সবাই যেইভাবে ভূতের গল্প শেয়ার করা শুরু করছে, আমি ভাবলাম তাইলে একটা চেষ্টা কইরা দেখাই যায়। সমিস্যা হইলো, আমার অভিজ্ঞতাগুলা খুব বেশি পার্সোনাল। এগুলা লিখতে গেলেই নাম চইলা আসবো, জায়গার বা প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তির। আমি আবার এই জিনিসগুলা আড়ালে রাখতেই পছন্দ করি। তাও ভাবলাম, আজকে একটা দিয়াই দেখা যাক।
আমি তখন সদ্য ভার্সিটিতে ভর্তি হইছি। সারাজীবন শহরে থাকা আমার জন্য মফস্বলে, তাও আবার একদম গ্রামের দিকের একটা সদ্য প্রতিষ্ঠিত ভার্সিটিতে গিয়া মানাইয়া নেয়া বেশ কঠিন ছিল। তবে, তখন কচি বয়স, ডোন্ট কেয়ার ভাবে ঘুইরা বেড়াই। দুই-তিন মাসের মধ্যে সব ভুইলা হোস্টেল লাইফে জইমা গেলাম। সারাদিন পড়ি - আরে, গল্পের বই আর কি! রাতে তাস, মুভি, গেম। দিনে বাধ্য হইয়া ক্লাস, আড্ডা আর হোস্টেলের খাবার যা হোস্টেলে থাকা সবাইর কাছে কিংবদন্তির চাইতে কম কিছু না। তা, শীতকাল আইসা পড়লো। সেই সময়, আমাদের হোস্টেলের ডাইনিং-এ শুরু হইলো সমিস্যা। যেই মামা রান্না করতো, দেখা গেলো সে একদিন উধাও, ফোন বন্ধ, তার কোনো খবরই নাই। আরেকজন মামা আসার আগ পর্যন্ত আমরা তখন অকুল পাথারে, উষর মরুতে। সবচেয়ে কাছের খাওনের দোকানটাও, আমাদের হোস্টেল থেইকা কমসে কম দুই মাইল দূরে। যাওয়ার পথটা আবার একটা চিপা রাস্তা, কোনমতে দুইটা মিনিবাস যাইতে পারে পাশাপাশি, কিন্তুক নামে কইলাম হাইওয়ে। সাঁই সাঁই কইরা গাড়ি যায়, এর মধ্যে যেই কুয়াশা তাতে ডান হাত বাম হাতরে দেখতে পারে না; এই অবস্থায় হাঁইটা দোকানে যাওয়াটাও রিস্কি ছিল। কিন্তুক পেটের ঠেলা, বড় ঠেলা। বইয়ের নামটাও মনে আছে, দূরবীন। আগের দিন রাতে ধরছিলাম। শেষ হয় নাই, তাই ক্লাস থেইকা সোজা রুমে আইসা সেই যে বসছিলাম, উঠলাম যখন রাইত বাজে নয়টা। খিদায় পেট তো কাঁনতেসেই, আমিও আরেকটু হইলে কান্নাকাটি শুরু করুম- এই দশা। দোকান যদিও রাত দশটা পর্যন্ত খোলা, কিন্তু খাবারের টানাটানি বিধায় সবাই আগেভাগেই খাইতে চইলা যায়। দুই-তিন তালা ঘুইরাও এমন একজনরে পাওয়া গেলো না, যে না খাইয়া ছিল তখন পর্যন্ত; কয়েকজন দেখা গেলো পাউরুটি-কলারেই জীবনের সঙ্গী করছে, কিন্তু আমার তখন ভাতের হাউস জাগছে। শেষ পর্যন্ত- ধুর্বাল, কি আছে জীবনে- বইলা একাই জ্যাকেট গায়ে বাইর হইয়া গেলাম। মেইনা রাস্তায় উইঠা হাঁইটা যাইতাসি। কঠিন ঠান্ডা, ঠোঁট-মুখ-কান জইম্মা গেসে; আমি আবার কোনোকালেই মাফলার, কানটুপি এইসবের ধারধারিনা। এইখানে আসার আগে তো ব্যাগী গেঞ্জি-হাফপ্যান্ট পরতাম শীতকালে। তো, হাত দুইটা জ্যাকেটের পকেটে ঢুকাইয়া সতর্ক দৃষ্টিতে বাস কিংবা রিক্সার আসা-যাওয়ার খেয়াল রাইখা যাইতাছি। এমন সময় রাস্তার ওইপাশে একটা কুত্তা সামনে থেইকা আচানক উদয় হইয়া আমারে পাস কইরা পিছনদিকে গেলো গা। ভার্সিটিতে বেওয়ারিশ কুত্তার অভাব নাই। পোলাপাইন নিজেরাই তাগোরে খাওয়াইয়া আরও পুষ্ট কইরা তুলতাসে, কাউরে কিছু কওয়ার নাই। অবশ্য কইবোই বা কেডা, আমি নিজেই দিনে বিশ টাকার পাউরুটি-বিস্কুট খাওয়াই কুত্তাগুলারে। মোটামুটি সবগুলার আকিকা করা শেষ, সবাইর ফেভারিটও আছে। আমার যেমন কালা নামের একটা কুত্তা। নামের মতন তার পুরা বডিটাই কালো রঙের, কিন্তু খুব মাই ডিয়ার টাইপ কুত্তা। লেজে পাড়া দিলেও ঘেউ না কইরা কেউ করে এমন। তো, কুত্তাটারে দেইখা আমি ভাবসি, কালা-ই গেসে। কারণ, এই কুত্তাটাও পুরাই কালো রঙের। যতটুকু দেখসি, সেইরকমই মনে হইছে। কিন্তু, কালা হইলে আমারে দেইখা এমনে পাশ কাঁটাইয়া চইলা যাওয়ার ত কথা না, এতটা বেঈমান অন্তত কোনো কুত্তা হইতে পারে না। কাজেই আমি "এই কালা, চু চু" কইরা শিষ বাজাইয়া ডাকলাম কুত্তাটারে পিছন ফিরা।
কুত্তাটা যা করলো সেইটাই ইতিহাস। সে বেশ নরমাল গতিতেই হাঁইটা যাইতেছিলো, হঠাৎ থাইমা গেলো আমার ডাক শুইনা। এরপর নিজের পুরা বডিটারে না ঘুরাইয়া, জাস্ট ঘাড় থেইকা শুরু কইরা মাথাটারে পুরা ১৮০ ডিগ্রী এঙ্গেলে ঘুরাইয়া আমার দিকে তাকাইলো। তার পুরা বডি সামনের দিকে আর মাথাটা খালি পিছনদিকে ঘুইরা আছে। কাহিনীটা বুঝতে আমার সেকেন্ড দশেক লাগলো, এইটা কালা না এবং ভালাও না। আর কিছু বুঝার আগেই দেখলাম, আমি দৌঁড়াইতাসি। মাথা পুরা ব্ল্যাংক হইয়া যাওয়ায়, আমার বডি কন্ট্রোল নিয়া বেস্ট অপশন বাইছা নিসে। এইটা হাইওয়ে, বাস ঢাক্কা দিতে পারে, রিকশা আছে, এত লম্বা পথ আমার মতন আনফিট লোক দৌঁড়াইয়া পারব না বা ভূত দেখলে দৌঁড় দিতে নাই - এইসব কিছু আমার মাথায় নাই তখন। মাথায় শুধু একটাই জিনিস টিং টিং কইরা বাজতাসে- দৌঁড়া ফরেস্ট, দৌঁড়া। দেড় মাইলের মতন দৌঁড় শেষে আমি যখন দোকানে গিয়া পৌঁছাইলাম তখন আমারে দেইখাই দোকানদার রাজীব মামা আর তার ছেলে রয়েল বুঝলো, কাহিনী ঝিরঝির। তারা মাথায় পানি দিয়া, গায়ে ফুঁ দিয়া একশেষ করছিল। এবং সেই সাথে আমারে কইছিল, এই রাস্তায় কখনো যাতে রাতের বেলা একা এমনে না যাই। এইখানে ভার্সিটি হওয়ার আগে বলে এই রাস্তায় বহুত ডাকাতি হইতো, একটা গ্রামই ছিলো ডাকাতদের। গলাকাটা কোনো ব্যাপারই ছিলো না তাদের কাছে। রাস্তায় তাই অনেক সময়, অনেক কিছুই দেখা যায়- যদিও তারা মানুষের ক্ষতি করে খুব কম। এত কিছু, তখন মাথায় ঢুকে নাই, জাস্ট শুইনা গেসিলাম। আমারে সাথে কইরা হোস্টেলে পৌঁছাইয়া দিয়াও গেসিলো মামা। ভূতের সাথে সেইটাই আমার প্রথম মোলাকাত না। কিন্তু, এই সাক্ষাতটা খুব মাথায় ঢুইকা আছে। জিনিসটার ইমপ্যাক্ট অন্য রকম ছিল।
তো, এই হইলো কাহিনী। আশা করি, এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সহজেই দেয়া যাইবো। কিন্তু, আমি আবার কট্টর ভূত বিশ্বাসী হওয়ায় সেগুলা শুনতে ভাল্লাগে না। এই আধুনিক, ছায়েন্টিফিক, বাস্তব দুনিয়ায় কিছু রহস্য নাহয় থাকুক। কিছু শাকচুন্নী, মামদো আর বেহ্মদত্যিরা থাকুক নিজেদের মতন।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০২০ বিকাল ৪:৩২