এই নতুন বাসাটায় আসার পর থেকে আমাদের উদ্দাম স্বাধীনতায় একটা ছেদ পড়লো। আম্মু এককথায় বলে দিল, আর যাই করি না কেন, দোতালার শেষ মাথায় যে কালো রং করা দরজাটা আছে সেটা খোলা যাবে না। কখনোই না।
নিষেধাজ্ঞাটার গুরুত্ব বোঝানোর জন্যই বোধহয় তার দুইদিন পর যখন ভাইয়া দরজাটার লকটা আম্মুর ব্যাগ থেকে চুরি করে আনা খোঁপার কাঁটা বাঁকিয়ে খোলার চেষ্টা করছিল আম্মু সেটা টের পেয়ে ছুটে এলেন ও তার কাছে থাকা তিন নাম্বারি বেত দিয়ে রীতিমতো অমানুষিক ভাবে ভাইয়াকে মেরে আমাদের মাথায় একটা কথা ঠেসে ঢুকিয়ে দিলেন। আর সেটা হল, কালো দরজাটা খোলা যাবে না। ওটার ভেতরে কি আছে সেটা দেখার লোভের সামনে আম্মুর ঐ বেতের এলোপাথাড়ি বাড়িগুলোর ভয়টা যথেষ্ট ছিল।
প্রতিদিন আম্মুকে স্কুলে যেতে হয় ক্লাস নিতে। ভাইয়াকে আম্মু সাথে করে নিয়ে যায়। ভাইয়াকে ওর স্কুলে নামিয়ে, আম্মু তার নিজের স্কুলে চলে যায়। আমি নাকি এখনো একটু ছোট। তাই স্কুলে যাওয়ার দরকার নেই আমার। একটু বড় হলে, এই সামনের বছর থেকেই; আমিও স্কুলে যাওয়া শুরু করব। নতুন বাসা তাই এখানে বুয়া নেই। আগের বাসাটায় রহিমা বুয়া এসে আমাকে আর আফুকে দেখে রাখতেন যতক্ষণ আম্মা স্কুলে থাকতেন তার পুরোটা সময়। এখানে এখনো কাউকে খুঁজে পায় নি আম্মু। আর তাই আমাকেই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আফুকে দেখে রাখার। ওহ, আফুকে চেনেন না। আরে, আফনান, আমার ছোটভাই। আমার আব্বু-তো গতবছর থেকে বিদেশেই থাকে। দাদা-দাদী থাকেন সেই সৈয়দপুরে। আম্মুতো টিচার। তাই চাইলেও ওখানে গিয়ে থাকতে পারেন না। এখন যেমন এই গাজীপুরের শ্রীপুরে আসতে হয়েছে আম্মুকে, স্কুলে পড়ানোর জন্য। বছরের মাঝখানে এভাবে আসা লাগে না, কিন্তু কি একটা সমস্যা নাকি হয়েছে। আব্বুর সাথে আম্মু কয়েকদিন কথা বলে এখানে চলে আসলো নিজেই সব ঠিকঠাক করে। নানা-নানী গ্রামে থাকেন। বাসা পাল্টানোর সময় নানু এসেছিলেন, আবার চলে গেছেন। নানা-ভাইয়ের অনেক বয়স হয়েছে তো, একা থাকতে পারেন না। আমি ছোট হলে কি হবে। আমার অনেক সাহস। বড় হয়ে আমিই আম্মুকে দেখেশুনে রাখবো তো। তাই এখন আফুকে দেখে রাখার দায়িত্ব আমাকে দেয়ায় খুশিই হলাম আমি।
প্রতিদিন সকালে যাওয়ার আগে আম্মু আমাকে কাছে ডেকে বলেন, “আফুকে দেখে রাখতে পারবিনা মামনি?” আমি মাথা নেড়ে বলি, “হ্যাঁ। পারবো তো। তুমি একদম চিন্তা করো না। যাও, স্কুলে যাও।” আমি দেখি আম্মুর চোখে পানি চলে আসবে আসবে করছে। তখন আম্মু পট পট কয়েকবার চোখের পাতা ফেলে পানিটাকে হাপিশ করে দেন। এদিক ওদিক তাকান। উঠে গিয়ে আফুকে অনেক অনেক আদর করেন। আফুর দুধ আর আমার খাবার তৈরি করে ডাইনিং টেবিলটার উপর সাজিয়ে রাখেন। ভাইয়ার খাওয়া শেষে তাড়াতাড়ি বের হয়ে যান। ভাইয়ার নতুন স্কুলটা একেবারে যাচ্ছেতাই। সেটা নিয়ে প্রতিদিন আফসোস করেন আম্মু।
ভাইয়া মার খাওয়ার সপ্তাহ খানেক পরে আম্মু ভাইয়াকে নিয়ে চলে গিয়েছেন ঘণ্টা তিনেক হবে। একটা বুয়া ঠিক হয়েছে, কিন্তু সে আবার নাকি সকালে আসতে পারবে না। তার আসতে আসতে দুপুর বারোটা। তাও মন্দের ভালো। সাড়ে এগারোটা বাজে। আমি আফুকে দুধ গরম করে খাওয়ালাম মাত্র, এমন সময় দরজায় কলিং বেলের শব্দ হল। বুয়ার কাছে বাসার চাবি দেয়া আছে। কাজেই কলিং বেল তো বাজানোর কথা না। আমি দরজার পাশেই রাখা একটা ছোট টুল টেনে পিকহোল দিয়ে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। ভাইয়া চলে এসেছে স্কুল থেকে। একা একা। ভাইয়ার স্কুল তো শেষ হয় সেই দুইটায়। তারপর আম্মু গিয়ে ভাইয়াকে নিয়ে একবারে বাসায় ফিরে আসেন। আমি তাড়াতাড়ি ভেতর থেকে লক ঘুড়িয়ে দরজা খুলে দিলাম। ভাইয়া বুঝতে পেরেছিল, তাই অপেক্ষা করলো। আমি টুলটা সরিয়ে নেওয়ার পর দরজা খুলে ঢুকল সে। “একটা মজা দেখবি? জলদি আয়।” ভাইয়া মুচকি হেসে আমাকে বলল।
আমি আসতে আসতে ভাইয়া একেক লাফে দুইটা করে সিঁড়ি ভেঙ্গে দোতলায় উঠে গেলো। খাওয়ার চেয়ার থেকে আফু অবাক হয়ে ঐদিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওর হাতের সামনে থেকে ফিডারটা সরিয়ে একটা খেলনা গাড়ি ধরিয়ে দিয়ে দোতালায় ছুটলাম।
দোতলায় উঠেই আমি বুঝতে পারলাম মজাটা কি হবে। করিডরের শেষ মাথায় ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। হাতে একটা চাবির গোছা। নিশ্চয়ই আম্মুর ব্যাগ থেকে কোন একসময় চুরি করেছে। আম্মু যখন টের পাবে, কি হবে ভেবে আমি শিউড়ে উঠলাম। আজকে আর তিন নাম্বার না, একেবারে এক নাম্বারি বেতটা দিয়ে ভাইয়ার পিঠটা ফালা ফালা করে ফেলবে আম্মু আমি মানসচক্ষে দেখতে পেলাম। ভাইয়া চাবির গোছাটা থেকে একটা নির্দিষ্ট চাবি বের করে দরজাটার লকে ঢুকিয়ে আস্তে করে মোচর দিল। আমার মাথার ভেতর কেউ একজন চিৎকার করে ভাইয়াকে থামাতে বলছিল কিন্তু আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলাম। চিৎকার দূরের কথা, একটা শব্দও বের হল না আমার মুখ থেকে। ভাইয়ার মোচড়ের সাথে সাথে দরজাটা আস্তে আস্তে ভেতরের দিকে খুলে গেল।
রুমটার ভিতরে যেন অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে। বাইরে বের হওয়ার জন্য ভীষণ উতলা। আজকে অনেকদিন পর সেই সুযোগ পেয়েছে বলে কি ভীষণ আনন্দিত। রুমটার অন্ধকার মুখ থেকে একটা কালচে সবুজ হাত বের হয়ে আসলো।
হাতটা দেখা মাত্র আমার মুখের বাঁধ ভেঙ্গে গেল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেলাম চিৎকার করতে শুরু করেছি আমি। সেই সাথে মাথা থেকে নির্দেশ যাওয়ার আগেই আমার শরীরটাও নড়তে শুরু করেছে। ছুটতে থাকলাম আমি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে, ঐ হাতটা ভাইয়াকে ধরার আগেই আমাকে ভাইয়ার কাছে পৌঁছাতে হবে।
হাতটা দেখতে কোন বৃদ্ধ মানুষের হাতের মতন। কুঁচকানো, ঝুলে ঝুলে আছে কালচে সবুজ চামড়া। পুরো হাতটা জুড়ে বড় বড় গোঁটা, কোন কোনটা ফেটে লালচে-সাদাটে পুঁজ বেয়ে বেয়ে পড়ছে। হাতের তালু থেকে বের হওয়া আঙুলগুলো একটু বেশিই কালো। এই এত দূর থেকেও বুঝতে পারলাম এই কালোটা খুব খারাপ কিছু বোঝাচ্ছে। কি ভীষণ পচা-গলা একটা দুর্গন্ধ ধক করে এসে ধাক্কা মারল আমার নাকে। তীব্র সেই কটু গন্ধে আমার চোখে পানি চলে আসার দশা হল। হাতটা থেকে টপ টপ শব্দে নীচে গড়িয়ে পড়ছে লালচে তরল। মেঝেতে পড়া মাত্র ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দ করে সাদাটে ধোঁয়া তুলে মিলিয়ে যাচ্ছে, যেন পুড়িয়ে দিচ্ছে মেঝেটাকে।
তাড়াহুড়া করতে গিয়েই হোঁচট খেলাম। মেঝেতে পড়ে গেলাম আমি কিন্তু মাথাটা উঁচু করে রেখেছি। চিৎকার করে ভাইয়াকে সরে যেতে বলছি দরজার সামনে থেকে। কি অদ্ভুত! মূর্তির মতন স্থাণু হয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভিতরের দিকে তাকিয়ে রইল ভাইয়া। ভাইয়ার সাদা স্কুল-শার্টটাকে আঁকড়ে ধরল হাতটা, সেই সাথে ভাইয়াও চিৎকার করে উঠলো। হাতটা ধরামাত্র সাদা শার্টটায় কালচে একটা ছাপ পড়ে গিয়েছে, এতদূর থেকেও বুঝতে পারলাম আমি শুকনো চ্যাটচ্যাটে রক্তের দাগ সেটা।
হাচরে-পাচরে উঠে দাঁড়ালাম আমি। করিডরটা খুব একটা লম্বা নয়। এখনো ভাইয়ার কাছে পৌঁছাতে পারবো আমি। পারতেই হবে আমাকে। প্রাণপণে ছুটলাম আমি। কিন্তু আমাকে উপহাস করেই যেন একটা হ্যাঁচকা টানে ভাইয়াকে ঘরের ভেতর টেনে নিয়ে গেল হাতটা। সেই সাথে একটা কি ভীষণ জান্তব চিৎকার ছড়িয়ে পড়লো বাসার আনাচে-কানাচে। দুই হাতে কান চাপা দিয়ে বসে পড়লাম আমি। ঐ চিৎকার যে ভাইয়ার গলা থেকে বের হয়েছে বিশ্বাস করতে চাইছিলাম না আমি। ক্লিক শব্দ করে দরজাটা লেগে গেল, তালায় লাগিয়ে রাখা চাবির গোছাটা ঝনঝন শব্দে মেঝেতে পড়লো। আমি নির্বাক বসে তাকিয়ে থাকলাম। সব চুপচাপ। শুধু নীচ থেকে আফুর কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২১ রাত ৮:০৯