somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যুদ্ধ শিশু '৭১ : ডঃ জিওফ্রে ডেভিসের সাক্ষাৎকার

১২ ই নভেম্বর, ২০০৬ রাত ১১:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



(প্রাক কথন : কাগজপত্র বলছে যুদ্ধপরবর্তীকালীন সময়ে বাংলাদেশে কর্মরত চিকিৎসকদের একজন ছিলেন জিওফ্রে ডেভিস। সিডনিতে তার এই সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিলেন বীনা ডি’কস্টা। সাক্ষাৎকার কাল ২০০২ সাল। স্বাধীনতার ৩২ বছর পর। অনেক ঘটনাই তখন ডেভিসের স্মৃতিতে ঝাপসা।
নিউসাউথওয়েলস থেকে পাশ করা ডেভিস বাংলাদেশে ছিলেন মার্চ ’৭২ থেকে মাস ছয়েক। ইন্টারন্যাশনাল প্ল্যানড প্যারেন্টহুড, ইউএনএফপিএ এবং হু’র তত্ত্বাবধানে কাজ করেছেন। তার কাজের ধরণের স্পর্শকাতরতা বিবেচনা করেই এসব সংগঠনের কেউ তাকে নিজেদের একজন বলে স্বীকৃতি দেয়নি। উনি স্মরণ করেছেন, ‘পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের পাশবিকতা থেকে বেচে যাওয়া মেয়েদের জন্য কিছু করতেই আমি ছিলাম সেখানে। যাদেরকে সম্ভব গর্ভপাত করানো হয়েছে, যাদের সম্ভব হয়নি সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়ায়, তাদের জন্মদানে সাহায্য করা হয়েছে। সেটা সাফল্যের সঙ্গেই আমরা করেছি। বাংলাদেশে তখন সংখাতত্ত্বে সব কিছুই ছিল বড় রকমের। আমি ক্ষয়ক্ষতির কথা বলছি। যখন সেখানে পৌছলাম এদের অনেকেই হয়তো মারা গেছে, নয়তো পরিবারে ফিরে গেছে। এটাই সবাইকে আতঙ্কিত করে তুলেছিল। আমাদের কিছু করা দরকার। আমরা ভেবে উপায় বের করার চেষ্টায় ছিলাম। ইংল্যান্ডের একজন ছিল আমার সঙ্গে। পরে আর তার হদিশ পাইনি। অদ্ভুত এক ব্যাপার।’
সাক্ষাৎকারের আকার বেশ বড়। সংক্ষিপ্ত করার চেয়ে ভেঙে দেওয়াকেই উপায় মানছি।)

বীনা : আপনি কি স্বেচ্ছায় গিয়েছিলেন?
ডেভিস : হ্যাঁ।

বীনা : কেন আপনি আগ্রহী হলেন?
ডেভিস : অ্যাডভান্সড প্রেগনেন্সি (গর্ভপাতের নিরাপদ সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়া) টার্মিনেটিংয়ে আমার বিশেষ একটি টেকনিক ছিল। আমি যুক্তরাজ্য থেকে মূলত ট্রেনিং নিয়েছি। যাহোক, আমি সাধারণত ৩০ সপ্তাহের নিচের গর্ভবতীদের গর্ভপাত করিয়েছি।
বীনা : ঢাকায় কোথায় কাজ করেছেন?
ডেভিস : ধানমন্ডীর একটি ক্লিনিকে। এছাড়া আরো অনেক শহরেই যেখানে হাসপাতাল বলে কিছু অবশিষ্ট ছিল। যেহেতু সংখ্যাটা অনেক বেশি, তাই মূলত আমি স্থানীয়দের শিখিয়ে দিচ্ছিলাম কীভাবে কী করতে হবে। তারা শিখে নিলে আমি অন্য কোথাও চলে যেতাম একই কাজ করতে।

বীনা : তথ্য সংরক্ষণের স্বার্থেই জানতে চাচ্ছি, ঠিক কী ধরণের কাজ করতেন ওখানে নির্দিষ্ট করে বলবেন কী?
ডেভিস : আমি ওখানে যাওয়ার আগে নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র নামে একটা সংস্থা হয়েছিল যার দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি সোবহান। তারা চেষ্টা করছিলেন গর্ভবতী সব মেয়েদের নিরাপদ কোনো এক জায়গায় জড়ো করতে। যাদের গর্ভপাত করানো সম্ভব, করাতে। আর বাচ্চা হলে তাদেরকে ইন্টারন্যাশনাল সোসাল সার্ভিসের হাতে তুলে দিতে।

বীনা : সেসময় আপনার সঙ্গে কাজ করেছেন এমন কারো নাম মনে আছে?
ডেভিস : যুদ্ধ পুনর্বাসন সংস্থার প্রধান ছিলেন জাস্টিস সোবহান আর এ ব্যাপারে সবচেয়ে তৎপর মানুষটি ছিলেন ফন শুখ। তার নামের প্রথম অংশটা স্মরণ করতে পারছি না। তার স্ত্রীর নাম ছিল সম্ভবত মেরি। তারা আর্থিক সহায়তা দিচ্ছিলেন। বাঙ্গালী কর্মকর্তাদের নাম আমার মনে নেই। তাছাড়া ইতিহাসের এই অংশটুকু কেউই মনে রাখতে চাইছিল না।

বীনা : এ কথা কেনো বললেন?
ডেভিস : ওহ, কারণ পুরো ব্যাপারটা গর্ভপাত এবং বাচ্চাদের দত্তকের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। আরেকটা প্রেক্ষাপট হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান কমনওয়েলথভুক্ত দেশ ছিল, তাদের সব অফিসাররাই ইংল্যান্ডে ট্রেনিং নেওয়া। এটা এক অর্থে ব্রিটিশ সরকারের জন্যও ছিল বিব্রতকর। পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তারা বুঝতে পারছিল না এ নিয়ে এত হৈ চৈ করার কী আছে! আামি ওদের অনেকের সাক্ষাৎকার নিয়েছি। কুমিল্লার একটি কারাগারে আটক ছিল তারা এবং খুবই বাজে অবস্থায় (ব্যাপারটা আমার কাছে অবশ্য উপভোগ্য ঠেকেছে)। ওরা বলত, ‘এসব কী হচ্ছে? আমরা কী করতে পারতাম? যুদ্ধ হচ্ছিল তো!’

বীনা : মেয়েদের ধর্ষণ করাকে কীভাবে তারা ন্যায়সঙ্গত ভাবল?
ডেভিস : টিক্কা খান নাকি তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, বুঝিয়েছিলেন একজন ভালো মুসলমান তার পিতা ছাড়া আর সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে! তাই তারা যতজন সম্ভব বাঙ্গালী মেয়েদের গর্ভবতী করার চেষ্টা করেছে। এটাই ছিল ওদের থিওরি।

বীনা : মেয়েদের কেন গর্ভবতী করতে হতো? তার কারণ বলেছে আপনাকে?
ডেভিস : হ্যাঁ, এর ফলে গোটা পূর্ব পাকিস্তানে একটা নতুন প্রজন্ম জন্ম নেবে যাদের শরীরে থাকবে পশ্চিম পাকিস্তানী রক্ত। সেটাই তো ওরা বলল।

বীনা : পাকিস্তানের অনেক তথ্য উপাত্তে দেখা যাচ্ছে ধর্ষনের সংখ্যা নাকি ইচ্ছা করেই বাড়িয়ে বলা হয়েছে। আপনি কী তা সত্যি মানেন?
ডেভিস : না না, প্রশ্নই ওঠে না। বরং তারা যা করেছে সেটাই রক্ষণশীলতার কারণে অনেকখানি চেপে যাওয়া হয়েছে। ওরা কীভাবে শহর দখল করত তার বর্ণনা খুবই চমকপ্রদ। পদাতিকদের পেছনে রেখে গোলন্দাজদের দিয়ে হাসপাতাল ও স্কুলে কামান দাগত। এতে গোটা শহরে একটা ভীতিকর আতঙ্ক তৈরি হতো। আর তারপরই পদাতিকরা ঢুকে মেয়েদের ওপর হামলা চালাত। একদম ছোট শিশু বাদ দিলে, একটু পরিণত মেয়েদের তারা শিকার বানাত। বাকিরা অংশ নিত শহর জ্বালানো পোড়ানোয়। পূর্ব পাকিস্তান সরকার এবং আওয়ামী লিগের সমর্থক সবাইকে গুলি করে মারা হতো। আর মেয়েদের সশস্ত্র পাহারায় রাখা হতো কোনো জায়গায় যাতে সৈন্যরা তাদের ব্যবহার করতে পারে। বিভৎস একটা ব্যাপার। এমন কোনো ঘটনা আগে ঘটেছিল বলে আমার অন্তত জানা নেই। তারপরও ঠিক এমনটাই ঘটত। (চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুলাই, ২০০৮ দুপুর ১২:০৬
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাকি চাহিয়া লজ্জা দিবেন না ********************

লিখেছেন মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৩৫

যখন প্রথম পড়তে শিখেছি তখন যেখানেই কোন লেখা পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। সেই সময় দোকানে কোন কিছু কিনতে গেলে সেই দোকানের লেখাগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তাম। সচরাচর দোকানে যে তিনটি বাক্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

=এই গরমে সবুজে রাখুন চোখ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১

০১।



চোখ তোমার জ্বলে যায় রোদের আগুনে?
তুমি চোখ রাখো সবুজে এবেলা
আমায় নিয়ে ঘুরে আসো সবুজ অরণ্যে, সবুজ মাঠে;
না বলো না আজ, ফিরিয়ো না মুখ উল্টো।
====================================
এই গরমে একটু সবুজ ছবি দেয়ার চেষ্টা... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

×