somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কাঁথা নিয়ে যত কথা

১৯ শে জুন, ২০২০ বিকাল ৪:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বর্ষা কাল অথচ কাঁথা ছাড়া ঘুম ব্যাপারটা আমার কাছে একদম ভালো লাগেনা। যে বৃষ্টি শুরু এক দৌড়ে আম্মুর হাতের সেলাই করা কাঁথা নিয়ে আমি হারিয়ে যায় ঘুমের দেশে। বুঝতেই পারছেন আজকের লেখাটা মূলত কাঁথা নিয়ে।

বাংলার লোকশিল্প
লোকশিল্প হল মানব সমাজের নান্দনিক ভাবনার প্রতিফলিত ঐতিহ্যানুসারী প্রতিরূপ যা ব্যক্তি নয়, দল নয়, কিন্তু এক সার্বজনীন পরিচায়করূপে স্বীকৃত।
বাংলার লোকশিল্পকলার মধ্যে-মৃৎশিল্প, দারু-তক্ষণশিল্প, বয়ন ও বুননশিল্প, সূচিশিল্প, পটশিল্প, ডোকরাশিল্প, শঙ্খশিল্প ও অন্যান্য আরও লোকশিল্প বিশেষভাবে পরিচিত লাভ করেছে।

সূচিশিল্প
সুতো দিয়ে কাপড়ের উপর ছবি আঁকা, কাঁথা সেলাই, রুমাল, শিকা তৈয়ার, বিছানার যাবতীয় জিনিসপত্র, ছোট ছেলে-মেয়েদের জামাকাপড় ইত্যাদি সূচিশিল্পের অন্তর্গত।
সূচ ও সুতো দিয়ে নকশা করে কাপড়ের উপরের সৌন্দর্যবর্ধন- শিল্পকলার এই ধারা আবহমান কাল ধরে চলে আসছে যার একটি বাস্তব চিত্র আজো কাঁথার(নকশিকাঁথা)মধ্যে আমরা খুঁজে পাই।

কাঁথা
কাঁথা বা কেন্থা বা খেতা বা শুজনি মূলত গ্রামবাংলার হাতে সেলাইয়ের কাজ করা আচ্ছাদন বস্ত্র। এটি কম্বলের তুলনায় পাতলা। সাধারণত বর্ষার মৌসুমে এবং হালকা শীতের সময় শয্যাকালে গাত্র আচ্ছাদন হিসাবে, এছাড়াও অন্যান্য গৃহস্থলি কাজে এটি ব্যবহার করা হয়। যেমনঃ বর্তন খাওয়ারের ঢাকনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বোচকা কাঁথা জিনিসপত্র বাঁধার জন্য এই ধরনের কাঁথার ব্যবহার করা হয়।


কাঁথা শব্দের উৎস
কাঁথা শব্দটির কোন উৎস স্পষ্টভাবে জানা যায় নি। পিছনের ইতিহাস থেকে ধারণা করা হয়, সংস্কৃত শব্দ কন্থা ও প্রাকৃত শব্দ কথথা থেকে কাঁথা শব্দের উৎপত্তি।
নিয়াজ জামানের মতে, কাঁথা শব্দটি উৎপত্তি হয়েছে সংস্কৃতি শব্দ "কঁথা" হতে যার বাংলা হলো ত্যানা বা কাপড়ের টুকরা।

কাঁথার উৎস ও ইতিহাস
বাংলার কাঁথা শিল্প এক সুপ্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন। বহু প্রাচীনকাল থেকে জীর্ণ বস্ত্রখন্ডে তৈরী কাঁথার ব্যবহার শুরু হলেও কাঁথার গায়ে বিচিত্র নকশা খচিত করার রেওয়াজ কবে প্রচলিত হয় তা সঠিকভাবে বলা যায় না। কাঁথার সংগ্রহ রয়েছে বিভিন্ন সংগ্রহশালায়। এইসব কাঁথার বয়স খুব বেশি পুরোনো নয়।

স্টেলা আরিখের রচনায় ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে কাঁথার সন্ধান পাওয়া যায় ( Marg III, No. 2, P. 20 )।

১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে প্রভাস সেন কাঁথার প্রাচীনতা নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন তা হল : - The tradition of kantha embroidery is very old. It is mentioned in the definitive Sanskrit grammar written by Panini around the six century B.C. and also in the epic Ramayana of Valmiki about two centuries later. The earliest mention of kanthas in Bengali literature is found in the Charyapadas- the earliest known in as old form of Bengali that prevailed from the 8th to 11th Centuries A.D. ( Provash Sen : Crafts of West Bengal ; Ahmedabad, 1994, P. 56 ) .

কাথার নির্মাণশৈলী ও উপকরণ
সাধারণত কাঁথা সেলাইয়ের জন্যে পুরনো শাড়ী, সূচ, বিভিন্ন ধরণের রঙিন সুতো, পাটি, কাঠের ব্লক, সুতো কাটার যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। নিচের ধাপগুলো অনুসরণ করে একটি পূর্ণ কাঁথা তৈরী করা হয়।

১। প্রধানত পুরানো কাপড় স্তরে স্তরে সজ্জিত করে পুরনো কাপড়ের সুতো দ্বারা সেলাই করে কাঁথা তৈরি করা হয়। কারণ পুরাতন কাপড়ের উপর নুতন সুতায় কাজ করতে গেলে পুরনো কাপড়ের জমি কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

২। মহিলারা তাঁদের পুরনো শাড়ি থেকে কাপড়ের পাড়, মূল কাপড় থেকে আলাদা করে নিয়ে বিভিন্ন রঙের সুতো উঠান। পাড় থেকে সুতো উঠানোর পদ্ধতি - পাড়টির এক দিকে এক পায়ের দু'আঙ্গুলে চেপে ধরে বাঁ হাতে টেনে নিয়ে পাড়ের ছেঁড়ার দিক থেকে সুতো টেনে ডান হাতের চার আঙ্গুলের মধ্যে রিং মত গোল করে গুটিয়ে নিয়ে পরপর সুন্দরভাবে বাঁশের অথবা কাঠের চালায় সাজিয়ে নেন একটি রংকে।

৩। প্রথমে নির্দিষ্ট পাশ ও লম্বা মাপ ঠিক করে, কাঁথার জমির চারদিকের বর্ডারকে নিচের পাটির সাথে সুতো দিয়ে টান টান করে তার চারপাশের লতা, পাতা ও ফুল দিয়ে সুন্দরভাবে আলপনার বর্ডার তৈরি করা হয়।

৪। এরপর শিল্পীর ইচ্ছামত ভিতরের জমিটিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে, তার ভিতর লতা-পাতা, ফুল, চাঁদ-তারা, হাতি, ঘোড়া, পাখি, প্রজাপতি ও নানান জীবজন্তুর ছবি এঁকে নেন। তারপর সেই সাধারণ কাঁথার উপর রঙিন সুতা দিয়ে মনের মাধুরী মিশিয়ে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তোলে নারীরা। তবে সাধারণ কাঁথার ক্ষেত্রে নকশা করা হয়না।

৫। মূলত নকশা করার পূর্বে কোন কিছু (কলম, রঙ পেন্সিল) দিয়ে এঁকে নেওয়া হয়। তারপর সুঁই-সুতা দিয়ে ওই আঁকা বরাবর সেলাই করা হয়। কাঁথায় সাধারণত মধ্যের অংশের নকশা আগে করা হয় এবং ধীরে ধীরে চারপাশের নকশা করা হয়। আগে কিছু কাঁথার নকশা আঁকানোর জন্য কাঠের ব্লক ব্যবহার করা হত, এখন ট্রেসিং পেপার ব্যবহার করা হয়।

৬। তারপর এই নকশার উপরে ফোঁড় দেয়ার নৈপুণ্যের গুণে কাঁথায় বিচিত্র বর্ণের নকশা, বর্ণিল তরঙ্গ ও বয়নভঙ্গির প্রকাশ ঘটে। নকশার সাথে মানানোর জন্য বা নতুন নকশার জন্য কাঁথার ফোঁড় ছোট বা বড় করা হয় অর্থাৎ ফোঁড়ের দৈর্ঘ্য ছোট-বড় করে বৈচিত্র্য আনা হয়। ‘পাটি বা চাটাই ফোঁড়’ এবং ‘কাইত্যা ফোঁড়’ নামে সেলাইয়ের দু্টি ধরন নকশি কাঁথায় বিশেষ ব্যবহৃত হয়। এই ফোঁড় এর মাধ্যমে কাঁথাকে সম্পূর্ণ ভাবে চিত্রায়িত করা হয়।



সেলাই এর সময় কাল
সাধারণ কাঁথা (নকশা বিহীন) সেলাই করতে ৩-৪ দিন সময় লাগে। বাচ্চাদের ছোট কাঁথা সেলাই করতে ১ দিনের কম সময় লাগে।নকশী কাঁথা সাধারণত একদিনে তৈরি হয় না, সময় নিয়ে ধীরে ধীরে এতে কারুকার্য ফুটিয়ে তোলা হয়। মাঝারি আকারের কাঁথা তৈরিতে সাত থেকে পনের দিন সময় লেগে যায়। বড় কাঁথা এবং জটিল নকশার ক্ষেত্রে কাঁথার চিত্রকল্প, নকশা এবং কাঁথার দৈর্ঘ্য অনুসারে সেলাই করতে এক মাস-দেড়মাস মাঝে মাঝে এক বছর সময় ও লেগে যায়।

কাঁথার ফোঁড়
কাঁথা সেলাইয়ে ফোঁড়ই প্রধান। একটি কাঁথা কতটা মনমুগ্ধকর হবে তা নির্ভর করে কাঁথার ফোঁড়ের ধরণের উপর। কাঁথায় এই ফোঁড়গুলো চমৎকার চিত্রণের কাজ করে।
কাঁথায় ব্যবহৃত বিভিন্ন ফোঁড়ঃ

১। রান ফোঁড়: সবচেয়ে সহজ। এটি খুব দ্রুত করা যায়। রান সেলাই কাঁথার প্রধান ফোঁড় এবং সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। কাপড়ে সুচ খানিকটা ঢুকিয়ে একটু কাপড় ছেড়ে নিচ থেকে উপরে তুলে এই ফোঁড় করা হয়। উপর ও নিচের লাইন সব সময়ই সমান থাকে। এই ফোঁড়ে কাঁথার মোটিফ তোলা হয়। ডিজাইন অনুসারে রান সেলাই লম্বালম্বি, কোনাকুনি, আড়াআড়ি, গোল কিংবা ত্রিভুজ বা চৌকোভাবে দেয়া যেতে পারে।

২। ডবল রান ফোঁড়: প্রথমে একবার রান সেলাই করার পর ফাঁকাগুলোতে আবার পর পর রান ফোঁড় দেয়াকে ডবল রান ফোঁড় বলা হয়। ভরাট ঘন হয় বলে এই ফোঁড়ের সেলাই দেখতে খুব সুন্দর। কোনো কোনো অঞ্চলে একে ডুরে রান বলে।

৩। ডারনিং ফোঁড়: রিফুর মতো ছোট ছোট রান দিয়ে এটি করতে হয়। প্রথমে দুটি লাইনেই রান ফোঁড় দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় লাইনের ফোঁড় প্রথম লাইনের ফাঁকের মধ্যে দিতে হয়। এরপর রিফুর মতো ছোট ছোট রান দিয়ে পুরো অংশ ভরাট করা হয়। এই ফোঁড় দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইন করা হয়।

৪। বেঁকি ফোঁড়: এটি রান ফোঁড়, তবে ছোট-বড় করে রান সেলাই দিতে হয়। অর্থাৎ ছোট থেকে বড় কিংবা বড় থেকে ছোট রান সেলাই দিতে হয় সমান্তরালভাবে, যা দেখতে বাঁকা লাগে। এই ফোঁড়ের সাহায্যে পাতা, চালতাফুল, ঘূর্ণি বা চরকি, ধানের ছড়ি ইত্যাদি ডিজাইন করা হয়।

৫। বখেয়া ফোঁড়: অত্যন্ত টেকসই সেলাই। ব্যাক বা বখেয়া ফোঁড় হলো কাপড়ে সুচ ঢুকিয়ে পাশে তুলে আবার পেছন দিক থেকে প্রথম ফোঁড়ের মাথায় সুচ গলিয়ে নিচে দিয়ে আবার তুলতে হয় সমান দূরত্বে। এই ফোঁড় রানের মতো ফাঁক-ফাঁক নয়, ভরাট বা স্পষ্ট হয়

৬। ক্রস ফোঁড়: অত্যন্ত প্রচলিত সেলাই। এই ফোঁড় দুটি বিপরীতমুখী কোণের সমন্বয়ে হয়, যেটি পরস্পরকে মধ্যবিন্দুতে ছেদ করে। সাধারণত কাঁথায় ক্রস ফোঁড়ের ব্যবহার করা হয় না। তবে রাজশাহীর কাঁথায় এই ফোঁড়ের ব্যবহার লক্ষ করা যায়। কাপড়ের মধ্যে চৌকো করে সুতোয় ঘর কেটে তার মধ্যে ক্রস ফোঁড় দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইন তোলা হয়।

৭। বোতামঘর: কাপড়ে সুচ বিঁধিয়ে তুলে নিয়ে সুচের মাথার ওপর দিয়ে সুতাটা দিয়ে এই ফোঁড় সমান দূরত্বে করা হয়। তবে কোনো কোনো মোটিফের ক্ষেত্রে এবং বর্ডারের চারপাশে এই ফোঁড় ব্যবহৃত হয়। একে কম্বলমুড়ি সেলাইও বলা হয়।

৮। ডাল ফোঁড়: কাঁথায় অনেক সময়ে আউটলাইনের জন্য কিংবা ডিজাইন খুব স্পষ্ট করে দেখানোর জন্য ডাল ফোঁড়ের ব্যবহার করা হয়। সুচটাকে নিচ থেকে উপরে তুলে আবার আগের ফোঁড়ের পাশের একটু অংশ থেকে সামান্য বাঁকাভাবে সুচ তুলে আনতে হয়। সাধারণত গাছের ডাল, পাতার শির, লতা ইত্যাদি নকশা সৃষ্টি করতে এর ব্যবহার হয় বলে একে ডাল ফোঁড় বলা হয়।

৯। চেন ফোঁড়: কোনো কোনো কাঁথায় এর ব্যবহার দেখা যায়। সুচ নিচ থেকে উপরে তুলে সুতাটা সুচের মাথার উপর দিয়ে ঘুরিয়ে টেনে তুলে আবার আগের ফোঁড়ের মাথায় ঢুকিয়ে টেনে তুলে এটি করা হয়। দেখতে চেনের মতো হয় বলে একে চেন ফোঁড় বলা হয়। এর সাহায্যে নানা রকমের ফুল, লতা-পাতা ইত্যাদি নকশা করা হয়।

১০। ভরাট ফোঁড়: কোনো আলাদা ফোঁড় নয় এটি। বিভিন্ন ফোঁড় দিয়ে কাঁথায় বিভিন্ন মোটিফ, ফুল, পাতা ইত্যাদি ভরাট করা হয়। যেহেতু ভরাটের কাজ করে, তাই একে ভরাট ফোঁড় বলা হয়। বিভিন্ন মোটিফ বা ডিজাইন ভরাট ফোঁড়ে করা হয়। এটি দু’রকমের- একটা হলো দু’দিকেই সমানভাবে ভরাট হয়, আর একটা শুধু উপরে ভরাট হয়।

১১। হলবিন ফোঁড়: এটি বাংলার বাইরের কাঁথা বা লেপ সেলাইতে ব্যবহার করা হয়। এই ফোঁড়ে সমান জায়গার সারিতে একদিকে রান সেলাই করা হয়। তারপরে সুচের দিক উল্টে দেয়া হয় এবং দ্বিতীয় সারি দিয়ে প্রথম সারির শূন্যস্হান পূরণ করা হয়। জ্যামিতিক নকশার সূচিকর্মে হলবিন ফোঁড়ের ব্যবহার করা হয়। মাঝে মাঝে এটি ক্রস ফোঁড় সহযোগেও করা হয়। বাংলার কাঁথায় জ্যামিতিক নকশার কাজে অনেক সময় এই ফোঁড়ের ব্যবহার করা হয়।

১২। স্যাটিন ফোঁড়: এটি কাঁথার নকশায় ভরাটের কাজ করে। এই ফোঁড় ছোট-বড় করে কাপড়ে সুচ ঢুকিয়ে উপরে তুলে, আবার ওই একইভাবে ঘন ঘন করে তুলতে হয়। এই সেলাইয়ের বৈশিষ্ট্য হলো, এর দু’দিকেই সমান হয় অর্থাৎ দেখতে একই রকম হয়। কাঁথার বিভিন্ন মোটিফ বা ডিজাইনে এই ফোঁড়ের ব্যবহার দেখা যায়।

১৩। হেরিংবোন ফোঁড় বা শেডওয়ার্ক ফোঁড়: কাপড়ে সুচ ঢুকিয়ে কোনাকুনিভাবে উপরে তুলে তার পাশে সুচ ঢুকিয়ে আবার কোনাকুনিভাবে ডান দিকে নিচে শুরুর একটু পরে সুচ তুলতে হবে- যা হবে বাঁকা ফোঁড়ের মতো দেখতে। হেরিংবোন অত্যন্ত বৈচিত্র্যময় ফোঁড়।

১৪। ডবল হেরিংবোন ফোঁড়: প্রথমে একটা লাইন একই রকম সুতা দিয়ে হেরিংবোন করতে হবে। এরপর অন্য একটা সুতা দিয়ে হেরিংবোন ফোঁড় তুলতে হবে- এতে ফোঁড়গুলো একত্রে জড়িয়ে থাকলেও মাঝে একটু করে ফাঁক থাকে।

১৫। লিক ফোঁড়: রাজশাহী অঞ্চলের কাঁথায় লক্ষ করা যায়। এই ফোঁড়ে প্রথমে বেশ কয়েক লাইন রান সেলাই করতে হয় এবং একটা রানের থেকে আর একটা রানের মধ্যে এবং পর পর লাইনের মাঝে বেশ কিছুটা সমান্তরাল ছাড় থাকে।

১৬। জালি ফোঁড়: এর বৈশিষ্ট্য হলো, সুচটাকে কাপড়ে ঢুকিয়ে উপরে তুলে নিয়ে আবার উপর দিকে ফোঁড়ের গোড়া থেকে তুলে শেষটায় তোলা। নিচটা দেখতে দুটো ভি-এর মতো হয়, আর উপরটা হয় জালির মতো।

১৭। চাটাই কিংবা পাটি ফোঁড়: এই ফোঁড়ের সাহায্যে ফুল, পাতা, কলকা, চক্র, বেলপাতা এবং বিভিন্ন মোটিফ করা হয়। এতে খুব ঘন ঘন এবং সমদূরত্বে রান সেলাই দিতে হয়। প্রথমে তিন-চার লাইন রান সেলাইয়ের পর, পরের লাইনে আগের লাইনের ফাঁক অংশে রান ফোঁড় দিতে হয়।

১৮। দোরোখা ফোঁড়: এটি কাঁথায় এক চমৎকার চিত্রণের কাজ করে। এর দু’দিকেই সমান। উল্টো পিঠ দেখলে মনেই হয় না যে, এটি কাঁথার সোজা পিঠের অপর দিক। এই ফোঁড়ের বৈশিষ্ট্য হলো, এক পিঠের নকশাগুলো অন্য পিঠে ফুটিয়ে তোলা।

কাঁথার পাড়
পাড় হলো কাঁথার সীমানার দিকের অংশ। বেশিরভাগ নকশি কাঁথার পাড় আছে। কোন কোন ক্ষেত্রে একটি শাড়ীর পাড়কেই কাঁথার পাড় বানানো হয়, কখনো নকশা সেলাই করে পাড় বানানো হয়।
সাধারণ পাড় গুলো হলোঃ শামুক পাড়, চোক পাড়, অনিয়ত পাড়, অন্যান্য পাড়, ঢেউ পাড়, নক্ষত্র পাড়, ধানের শীষ অথবা খেজুর চারি পাড়, বিছে পাড়, বেকি পাড়, বরফি পাড়, চোখ পাড়, তাবিজ পাড়, মালা পাড়, মই পাড়, গাট পাড়, চিক পাড়, নোলক পাড়, মাছ পাড়, পাঁচ পাড়, বাইশা পাড়, আনাজ পাড়, শামুক পাড়, অনিয়ত পাড়, গ্রেফি পাড়, কলম পাড়।


বিচিত্র ধরণের কাঁথা
ব্যবহার ও আকার অনুযায়ী কাঁথা কে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা হয়েছে। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা করা হল।

সুজনি কাঁথা: অতিথিদের বসা বা শোওয়ার জন্য বিছানায় বিছিয়ে দেওয়া হয়। এই কাঁথার দৈর্ঘ্য প্রায় ছয় ফুট এবং প্রস্ত প্রায় সাড়ে তিন ফুট হয়। এই কাঁথা আকারে বড় বলে এর কেন্দ্রবিন্দুতে পদ্মের মটিফ যেমন থাকে, তেমন পাড়ের ডিজাইন, কলকা, নানান লতা-পাতার ডিজাইনের বাহারও দেখা যায়। ঝিকরগাছায় এই কাঁথার নাম "নাছ্নি কাঁথা "। এই কাঁথায় ফুলের নকশা তোলা হয় পার্সিয়ান প্রভাবে।



লেপ কাঁথা: শীতের সময় গায়ে দেয়ার জন্য বেশ মোটা ধরনের কাঁথা। মাপেও এটি সুজনি কাঁথার চেয়ে লম্বা ও চওড়ায় কিছুটা বড়। এতেও নানা ধরনের নকশা তোলা হয়, তবে সুজনির তুলনায় কম।



ব্যটন বা ওয়াড় কাঁথা: বালিশের ঢাকনা হিসাবে ব্যবহার করা হয় এই ধরনের কাঁথা। এই কাঁথার সাধরন মাপ হলো লম্বায় প্রায় দু-ফুট আর চওড়ায় প্রায় দের ফুট। এর দু-পাশে নানান লতা-পাতার ডিজাইন কিংবা কোনো কলকার ডিজাইন বা অন্য কোনো ডিজাইন দেওয়া হয়। আবার লেপের ঢাকনা হিসেবেও এই কাঁথার ব্যবহার লক্ষ করা যায়। তবে সে ক্ষেতে লেপের ওয়াড় কাঁথা মাপে অনেক বড় হয়। এই কাঁথাকে আবার ব্যটন কাঁথাও বলা হয়।



আর্শিলতা: আর্শি, চিরুনি ও প্রসাধনসামগ্রী রাখার জন্য এই ধরনের কাঁথা ব্যবহার করা হয়। এই কাঁথা তৈরী হয় ২৪ ইঞ্চি সরু টুকরো কাপড় দিয়ে, আবার কোথাও এই কাঁথা লম্বায় এক ফুট ও চওড়ায় আধ ফুট মাপেরও হয়। এতে চাকফুল, ময়ুর, কদমগাছ, কৃষ্ণলীলা, চাঁদ-তারা ইত্যাদি মটিফের প্রাধান্য বেশি দেখা গেলেও এর মধ্যিখানে পদ্ম, কলকা বা বিভিন্ন ধরনের লতার নকশাও দেখা যায়।


শিশুর কাঁথা: শিশুদের শোওয়া ও গায়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় এই কাঁথা। এই কাঁথা আকারে ছোট, অনেকটা তোয়ালের মত। একে আবার "মুতনি" কাঁথাও বলা হয়। মাপের দিক থেকে এটি লম্বায় এবং চওড়ায় তিন ফুটের হয়।


বর্তন ঢাকনি: খাওয়ারের ঢাকনা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অতিথিদের খাবারের থালার উপর ঢাকনি স্বরূপও এই ধরনের কাঁথার ব্যবহার দেখা যায়। কোনো কোনো অঞ্চলে একে আবার "বেষ্টনী" বা "গাত্রী" কাঁথাও বলে।


দস্তরখান: অতিথিদের খাওয়ার সময় ফরাস বা পাতিতে এই কাঁথা বিছিয়ে দেওয়া হয়। আবার কখনও কখনও অতিথিদের খাওয়ার সময় সামনেও এই কাঁথা বিছিয়ে দেওয়া হয়। একে টেবিল ম্যাটও বলা যেতে পারে।


বগলি বা নকশি থলি: এই ধরনের কাঁথার ব্যবহার হয় বিভিন্ন ধরনের থলি হিসাবে। এটি লম্বায় দশ ইঞ্চি এবং চওড়ায় ছয় ইঞ্চি মাপের হয়। এই ধরনের থলিতে সাধারণত টাকা-পয়সা, পান-সুপারি, জপের বা তসবির মালা রাখা হয়। একে বৈরাগীর ঝোলা বা জপের থলেও বলা হয়। এটি আকারে খামের মত বা অনেকটা ছোট বটুয়ার মত দেখতে হয়। বাংলাদেশে এর নাম "খিচা "এবং পশ্চিমবঙ্গে এটি "দুর্জনী" নামে পরিচিত।


জোত্ বা বোচকা কাঁথা: জিনিসপত্র বাঁধার জন্য এই ধরনের কাঁথার ব্যবহার করা হয়। এই কাঁথায় নানান মটিফ দিয়ে ডিজাইন তোলা হয়। এই কাঁথার আকার চৌকো। কাপড়-চোপড় ও অন্যান্য টুকিটাকি জিনিসপত্র যাতে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে ও বাঁধতে সুবিধা হয়। এই জন্য কাঁথা গুলি চৌকো আকৃতির হয়।


রুমাল কাঁথা: এই ধরনের কাঁথা চৌকো মাপের হয় অর্থাৎ এটি লম্বা ও চওড়ায় এক ফুট মাপের হয়। ছোট চারকোনা টুকরো কাপড় দিয়ে তৈরী হয় এই কাঁথা। এটি রুমাল হিসাবে ব্যবহার হলেও ডিশ ঢাকার জন্যও ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের কাঁথায় প্রজাপতি, পদ্ম, কলকা, ফুল, লতা-পাতা, পাখি ইত্যাদি মটিফ লক্ষ করা যায়।


গিলাফ: কোরান শরীফের ঢাকনা হিসাবে ব্যবহার করা হয়। চৌকো নকশি কাঁথাকে বরফির মত রেখে তিন দিক একত্রিত করে সেলাই করা হয় এবং এক দিক খোলা রাখা হয়।


জায়নামাজ: এইটি প্রার্থনা করার জন্য অর্থাৎ নামাজ পড়বার সময় ব্যবহার করা হয়। আকারে এইটি লম্বা ধরনের হয়। এতে ফুল, লতা-পাতা, গম্বুজ ও মিনারের মটিফ দেখা যায়।


আসন কাঁথা: পুজোর কাজে এই ধরনের কাঁথা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এটি বর-কনে বা অতিথিদের বসার জন্যও ব্যবহার করা হয়। এই কাঁথার আকার চৌকো বা আয়েতকার উভয়ই হতে পারে। আবার কিছু আসন কাঁথা দেখাযায় যেগুলি একটু লম্বাটে ও বড় আকারের হয়। পালকিতে বসার জন্যও এটি পেতে দেওয়া হয়। আবার কোনো সাধক বা পীর প্রার্থনা করার সময় এই কাঁথার ব্যবহার করেন। এতে রাধা-কৃষ্ণ, লক্ষ্মী, রথ ইত্যাদি মটিফ লক্ষ করা যায়। এই ধরনের কাঁথার ব্যবহৃত মটিফগুলি ধর্ম ও লোকজ বিশ্বাসবিষয়ক।


নকশি চাদর: গায়ে দেওয়ার জন্য শাল বা চাদর হিসাবে ব্যবহৃত হয়। এতে নানা ধরনের নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। বিশেষত কলকা মটিফ এতে লক্ষ করা যায়। তবে দু-পাশের বর্ডার পাড়ের ডিজাইন এবং কোন কলকা বা মধ্যিখানে বুটির মত ফুল বা লতা-পাতার ডিজাইন লক্ষ করা যায়



এছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কাঁথা লক্ষ করা যায়। যেমন - পাইড় কাঁথা, লাহরী কাঁথা, লীফ কাঁথা, গোলাপ বা ঢাকনি কাঁথা, পর্দা কাঁথা, সারিন্দা বা আবরণী কাঁথা প্রভৃতি।

নকশি কাঁথা
নকশী কাঁথা হচ্ছে মূলত নারীদের শিল্প। সাধারণ কাঁথার উপর বিভিন্ন ধরনের রঙিন সুতা দিয়ে নকশা তুলে যে বিশেষ ধরনের কাঁথা বানানো হয়, তাই নকশি কাঁথা। নকশি কাঁথা ভারত ও বাংলাদেশের লোকশিল্পের একটা অংশ। সাধারণ কাঁথা(নকশা বিহীন) সেলাইয়ের পর এর উপর মনের মাধুরী মিশিয়ে ফুঁটিয়ে তোলা হয় বিভিন্ন নঁকশা যার মধ্যে থাকে ফুল, লতা, পাতা ইত্যাদি। শুধু কতগুলো সূক্ষ্ম সেলাই আর রং-বেরঙ্গের নকশার জন্যই নকশিকাঁথা বলা হয় না। বরং কাঁথার প্রতিটি সূচের ফোঁড়ের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক একটি কাহিনী, পরিবেশ, জীবন গাঁথা, বলা যেতে পারে নকশিকাঁথা এক একটি জীবন। পুরো বাংলাদেশেই নকশি কাঁথা তৈরি হয়, ময়মনসিংহকে নকশি কাঁথার শহর ধরা হয়। এছাড়াও রাজশাহী, যশোর, ফরিদপুর নকশি কাঁথার জন্য বিখ্যাত । ২০০৮ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নকশি কাঁথার ভৌগোলিক স্বীকৃতি পায়।

নকশি কাঁথার নকশার ধরন
নকশি কাঁথা সেলাইয়ের কোনো নির্দিষ্ট নকশা নেই। যিনি সেলাই করেন তার মনে যা আসে তা-ই তিনি সেলাই করে যান। বলা যায় এটি হচ্ছে মনের ডাইরি।

সেলাইয়ের ধরন অনুযায়ী কাঁথা
চলমান সেলাইঃ চলমান সেলাই কাঁথাই হলো মূল দেশীয় কাঁথা। এটিকে আবার নকশি ও পাড় তোলা দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
লহরী কাঁথাঃ পারস্য শব্দ লহর থেকে লহরী কাঁথা নামের উদ্ভব। লহর মানে হলো ঢেউ। সাধারণত রাজশাহীতে এই কাঁথা বিখ্যাত।
আনারসি কাঁথাঃ আনরসি কাঁথা চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোরে পাওয়া যায়।
বাঁকা সেলাই কাঁথাঃ এই কাঁথা সবার প্রথম তৈরি হয় ব্রিটিশ আমলে। সাধারণত এই কাঁথা বাঁকা সেলাইয়ের মাধ্যমে তৈরি হয়।
শুজনি কাঁথা কাঁথাঃ এটি শুধু রাজশাহী এলাকায় পাওয়া যায়। সাধারণত এই কাঁথায় ঢেউ খেলানো ফুল ও লতাপাতার নকশা থাকে।

ধর্মীয় দিক থেকে কাঁথা
নকশি কাঁথার নকশা গুলোতে ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতির গভীর প্রভাব রয়েছে। যদিও কোন নির্দিষ্ট নিয়ম মানা হয় না, তবে ধরে নেওয়া হয় প্রত্যেকটা ভালো সেলাইকৃত নকশি কাঁথার একটি কেন্দ্র থাকবে। বেশিরভাগ কাঁথার কেন্দ্র হলো পদ্ম ফুল এবং পদ্ম ফুলের আশে পাশে নানা রকম আঁকাবাঁকা লতার নকশা থাকে। কখনো শাড়ীর পাড় দিয়ে সীমানা তৈরি করা হয়। নকশাতে ফুল, পাতা, পাখি মাছ, প্রাণী, রান্না আসবাব, এমনকি টয়লেট সামগ্রীও থাকতে পারে। বেশীর ভাগ কাঁথার প্রাথমিক কিছু নকশা একই রকম হলেও দুইটি কাঁথা একই রকম হয় না। সাধারণত কাঁথাতে একই নকশা বারবার ব্যবহৃত হয়।
উল্লেখযোগ্য নকশাগুলো হলোঃ
পদ্ম নকশাঃ পদ্ম নকশা নকশি কাঁথাগুলোতে সবচেয়ে বেশী পাওয়া যায়। পদ্ম ফুল হিন্দুধর্মের দেবদেবীর সাথে যুক্ত, এই জন্যও এটি বেশ জনপ্রিয়। পদ্মফুল হলো স্বর্গীয় আসন। এটা অবশ্য মহাজাগতিক মিলন ও নারীর প্রয়োজনীয়তাকেও বোঝায়। পদ্ম শাশ্বত আদেশ এবং আকাশ, মাটি ও পানির ঐক্য হিসেবেও মূর্ত। এটি জলের জীবনদায়ক ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে এবং এছাড়াও পাপড়ির খোলা ও বন্ধ করা অবস্থাকে সূর্যের সাথে তুলনা করা হয়। এটি পবিত্রতার প্রতীক। এটি ধনসম্পদের দেবী লক্ষ্মীর প্রতীক। অষ্টদল থেকে শুরু করে শতদল বিভিন্ন ধরনের পদ্ম নকশা রয়েছে। পুরাতন প্রায় প্রত্যেকটা কাঁথাতে মাঝখানে একটি ফুটন্ত পদ্ম দেখতে পাওয়া যেত।

সূর্য নকশাঃ এই নকশা পদ্ম নকশার কাছাকাছি নকশা। কখনো কখনো এই দুই নকশা কাঁথার কেন্দ্রে একসাথে দেখা যায়। এটি সূর্যের জীবনদায়ক ক্ষমতার প্রকাশ করে। সূর্য হিন্দুদের ধর্মীয় ও বিবাহ উভয় আচারেই গুরত্ব বহন করে।

চন্দ্র নকশাঃ চন্দ্র নকশা মুসলমান ধর্মীয় প্রভাব রয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় নক্ষত্র সহযোগে একটি অর্ধচন্দ্রাকার নকশা। এই নকশা মূলত জায়নামাজ কাঁথায় দেখতে পাওয়া যায়।

চাকা নকশাঃ সাধারণত চাকা নকশা হিন্দু ও বৌদ্ধ উভয়েরই ভারতীয় কলার প্রতীক। এটি আদেশের প্রতীক। এটি অবশ্য বিশ্বকেও প্রতিনিধিত্ব করে। যদিও বেশীর ভাগ কাঁথা নির্মাতা চাকার গুরুত্ব জানেনা, তবুও এটি বেশ জনপ্রিয়। এটি চাটাই ফোর এর তুলনায় সহজ।

স্বস্তিকা নকশাঃ সংস্কৃতিতে সু অস্তি মানে হলো এটি ভাল। এই নকশা সিন্ধু সভ্যতার সমসাময়িক। এটি ভালো ভাগ্যের প্রতীক। এটি মিছরি অথবা গোলক ধাঁধা হিসেবেও পরিচিত। সময়ের সাথে, মহেঞ্জোদাড়ো আমলের সোজা রেখা সম্বলিত স্বস্তিকার চেয়ে বক্ররেখা বেষ্টিত স্বস্তিকা এখন বেশি ব্যবহৃত হয়। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন প্রত্যেকটা ধর্মে এই প্রতীকের গুরুত্ব রয়েছে।

জীবনবৃক্ষ নকশাঃ সিন্ধু সভত্যার সময় থেকে ভারতের শিল্প-সংস্কৃতিতে এই নকশার প্রভাব রয়েছে। মনে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা পিপুল গাছকে জীবনবৃক্ষ হিসেবে ধারণা করত... এর মধ্যে দিয়ে দেবতা তার সৃষ্টির শক্তি প্রকাশ করছে। বৌদ্ধ আমলেও এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। পিপল বৌদ্ধদের নিকট পবিত্র বৃক্ষ, কেননা বুদ্ধ এই গাছের ছায়াই বসেই বোধিপ্রাপ্ত হন। এটি প্রকৃতির সৃষ্টির ক্ষমতা প্রতিফলিত করে এবং বাংলাদেশে অনেক জনপ্রিয়। আঙ্গুরগাছ ও লতাপাতার কাঁথার নকশায় যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে এবং এতে জীবন বৃক্ষের মতো একই রকম প্রতীক বহন করে। পান পাতার লহরি রাজশাহীতে অনেক জনপ্রিয়।

কালকা নকশাঃ মুঘল আমল থেকে আজ পর্যন্ত এই নকশা ব্যবহার করা হয়। কালকা নকশার উৎপত্তি পারস্যে ও কাশ্মীর এবং এটি বর্তমানে উপমহাদেশের অবিচ্ছেদ্য নকশা।

এছাড়াও রয়েছে পর্বত নকশা, মৎস নকশা, নৌকা নকশা, পায়ের ছাপ নকশা, রথ নকশা, মসজিদ নকশা, পাঞ্জা নকশা, কৃষি সামগ্রী, প্রানী-নকশা, সাজঘর সামগ্রী, রান্নাঘর সামগ্রী, পালকি নকশা।

ক্ষেত্রসমীক্ষাঃ পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ

ভৌগোলিক দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী দেখতে গেলে অবিভক্ত বাংলা জুড়েই কাঁথা শিল্পের প্রসার ঘটেছিল। প্রকৃত অর্থে কাঁথা শিল্প হল বঙ্গনারীর শিল্পকলা।

স্বাধীনতার পূর্ব অবিভক্ত বাংলায় কাঁথা শিল্পের যে প্রসার ঘটেছিল তা স্বাধীনতার পর বাংলার বিভক্ত হওয়ায় নানান দিক থেকে প্রভাবিত হয়েছে। পূর্ব বাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশের রাজশাহী, খুলনা, ঢাকা, যশোর, পুঠ্লা, নবাবগঞ্জ, রংপুর, দিনাজপুর, বরিশাল, মধুপুর প্রভৃতি অঞ্চলে কাঁথা শিল্পের প্রসার ঘটে।

অপরদিকে ভারতের অন্তর্গত পশ্চিম বঙ্গের বীরভূমের বোলপুর অঞ্চল, পুরুলিয়া, নদীয়ার কৃষ্ণনগর অঞ্চল বসিরহাটের সেনপালা অঞ্চল, বারাসাত, কদম্বগাছি প্রভৃতি অঞ্চলে কাঁথা শিল্পের বিস্তার লক্ষ করা যায়।

সাহিত্যে কাঁথা

কাঁথা বাঙ্গালির জীবনচর্যার সাথে কতটা অঙ্গাঙ্গিকভাবে জড়িত তা সংস্কৃতি ও বাংলা সাহিত্য পর্যালোচনা করলে বোঝা যায়। বহু প্রাচীনকাল থেকেই সাহিত্যে কাঁথার উল্লেখ পাওয়া যায়। বাংলায় “ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখা” এমন বাগধারা যেমন আছে ঠিক তেমনি আছে পল্লীকবি জসীম উদদীনের আখ্যানকাব্য ‘নকশী কাঁথার মাঠ’। এই আখ্যানকাব্য (কাহিনী কাব্য) দিয়েই বাংলা সাহিত্যে উঠে এসেছে কীভাবে কাঁথায় সূচের প্রতিটি পরতে পরতে ফুটে উঠতে পারে ভালোবাসা আর বেদনার কাহিনী। প্রেমিক রুপাই আর প্রেমিকা সাজুর ভালোবাসার অমর আখ্যান এই কাব্য।

“বিয়ের পরে রুপাই আর সাজুর ভালোবাসায় আখ্যান বেশি দূর যেতে পারেনি। ফেরারি হয়ে যায় রুপাই। স্বামীর অপেক্ষায় স্ত্রী সাজু বাকি জীবন নকশী কাঁথা বুনতে শুরু করে, দিন-মাস-বছর যায়। সাজু নকশী কাঁথায় সুঁইয়ের আচড় দিয়ে যায়, কাঁথায় লেখে কত গল্প, রুপাই ফিরে আসে না। সারা জীবন সাজুর এভাবেই কেটে যায়। সাজুর নকশী কাঁথা বোনা যেদিন শেষ হয়ে যায় সেদিন সে মাকে অনুরোধ করে, তার মৃত্যুর পর যেন তার কবরের উপরে নকশী কাঁথাটি বিছিয়ে দেওয়া হয়।” নকশী কাঁথার মাঠ

"কেহ কেহ নাকি গভীর রাত্রে দেখেছে মাঠের পরে
মহা-শূন্যেতে উড়াইছে কেবা নকসী কাঁথাটি ধরে
হাতে তার সেই বাঁশের বাঁশিটি বাজায় করুণ সুরে
তারি ঢেউ লাগি এ-গাঁও ওগাঁও গহন ব্যথায় ঝুরে।" ('নকশী কাঁথার মাঠ'; জসীম উদদীন)।

মূলত বাংলাদেশে নকশি কাঁথা শব্দটির বহুল ব্যবহার শুরু হয় জসীমউদ্দীনের “নক্সী কাঁথার মাঠ” (১৯২৯) কাব্য গ্রন্থ থেকে।

প্রায় পাঁচশ বছর আগে কৃষ্ণদাস কবিরাজ রচিত শ্রী শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত বইয়ে কাঁথার কথা প্রথম পাওয়া যায়।

এদেশের প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতী তাঁর রামায়ণ কাব্যে সীতার অন্যান্য গুণের সাথে কাঁথা সেলাইয়ের কথা বলেছেন এভাবে,

“ সীতার গুণের কথা কি কহিব আর।
কন্থায় আঁকিল কন্যা চান সুরুয, পাহাড়॥
আরো যে, আঁকিল কন্যা হাঁসা আর হাঁসি।
চাইরো পারে আঁকে কন্যা পুষ্প রাশি রাশি॥“


বাংলাদেশের নকশী কাঁথা ও অন্যান্য লোকশিল্প সম্পর্কে প্রথম লিখেছিলেন দীনেশ চন্দ্র সেন ও গুরুসদয় দত্ত তাছাড়া শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের কাঁথার সংগ্রহও দেখার মতো।

ব্যাক্তিগত ভাবে আমি, বাংলার নকশি কাঁথা - শীলা বসাক এর লেখা বইটি পড়েছি, আপনারাও চাইলে পড়তে পারেন। এই বইটিতে আরো বিশদ ভাবে কাঁথা নিয়ে লেখা আছে। আর পড়ার সুবিদার্থে আমি পরবর্তীতে দুটি পর্ব ই এক সাথে এডিট করে সংযুক্ত করেছি।
https://youtu.be/Vi1Tmughoic

তথ্যসূত্র:
https://bn.wikipedia.org/wiki/নকশি_কাঁথা
http://projonmonews24.com/article/8860/নকশী-কাঁথা-তৈরিতেই-চলে-জামিলার-পরিবার-1487949306
http://www.djanata.com/index.php?ref=MjBfMDZfMTZfMTRfMV8xM18xXzcyNjIy
https://archive1.ittefaq.com.bd/print-edition/bangla-novobarsh/2016/04/14/113987.html
https://bn.wikipedia.org/wiki/কাঁথা
https://roar.media/bangla/main/art-culture/nakshi-kantha-an-important-part-of-bengal-culture/
বাংলার নকশি কাঁথা - শীলা বসাক (বই)
http://sulagna141064.blogspot.com/2015/11/blog-post_94.htm

ছবিঃ গুগল









সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২০ ভোর ৪:১৭
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×