somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মহাভারত - প্রথম অংশ: পূর্বপুরুষগণ (২)

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"রাজা জন্মেজয়, ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে। পুনরাবৃত্তি ঘটে চলে একই ঘটনার, বার বার। আপনার বংশের ইতিহাসেই এই কথার প্রমাণ রয়েছে।"

০৪ - অপাপবিদ্ধ শকুন্তলা

সূর্যবংশীয় রাজা কৌশিক একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি একজন ঋষি হতে চান। কাজেই তিনি তার জাগতিক সকল সম্পদ বিসর্জন করে, নিজের পুরাতন জীবনের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে, আমৃত্যু নারী-সঙ্গ-বিবর্জিত থাকার কঠিন প্রতিজ্ঞা করে তপস্যা করতে শুরু করলেন। তপস্যা যদি সফল হয়, তবে তিনি হয়ে উঠবেন রাজর্ষি, রূপান্তরিত হবেন ক্ষত্রিয় থেকে ব্রাহ্মণে। ত্রিভুবনের সকলেই, এমনকি দেবতারাও তখন তাকে প্রণাম করতে বাধ্য হবেন।

দেবরাজ ইন্দ্র এদিকে কৌশিকের এই কঠিন তপস্যায় চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কেন যেন তার মনে হল, কৌশিক রাজর্ষি হয়ে একসময় দেবলোকে এসে তার স্থান দখল করতে চাইবে। কাজেই ইন্দ্র তার দেব-সভার সকল অপ্সরাদের মধ্যে সবচাইতে সুন্দরী মেনকাকে ডেকে পাঠালেন। তাকে বললেন সে যেন মর্ত্যলোকে গিয়ে রাজা কৌশিকের এই তপস্যা ভঙ্গ করে আসে। নৃত্যরত মেনকার অপরূপ সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে কৌশিক তার প্রতিজ্ঞার কথা ভুলে গেলেন। তিনি তপস্যা ভেঙে ফেলে, তার নারী সঙ্গ থেকে দূরে থাকার কথা ভুলে, মেনকার সাথে রমণে লিপ্ত হলেন।

তপস্বী কৌশিক আর অপ্সরা মেনকার মিলনে জন্ম নিলো এক কন্যাসন্তান।

কিন্তু এই সন্তান কৌশিককে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে তিনি এক মুহূর্তের অসংযমে কত দীর্ঘকালের তপস্যা ছেঁড়ে এসেছেন। নিজের প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছেন স্বর্গের অপ্সরার ছলনায় ভুলে। অন্যদিকে মেনকা ইন্দ্রের দেয়া কাজে সফল হয়ে গিয়েছিল, কাজেই মর্ত্যে থাকতে আর ভালো লাগছিলো না তার। দুইজনই কন্যা-শিশুটিকে জঙ্গলে ফেলে রেখে যার যার রাস্তায় চলে গেলেন।

ঋষি কণ্ব যখন এই কন্যা-শিশুটিকে খুঁজে পেলেন তখন একদল শকুন তাকে ঘিরে ধরে নিজেদের প্রশস্ত ডানা মেলে রক্ষা করে চলছিল। কাজেই তিনি শিশুটির নাম রাখলেন শকুন্তলা। শকুনের ডানার নীচে আশ্রয়-লাভকারী কন্যা। কণ্ব শকুন্তলাকে নিজের আশ্রমে নিয়ে গিয়ে আপন মেয়ের মতন মায়া-মমতা দিয়ে বড় করতে থাকলেন।

একদিন রাজা দুষ্মন্ত, চন্দ্রবংশীয় রাজা ও পুরুরবার বংশধর, ঋষি কণ্বের আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন। শিকারের উদ্দেশ্যে এই জঙ্গলে প্রবেশ করেছিলেন তিনি। ভাবলেন সেই সাথে ঋষিকে একটু প্রণাম জানিয়ে যাবেন। আর, শিকারে যে পরিমাণ ক্লান্ত হয়েছিলেন তিনি তাতে দুয়েকদিন বিশ্রাম পেলে মন্দ হয় না। কিন্তু, সেই সময় ঋষি কণ্ব আশ্রমে ছিলেন না। তিনি তীর্থযাত্রায় বের হয়েছেন। এই তথ্য তাকে দিল শকুন্তলা। রাজা অবশ্য তখন এইসব কথা শোনার মতন অবস্থায় নেই। শকুন্তলা এখন পূর্ণ যুবতী। মা মেনকার রূপের ছটা মেয়ে শকুন্তলার মধ্যেও একইভাবে বিরাজমান। আশ্রম-বাসিনী রমণীর এহেন স্বর্গীয় সৌন্দর্যের সামনে এসে দুষ্মন্ত প্রেমে পরতে বাধ্য হলেন।

ভালোবাসার কাছে রাজার গৌরব পরাজিত হল, দুষ্মন্ত বিনীতভাবে শকুন্তলাকে বললেন, "আমি রাজা দুষ্মন্ত, তোমাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক। তুমি কি আমার রানী হয়ে আমাকে কৃতার্থ করবে?"

লজ্জাবনত শকুন্তলা নম্র গলায় দুষ্মন্তকে বললেন, "আপনি বরং আমার পিতার সাথে কথা বলে নিন রাজন। তার অনুমতি যেখানে, আমি সেখানেই বিয়ে করবো।"

দুষ্মন্ত তখন প্রেমের এমন আবেগে ভাসছেন, আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করার সময় তার নেই। তিনি শকুন্তলাকে বললেন, "তোমাকে দেখে যতটুকু বুঝতে পেরেছি, তুমিও আমাকে ততটাই ভালোবেসে ফেলেছ যতটা আমি তোমাকে ভালবেসেছি এই কিছুক্ষণের সাক্ষাতে। কাজেই, আমরা দুইজন যদি রাজী থাকি তবে চাইলে গান্ধর্বমতে এই অরণ্যের গাছগুলোকে সাক্ষী রেখে আমাদের বিয়ে হতে পারে। শাস্ত্রে এই বিয়ে করার বিধি আছে। প্রয়োজনে পরে আমি তোমার পিতা ঋষি কণ্বের নিকট তোমাকে আমার রানী করার অনুমতি চাইবো। আমাদের দুইজনের মত থাকলে তিনি নিশ্চয়ই আমাকে বিমুখ করবেন না।" সুদর্শন রাজার কথায় শকুন্তলা বিগলিত হলেন, তিনি লাজুক হেসে বিয়েতে সম্মতি প্রদান করলেন।

কাজেই বৃক্ষদের সাক্ষী রেখে তাদের বিয়ে হয়ে গেলো। দুজনে প্রেম-সমুদ্রে অবগাহন করতে করতে জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত সেই আশ্রমে দিন কাটাতে লাগলেন। কিন্তু, দুষ্মন্ত একজন রাজা। আর রাজা যদি রাজধানীতে না থাকেন, প্রজাপালন ও শাসন না করেন তবে তার রাজধর্ম বিনষ্ট হয়। কাজেই দুষ্মন্তকে এবার তার রাজপ্রাসাদে ফিরে যেতেই হবে। কিন্তু, ঋষি কণ্ব তখনও তীর্থ থেকে ফিরে আসেননি। তার সাথে দেখা না করে শকুন্তলা আশ্রম ছেঁড়ে যেতে আগ্রহী ছিলেন না। কাজেই দুষ্মন্ত বললেন, "প্রিয়, আমার পক্ষে আর বেশিদিন এই আশ্রমে হেলায় সময় কাটানো সম্ভব না। আর তুমি যেটা বলছ তাও ঠিক। তোমার পিতৃস্বরূপ ঋষি কণ্বের অনুমতি ব্যতীত তোমাকে আমার সাথে করে প্রাসাদে নিয়ে যাওয়াটা আসলেই ঠিক হবে না। তুমি এই আশ্রমেই থাকো। ঋষি কণ্ব তীর্থযাত্রা শেষ করে আশ্রমে ফিরে আসা মাত্র আমি এসে তার সাথে কথা বলে, তার অনুমতি নিয়ে, তোমাকে আমার সাথে করে নিয়ে যাবো।"

তারও অনেকদিন পর কণ্ব ফিরে আসলেন। আশ্রমে এসেই কণ্ব শকুন্তলাকে দেখে বুঝতে পারলেন যে শকুন্তলা কারো প্রেমে পড়েছে, এবং তিনি এও বুঝতে পারলেন সেই ভালোবাসার ফসল এখন শকুন্তলার গর্ভে বড় হচ্ছে। ঋষি কণ্ব শকুন্তলার স্বামীর পরিচয় জানতে পেরে খুবই খুশী হলেন। আনন্দিত চিত্তে তিনি আর শকুন্তলা অপেক্ষা করতে থাকলেন কবে দুষ্মন্ত এসে শকুন্তলাকে আশ্রম থেকে নিজের সাথে নিয়ে যাবে। কিন্তু দিন গড়িয়ে সপ্তাহ পার হয়ে মাস গেলো। কিন্তু, রাজা দুষ্মন্তের কোন দেখা পাওয়া গেলো না।

যথাসময়ে শকুন্তলা পুত্রসন্তানের জন্ম দিলেন। তার নাম রাখা হল ভরত। ঋষি কণ্বের আশ্রমে, শকুন্তলার স্নেহ-মমতার স্পর্শে বেড়ে উঠতে থাকলো ভরত। ঋষি কণ্ব আর শকুন্তলা ভুলেই গিয়েছিলেন যে রাজা দুষ্মন্ত একসময় শকুন্তলাকে বিয়ে করেছিলেন, তাকে এসে নিজের সাথে করে নিয়ে যাবার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন। ভুলেই গিয়েছিলেন যে দুষ্মন্ত একসময় শকুন্তলাকে ভালবেসেছিলেন। কিন্তু, একদিন ভরত প্রশ্ন করলো, "মা, আমার বাবা কে? কি তার পরিচয়?"

ঋষি কণ্ব শকুন্তলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "ভরতের জানা উচিত কে তার পিতা।"

দুষ্মন্তের জন্যে আর অপেক্ষা করে কোন লাভ নেই সেটা ঋষি কণ্ব বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তাই শকুন্তলাকে বললেন ভরতকে সাথে করে রাজা দুষ্মন্তের কাছে গিয়ে তার পিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে। শকুন্তলা ঋষি কণ্বের পরামর্শ অনুযায়ী ভরতকে সাথে নিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো বন থেকে বের হলেন। বনের গাছপালাগুলো শকুন্তলাকে ফুলের অলঙ্কার আর পাতার আচ্ছাদনে আবৃত করে দিল যাতে দুষ্মন্তর সামনে শকুন্তলা যখন দাঁড়াবেন, তখন তার সৌন্দর্য যেন দুষ্মন্তকে সেই প্রথম দেখার স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়।

কিন্তু, দুষ্মন্তের সামনে দাঁড়িয়ে যখন শকুন্তলা নিজের ও তার পুত্র ভরতের পরিচয় দিলেন, রাজা দুষ্মন্ত তাদের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে বসলেন। এমন একটা ভাব নিলেন তিনি, যে তিনি চিনতেই পারছেন না শকুন্তলা কে আর তার গর্ভের সন্তান দুষ্মন্তের পুত্র হয় কি করে! তিনি উলটো বিদ্রূপ মাখা স্বরে শকুন্তলাকে প্রশ্ন করলেন, "ভদ্রে, আপনি যে দাবী করছেন আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছিল, তার উপযুক্ত কোন প্রমাণ কি আপনার কাছে আছে? কেউ কি সাক্ষী ছিল সেই বিয়ের?"

"হ্যাঁ, ছিল।" শকুন্তলা এক বাক্যে উত্তর দিলেন। "সাক্ষী ছিল অরণ্য, সেই অরণ্যের সব গাছপালারা।"

রাজা দুষ্মন্ত সহ রাজসভার সকলেই হেসে উঠলেন এই কথা শুনে। শকুন্তলা আশ্রমবাসী হতে পারেন। তবে তার আত্মসম্মান-জ্ঞান ছিল টনটনে। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, "রাজা, আপনি ভুল বুঝেছেন। আমি এখানে আমার স্বামীর সন্ধানে আসি নি। তিনি যখন আমাকে বিস্মৃত হয়েছেন তখন আমার তাকে মনে রাখার কোন কারণ আছে কি? আমি এখানে এসেছিলাম আমার পুত্রের প্রশ্নের জবাব দিতে। তাকে দেখাতে যে কে তার পিতা। আমার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এবং ভরতের প্রতি আমার দায়িত্বের অংশটুকু আমি পালন করেছি, তাকে মায়ের আদর-স্নেহ-ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছি। কিন্তু, সে একজন রাজপুত্র। কাজেই আমি চাইবো, তার পিতা যেন নিজ দায়িত্বের অংশটুকু পালন করেন। ভরতকে যেন একজন আদর্শ রাজপুত্রের মতন সম্মান ও শিক্ষা দিয়ে রাজ্যচালনার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হয়।" নিজের কথা শেষ করে শকুন্তলা ঘুরে রাজসভা থেকে বেড়িয়ে যেতে উদ্যত হলেন।

এমন সময়, দেবতারা আকাশ থেকে কথা বলে উঠলেন। তারা রাজা দুষ্মন্তকে ভৎর্সনা করলেন শকুন্তলাকে নিজের পত্নী হিসেবে স্বীকার না করার জন্য। তারা সাক্ষী দিলেন যে, শকুন্তলা নিঃসন্দেহে দুষ্মন্তের স্ত্রী আর ভরত তাদের দুজনের সন্তান। রাজা দুষ্মন্ত নিজের ভুল বুঝতে পারলেন ও শকুন্তলার কাছে ক্ষমা চাইলেন। এই রাজ্য, এই সমাজ হয়তো আশ্রমবাসীনি, অরণ্যচারী এক মেয়েকে রানী হিসেবে মেনে নেবে না সেই ভয়ে তিনি শকুন্তলার সাথে নিজের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করছিলেন। তিনি দেবতাদের আশ্বাসবাণী শুনে শকুন্তলাকে নিজের রানী ও ভরতকে তার উত্তরাধিকারী রাজপুত্র হিসেবে ঘোষণা দিলেন।

শকুন্তলা, যিনি আসলে সূর্যবংশীয় রাজা কৌশিকের কন্যা। আর দুষ্মন্ত, যিনি চন্দ্রবংশের সুযোগ্য রাজা। তাদের ছেলে ভরত এই দুই অসাধারণ বংশের সম্মিলিত গুণাবলীর আধার, এক অনন্যসাধারণ রাজা হিসেব বিখ্যাত ছিলেন। তার বংশধরেরা পুরো জম্বুদ্বীপ শাসন করতেন, যেই জম্বুদ্বীপের নাম পরবর্তীকালে রাজা ভরতের নাম অনুসারে ভারত-বর্ষ রাখা হয়।

০৫ - ভরতের উত্তরসূরি


ভরত একজন সুবিখ্যাত রাজা হিসেবে প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তার তিনজন সুযোগ্য পত্নীও ছিল। তাদের ঔরসে ভরতের অনেক পুত্রের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু, কোন এক অদ্ভুত কারণে ভরত তার কোন পুত্রের প্রতিই প্রসন্ন ছিলেন না। তাদের ব্যাপারে তিনি "এই ছেলেটা দেখতে আমার মতন হয় নি।" কিংবা, "এই ছেলের আচার-ব্যবহার তো দেখি আমার মতন নয়।" - ধরনের মন্তব্য করতেন। হয়তো তিনি মনে মনে সন্দেহ করতেন যে তার স্ত্রীরা অন্য পুরুষের প্রতি আসক্ত। কিংবা হয়তো তিনি তার কোন পুত্রসন্তানকেই এই বিশাল ভারতবর্ষে রাজত্ব করার উপযুক্ত মনে করতেন না।

এভাবেই সময় কেটে যেতে থাকলো। রাজা ভরত বৃদ্ধ হয়ে গেলেন কিন্তু তখনও তার কোন উপযুক্ত উত্তরাধিকারী ছিল না। কাজেই তিনি পুত্রসন্তান কামনা করে এক যজ্ঞের আয়োজন করলেন। যজ্ঞ শেষে দেবতারা তাকে ভিতথ নামের এক পুত্র দান করলেন।

ভিতথ আসলে বৃহস্পতির পুত্র ছিলেন। তার মা ছিলেন মমতা। মমতা কিন্তু বৃহস্পতির পত্নী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বৃহস্পতির বড়ো ভাই উতথ্যর স্ত্রী। মুহূর্তের ইন্দ্রিয়-লালসায় বৃহস্পতির পদস্খলন ঘটে আর মমতার গর্ভে জন্ম হয় ভিতথর।

যেহেতু বৃহস্পতির অন্যায় আচরণের ফলে ভিতথর জন্ম হয়েছিল তাই তার মা মমতা অপমানিত বোধ করে তাকে পরিত্যাগ করেন। অন্যদিকে, বৃহস্পতি নিজের এই অসদাচরণের জন্য লজ্জিত হয়ে এই ছেলেকে পরিত্যাগ করেন। কাজেই শকুন্তলার মতন, ভিতথও নিজের পিতা-মাতা কর্তৃক পরিত্যক্ত হয়েছিলেন। দেবতারা তাকে আপন করে নেন, তাকে প্রতিপালন করেন আর পরবর্তীতে যজ্ঞ সমাপ্ত হলে ভরতকে পুত্র হিসেবে প্রদান করেন।

ভিতথর মধ্যে একজন অসাধারণ রাজা হওয়ার সকল গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। ভরতও সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। আর তাই, পালিত পুত্র হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভিতথকেই নিজের উত্তরাধিকারী ও যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করেন।

ভরত জানতেন, রাজা হওয়ার জন্য সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যোগ্যতা। শুধুমাত্র নিজের রক্তের ধারাকে সিংহাসনে বসাতে বদ্ধপরিকর হয়ে থাকলে সুযোগ্য রাজার অভাবে রাজ্য ও প্রজারা নিদারুণ দুর্দশায় দিন কাটাতে বাধ্য হয়। আর তাই তিনি নিজ পুত্রদের চাইতে পালক পুত্রকে, রক্তের চাইতে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। একারণেই ভরত আর সব রাজার চাইতে ভিন্ন, সকল রাজার চাইতে শ্রেষ্ঠ, মহান। ভারতবর্ষ নামকরণ যে ভরতের নামে করা হয়েছিল তা রাজা ভরতের এইসব অসামান্য গুণাবলীর জন্যই।

কিন্তু, চন্দ্রবংশের অনাগত কালের রাজারা ভরতের এই পদাঙ্ক অনুসরণ করতে ব্যর্থ হবেন। যোগ্য হিসেবে সিংহাসন যার প্রাপ্য ছিল সেই ভাতৃষ্পুত্র যুধিষ্ঠিরকে উত্তরাধিকারী মনোনীত না করে ধৃতরাষ্ট্র তার নিজের ছেলে দুর্যোধনকে সিংহাসনে বসাবেন।

০৬ - যৌবনপ্রত্যাশি যযাতি

শর্মিষ্ঠা ছিলেন অসুরদের রাজা বৃষপর্বার কন্যা আর দেবযানী ছিলেন অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা। তারা দুজন প্রাণের বান্ধবী ছিলেন। কিন্তু, একদিন তাদের মধ্যে দারুণ ঝগড়া লেগে গেলো।

আসলে, এক পুকুরে স্নান করা শেষে তারাহুরায় দেবযানী ভুলে শর্মিষ্ঠার কাপর পরে ফেলেন। শর্মিষ্ঠা তাতে ভীষণ রেগে গিয়ে দেবযানীকে চোর বলে গালিগালাজ করতে থাকেন আর তার পিতা শুক্রাচার্যকে একজন ভিক্ষুক বলে অপমান করেন। তারপর শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে ধাক্কা দিয়ে একটা কুয়ার মধ্যে ফেলে রেখে একা একাই রাজপ্রাসাদে ফিরে যান।

সেদিন রাতে দেরি করে ঘরে ফিরে দেবযানী তার পিতাকে পুরো ঘটনা খুলে বললেন। কান্নাকাটি, আহাজারি থামাতে শুক্রাচার্য প্রতিজ্ঞা করলেন যে তিনি শর্মিষ্ঠাকে আচ্ছামতন শিক্ষা না দিয়ে থামবেন না। তিনি ঘোষনা দিলেন, "যতক্ষণ পর্যন্ত রাজা বৃষপর্বা নিজে এসে আমার কাছে তার কন্যার আচরণের জন্য ক্ষমা না চাইবেন আমি অসুরদের জন্য আর একটাও যজ্ঞ সম্পন্ন করবো না।"

বৃষপর্বা শুক্রাচার্যের কাছে ক্ষমা চাইলেন এবং যজ্ঞ শুরু করতে বললেন। কারণ যজ্ঞ ব্যতীত অসুররা দেবতাদের সাথে যুদ্ধে পেরে উঠবে না তা নিশ্চিত। কিন্তু, শুক্রাচার্য রাজী হলেন না। তিনি এবার অসুররাজকে বললেন, "আপনি আপনার কন্যা শর্মিষ্ঠাকে উপযুক্ত শাস্তি না দিলে আমি যজ্ঞ শুরু করবো না। এক কাজ করুন, আপনি শর্মিষ্ঠাকে আমার মেয়ে দেবযানীর দাসী হিসেবে কাজ করতে বলুন, তার বদলে আমি অসুরদের জন্য যজ্ঞ করা শুরু করবো।"

বৃষপর্বার হাতে দ্বিতীয় কোন উপায় ছিল না। রাজকন্যা শর্মিষ্ঠা তাই দেবযানীর দাসী হিসেবে কাজ করতে শুরু করলেন। কিন্তু এই শাস্তি শর্মিষ্ঠার জন্য শাপে-বর হয়ে আসলো।

দেবযানীকে যেদিন কুয়াতে ফেলে এসেছিল শর্মিষ্ঠা সেদিনই রাজা যযাতি শিকার করতে বনে এসেছিলেন। একসময় ক্লান্ত হয়ে পানি পান করার জন্য তিনি কুয়ার নিকটে আসেন। এসেই দেখতে পান নীচে পরে থাকা দেবযানীকে। তিনি দেবযানীকে সেখান থেকে তুলে আনেন। দেবযানী তখন রাজা যযাতিকে বলেন, "যেহেতু আমি একজন অবিবাহিত, কুমারী কন্যা। আর রাজন আপনি উপযুক্ত কারণে হলেও আমার হাত ধরে এই কুয়া থেকে আমাকে তুলে এনেছেন। কাজেই, শাস্ত্রমতে এখন আপনি আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য।"

যযাতি নিজেও শাস্ত্রের এই নিয়মের ব্যাপারে সম্যক অবগত ছিলেন। আর দেবযানী দেখতে মোটেও কদাকার ছিলেন না। বরং সুন্দর, কোমল মুখশ্রীর আশ্রম-বাসিনী দেবযানীকে পছন্দ না করার কোন কারণ ছিল না। তিনি শুক্রাচার্যের আশ্রমে এসে তার আশীর্বাদ নিয়ে দেবযানীকে নিজের আইনসিদ্ধ স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে নিজের সাথে রাজপ্রাসাদে নিয়ে যেতে চাইলেন।

দেবযানী হঠাৎই বলে উঠলেন, "সাথে করে আমার সব দাসীরাও যাবে।" এই চাওয়ার পেছনে ইচ্ছা ছিল একটাই। শর্মিষ্ঠাকে আরও অপমান করা।

"রানীর ইচ্ছাই, আমার ইচ্ছা।" যযাতি সম্মতি দিলেন। কাজেই শর্মিষ্ঠার সামনে আর কোন উপায় খোলা থাকলো না। তিনি দেবযানীর সাথে দাসী হিসেবে যযাতির রাজপ্রাসাদে যেতে বাধ্য হলেন।

দিন যায়, মাস যায়। একসময় যযাতি শর্মিষ্ঠার প্রেমে পড়লেন। আসলে যত যাই হোক, দেবযানী ছিলেন আশ্রম-বাসিনী। একজন মহর্ষির কন্যা। অন্যদিকে শর্মিষ্ঠা একজন রাজকন্যা ছিলেন। তার দেহে বইছে রাজরক্ত। কাজেই যযাতি তার সমমনা, সমযোগ্যতা সম্পন্ন শর্মিষ্ঠার প্রেমে পড়লেন। আর শর্মিষ্ঠাও সেই নিষিদ্ধ প্রেমের ডাকে সাড়া দিলেন। তারা দুইজন লুকিয়ে বিয়ে করে ফেললেন, এমনকি শর্মিষ্ঠা যযাতির সন্তানদের নিজ গর্ভে জন্ম দিলেন।

দেবযানী এইসবের কিছুই জানতেন না। শর্মিষ্ঠা তাকে বুঝিয়েছিলেন যে তার প্রেমিক আর কেউ নন, একজন সাধারণ প্রাসাদ-রক্ষী মাত্র। কিন্তু একদিন দেবযানী দেখলেন যে শর্মিষ্ঠার ছেলেরা যযাতিকে নিজেদের পিতা হিসেবে ডাকছে। রাজা যযাতি আর শর্মিষ্ঠা দুজনই তাকে ধোঁকা দিয়েছেন বুঝতে পেরে দেবযানী রাগে, ক্ষোভে, অপমানে প্রাসাদ ছেঁড়ে নিজের পিতা শুক্রাচার্যের কাছে ফিরে গেলেন। আর আবারো, শুক্রাচার্য তার প্রিয় কন্যার দুঃখ সহ্য করতে না পেরে যযাতিকে অভিশাপ দিলেন।

"ঠিক এই মুহূর্ত থেকে শুরু করে আমৃত্যু তুমি বৃদ্ধ হয়ে দিন কাটাবে। যে যৌবনের ডাকে তুমি আমার মেয়েকে ধোঁকা দিয়েছ, সেই যৌবন আর তোমার থাকবে না। আর যেই সন্তান তুমি জন্ম দিয়েছ শর্মিষ্ঠার ঔরসে, সেই সন্তানধারণের ক্ষমতাও তোমার লুপ্ত হবে। আজ থেকে তুমি অক্ষম।" কিন্তু পরে দেখা গেলো, এই অভিশাপের ফলে সবচাইতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেন দেবযানী নিজেই। একজন বৃদ্ধ, অক্ষম স্বামী নিয়ে আর যাই হোক সংসার করা যায় না। কিন্তু, শুক্রাচার্যের নিজেরও সেই ক্ষমতা ছিল না যে তার নিজের দেয়া অভিশাপকে রহিত করবেন। কাজেই তিনি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটিয়ে তার দেয়া অভিশাপকে একটু পালটে দিলেন। "তুমি আবারও তোমার যৌবন ও সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা ফিরে পাবে। তবে রাজা, সেটা তখনই সম্ভব হবে যখন তোমার কোন পুত্র স্বেচ্ছায় আমার দেয়া এই অভিশাপ তোমার বদলে বহন করতে রাজী হবে।"

যযাতি তৎক্ষণাৎ নিজের পুত্রদের ডেকে পাঠালেন। দেবযানীর গর্ভে জন্ম নেয়া যযাতির বড় ছেলে যদু এই অভিশাপের দায়ভার নিজের কাঁধে নিতে রাজী ছিলেন না। "সময়ের গতিকে কে থামাতে পারে পিতা? আমার আগে আপনি বৃদ্ধ হবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। আর আপনি চাইছেন আমি বৃদ্ধত্বকে বরণ করে নেই যখন কিনা আপনি পিতা হয়ে যৌবনকে আলিঙ্গন করবেন? একি অধর্ম নয়?"

অন্যদিকে, শর্মিষ্ঠার ঔরসে জন্ম নেয়া যযাতির ছোট ছেলে পুরু পিতার এই আজ্ঞা পালন করতে রাজী হলেন।

কাজেই দেখা গেলো পুরু অকালেই বৃদ্ধ হয়ে পরলেন আর তার পিতা যযাতি যৌবনের আনন্দ ভোগ করতে থাকলেন। যখন পুরু লাঠিতে ভর দিয়ে হাটছিলেন, বৃদ্ধ বয়সের নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছিলেন; যযাতি তখন অরণ্যে শিকার করতে ব্যস্ত, কিংবা নারী সম্ভোগে সময় কাটাচ্ছেন।

অনেক বছর পর, রাজা যযাতি বুঝতে পারলেন এই অসীম যৌবন, অনিঃশেষ কামনার কোন অন্ত নেই। কাজেই যযাতি পুরুর থেকে তার অভিশাপ ফিরিয়ে নিলেন।

যখন উত্তরাধিকারী নির্বাচনের সময় আসলো, রাজা যযাতি ঘোষণা দিলেন, "আমার পরে আমার ছোট ছেলে পুরুই হবে রাজা। আমার অভিশাপ বিনা দ্বিধায় নিজের কাঁধে নিয়ে সে আমার জন্য অনেক দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেছে। সে একজন আদর্শ সন্তান। আর আমার বিশ্বাস সে একজন আদর্শ রাজাও হবে।" অন্যদিকে নিজের বড় ছেলে, যদু, প্রকৃত উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তাকে সিংহাসন থেকে বঞ্চিত করে রাজা যযাতি উলটো অভিশাপ দিলেন, "তুমি আমার সন্তান হয়েও আমার কষ্ট লাঘবের কোন চেষ্টা করো নি। আমি অভিশাপ দিচ্ছি, তুমি কিংবা তোমার কোন বংশধরেরা কখনো রাজা হবে না।"

অপমানিত-বঞ্চিত যদু, যযাতির রাজ্য ছেঁড়ে দক্ষিণে নাগদের রাজ্য মথুরায় গমন করলেন। তার রাজসুলভ সৌন্দর্য ও ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে নাগ ধূম্রবর্ণ যদুকে বললেন, "হে অতিথি, আপনি আমার কন্যাদের বিয়ে করে আমার জামাতা হিসেবে এই মথুরাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করুন।" যদুর জন্য এটা দারুণ এক প্রস্তাব ছিল। কারণ নাগরাজ্য মথুরায় কোন রাজা ছিল না। বিশিষ্ট নাগদের নিয়ে গঠন করা একটি ছোট্ট পরিষদ মথুরার শাসনকার্য পরিচালনা করতো। অভিশপ্ত যদু জানতেন যে তিনি কখনো রাজা হতে পারবেন না। কিন্তু, মথুরায় থাকলে রাজা না হয়েও তিনি মথুরা শাসন করতে পারবেন। যদু তাই ধূম্রবর্ণের কন্যাদের বিয়ে করলেন। তাদের ঔরসে জন্ম নিলো অন্ধক, ভোজক, বৃষ্ণি সহ অসংখ্য উপজাতি। আর এই সকল উপজাতিকে একত্রে বলা হয় যাদব-বংশ।

এই যাদব বংশেই জন্ম নেবেন বিষ্ণু-অবতার, ঈশ্বর-স্বরূপ কৃষ্ণ। কিন্তু, কৃষ্ণও কখনো রাজা হবেন না। তবে পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে পুতুলনাচিয়ের মতন তিনি নিয়ন্ত্রণ করবেন আসমুদ্রহিমাচল ভারতবর্ষের রাজাদের ভবিষ্যৎ।

পুরুই প্রতিষ্ঠা করবেন প্রখ্যাত কুরু-বংশের। তার উত্তরসূরিই হল কৌরব আর পাণ্ডব-রা।

যযাতির দেয়া অভিশাপের ফলে এমন এক মহাযুদ্ধের বীজ বপন হয়ে গিয়েছিল যার ফল দেখবে কুরুক্ষেত্রের ময়দান। পুত্র পিতার কথা মেনে নেয়ায়, প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মের ব্যতিক্রম ঘটিয়ে যযাতিকে অনন্ত যৌবন দান করায় ছোট ছেলে পুরুই রাজপুত্র হয়ে গেলেন, যদু হলেন দুঃখজনক ভাবে বঞ্চিত। অনেক বছর পর, এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ভীষ্ম নিজের বৃদ্ধ পিতার বিয়ের জন্য নিজের সিংহাসনের দাবী, নিজের পারিবারিক জীবন উৎসর্গ করে দেবেন।

০৭ - ক্ষমাশীল মাধবী

মাধবী ছিলেন রাজা যযাতির কন্যা। মাধবীর ভাগ্যলিপিতে লেখা ছিল যে এই কন্যা একসময় চারজন সুযোগ্য রাজার জন্মদাত্রী হবে। একদিন গালভ নামের একজন ঋষি রাজা যযাতির কাছে আসলেন। তিনি রাজা যযাতির নিকট আটশত ঘোড়া চাইলেন। সাধারণ ঘোড়া হলে রাজা যযাতি যোগার করে দিতে পারতেন অনায়াসে। কিন্তু, গালভের দাবীটা ছিল অদ্ভুত। ঘোড়াগুলোকে সম্পূর্ণ সাদা রঙের হতে হবে। সেই সাথে ঘোড়াগুলোর একটা কান কালো রঙের হতে হবে। এইসব ঘোড়া অবশ্য গালভ নিজের জন্য চাচ্ছিলেন না, ঘোড়াগুলো তিনি উপহার দেবেন তার গুরু মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে।

এই ধরনের অদ্ভুত দাবী শুনে রাজা যযাতি হতবাক হয়ে গেলেন। এতগুলো সুনির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যের ঘোড়া যোগার করা তার জন্য অসম্ভব ছিল। কিন্তু, ঋষি গালভকে খালিহাতে ফিরিয়ে দিতে তিনি চাচ্ছিলেন না। তাই তিনি গালভকে বললেন, "মহাত্মা, আপনি আমার কন্যা মাধবীকে আপনার সাথে নিয়ে যান। তাকে চারজন এমন রাজার কাছে নিয়ে যান যারা প্রত্যেকেই নিজেদের উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর অভাবে দুঃখ-কষ্টে দিন অতিবাহিত করছে। আমার এই কন্যা তাদের প্রত্যেককে সিংহাসনের উপযুক্ত সন্তান প্রদান করবে। আপনি তার বদলে সেই সকল রাজাদের কাছ থেকে দুইশত করে ঘোড়া নিয়ে মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে দিতে পারবেন।"

যেই কথা সেই কাজ। গালভ মাধবীকে নিয়ে অসংখ্য রাজাদের নিকট গেলেন। তাদের মধ্যে তিনজন রাজা গালভের দেয়া শর্তে পূরণে সম্মত হয়ে মাধবীর ঔরসে পুত্রের জন্ম দিলেন। এভাবে গালভ ছয়শ ঘোড়া যোগার করতে সক্ষম হল। অবশেষে, গালভ তার গুরু বিশ্বামিত্রের নিকট গিয়ে বিনীতভাবে বলল, "গুরুদেব, এই নিন আপনার ঘোড়া। এখানে ছয়শটি ঘোড়া আছে। আর এই নিন, যযাতি-কন্যা মাধবীকে। তার ঔরসে আপনার বীর্য হতে জন্ম হবে একজন প্রখ্যাত রাজার। সেটাকে আপনি অবশিষ্ট দুইশত ঘোড়ার বদলে দেয়া উপহার বলে মনে করুন।" বিশ্বামিত্র গালভের এই প্রস্তাবে সম্মত হলেন। মাধবী বিশ্বামিত্রকেও একজন পুত্রসন্তান উপহার দিলেন।

চারজন পুত্রের জন্ম দেয়া শেষে মাধবী তার পিতা রাজা যযাতির নিকট ফিরে আসলেন। রাজা যযাতি তাকে বিয়ে দিতে চাইছিলেন কিন্তু মাধবী সংসারের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে তপস্বিনীর জীবন কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেন।

পুরুকে রাজসিংহাসনে বসিয়ে রাজা যযাতি এই মর্ত্যলোক ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন। সেখানে দীর্ঘদিন তিনি স্বর্গের আরাম আয়াসে দিন কাটালেন। কিন্তু একসময় দেবতারা তাকে স্বর্গ থেকে বের করে দিলেন। বিস্মিত যযাতি কারণ জানতে চাইলে দেবতারা বললেন, "স্বর্গে থাকতে হলে যেই পরিমাণ পুণ্যফল থাকতে হয় তার অধিকাংশই তুমি তোমার দীর্ঘ জীবনের কারণে মর্ত্যেই ব্যয় করে ফেলেছ। অবশিষ্ট পুণ্যও শেষ হয়ে গিয়েছে। কাজেই, তুমি আর স্বর্গে বাস করার উপযুক্ত নও।"

যযাতি আবারো স্বর্গ থেকে মর্ত্যে এসে পড়লেন। তিনি যেখানে এসে পড়লেন সেই বনেই তপস্যা করছিলেন মাধবী। পিতা যযাতির এই দুরবস্থা দেখে মাধবী বন থেকে বের হয়ে তার চার পুত্রের নিকট গেলেন। তারা সকলেই তখন সুযোগ্য হস্তে শাসন করছে পৃথিবীতে। ন্যায়বান, প্রজাপালন রাজা হিসেবে তাদের সুনাম তখন সুবিদিত। মাধবী তাদের কাছে গিয়ে নিজ নিজ সঞ্চিত পুণ্য থেকে এক-চতুর্থাংশ করে চাইলেন তার পিতা যযাতির জন্য। কিন্তু, তার পুত্ররা সকলেই মানা করে দিল। "যেই মানুষটা তোমার পিতা হওয়া সত্ত্বেও তোমার সাথে কেবলমাত্র একটা নিত্য ব্যবহার্য বস্তুর মতন আচরণ করেছে, অসংখ্য রাজার নিকট তোমাকে প্রেরণ করেছে মর্যাদা-হীনভাবে তাদের বংশের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখার উপকরণ হিসেবে, সেই মানুষটার জন্য তুমি আমাদের কাছে পুণ্য চাইতে এসেছ? কেন মা?"

মাধবী স্মিতহাস্যে বললেন, "কারণ আমি আমার পিতাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আমি তোমাদের মা, উনি আমার পিতা ও তোমাদের মাতামহ। এটাই শেষ কথা। আমি এখন রাগ করে থাকলে কিছুই পালটাবে না। যা হওয়ার তাই হয়েছে। আমার ভাগ্যের বিধান ছিল চারজন রাজার মা হওয়া, আমি তাই হয়েছি। আমি জানি যে রাগ-ক্ষোভ-ক্রোধ মনের মধ্যে পুষে রাখলে তাতে কোন লাভ হয় না। এগুলো বর্জন করো পুত্ররা। ক্ষমাশীল হও, উদার হও। সেটাই মানবধর্ম হওয়া উচিত।" মায়ের এই কথা শুনে রাজারা নিজেদের ভুল বুঝতে পারলেন। তারা নিজেদের সঞ্চিত পুণ্য থেকে এক-চতুর্থাংশ করে নিজেদের মাতামহকে দান করলেন।

কন্যা মাধবীকে হাজারো আশীর্বাদ করে যযাতি সেই পুণ্যের বলে আবারও স্বর্গে ফিরে গেলেন।

কিন্তু, সকলেই ভুলে যাবে মাধবীর সেই অমূল্য বাণী। ক্ষমাশীল হও, উদার হও। বছরের পর বছর পার হয়ে যাবে। কিন্তু, পাণ্ডব কিংবা কৌরব, কোন পক্ষই অপরকে ক্ষমা করতে চাইবে না, উদার হতে চাইবে না। আর তার ফলে নিদারুণ মূল্য দিতে হবে কুরু বংশকেই। পর্দা উঠবে কুরুক্ষেত্রের মহাযুদ্ধের।

(চলিতেছে...)

আগের পর্ব এখানেঃ

মহাভারত - পূর্বকথাঃ সর্পযজ্ঞ

মহাভারত - প্রথম অংশ: পূর্বপুরুষগণ (১)

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৩:৩১
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজকের ডায়েরী- ১৩৯

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ সকাল ১০:৪১

ছবিঃ আমার তোলা।

আজকে সাত রোজা।
সময় আসলে অনেক দ্রুত যায়। গতকাল সুরভি আর ফারাজাকে নিয়ে গিয়েছিলাম শপিং করতে। কারন আমি জানি, ১৫ রোজার পর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্বাসীকে লজিকের কথা বলার দরকার কি?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:১৭




হনুমান দেবতা এবং বোরাকে কি লজিক আছে? ধর্ম প্রচারক বলেছেন, বিশ্বাসী বিশ্বাস করেছেন ঘটনা এ পর্যন্ত। তাহলে সবাই অবিশ্বাসী হচ্ছে না কেন? কারণ অবিশ্বাসী বিশ্বাস করার মত কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের শাহেদ জামাল- ৭১

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ দুপুর ২:৫৪



শাহেদ জামাল আমার বন্ধু।
খুব ভালো বন্ধু। কাছের বন্ধু। আমরা একসাথেই স্কুল আর কলেজে লেখাপড়া করেছি। ঢাকা শহরে শাহেদের মতো সহজ সরল ভালো ছেলে আর একটা খুজে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভাবছিলাম ২ লক্ষ ব্লগ হিট উপলক্ষে ব্লগে একটু ফান করব আড্ডা দিব, কিন্তু এক কুৎসিত অপব্লগার সেটা হতে দিলোনা।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ১৮ ই মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:০৫



এটি ব্লগে আমার ২৬০ তম পোস্ট। এবং আজকে আমার ব্লগের মোট হিট ২০০০০০ পূর্ণ হয়েছে। আমি আনন্দিত।এই ছোট ছোট বিষয় গুলো সেলিব্রেট করা হয়তো ছেলে মানুষী। কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

বয়কট বাঙালি

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৯ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:২৪



কদিন পরপরই আমাদের দেশে বয়কটের ঢল নামে । অবশ্য তাতে খুব একটা কাজ হয় না । বাঙালির জোশ বেশি দিন থাকে না । কোন কিছু নিয়েই বাঙালি কখনই একমত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×