মূল লেখা: এখানে
লেখক: হিমু
মুহম্মদ বিন তুঘলক নির্বোধ ছিলেন না। ভারতবর্ষে নির্বোধ সুলতানের পক্ষে ছাব্বিশ বছর দিল্লির সুলতানাত শাসন করা সম্ভব কোনো কালেই ছিলো না। তর্কশাস্ত্রে সুপণ্ডিত বহুভাষী এই শিল্পী সুলতান যুদ্ধের ময়দানেও কুশলী ছিলেন। সাম্রাজ্য চালাতে আর বাড়াতে গেলে যে নৃশংসতার প্রয়োজন হয়, তা-ও তাঁর ছিলো। কিন্তু মুহম্মদ বিন তুঘলকের গুণের কথা বাঙালির মুখে মুখে ফেরে না, ফেরে তাঁর প্রশাসনিক খামখেয়ালের গল্পই, বাগধারায় যাকে আমরা বলি তুঘলকি কাণ্ড।
উঠলো বাই তো কটক যাই, এমন বায়ুতাড়িত সিদ্ধান্ত না নিলেও, দিল্লি থেকে দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তরের যে উটকো হুকুম সুলতান করে বসেছিলেন, তার পেছনে খুব ঠাণ্ডা মাথার বিবেচনা কাজ করেছে বলে আমাদের মনে হয় না। মুহম্মদ বিন তুঘলক যখন তখতে বসেছেন, তখন সুলতানাতের পশ্চিম সীমান্তে আর আগের মতো উৎপাত নেই, আফগান-মঙ্গোলরা নিজেদের অন্য হাঙ্গামায় ব্যস্ত, আর সুলতান তাঁর সীমানার ঘাঁটিগুলোকে নিয়ন্ত্রণও করতেন লৌহমুষ্ঠিতে। পশ্চিম সীমান্ত তুলনামূলকভাবে শান্ত থাকায় তুঘলক সাম্রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করেন দক্ষিণ দিকে, যেখানে প্রতাপশালী সব হিন্দু রাজ্য সগৌরবে দিল্লির আধিপত্যকে কাঁচকলা দেখিয়ে যাচ্ছে। মুহম্মদ বিন তুঘলক চিন্তা করেন, যদি তিনি রাজধানীকে আরো দক্ষিণে, ভারতবর্ষের আরো কেন্দ্রে নিয়ে যান, তাহলে সেখানে বসে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলোকে তিনি আরো জুত করে কাবু করতে পারবেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে তিনি গোটা রাজধানী দিল্লি থেকে দৌলতাবাদে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেন। দৌলতাবাদ দুর্গ সম্ভবত চতুর্দশ শতাব্দীতে পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত দুর্গগুলোর একটি ছিলো, কিন্তু দেবগিরি দিল্লির মতো মহানগর ছিলো না। সুলতানের নিজের বিলাসের সুযোগ সেই শহরে নিশ্চিত হলেও, তাঁর পাত্র-অমাত্যবর্গের জন্যে দৌলতাবাদে রম্যহর্ম্যের সুবন্দোবস্ত ছিলো না। আর দিল্লির সাধারণ মানুষ ও সৈন্যদের জন্যে জীবনধারণের যে নিত্যব্যবহার্য রসদ, তা যোগাতেও দৌলতাবাদ ব্যর্থ ছিলো। মুলতান থেকে দৌলতাবাদে বদলি হতে অস্বীকৃতি জানানোয় ক্রুদ্ধ সুলতান কিশলু খাঁ নামে এক সেনাপতিকে সুদূর মুলতানে গিয়ে দমন করেছিলেন। দৌলতাবাদ নিয়ে এই অসন্তোষ কিশলু খাঁর একার মনেই ছিলো, এমনও নয়। ফলে সুবিধা করতে না পেরে দুই বছরের মাথায় আবার মুহম্মদ বিন তুঘলক পাইকলস্কর ও জনতাকে সঙ্গে নিয়ে দিল্লি ফিরে আসেন। দিল্লি থেকে দৌলতাবাদের এই আপডাউন যাত্রায় অসংখ্য মানুষের মৃত্যু ঘটে। দিল্লিতে রাজধানী পুনর্প্রতিষ্ঠার পরও সেটিতে প্রাণের স্পর্শ ফিরে আসতে সময় লাগে। ইবনে বতুতা লিখেছিলেন, দিল্লিতে পা রেখে আমার মনে হয়েছিলো আমি এক ঊষর মরুতে এসে পড়েছি।
তুলিশিল্পী মুহম্মদ বিন তুঘলক চমৎকার নকশা করা নানা মুদ্রাও বাজারে ছেড়েছিলেন। দাক্ষিণাত্য থেকে সোনাদানা লুট করে এনে তিনি ঠিক করেন, স্বর্ণমুদ্রায় তিনি এবার সোনার পরিমাণ বাড়িয়ে দেবেন। মুদ্রার নকশা সুলতান নাকি নিজেই বাতলে দিতেন। তাঁর মুদ্রানকশার ক্ষুধা মেটাতে তিনি নানারকম সিকি আধুলিও বাজারে ছাড়েন। বাজার থেকে সোনা আর রূপা তুলে রাজকোষে জমা করতে তিনি তামা আর কাঁসার মুদ্রা নকশা করে লোক ভোলানোর ধান্দাও করেছিলেন। মানুষ তাঁর সেই ফিকিরে পা দেয়নি। মুহম্মদ বিন তুঘলকের রাজকোষে সেই ব্যর্থ প্রকল্পের উপজাত হিসেবে পড়েছিলো স্তুপের পর স্তুপ তামার মুদ্রা, তাদের অপূর্ব সব শৈল্পিক কারুকাজ সত্ত্বেও।
মুহম্মদ বিন তুঘলকের গল্প আমাদের যা শেখায়, তা হচ্ছে, শাসক কত বড় তর্কশাস্ত্র পণ্ডিত, কত বড় ভাষাবিদ, কতবড় তুলিশিল্পী, তা সাধারণ মানুষ মনে রাখে না। এমনকি শাসক কত বড় সুনিপুণ যোদ্ধা, বা পররাজ্যজয়ে কত কুশলী, সেটাও লোকে দীর্ঘ মেয়াদে গিয়ে মনে রাখে না। মানুষ মনে রাখে শাসকের কারণে সাধারণ মানুষের জীবনে হয়রানির কথা। মুহম্মদ বিন তুঘলক একজন যোদ্ধা হিসেবে দুর্ধর্ষ ছিলেন, যুদ্ধশাসনে আর সমরপরিকল্পনাতেও সুদক্ষ ছিলেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের কথা তিনি ভাবেননি। নিজের নকশাস্পৃহা চরিতার্থ করার কাজে সাধারণ মানুষের সাড়া তিনি পাবেন না, এই সত্যও তিনি উপলব্ধি করতে পারেননি। সাধারণ মানুষের মনোভাব অনুধাবনে তাঁর এই ব্যর্থতা, এই নির্লিপ্তি সাতশো বছর পরও তাঁকে শাস্তি দিয়ে চলছে মানুষের মুখে মুখে তুঘলকি কারবার শব্দযুগলে।
আমার কৌতূহল, এই উদ্ভট সিদ্ধান্ত কি সুলতানের স্বকপোলকল্পিত? তিনি নিজে একদিন সকালে উঠে ডিমভাজা দিয়ে পরোটা খেতে খেতে আচমকা সিদ্ধান্ত নিলেন, কাইলকাই যামুগা দৌলতাবাদ? নাকি তাঁর কোনো নায়েব, কোনো ওয়াজির, কোনো উচ্চাকাঙ্খী আমলা তাঁকে এই প্ররোচনা দিয়েছিলো? সুলতান-সম্রাটরা সবসময়ই কিছু রত্ন পরিবেষ্টিত থাকেন, যারা তাঁকে নানা সংবাদ, পরামর্শ আর দার্শনিক কচকচি শোনায়। সাধারণ মানুষের সংসর্গরহিত এই প্রবলপ্রতাপ শাসকেরা নিজের ইন্দ্রিয়ের বর্ধিতাংশ হিসেবেই ব্যবহার করেন তাঁর পারিষদবৃন্দকে। ইতিহাসের কলমের আড়ালে কি সেই এক বা একাধিক পরামর্শদাতার নাম চাপা পড়ে গেলো, আর সেই পরামর্শে পটে যাওয়া সুলতানকে ইতিহাসের যূপকাষ্ঠে বলি দিতে হলো এতো তর্কশাস্ত্র, এতো হেকিমি এলেম, এতো ক্যালিগ্রাফিতে পারদর্শিতার সুনাম, আর নিজেকে পরিচিত করতে হলো শতাব্দীশ্রেষ্ঠ ভাঁড় হিসেবে? সুলতান কি দিল্লির প্রাসাদে বসে সেই কালান্তক গ্রীষ্মের দিনটিতে আঁচ করতে পেরেছিলেন যে তিনি যার কুবুদ্ধিতে পটতে যাচ্ছেন, সেই লোক সেই কুবুদ্ধির দায় বহন করবে না, ইতিহাস সুলতানের স্কন্ধেই যাবতীয় দায়ভার ন্যস্ত করবে বিশ্বস্ত হাতে?
কিংবা ধরুন কৌরবদের কথা। অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের সাথে মেয়ের বিয়ে দেয়ার আগে গান্ধারের রাজা সুবলকে এক জ্যোতিষী বলেছিলো, দুর্যোগ এড়াতে চাইলে আগে তোমার মেয়েটাকে একটা ছাগলের সাথে বিয়ে দাও, যাতে ধৃতরাষ্ট্র তার দ্বিতীয় স্বামী হয়। জ্যোতিষীর পরামর্শে কান দিয়ে রাজা সুবল গান্ধারীকে একটি ছাগলের সাথে বিয়ে দেন। ত্রিভুজগোষ্ঠীর আনন্দিত হওয়ার কারণ নেই, বিয়ে হওয়ার অব্যবহিত পরই সদ্যপরিণীত জামাতাকে রাজামশাই কোৎল করেন। গান্ধারীর সাথে সেই ছাগলটি ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো কি না, জানি না, তাই ত্রিভুজগোষ্ঠীর আনন্দিত হওয়ার ন্যূনতম কারণটিও ঢ্যাঁড়া কেটে বাদ দিতে হয়। ধৃতরাষ্ট্র পরে এই তথ্য জেনে গেলে সক্রোধে রাজা সুবলকে গুষ্টিশুদ্ধু বন্দী করেন। নিজের শ্বশুরকে হত্যা করলে বদনাম হবে, তাই একেবারে জানে না মেরে গান্ধারের রাজ পরিবারকে প্রতিদিন মাথা পিছু এক গ্রাস করে খাবার দেয়া হতো। প্রবল প্রতিহিংসাপরায়ণ গান্ধাররাজ ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ঠিক করেন, তিনি শোধ নেবেন। পরিবারের সকলের খাবার একত্র করে তিনি তা খেতে দেন নিজের সর্বকনিষ্ঠ পুত্র শকুনিকে। তার আগে এক আঘাতে শকুনির একটি পা মটকে দিয়ে বলেন, এই খোঁড়া পা তোকে প্রতিশোধের কথা মনে করিয়ে দেবে। বাপ-মাকে খুন করার শোধ নিতে কুরুরাজ্য ধ্বংস করাই তোর জীবনের লক্ষ্য। এবার পেট ভরে খা। সুবল রাজার পরিবার না খেয়ে অন্ধকূপে পড়ে পড়ে মরে গেলেও শকুনি কোনোমতে প্রাণে বেঁচে যায়। টিংটিঙে খোঁড়া শকুনির মাথা ছিলো খুব পরিষ্কার, তাই পরবর্তীতে সে ধৃতরাষ্ট্রের বড় ছেলে দুর্যোধনের উপদেষ্টার পদ অলংকৃত করে। পিতা সুবলের ঊর্বাস্থি দিয়ে শকুনি তৈরি করে সেই পাশার ছক্কা, যা তার আদেশ মান্য করতো। সেই পাশার ছক্কা সম্বল করেই যুধিষ্ঠিরকে দুর্যোধনের সাথে পাশা খেলতে বসিয়ে পাণ্ডবদের রাজ্য থেকে শুরু করে বৌ, সবই হস্তগত করে শকুনি। এ অজানা নয়, যে এমনটা ঘটলে একটা বিরাট যুদ্ধ লাগবেই। সেটাই ছিলো শকুনির উদ্দেশ্য, কুরু-পাণ্ডবে কিলাকিলি লাগিয়ে কুরুরাজ্য পয়মাল করা।
সহদেব শকুনিকে কুরুক্ষেত্রে হত্যা করলেও পুরাণ শকুনি মামাকে ক্ষমা করেনি। কুবুদ্ধি দেয়ার কাজে সুদক্ষ লোককে আজও শকুনি মামা ডাকে লোকে। যেখানেই প্রবল ক্ষমতাধর ব্যক্তি আছে, সেখানে রাজনৈতিক মহাকর্ষের টানে শকুনি মামারাও দলে দলে এসে জুটে যায়। সেই উপদেষ্টা শকুনিরা যে কুবুদ্ধি দেন, তা শাসকবর্গের হ্রস্বমেয়াদী স্বার্থে কাজে লাগে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তাদের ঊরুভঙ্গই ঘটায়। পৌরাণিক শকুনিরা সহজে পক্ষত্যাগ করতেন না, সাথে থেকেই আলগোছে পিঠে ছুরি মারা খাওয়ার বন্দোবস্ত করে যেতেন, বর্তমানের শকুনির মামারা হেসে খেলে দলও পাল্টে ফেলেন। কে যে কখন কার সাথে থেকে কী বুদ্ধি দিচ্ছে, সেই কীর্তির দাগ খুব মন দিয়ে অনুসরণ না করলে শাসক গোষ্ঠী পিঠে ছুরি খাওয়ার জন্যে পিঠ পেতে দেয়া ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। আর ইদানীং সেই ছুরি খাওয়ার জন্য তারা আর নিজেরা পিঠ পাতেন না, ছুরি গিয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের পিঠে। তারাই ভোগে, তারাই মরে, তারাই শাসকের অবিমৃষ্যকারিতার খেসারত দেয়, যেমন দিয়েছে সেই মুহম্মদ বিন তুঘলকের আমলেও।
ইতিহাসের ছাত্র-গবেষকদের জন্যে ইতিহাসের শকুনিসন্ধান এক আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হতে পারে বলে আমি মনে করি। বড় বড় রাজা-সম্রাট-সুলতান-নওয়াব-প্রধানমন্ত্রীদের ছোটোখাটো আইনস্টাইন ভেবে নেয়ার কোনো কারণ নেই, বরং তাদের সু- ও কুবুদ্ধি দিতে বহুসংখ্যক শকুনি মামা যে যুগে যুগে তাঁদের চোখ-কানের নাগালেই বহাল থাকতেন, এমন হওয়াই বেশি স্বাভাবিক। ইতিহাসের শকুনি মামাদের শনাক্ত করা এবং ইতিহাসের পাঠকের কাছে তুলে ধরার কাজটি ইতিহাসবেত্তাদেরই করতে হবে।
তাই আমরা জানতে চাই, কে সেই লোক, যে আজ থেকে দুই দশক আগে বাংলাদেশকে তথ্য পাচার হয়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে বিশ্বের তথ্য মহাসড়কে উঠতে বাধা দিয়েছিলো? এই অপসিদ্ধান্তের দায় তৎকালীন বিএনপি সরকারকে যেমন নিতে হবে, তেমনি এই শকুনি মামাটিকেও খুঁজে বের করতে হবে। আমরা জানতে চাই, ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দুই ভাগে ভাগ করে দলরাজনৈতিক ফায়দা লোটার কুবুদ্ধি মহাজোট সরকারকে কে দিলো? এই কুবুদ্ধির কুফল আওয়ামী লীগ একা ভোগ করবে না, ঢাকাবাসীসহ সারা দেশের মানুষই করবে। তাই এর রাজনৈতিক দায় আওয়ামী লীগকে যেমন নিতে হবে, পাশাপাশি আমাদের চিনে রাখতে হবে সেই বুদ্ধির জনক শকুনি মামাকেও। ইতিহাসের স্বার্থেই।