ওসি বেশ মনযোগ দিয়ে ইলাস্টিকটা টেনে টুনে দেখছেন। 'হুমম, মহিলাতো বেশ মোটা মনে হচ্ছে। আচ্ছা এই ৩৯ ব্যাপারটা বুঝলাম না। ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস তো জোড় সংখ্যায় হয় জানি। ও থাইল্যান্ড! ওরা তাহলে বেজোড় মাপে'- বলেই নিজের রসিকতায় হো হো করে হাসলেন। থামলেন। এবার সেই ফিচকে হাসির রেশটা মুখে লাগিয়ে প্রশ্ন করলেন, 'তারপর শামীম সাহেব। লাশটা কোথায়?'
শামীম দরদরিয়ে ঘামছে। মিনমিনিয়ে কোনোমতে বলল, 'কিসের লাশ? কী বলছেন এইসব'। এই ঠাণ্ডাতেও তার গরম লাগছে। পিঠ ভিজে গেছে। আবার তলপেটে কামড় ও দিচ্ছে খুব। পেশাব পেয়েছে। ইচ্ছা করছে উঠে একটা ভো দৌড় দিতে। আসলে অনেক চিন্তা একসঙ্গে মাথায় জট পাকিয়ে গেছে। নিপা যদি জানতে পারে কী হবে! ও কি বাপের বাড়ি চলে যাবে? ডিভোর্সের মামলা করবে? সাদিয়াই বা জানলে কী ভাববে? ও যে মেয়ে, তাতে তসলিমা নাসরিন টাইপ একটা স্ক্যান্ডাল দাড় করিয়ে দিতে পারে। নিজেকে ওঠাতে গপ্পো বানাতে ওর জুড়ি নেই। ভাবতেই মেজাজটা এবার খিচড়ে গেলো। ক্যানো সে কাজটা করতে গেলো। এবার আত্মহত্যা করতে ইচ্ছে করছে শামীমের।
২.
আজ একটু আগেই অফিস থেকে বেরিয়েছিল। বসকে মিথ্যে বলেই। সাদিয়ার বাসায় একটা সাহিত্যসভা হওয়ার কথা। সে নতুন কিছু লিখলেই বাসায় একটা সভা বসায়। খাওয়াদাওয়ার আয়োজন থাকে। উপস্থিতদের করণীয় একটাই- জটিল হয়েছে, দারুণ লিখেছ, বাংলা সাহিত্যে নতুন এক সূর্য্যর দেখা আমরা পেয়ে গেছি।' কথাগুলো শোনার সময় সাদিয়ার এক্সপ্রেশন খেয়াল করে শামীম। জুলজুলে চোখে তাকিয়ে থাকে, গদগদ ভাব। অর্গাজমিক আনন্দ পায় বুঝি! একটা সাহিত্য ফোরামেই পরিচয়। শামীম অবশ্য নিজে লেখে কম, তবে সমালোচক হিসেবে ইদানিং নাম করেছে। বেশ কিছু পত্রিকায় বই-পত্রের রিভিউ করে পয়সা আসে ঘরে। আজো সেরকমই এক সভা। সাদিয়া নতুন কবিতা লিখেছে। গিয়ে দেখে অতিথি সে একাই। একটু অস্বস্তি লাগে। সাদিয়ার সবচেয়ে বদগুণ হচ্ছে বেমক্কা মন্তব্য। হাসির ছদ্মবেশে এমন একটা কিছু বলবে যে ভিত নাড়িয়ে দেয়। সেদিন ভরমজলিশে বলল- শামীম ভাই আপনি অমন ঝুকে হাটেন ক্যান। কার্টুনের কচ্ছপরা দাড়িয়ে যেমন হাটে তেমন। হিহিহিহি।'
মেজাজ খারাপ হয়, তারও বলতে ইচ্ছে করে- আমারো তোমাকে দেখলে ভেটকি মাছের কথা মনে পড়ে। ট্যাগরা চোখ মুখের দুইপাশে ছড়ানো। গলা নাই, ঘাড়ের উপর মাথা বসানো। বুক-পেট-পাছা একাকার। কার্টুনে যেমন ব্যাটারির দুটো পা লাগিয়ে দেয়, তোমাকে দেখলে আমার সেই ছবি মনে আসে। হাহাহাহা।' বলে না। মুখ বুজে সয়ে যায়। কবিতা না ছাই। বাচ্চারা যেমন হাত দিয়ে প্লেন ওড়ানোর ভঙ্গি করে, অনেকটা কালোয়াতি ঢংয়ে কবিতাটা আবৃত্তি করে সাদিয়া। তার কণ্ঠ ভালো। কিন্তু কবিতাটা জঘন্য। ভিড়ভাট্টা নেই বলেই শামীম ধরিয়ে দেয় ঘাটতিগুলো- সাদিয়া তোমার বক্তব্য পরিষ্কার। কিন্তু ধারাবাহিকতা নেই। তুমি নারীর সামাজিক বৈষম্য তুলে ধরতে চেয়েছো। তবে এই জায়গাটা দেখো এখানে তোমার গাথুনী যতটা সবল শুরু বা শেষে সেটা নেই।' সাদিয়া গম্ভীর হয়ে যায়। 'চা খাবেন শামীম ভাই? বসুন এনে দিচ্ছি। আচ্ছা চলুন বারান্দায় বসি। ওখানে জোসনা দেখতে দেখতে চা খাওয়া যাবে।'
৩.
চিপা বারান্দা। এখনকার ফ্লাট বাড়িগুলোয় যেমন হয় আর কি। কাপড় শুকানোর জন্য সানশেডটা একটু গ্রিল দিয়ে ঘিরে বারান্দা বানিয়ে দিচ্ছে ডেভেলপাররা। পিঠ কোনোমতে ঠেকিয়ে পা গুটিয়ে জড়োসড়ো বসতে হয়। জোসনার কোন ঠাহর শামীম পায় না। বরং আশেপাশের কোনো বাড়ির বাতির ছটাই গায়ে পড়ছে বলে মনে হয়। বসার জায়গা করতে গিয়ে দেখে সারসার কাপড় ঝুলছে। একটা কালো ব্রার সাথে মুখ বাড়ি খায়। সরিয়ে বসে শামীম। সেই আধো-আধারে দুহাতে কাপ নিয়ে আসে সাদিয়া। 'চিনি একটু কম দিলাম। আপনার তো ভুড়ি হয়েছে, এখন থেকে ব্লাডসুগার কন্ট্রলে রাখার চেষ্টা করবেন।' শামীম একটু ঘাবড়ে যায়। না ভুল ধরিয়ে দেওয়াটা ভুল হয়েছে। এবার সাদিয়া তাকে হেনস্থা করা শুরু করবে।
আন্দাজ সঠিক। 'শামীম ভাই, আপনি কি জানেন আপনার মধ্যে একটা ছোকছোক ভাব আছে? আপনার তাকানোর স্টাইল হচ্ছে যাকে বলে চোরা চাউনি। আমার ধারণা আপনি সংসার জীবনে অসুখী। তো কবিতার কথা যা বলছিলেন। আপনি আসলে কবিতার ক-ও জানেন না। এর কোনো ধারাবাহিকতা নেই? একটা মেয়ে জন্মানোর পর সে ভালো করে হাটতে পারেনা, নাজুক থাকে। যখন যুবতী তখন সে সবল। আবার যখন সে বৃদ্ধা আবারো দুর্বল। কবিতাটায় আমি এটাই ফুটিয়ে তুলেছি। আপনি বুঝতেই পারলেন না। আবার সমালোচনা করেন। আপনাদের এই প্রবলেম, বোঝেন ঘণ্টা রাধেন ঘন্ট।' এক নিশ্বাসে বলে দম নেয় সাদিয়া। ক্ষোভ-অপমান-বিতৃষ্ণা সব একসঙ্গে খেলা করে শামীমের মনে। 'ভাবীর জন্য একটা গিফট কিনেছিলাম। আপনি দিলেন মুডটাই নষ্ট করে। আমি আপনাকে কত বড় লেখক ভাবতাম। আপনার জন্য আমার মনে কত শ্রদ্ধা, আর আপনি কিছু না বুঝেই আমার কবিতাটা ফালতু বানিয়ে দিলেন। কী কুক্ষণে যে আপনাকে শোনাতে গিয়েছিলাম। আর জ্যোতি দা'টা যেন কেমন। প্রতিদিন সকাল-বিকাল ফোন করবে- কি লিখলে সাদিয়া। আসতে বললাম অমনি সব আহ্লাদ উধাও, ওনার কাজ আছে! ব্যস্ত। আসতে পারবেন না। কাদের সঙ্গে মিশি!' সব আগুন উগড়ে দিয়ে থামে। শামীম কোনোমতে বলে, 'আমি ওভাবে ভেবে দেখিনি আসলে। আচ্ছা তাহলে উঠি আজ?' 'যাবেন? ঠিক আছে যান। দেখি কবিতাটা নিয়ে আবার বসতে হবে। ফোন করব আপনাকে। চলেন।' সাদিয়ার পিছু পিছু বেরুতে গিয়ে ওঠার সময় আবার মাথায় বাড়ি খায় ব্রাটা। কী এক অদ্ভুত প্রতিহিংসায় সেটা খপ করে পকেটে পুরে ফেলে শামীম।
৪.
ঠিক কী কারণে ভেবে পায়না। রিকশায় বসার সময় পকেটে হাত ভরে মুঠো করে ধরে রেখেছে কাপড়টা। দাম্পত্য জীবনে দারুণ সুখী শামীম। নিপার মতো মেয়েই হয় না। সব অর্থেই কথাটা খাটে। একবার ভাবে ব্রাটা নিয়ে মাস্টারবেট করলে ক্যামন হয়? মনে মনে হাসে। সাদিয়া যে টাইপ মেয়ে, তাতে কামভাব জাগে না। উল্টো পালাই পালাই করবে। ঠিক এমন সময় রিকশা থামায় টহল পুলিশ। 'নামেন, রিকশা চেক করব।' শামীম ভয় খায়। অদ্ভুত এক আতঙ্ক নিয়ে নেমে দাড়ায়। একজন কনস্টেবল সিট খুলে চেক করে। শামীম মুঠো আকড়ে থাকে পকেটের পাশে এক সেপাই। ফেলতেও পারছে না। 'উনারে সার্চ করব স্যার? - ওয়ারল্যাস হাতে দাড়ানো এক এএসআইকে জিজ্ঞেস করে সে।
অফিসার তাকান শামীমের দিকে। 'কী করেন?' 'জ্বী, কিছু করি নাই- আউলে যায় শামীমের। তার মুখে কী আসলেই চোর চোর ভাব। সাদিয়া কী এই চোরা চাউনির কথাই বলেছিল? 'কিছু করি নাই মানে? পকেটে হাত দিয়ে রাখছেন ক্যান? পকেটে কী?' 'কিছু না কিছু না' বলে পকেট থেকে হাত বের করতে গিয়েও করেনা। বরং ঠেসে ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে যেন। অফিসার এইবার সন্দীহান। 'চেক করোতো ব্যাটাকে।' শামীম বলে, 'স্যার আমি ভদ্রলোক। এক কোম্পানিতে চাকরি করি। আপনে খোজ নিয়ে দেখেন।' 'চুপ ব্যাটা হাত বাইর কর'- ধমকে উঠে এইবার সেপাই। বডি সার্চে যায় না। সরাসরি হাত দেয় পকেটে। বের করে আনে দুটো ত্রিভুজ জোড় লাগানো কাপড়খানা। 'স্যার মাইয়া মাইনষের ব্রেসিয়ার।' 'আচ্ছা!'- কিছুটা কৌতুক, কিছুটা কৌতুহল অফিসারের মুখে। 'তা মিস্টার ভদ্দরলোক। মাগীবাড়ি থেকে আসতেছেন নাকি। আসার সময় টাকা উসুল করতে বউয়ের জন্য গিফট- নাকি! গাড়িতে ওঠেন।' সামনে অন্ধকারে পার্ক করা পিকআপটার দিকে আঙুল তোলে। শামীম বলে, 'বিশ্বাস করেন স্যার আমি কিছু করি নাই।' অফিসারের এক ধমক, 'চুপ। একদম চুপ। কারে খুন কইরা কাপড় খুইলা নিয়া আসছস বিশ্বাস নাই। তোর মুখ দেইখাই বোঝা যায় তুই ক্রিমিনাল। চুপচাপ গাড়িতে ওঠ। যা ক'বি থানায় গিয়া, এখন চুপ।'
৫.
গাড়িতে কেউ ছিল না আর। ঝেড়ে একটা দৌড় দেওয়ার চিন্তা এসেছিল। কিন্তু পায়ে সাড়া পায়নি। মাথায় চিন্তার ঘুরপাক। জানাজানি হলে কী হবে। কীভাবে সাহায্য পাবে? ফোন করতে পারে বসকে। সেখানে চাকুরি হারানোর ভয়। মোবাইলেও বড়জোর মিসকল দেয়া যাবে। নিপাকে ফোন করার প্রশ্নই আসে না। সাদিয়াকে তো না-ই। একবার ভাবে অফিসারের পা জড়িয়ে কান্নাকাটি করে। কিন্তু তাতে রেহাইর বদলে সন্দেহটা আরো পাকাপোক্ত হ ওয়ার জোর সম্ভাবনা। শুনেছে পুলিশ ঘুষ খায়। কিন্তু তার পকেটে কেচেকুচে পঞ্চাশ টাকাও হবে না। দিশেহারা লাগছে শামীমের।
থানার ওসি ব্যস্ত মানুষ। তাকে বসতে দিয়ে ফোনে কথা বলছেন এখানে ওখানে। ওয়ারল্যাসে নির্দেশ দিচ্ছেন। দর্শনার্থীও আছে কয়েকজন। আসামী ছাড়াতে এসেছে। ধান্দাবাজিটা প্রকাশ্যেই হচ্ছে। এক ফাকেই তাকে আবার বললেন কথাটা- 'লাশটা কই।' শামীমের রা সরছে না মুখে। কোনো উত্তর নেই। যা হবে হবে। সংসার ভেঙ্গে যাবে। চাকুরি হারাবে। জেল খাটবে। তাতেও যদি প্রায়শ্চিত হয়। কিন্তু সে আর চাপ নিতে পারছে না। ভেবেই মনের জোরটা যেন জুড়ে বসে। এখন আর কোনো কিছুতেই কিছু এসে যায় না।
৬.
শেষটা অনেকভাবেই হতে পারত। এখানে অস্বাভাবিক কিছু হয়নি। ওসি একটু পর বললেন, 'ফরেনসিকে পার্ভারশন নানারকম হয়। এর একটা হচ্ছে ফেটিশ। মেয়েদের আন্ডার ওয়ার নিয়ে যৌন কল্পনা। পারলে ট্রিটমেন্ট করান, সাইকোলজিস্ট দেখান।' শামীমের ইচ্ছে হচ্ছিল বলে, 'ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। আর সাইকোলজিস্ট না, সাইক্রিয়াটিস্ট।' চুপ থাকে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার আনন্দটা পেল ওসি যখন শেষ করলেন এই বলে- 'আপনারা উচু তলায় অদ্ভুত সব ফ্যাসিনেশন নিয়া ঘোরাফেরা করেন। ক্রাইমের লেভেল পাল্টাচ্ছে দিনকে দিন। যান, বাসায় যান। আর যাওয়ার আগে এই মুচলেকাটায় সই করে যান। নাম-ঠিকানা ঠিকঠাক লিখবেন।' মুচলেকা বলতে একটা ডিমাইসাইজ সাদা কাগজ। কিছু লেখা নেই। নিচে এক কোনায় নাম-ধাম লেখে শামীম। এরপর বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে একটু বেগ কমায়। ব্রাটা নিয়ে যাবে? থাক, ভেবে জোর হাটা দেয়। সেদিকে তাকিয়ে হাসেন ওসি। ড্রয়ারে ব্রা'টা রাখতে রাখতে বলেন, 'খচ্চর। এখনো মাথায় ফাউল চিন্তা।'
পেইন্টিং : লে থমাস
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ বিকাল ৪:০৯