যুদ্ধবিধবস্ত একটা দেশের বিনির্মাণ চলছে। সেখানে অনাকাঙ্খিত মাতৃত্ব নিয়ে সারসার নারী। স্বাধীনতার পর এই ব্যাপারটা দারুণ এক মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াল সরকারের জন্য। সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে অসমর্থিত এক হিসেবে জানা গেছে ২৫ হাজার বাঙ্গালী কিশোরী-তরুণী-যুবতী যুদ্ধের পরপর গর্ভবতী হয়ে পড়ে। বাংলাদেশের মতো দেশে কুমারীত্ব (এখানে অক্ষত যোনীর কথা বলা হচ্ছে) সতীপনার সবচেয়ে বড় নমুনা। তাই ধর্ষিতাদের ইস্যুটা একই সঙ্গে দেশের সম্মাণ ও লজ্জা নিয়ে টানাপোড়েনে ফেলল। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান প্রায় প্রতিটি জনসভায় বীরাঙ্গনাদের নিজের মেয়ে বলে পরিচয় দিলেন। আহবান জানালেন সমাজ ও পরিবারকে তাদের ফিরিয়ে নিতে, পুনর্বাসিত করতে। আবার একই সময়ে দৃঢ়ভাবেই জানালেন পাকিস্তানীদের বীর্যধারী এই জারজদের কোনো মূল্যেই দেশের মাটিতে রাখা হবে না।
স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার যে পাঁচসালা কর্মসূচী নিল, তাতে গুরুত্ব দেওয়া হলো মাতৃত্বের শিকার নারীদের গর্ভপাত এবং সন্তান জন্মদানের। সরকারীভাবেই তাদের উৎসাহ দেওয়া হলো এ ব্যাপারে। যুদ্ধকালীন ঘটনাপ্রবাহের একটা রূপক সূচকই যেন ফুটে উঠলো মাতৃত্বের শিকার এসব নিগৃহিতা নারীদের শরীরে।
১৯৭২ সালে ২৯ মে নিউইয়র্ক টাইমস লিখল : মার্কিন সমাজকর্মীদের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে ধর্ষিতা মেয়েদের শিশুদের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে দত্তক দেওয়ার একটা কর্মসূচী নিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য এ এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ, কারণ তাদের সমাজে অচেনা কাউকে সন্তান দত্তক দেওয়ার রেওয়াজ নেই। ইন্টারন্যাশনাল সোসাল সার্ভিস আমেরিকান ব্রাঞ্চের জেনারেল ডিরেক্টর ডব্লু সি ক্লেইন জানিয়েছেন দত্তক দেওয়াটা একটা বিকল্প উপায়। গর্ভপাত, শিশুহত্যা এবং ভিখিরিদের কাছে সন্তান বিক্রি করা ঠেকাতেই (তারা এদের দেখিয়ে সহানুভূতি আদায় করে কামানোর চেষ্টা করত) এই উপায় ভেবে বের করেছে বাংলাদেশ সরকার।
ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড (আইপিপি), ইন্টারন্যাশনাল অ্যাবরশন রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার এবং স্থানীয় অনেক ক্লিনিকে সরকারী সহায়তায় গর্ভপাতের ব্যবস্থা নেওয়া হলো। আইপিপি সেসময় গঠিত কেন্দ্রীয় নারী পুনর্বাসন সংস্থাকে সাহায্য করতে ঢাকায় এবং দেশের আরো ১৭টি জায়গায় বিশেষ ক্লিনিক খুলল নির্যাতিতাদের মুক্তি দিতে। যদিও আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডঃ ডেভিস সঠিক সংখ্যাটা স্মরণ করতে পারেননি, কিন্তু তার আগের এক উদ্ধৃতিতে দেখলাম প্রায় ৫ হাজার বাঙ্গালী মেয়ে গর্ভপাত করেছেন। এবং এর বেশিরভাগই বিজ্ঞান সম্মত উপায়ে নয়।
মাদার তেরেসাও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কলকাতা থেকে। যেসব মেয়ে তাদের নবজাতককে দিয়ে দিতে ইচ্ছুক, তাদের আশ্রয় দেবার ঘোষণা দিলেন তিনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পারিবারিক চাপ ছিল এসব শিশুকে যেভাবেই হোক বর্জনের। স্বচ্ছল কিছু পরিবার গোপনে কলকাতায় তাদের মেয়েদের পাঠিয়ে দিল গর্ভপাত সেরে আসতে।
নীলিমা ইব্রাহিম জানিয়েছেন পুনর্বাসন কেন্দ্রের প্রথম নীতিই ছিল গর্ভপাত। এরপর সরকারীভাবে দ্বিতীয় নীতিতে নির্ধারণ করা হতো জন্ম নেওয়া এসব জারজ শিশুদের ভাগ্য। তার ভাষায়, আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম বিদেশী কোনো দেশ এসব শিশুকে দত্তক নিতে চাইলে দিয়ে দেব... অনেক মেয়ে অবশ্য কান্নাকাটি করেছে, তারা বাচ্চাদের ছাড়তে চায়নি। আমাদের এমনকি তাদের ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তারপর বাচ্চাগুলো সরিয়ে ফেলতে হয়েছে... এক মেয়ের বয়স ছিল মাত্র চৌদ্দ। অল্পবয়সী মেয়েগুলো আবেগের কারণেই ওমন করত। কিন্তু বয়সীরা তাদের পরিণিতবোধ দিয়েই বুঝেছিল এ ধরণের শিশু রেখে পায়ের নিচে মাটি হারাবে তারা।
ইব্রাহিম আরো জানাচ্ছেন, সেসব মেয়েদের সন্তান রাখার বা না রাখার কোনো বিকল্প দেওয়া হয়নি। সংশ্লিষ্ট সমাজকর্মীরা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন এসব মেয়েকে সাহায্য করার। কিন্তু রাষ্ট্রের শুদ্ধতার কাছে ধর্ষিতাদের মানসিক চাপ ও আবেগের কোনো কদর ছিল না। এটাই ছিল বাংলাদেশ সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক সিদ্ধান্ত। সে সময়কার সমাজকর্মীদের একজন মালেকা খান জানিয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের নীতি ছিল দু’রকম। প্রথমত গর্ভপাত, দ্বিতীয় হচ্ছে সন্তান জন্ম নিলে তাকে দত্তক দেওয়ার জন্য আইন প্রণয়ন। কিন্তু তিনিও সঠিক জানাতে পারেননি ঠিক কজন ধর্ষিতা গর্ভপাত করিয়েছিলেন, কতজন দত্তক দিয়েছেন। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০০৮ সকাল ১১:৫২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



