এক কথায় চমৎকার ভোট। উৎসবমুখর ভোট। প্রচুর স্বেচ্ছাসেবক রাখা হয়েছিলো।মোড়েমোড়ে, প্রধানফটকে, ভোটারদের লাইনের কাছে এবং ভোটকক্ষের ভেতরে। তিন রাস্তার মোড়ে দায়িত্বপালনরত ৫জনের সাথে প্রথম দেখা হয়। সবার গায়ে জনপ্রিয় নেতার ছবি সংবলিত টিশার্ট। সবাই বলে উঠলেন, “ ডায়রেক মাইরা দিয়েন, বুথের মধ্যে যাওয়া লাগবে না, ডায়রেক মাইরেন যান”। সবাই মুখচাওয়াচাওয়ি করলাম।
।
পরের মোড়ে পৌঁছলাম যখন, ৮-১০ জন টিনএজার স্বেচ্ছাসেবক বীরবিক্রমে এগিয়ে এলো, প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে আসার মত। সবাই একই টিশার্ট পরা, একই কথা সবার, ওপেনে (প্রকাশ্যে) দিতেহবে।
।
ঐতিহাসিক এ ভোটযাত্রায় সহযাত্রী ছিলাম ১০-১২জন। আমরা প্রধান সড়কে উঠে গেছি। ধীর পায়ে , খানিকটা সংশয় নিয়ে এগিয়ে চলছি ভোটকেন্দ্রের দিকে। টিনএজার গ্রুপের কমান্ডার একজনকে দ্রুত দৌঁড়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলো। আমাদের অতিক্রম করে দ্রুত ভোটকেন্দ্রের দিকে ছুটে গেলো সংবাদদাতা শিশুটি। মুহূর্তেই খবর পৌঁছে গেল, “দশ বারটা ভোট আসতেছে”।
প্রধান গেট পাহারা দিচ্ছেন বজলু ভাই নিজেই। সাথে লোকজন। বজলু ভাই জেলা শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি। লেখা পড়া না জানলেও এলাকার শিক্ষিত অশিক্ষিত, ছোট বড় সবাই তাকে ভাই বলে। যেমন বডি ফিগার, তেমন বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। এক কথায় ভোটকেন্দ্রের লড়াকু সৈনিক। আমাদের সহযাত্রীদের মধ্য থেকে মাথামোটা এক ভোটার বলে বসলেন, “কেন, ওপেনে কেন দেব”? বজলু ভাই আগুনের স্ফুলিঙ্গের মত জ্বলে উঠলেন। এই প্রচণ্ড শীতের মধ্যেও কপাল ঘামে ভিজে গেছে। টকটকে চোখদু’টো যেন জ্বলছে। আবেগের উত্তেজনায় দুই ঠোঁট বার বার কেঁপে উঠছে। ৭ই মার্চের ভাষণের মত আঙ্গুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলছেন, “ওপেনে দিতে না পারলে চলে যান এখান থেকে, ভোট দেয়া লাগবেনা আপনার”। মাথামোটা সহযাত্রীটি একদম চুপশে গেলো।
।
আরেক বুদ্ধিমান সহযাত্রী এগিয়ে গিয়ে বজলু ভাইকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “ ওপেনে কেন দিতে পারবনা বাবা, অবশ্যই ওপেনে দেবো।বজলু ভাই একটু থামলেন। নিশ্বাস তার ঘন হয়ে গেছে। জোরে জোরে হাপাচ্ছেন। তার সহযোগীরা যার যার মত করে আগান্তুক ভোটারদেরকে ভোট দেয়ার নিয়োম শিখিয়ে দিচ্ছেন। “ওপেনে দিতে হবে”।
।
লাইনে দাঁড়াতে হয় যেখানে, সেখানেও দলীয় স্বেচ্ছাসেবকরা নিয়োজিত ছিলেন।খুব আন্তরিকতার সাথে তারা ওপেনে ভোট দেয়ার নিয়মটি মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন বারবার।
।
ভোটকক্ষের ভেতরেও প্রয়োজনীয় সংখ্যক দলীয় নেতাকর্মী সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছিলেন ভোটারদের। কাউকে সিল মেরে, কাউকে ভাঁজ করে দিয়ে , কাউকে বাক্সে ঢুকিয়ে দিয়ে সহযোগিতা।
।
নরীদের কক্ষে নারী স্বেচ্ছাসেবক। আমার সহযাত্রী নারী ভোটাররা একেক জন একেক বিবরণ দিলেন। একজন বললেন, “আমারে ওপেনে দেতে কইছে, ওপেনে দিছি”। একজন বললেন আমার ব্যালট টান দিয়ে নিয়ে একজনে সিল মেরে বেলট ফেরত দিয়ে বলে, “নেন বাক্সের মধ্যে রাখেন”। একজন বললো, আমারে কইচে যান আপনারাটা দেওয়া হয়ে গেছে।
।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এবং নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত পরিশ্রমের সাথে কাজ করেছেন। জেলা যুব সংগঠনের রসভাপতি বারবার সবগুলো রুমে ঢুকছেন, দেখছেন, দ্ব্যার্থহীনকণ্ঠে নির্দেশনা দিচ্ছেন, “খবরদার, একটা ভোটও যেন এতিক সেদিক না হয়।”
।
পোলিং অফিসারদেরকে বলে দিচ্ছেন, “যারা ওপেনে সিল না মেরে চলে যাবে তাদেরকে লাল কালি দিয়ে দাগ দিয়ে রাখবেন।আর যারা কাপড়ের আড়ালে যেয়ে ভোট দেবে তাদেরকেও মার্ক করে রাখবেন”।
।
বিপত্তি ঘটলো আরেক মাথামোটা সহযাত্রীকে নিয়ে। এত এত বার এত এত ভাবে বলে দেয়ার পরও সে পর্দার আড়ালে যেয়েই ভোট দিলো। কাউকে না দেখিয়েই ওমনি বাক্সের মধ্যে ফেলে দিল। একজন পোলিং অফিসার সাথে সাথে দাগ দিয়ে রাখলেন।মুহূর্তেই রটে গেল,“ফটিক পর্দার আড়ালে ভোট দিয়েছে”। ফটিক বাড়ি ফেরার আগেই তার বাড়িতে স্বেচ্ছাসেবকদের একটি চৌকস দল পৌঁছে গেলো। দেশ এখন ডিজিটাল। ফটিকের মোবাইল বেজে ওঠে, “ফটিক তুই পালিয়ে যা, বজলু ভাইরা যাচ্ছে”।
।
ভোট দিয়ে ফেরার পথে দেখি একটি জটলা জটলার কেন্দ্রে এক মহিলা। বোরখাা পরা। মাথামোটা মহিলা জোরে জোরে বকে চলেছে।সাথে আরো ৩-৪ জন। নীরব। দ্বিধাগ্রস্ত। বাড়ির দিকে যাবে, নাকি কেন্দ্রের দিকে। মহিলাটি রীতিমত বক্তৃতা শুরু করেছে,“ ভোট আমার নাগরিক অধিকার, দেখিয়ে ভোট দিতে হলে দেবোনা ভোট, ইত্যাদি”।
।
টিনএজারদের কমান্ডার এগিয়ে আসে। “আপনার ভোট দেয়া লাগবেনা, বাড়ি যেয়ে ঘুম পড়েন। এই, তোরা চিনে রাখ, এইটা মৌলবির বউ”। মহিলা আবার বলতে শুরু করেন,“এই, তুই মন্টুর ছেলে, আমার ছেলের চেয়েও তোর বয়স কম। তুই এত কথা বলছিস কেন্? ….. ইত্যাদিইত্যাদি”।
।
ফটিক এখনো আত্মগোপনে। কিন্তু এভাবে কত দিন সম্ভব? ফটিক দিনমজুর। পালিয়ে থাকলে সংসার চলবে না। বেরই বা হবে কিভাবে? একেক বার একেক কথা ভেবে মনে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করে।আবার চুপসে যায়।শেষ মেস সিদ্ধান্ত নেয়, আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসবে। কিল ঘুষি, চড় লাথি যা খাওয়ার এখনি খেয়ে নেনে। তারপর আর ভয় নেই।কিন্তু লুকিয়ে থাকলে পুরো পাঁচ বছরই লুকিয়ে থাকতে হবে। এটা সম্ভব নয়। সম্ভব্য ধোলাইটি খাওয়ার সময় অনুনয় বিনয় করে কী বলবে তাও রেডি করে রেখেছে ফটিক। “ভাই আমিতো ইচ্ছা কইরা পর্দার আবডালে যাইনাই। অফিসার কইলো, তাই গেলাম। তা ছাড়া পর্দার আড়ালে গেলেও ভোটতো নৌকায়ই দিচি”।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:১৫