন্তানদের।

১১ - তিন কন্যা

রাজা শান্তনু আর রানী সত্যবতীর দুইজন পুত্রসন্তান জন্মেছিল। চিত্রাঙ্গদা আর বিচিত্রবীর্য। কিছুদিন পরই, রাজা শান্তনু স্বর্গলাভ করলেন। ভীষ্ম তখন তার মা সত্যবতী আর রাজতনয়দের দেখভাল করতে থাকলেন। সত্যবতী চাচ্ছিলেন তার এই ছেলে দুইজন বড় হয়ে বিয়ে করে এক অসাধারণ রাজবংশের জন্ম দেবে। কিন্তু, চিত্রাঙ্গদা বিয়ে করার আগেই মৃত্যুবরণ করলেন। একই নামের এক গন্ধর্ব তাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলে তিনি এক দীর্ঘ যুদ্ধ শেষে প্রাণ হারান। অন্যদিকে বিচিত্রবীর্য ছিলেন চির-রুগ্ন, অসুস্থ দেহের। নিজের জন্য কোন মেয়েকে স্ত্রী হিসেবে বেছে নিতেও অক্ষম ছিলেন তিনি। কাজেই ভীষ্মই বিচিত্রবীর্যের জন্য পত্নীর সন্ধানে রত হলেন।

সেই সময় কাশীর রাজা নিজের তিন মেয়ের জন্য স্বয়ম্বর সভার আয়োজন করছিলেন। তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা আর অম্বালিকা সেই সভায় আগত সব রাজাদের মধ্য থেকে নিজেদের জন্য উপযুক্ত স্বামী বেছে নেবেন। কিন্তু, সেই স্বয়ম্বর সভার দাওয়াত অবশ্য বিচিত্রবীর্যের নিকট আসে নি। এর একটা কারণ, সকলেই জানতো যে বিচিত্রবীর্য কোন রমণীর স্বামী হওয়ার যোগ্য নয় তার শারীরিক অসুস্থতার কারণে। অবশ্য তার চাইতেও বড় একটা কারণ ছিল। ভীষ্ম যখন আমৃত্যু চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তারও অনেক আগেই কাশীর রাজার বোনের সাথে তার বিয়ে হওয়ার পাকা-কথা হয়ে ছিল। এমন অবস্থায়, আমৃত্যু চিরকুমার থাকার ব্রত নেওয়াতে, কাশীর রাজা ভীষণ অপমান বোধ করছিলেন। এই নিমন্ত্রণ না দেয়াটা সেই অপমানের বদলাও হতে পারে।

ঐদিকে স্বয়ম্বর সভার দাওয়াত না পেয়ে ভীষ্ম পুরো কুরুবংশকেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা হয়েছে বলে ধরে নিলেন। তিনি সটান রথে উঠে কাশীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলেন এবং কাশী পৌঁছে স্বয়ম্বর সভা থেকে কাশীরাজের তিন কন্যাকে জোরপূর্বক অপহরণ করে নিয়ে আসলেন। সভায় উপস্থিত রাজারা রাজকন্যা আর নিজেদের সম্মান - দুইই রক্ষার্থে জান-প্রাণ দিয়ে লড়াই করলেন ঠিকই কিন্তু ভীষ্মকে আটকাবেন তেমন বীর কই? কাশীরাজের তিন কন্যাকে নিয়ে এসে ভীষ্ম তার ছোট ভাই বিচিত্রবীর্যর সাথে বিয়ে দিতে নিলেন।

কিন্তু, কাশীরাজের বড় মেয়ে অম্বা, রাজা শাল্ব-কে মনে মনে ভালোবাসতেন। তার ইচ্ছা ছিল, স্বয়ম্বর সভায় উপস্থিত রাজাদের মধ্য থেকে তিনি শাল্বকেই বরমাল্য পড়াবেন। কাজেই, তিনি ভীষ্মের নিকট করজোড়ে বললেন, "হে বীর, আমার অন্য দুই বোনের সাথে আপনি আপনার ভাই বিচিত্রবীর্যের বিয়ে দিন। কিন্তু, আমাকে এই বিয়ে করতে বলবেন না। আমি অনেক আগে থেকেই রাজা শাল্বকে ভালবাসি। আমাকে অনুমতি দিন, আমি ফিরে গিয়ে তাকেই বিয়ে করতে চাই। আমার উপর দয়া করুন।" তার এই মিনতি শুনে ভীষ্ম তাকে তার প্রিয়তম রাজা শাল্বের কাছে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

স্বয়ম্বরে রাজা শাল্বও উপস্থিত ছিলেন ও রাজকন্যাদের বাঁচাতে ভীষ্মের সাথে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়েছিলেন। কাজেই যখন অম্বা ফিরে এসে তাকে বিয়ে করতে চাইলো সেটা রাজা শাল্বের পুরুষকারে ভীষণ আঘাত করলো। "কি করে আমি সেই রমণীকে নিজের রানী হিসেবে গ্রহণ করবো যাকে আমি অন্য পুরুষের বাহুবলের নিকট পরাজিত হয়ে অপহৃত হতে দিয়েছিলাম? আবার সেই একই পুরুষ তাকে দয়া করে আমার নিকট ফিরিয়ে দিলে সেটা দান হিসেবে গ্রহণ করা যায় কিভাবে? আমাকে ক্ষমা করবেন রাজকন্যা, আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।"

অপমানিত-ক্ষুব্ধ অম্বা ফিরে আসলেন বিচিত্রবীর্যের কাছে। কিন্তু, বিচিত্রবীর্য উদ্ধত স্বরে অম্বাকে বললেন, "আমি একজন রাজা। আর রাজারা শুধু দান করতে জানে, সেই দান ফিরিয়ে নিতে নয়।"

কাজেই অম্বা ভীষ্মের কাছে গিয়ে তাকে বিয়ে করার দাবী জানালেন। "আপনার কারণেই আজ আমার এই দশা। আপনি আমাকে স্বয়ম্বর সভা থেকে তুলে না আনলে এসবের কিছুই হতো না। আমি শাল্বকে বিয়ে করে সুখে দিন কাটাতে পারতাম। কিন্তু, আপনার কারণে এখন শাল্ব কিংবা বিচিত্রবীর্য - কেউই আমাকে বিয়ে করতে সম্মত হচ্ছে না। যেহেতু, আপনি নিজেই আমাকে স্বয়ম্বর সভা থেকে অপহৃত করে নিয়ে এসেছিলেন, সুতরাং শাস্ত্রমতে একমাত্র আপনিই আমার স্বামী হওয়ার অধিকার রাখেন। আমাকে আপনার বিয়ে করতেই হবে, এটা আপনার কর্তব্য।"

ভীষ্ম অবশ্য সেকথায় কান দিলেন না। "রাজকন্যা, আপনি নিশ্চিত আমার করা প্রতিজ্ঞার ব্যাপারে অবগত আছেন। আর সেই প্রতিজ্ঞার কারণে আমার পক্ষে কোন নারীকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমাকে ক্ষমা করবেন। রাজা শাল্ব কিংবা বিচিত্রবীর্য - কেউই যখন আপনাকে বিয়ে করতে চাইছে না সেক্ষেত্রে আমি আপনাকে মুক্ত করে দিলাম।"

অম্বা তার এই দুর্দশার জন্য ভীষ্মকে অভিযুক্ত করে বললেন, "আপনি এমন প্রতিজ্ঞা করে থাকলে, সেই স্বয়ম্বর সভা থেকে আমাকে তুলে আনার অধিকার আপনাকে কে দিল? এখন কেউই আমার দার-পরিগ্রহ করতে রাজী হচ্ছে না। এর সম্পূর্ণ দায়ভার আপনার।" অম্বা এরপর সমস্ত পৃথিবী ঘুরে এমন একজন যোদ্ধার খোঁজ করতে থাকলেন যে ভীষ্মকে হারিয়ে তার এই বিক্ষত মনে কিছুটা হলেও সান্ত্বনার প্রলেপ দিতে পারবে। কিন্তু, দুনিয়ার তাবৎ যোদ্ধারাই ভীষ্মের নাম শুনে পিছিয়ে যেতে লাগলেন। কাউকেই খুঁজে না পেয়ে অম্বা শেষ পর্যন্ত তার আর্তি নিয়ে গেলেন ভীষ্মের শিক্ষক, পরশুরামের কাছে।

পরশুরাম একজন ব্রাহ্মণ ছিলেন ঠিকই, কিন্তু তিনি কোন ক্ষত্রিয়ের তোয়াক্কা করতেন না। তার মনে ক্ষত্রিয়দের উপর তীব্র ঘৃণা জমে ছিল। বহু বর্ষ আগে, একদল ক্ষত্রিয় তার পিতাকে হত্যা করে তার গরু চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই অপরাধের প্রতিশোধ নিতে পরশুরাম কুঠার হাতে তুলে নিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে ক্ষত্রিয়দের পঞ্চ-বংশ নির্মূল করে ফেলেন। কুরুক্ষেত্রের ময়দানে পাঁচটি বিশাল সরোবর ছিল, সামন্ত-পঞ্চক নামে। পরশুরাম পাঁচ বংশের ক্ষত্রিয়দের রক্ত দিয়ে সেই দীঘিগুলো পূর্ণ করেন। কাজেই, দুনিয়ার সকল ক্ষত্রিয়রাই পরশুরামের নাম শুনলে ভয়ে কেঁপে উঠত।

অম্বার কাহিনী শুনে, ভীষ্মের এই হঠকারী আচরণে, পরশুরাম ক্ষুব্ধ হলেন। তিনি ভীষ্মকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করলেন। ভয়ংকর যুদ্ধ শুরু হল। ত্রিভুবনের সকলেই উৎকণ্ঠিত চিত্তে দেখতে থাকলো। দিনের পর দিন কেটে গেলো, পরশুরাম আর ভীষ্ম কেউই কারো থেকে কম যান না। শেষ পর্যন্ত পরশুরাম যুদ্ধ থামিয়ে বললেন, "ভীষ্মকে মারা সম্ভব নয়, কারণ যতক্ষণ ভীষ্ম না চাচ্ছে ততক্ষণ ভীষ্মের মৃত্যু হবে না। আবার ভীষ্মকে যুদ্ধে হারানোও অসম্ভব, যুদ্ধবিদ্যার সকল জ্ঞানই ভীষ্মের অবগত আছে। এটা জেনেও যদি আমি আর ভীষ্ম যুদ্ধ করতে থাকি, তবে এক পর্যায়ে আমরা এমন অস্ত্র চালনা করতে বাধ্য হব যা প্রলয় ডেকে এনে সৃষ্টিকেই ধ্বংস করে দেবে। কাজেই, এই যুদ্ধ এখানেই সমাপ্ত।"

আর কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে অম্বা ঠিক করলেন যতক্ষণ পর্যন্ত দেবতারা নিজেরা এসে তাকে ভীষ্মকে হত্যা করার উপায় না বলবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি এক পায়ে পাহাড়-চুরায় দাঁড়িয়ে তপস্যা করতে থাকবেন।

তার তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে, মহাদেব শিব নিজে এসে অম্বার সামনে উপস্থিত হলেন। "হে তপস্বিনী, তুমি ভীষ্মকে হত্যার উপায় জানতে চাও। তবে শুনে রাখো, তুমি নিজেই হবে ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ, তোমার হাতেই সেই মহাবীরের জীবনকাহিনীর সমাপ্তি লেখা আছে। তবে এই জন্মে না, এর পরের জন্মে তুমি ভীষ্মকে হত্যা করবে।" প্রতিশোধের ইচ্ছা, ভীষ্মকে হত্যা করার আকাঙ্ক্ষা অম্বার মনে এতটাই তীব্র ছিল যে অম্বা জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করলেন শুধুমাত্র আবারও জন্ম নিয়ে ভীষ্মকে হত্যা করার জন্য পৃথিবীতে ফিরে আসতে। পাঞ্চালের রাজা দ্রুপদের ঘরে, শিখণ্ডী নামে জন্ম নেবেন অম্বা। এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে নিজের হাতে ভীষ্মকে হত্যা করে মহাদেবের অমোঘ বাক্যকে সত্য প্রমাণিত করবেন।

১২ - বিচিত্রবীর্যের সন্তান

ভীষ্মের এত কষ্ট সবই বিফলে গেলো। কোন সন্তান জন্ম দেয়ার আগেই, বিচিত্রবীর্য মারা গেলেন। রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করার যে স্বপ্ন দেখছিলেন সত্যবতী, তা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো।

সত্যবতী আর উপায় না দেখে ভীষ্মের কাছে গেলেন। "পুত্র, তুমি নিশ্চয়ই ধর্মশাস্ত্রের ব্যাপারে জানো। সেই শাস্ত্রে লেখা নিয়োগ-নীতিতে বলা আছে, কোন ব্যক্তি যদি উত্তরাধিকারী না রেখেই মারা যায় তবে তার পিতা অথবা মাতার অন্য কোন সন্তান সেই মৃত ব্যক্তির বিধবা স্ত্রীদের গর্ভে সন্তান জন্ম দিতে পারবে। সেই সন্তান শাস্ত্রমতে ঐ মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারী বলেই স্বীকৃতি পাবে। আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, বিচিত্রবীর্যের বিধবা স্ত্রীদের গর্ভে তোমার সন্তান জন্ম দেয়ার জন্য, যাতে এই বংশধারা টিকে থাকে।"

ভীষ্ম হাতজোড় করে বললেন, "মা, আমি শাস্ত্রর ব্যাপারে যেমন জানি, তেমনি আপনিও আমার প্রতিজ্ঞার ব্যাপারে জানেন। আপনার আর বাবার সুখের জন্য আমি এই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। কিন্তু, সেই প্রতিজ্ঞা আমি কারো জন্যেই ভাংতে পারবো না। সেটা অধর্ম হবে।"

শেষ পর্যন্ত সত্যবতী , ঋষি পরাশরের কাছে পালিত তার আরেক ছেলে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নের কাছে দূত পাঠালেন। ততদিনে সবাই তাকে ব্যাস নামে ডাকছে। ব্যাস - যিনি সংকলন করেন। এক অসাধারণ কাজ ততদিনে ব্যাস সম্পন্ন করে ফেলেছেন। সম্পূর্ণ বেদকে চার খণ্ডে বিভক্ত করে একটা পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে ফেলেছেন। ব্যাস খবর পেয়ে সত্যবতীর কাছে আসলে, সত্যবতী তাকে বললেন, "পুত্র, তুমি বিচিত্রবীর্যের দুই পত্নীর গর্ভে তোমার সন্তান জন্ম দাও যাতে বিচিত্রবীর্যের বংশ, এই কুরুবংশ, আর অনেক বছর ভারতবর্ষে সুশাসন বজায় রাখতে পারে।"

ব্যাস বিনয়ের সাথে বললেন, "আপনি যদি সেটাই চান, তাই হবে মা। তবে আপনার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে এক বছর সময় দেয়ার। গত চৌদ্দ বছর ধরে আমি অরণ্যে, সন্ন্যাসীর জীবন যাপন করেছি। আমার চুল রুক্ষ, জট বাঁধা। গায়ের চামড়ায় পুরু হয়ে ময়লার আস্তরণ জমে আছে। আমার এই রূপ দেখে, মেয়েরা বিলক্ষণ ভয় পাবে।"

কিন্তু সত্যবতী আর একটা মুহূর্তও দেরী সহ্য করতে পারছিলেন না। "তুমি অযথাই দুশ্চিন্তা করছ পুত্র। তারা ভয় পাবে না। তোমার সাথে দ্বিধা ছাড়াই মিলিত হবে তারা। তুমি এখনই যাও।"

ব্যাস তার মায়ের কথার অবাধ্য হতে চাচ্ছিলেন না। কাজেই তিনি প্রথমে অম্বিকার কাছে গেলেন। ব্যাসের চেহারা দেখে অম্বিকা চোখ বন্ধ করে নিদারুণ বিতৃষ্ণার সাথে মিলিত হলেন। কাজেই, অম্বিকার গর্ভে জন্ম নেয়া পুত্রসন্তানটি হল জন্মান্ধ। তার নাম রাখা হল ধৃতরাষ্ট্র।"

এরপর ব্যাস যখন অম্বালিকার সাথে মিলিত হতে গেলেন, ব্যাসের এই ভয়ংকর রূপ দেখে অম্বালিকার চেহারা থেকে রক্ত সরে গিয়ে ফ্যাকাসে বর্ণের হয়ে গেলো। অম্বালিকার গর্ভে জন্ম নেয়া ছেলেও তাই ফ্যাকাসে রঙের, দুর্বল, রুগ্ন দেহের হল। তার নাম রাখা হল পাণ্ডু।

জন্ম নেয়া দুই পৌত্রের অবস্থা দেখে সত্যবতী হতাশ গলায় ব্যাসকে আবারো অনুরোধ করলেন, "তুমি আরেকবার অম্বিকার কাছে যাও পুত্র। আমি কথা দিচ্ছি, সে এইবার আর চোখ বন্ধ করে থাকবে না।"

ব্যাস আবারো মায়ের কথার মান রাখলেন। কিন্তু, এবার অম্বিকা আর বিছানাতেই আসলো না। অন্ধকার ঘরে অম্বিকার দাসী ব্যাসের সাথে মিলিত হল। আর ব্যাসের এই বাইরের রূপ দেখে সে বিন্দুমাত্র ভয় পেল না। বরং ভালোবাসায় পরিপূর্ণ এক মন নিয়ে সে ব্যাসের সাথে মিলিত হল। তার গর্ভে জন্ম নিলো বিদূর নামের এক ছেলে। বুদ্ধিমান, জ্ঞানী, সুদর্শন, আদর্শ লক্ষণযুক্ত। কিন্তু, রাজা হওয়ার লক্ষণ থাকলেই তো আর হয় না। দাসীর গর্ভে জন্ম নেয়া বিদূর আড়ালেই থেকে যাবেন। রাজমুকুট থেকে যাবে তার হাতের নাগালের বাইরে।

বিদূরের জন্মের পেছনে একটি ঘটনা রয়েছে, সেটা এখানে বলে যাই।

ঋষি মাণ্ডব যখন তার অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত আশ্রমে গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন, একদল চোর সৈন্যদের চোখ এড়াতে ঋষির আশ্রমে এসে লুকিয়ে থাকলো। ধ্যানমগ্ন মাণ্ডব জানতেও পারলেন না এই ঘটনার কথা। কিন্তু, রাজার সৈন্যরা এসে যখন আশ্রমে লুকিয়ে থাকা চোরদের পেল, তারা ঋষি মাণ্ডবকে ওই চোরদের লুকিয়ে রাখার অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করে ধরে নিয়ে গেলো। রাজাও এই ঘটনার কথা জানতে পেরে তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করতে বললেন। মৃত্যুর পর মাণ্ডব যখন যমরাজের সামনে এসে উপস্থিত হলেন, তিনি যমের কাছে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তার এই লজ্জাজনক মৃত্যুর ব্যাপারে কৈফিয়ত চাইলেন। তিনি একজন ঋষি, জ্ঞানত কখনো কোনও অপরাধ করেন নি, কখনো কারো মনে কষ্টও দেন নি। সেই তাকেই কেন এভাবে শূলের মাধ্যমে প্রাণ হারাতে হবে। যম বললেন, "ঋষি মাণ্ডব, আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছেন, কিন্তু অনেক আগে যখন আপনি একেবারে ছোট ছিলেন, তখন আপনি ছোট ছোট পোকামাকড় ধরে তাদের হাত পা টেনে টেনে ছিঁড়ে বন্ধুদের সাথে মজা করতেন। সেই কর্মের ফলেই আজ আপনাকে মৃত্যুবরণ করতে হল। আপনার কর্মের প্রতিফল আপনি হাতেনাতেই পেয়েছেন।" মাণ্ডব এই কথা শুনে আরও উত্তেজিত হয়ে পরলেন। ছোটবেলায়, যখন ঠিকমতন ভালো-খারাপের জ্ঞানও হয় নি, তখনের করা একটা আপাত নির্দোষ কাজের বদলে এভাবে অপমানজনক-ভাবে মৃত্যুবরণ করতে হবে। যম নিরাসক্ত গলায় বললেন, "নিঃসন্দেহে। এটাই তো কর্মফলের মূল নীতি।" যমের এরকম স্পষ্ট কথায় আগের থেকেই রুষ্ট মাণ্ডব ক্রুদ্ধ হয়ে যমরাজকে অভিশাপ দিলেন যে তাকেও মানবজন্ম গ্রহণ করতে হবে। এবং সেই জন্মে একজন রাজার, একজন আদর্শ শাসকের সকল গুণাবলি বর্তমান থাকার পরও, যম কখনোই রাজসিংহাসনে বসতে পারবেন না। আর এভাবেই, যমরাজ বিদূর হয়ে জন্ম নিলেন।

ভীষ্মের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই বড় হতে থাকলো ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু আর বিদূর। নিয়তির কি অদ্ভুত পরিহাস। নিজের পিতার জন্য কখনো পরিবারের বাঁধনে না জড়ানোর প্রতিজ্ঞা করা ভীষ্ম তার পিতার পরিবারের দেখভাল করতে করতেই একটা জীবন কাটিয়ে দিলেন। রানী সত্যবতী, বিচিত্রবীর্যের দুই বিধবা পত্নী আর তিনজন ভ্রাতুষ্পুত্রকে নিয়ে চিরকুমার থাকার প্রতিজ্ঞা করা, সিংহাসন-ত্যাগী ভীষ্ম সেই সিংহাসনের জন্যই, রাজ্য আর রাজত্বের কথা ভেবেই কুরুবংশের হাল ধরলেন শক্ত হাতে।

(সগৌরবে চলছে)

মহাভারত - পূর্বকথাঃ সর্পযজ্ঞ

মহাভারত - প্রথম অংশ: পূর্বপুরুষগণ (১)

মহাভারত - প্রথম অংশ: পূর্বপুরুষগণ (২)

মহাভারত - দ্বিতীয় অংশ: জনক-জননীরা (১)
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৩৬
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বিশ্বাসীকে লজিকের কথা বলার দরকার কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:১৭




হনুমান দেবতা এবং বোরাকে কি লজিক আছে? ধর্ম প্রচারক বলেছেন, বিশ্বাসী বিশ্বাস করেছেন ঘটনা এ পর্যন্ত। তাহলে সবাই অবিশ্বাসী হচ্ছে না কেন? কারণ অবিশ্বাসী বিশ্বাস করার মত কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৭১

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:৫৪



শাহেদ জামাল আমার বন্ধু।
খুব ভালো বন্ধু। কাছের বন্ধু। আমরা একসাথেই স্কুল আর কলেজে লেখাপড়া করেছি। ঢাকা শহরে শাহেদের মতো সহজ সরল ভালো ছেলে আর একটা খুজে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভাবছিলাম ২ লক্ষ ব্লগ হিট উপলক্ষে ব্লগে একটু ফান করব আড্ডা দিব, কিন্তু এক কুৎসিত অপব্লগার সেটা হতে দিলোনা।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:০৫



এটি ব্লগে আমার ২৬০ তম পোস্ট। এবং আজকে আমার ব্লগের মোট হিট ২০০০০০ পূর্ণ হয়েছে। আমি আনন্দিত।এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সেলিব্রেট করা হয়তো ছেলে মানুষী। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

শয়তান বন্দি থাকলে শয়তানি করে কে?

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ১০:২০



রমজানে নাকি শয়তানকে বেধে রাখা হয়,তাহলে শয়তানি করে কে?

বহুদিন পর পর ব্লগে আসি এটা এখন অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। বেশ কিছু বয়স্ক, মুরুব্বি, সম বয়সি,অল্প বয়সি একটিভ কিছু ব্লগার... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কট বাঙালি

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৪



কদিন পরপরই আমাদের দেশে বয়কটের ঢল নামে । অবশ্য তাতে খুব একটা কাজ হয় না । বাঙালির জোশ বেশি দিন থাকে না । কোন কিছু নিয়েই বাঙালি কখনই একমত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×