somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সহিংসতা ও মৃত্যু রাজনীতি: জীবনের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর তামাশা

১৭ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ৮:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যে দেশে জীবন জিয়ে না, সেই দেশের নাম বাংলাদেশ। অকালপ্রয়াত মানুষের সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে, তখনই অকাল। যে রাজ্যে অপঘাতের শক্তি জয়ী হয়, সেটাই নৈরাজ্য। আমরা নৈরাজ্যের নৈনাগরিক। নৈরাজ্যের মধ্যে নিরীহ-নিষ্পাপ জীবন বাঁচতে পারে না। যেমন বাঁচেনি নারায়ণগঞ্জের কিশোর তানভীর ত্বকী। যে ব্যবস্থা এ রকম অজস্র নিরীহ জীবনকে অপঘাত থেকে বাঁচাতে পারে না, সেই ব্যবস্থা দুর্বৃত্তের রক্ষাকবচ। জল্লাদের রক্ত ছিটানো পথে পিছল খায় যে দেশের রাজনীতি, সেই রাজনীতি ঘাতকের সহায়। সেই দেশ এক বেহাত মানচিত্র, জনগণের স্বদেশ নয়। নৈরাজ্যে নাগরিক অধিকার এক নিষ্ঠুর তামাশা মাত্র।
এই বাংলাদেশ কেউ চায় না, কে বলল? এই বাংলাদেশই গণহত্যাকারী, লুটেরা আর পিশাচ-মাফিয়ারা চায়। তারাই এই দেশের রাজা, বাদবাকি সবাই প্রজা। তারা চায় বলেই এই অকাল চলতে পারছে, তারা শক্তিমান বলেই ত্বকীর খুনিরা ধরা পড়ে না। গ্রাম ও শহরে গুলিতে আর চাপাতিতে মানুষের রক্ত ঝরে, জানকবজ হয়ে যায়। অথচ তদন্ত নেই, বিচার নেই। কোন জীবন অন্য কারও জীবনের চেয়ে বেশি মূল্যবান, কোন হত্যা বেশি জায়েজ—এই হিসাব করবে মৃত্যুর সওদাগর। জীবনের দায় তাদের থাকতে নেই। আমাদের কাছে সব মৃত্যুই সমান মর্মান্তিক। সব শোকই সমান অসহনীয়। যাঁরা বুকের ধন হারান, তাঁদের মনের ঘরে আলো কমে আসে। সব কান্নাই নোনা ব্যথার। সব মৃত্যুই মানবতার। ইংরেজ কবি জন ডানের কথায়, ‘যে কারও মৃত্যুই আমাকে খালি করে দিয়ে যায়। কেননা, আমি মানবতারই একজন। কার জন্য ঘণ্টা বাজে জানতে লোক পাঠিয়ো না, ঘণ্টা তোমার জন্যই বাজে।’ বাংলাদেশে আমরা এখন মানবতার মৃত্যুর ঘণ্টাধ্বনিই শুনতে পাচ্ছি। বধির রাজনীতি তাও শুনতে পারে না।
নতুন মৃত্যু এসে ভুলিয়ে দিচ্ছে পুরোনো মৃত্যুকে। মিরাজের মৃত্যু সরিয়ে দিচ্ছে সাগর-রুনির মৃত্যুকে। তাজরীন ফ্যাশনস ও স্মার্ট গার্মেন্টসের শতাধিক শ্রমিকের মৃত্যুর জায়গা নিয়েছে গত এক মাসের রাজনৈতিক সহিংসতার শতাধিক মৃত্যু। মতিঝিলে শিবিরের আঘাতে নিহত ব্যাংকের লিফটম্যান জাফর মুন্সি কিংবা শাহবাগমুখী মিছিলে হামলায় নিহত রামপুরার কিশোর কিংবা দেশের বিভিন্ন জেলায় সংঘাতে নিহত পুলিশ ও সাধারণ গ্রামবাসী; কিংবা মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসে হাতবোমার আঘাতে প্রাণ হারানো মানিকগঞ্জের বৃদ্ধ কৃষক মোসলেম উদ্দিন, কোন মৃত্যুর কথা বলব? হরতাল-সমর্থকদের দেওয়া আগুনে বাসের মধ্যে পুড়ে মরা মানুষদের সঙ্গে কোথায় তফাত গার্মেন্টসের বা বস্তির আগুনে পুড়ে মরা মানুষদের? জীবনে পার্থক্য থাকলেও মৃত্যুতে তারা সবাই এক। তারা বাংলাদেশে বিপন্ন সাধারণের প্রতীক। এসব নির্বিচার মৃত্যুর কোনটা জায়েজ আর কোনটা নাজায়েজ? এই পার্থক্য করতে পারে এমন কোনো মানদণ্ড কি আমাদের আছে? সব প্রাণহরণই যদি অপরাধ হয়, তাহলে সব নিহতই অপরাধের শিকার। মৃত্যু তাদের সব দোষ-গুণের ঊর্ধ্বে নিয়ে গেছে। তাদের রাজনৈতিক বা আদর্শের পরিচয় আর বড় নয়। কেননা, ‘যে কারও মৃত্যুই আমাকে খালি করে দিয়ে যায়। কেননা, আমি মানবতারই একজন।’
দুই পক্ষে তো জনগণই মরছে। তার মানে কি জনগণই জনগণকে হত্যা করছে? সরকার ও বিরোধী দল কারও হাতে রক্তের দাগ লেগে নেই? যাদের হাত দিয়ে খুন হয়, তাদের বিচারের পাশাপাশি যে রাজনীতি খুনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে, গণহত্যাকারীদের রক্ষা করে, সেই রাজনীতিরও বিচার হতে হবে। এক ঘাতক যে আরেক ঘাতকের বিচার করবে না বা করতে পারবে না, আর কত জীবনের বিনিময়ে সেই বুঝ আমাদের আসবে? তাহলে কার স্বার্থে কার জীবন যাচ্ছে সেই প্রশ্নটাই প্রধান। হত্যালীলা ছাড়া যাঁরা রাজনীতি চালাতে পারেন না, এই পোড়া দেশে তাঁদের কিসের প্রয়োজন?
একাত্তরের গণহত্যার হোতাদের মতো চলমান রাজনৈতিক হত্যার কারিগরেরা আইনের বাইরেই থাকতে চান। তাঁদের বিচারের ঊর্ধ্বে রাখার জন্য রাজনীতি আছে, দল আছে, গোপন ও প্রকাশ্য বাহিনী আছে। কেবল সাধারণ মানুষের জন্য কেউ নেই। যে রাজনীতি জীবন বাঁচায়, সুবিচার করে সেই রাজনীতি পরাস্ত। অথচ সুবিচারের দাবিতেই তো শাহবাগ জেগেছিল। সেই জাগরণও বেহাত হতে বসেছে। প্রতিবাদকে কবজা করে আপন গোয়ালে ঢোকানোর বাজিকরেরা বসে নেই। আন্দোলন তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার হাতিয়ার। নিরীহদের প্রতিবাদকে অস্ত্রে ও মিথ্যায় বিপর্যস্ত করার কারবারিরাও তৎপর। যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাঁরা সব পারেন। তাঁদের কাছে হরতালের অধিকারই গণতন্ত্র, জীবনের অধিকার বলে কোনো কথা তাঁদের অভিধানে নেই। এ অবস্থায় কেবল জীবনই ধ্বংস হয় না, ধ্বংস হয় সত্য আর শুদ্ধ মন বা ইনোসেন্স। এরাই বাংলাদেশের রাজনীতির জোড়া খুন। ত্বকীর মৃত্যুর মধ্যে এই জোড়া খুনের উল্লাসই দেখা যায়। এই উল্লাসকে মোকাবিলা করতে না পারলে বাংলাদেশে জীবন ও শান্তি কোনোটাই নিরাপদ হবে না। দ্বিদলীয় রাজনীতির দোনলা বন্দুক বাংলাদেশকে তাড়িয়েই বেড়াবে।
জনগণের জন্য লড়ার বা কাঁদার কেবল জনগণই আছে। আর আছে প্রতিটি নিহতের পিতামাতা। ইংরেজ কবি উইলিয়াম ব্লেকের কবিতায় শুনতে পাই এমনই এক পিতার হাহাকার। ছেলে বলছে পিতাকে,
‘বাবা! ও বাবা! কোথায় ছুটছ তুমি। অত তাড়াতাড়ি যেয়ো না কোথাও। কথা বলো বাবা, কথা বলো তোমার খোকার সঙ্গে। নইলে, হারিয়ে ফেলবে যে আমায়’ আর পিতা দেখছে, ‘রাত ছিল নিকষ, কেউ ছিল না বাবার মতো। শিশিরে ভিজে যাচ্ছিল শিশুটির গা। গভীর কাদার মধ্যে পড়ে ছিল সে, কেঁদেছিল শেষবার। আর উবে গিয়েছিল ভাপের মতো।’ (দ্য লিটল বয় লস্ট/উইলিয়ম ব্লেক: সংস অব ইনোসেন্স)
দিনের শেষে প্রশ্ন একটাই, ত্বকীর মতো নিরীহ-নিষ্পাপ জীবনগুলো কি বধ্যভূমির ভাপের মতো বাতাসে মিলিয়ে যাবে? রাজনীতি তাদের মনে রাখবে না, তারা কেবল না শুকানো ক্ষতের মতো রক্ত ঝরিয়ে যাবে দেশের বুকের গভীরে? রাষ্ট্রের পাষাণ মনে কি বিচারের দাবি কোনো প্রতিধ্বনি তৈরি করবে না?
ফারুক ওয়াসিফ: সাংবাদিক ও লেখক।
[email protected]
উৎসঃ প্রথমআলো
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গল্পঃ অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি

লিখেছেন ইসিয়াক, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১২

(১)
মাছ বাজারে ঢোকার মুখে "মায়া" মাছগুলোর উপর আমার  চোখ আটকে গেল।বেশ তাজা মাছ। মনে পড়লো আব্বা "মায়া" মাছ চচ্চড়ি দারুণ পছন্দ করেন। মাসের শেষ যদিও হাতটানাটানি চলছে তবুও একশো কুড়ি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগার'স ইন্টারভিউঃ আজকের অতিথি ব্লগার শায়মা

লিখেছেন অপু তানভীর, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১১:০৫



সামুতে ব্লগারদের ইন্টারভিউ নেওয়াটা নতুন না । অনেক ব্লগারই সিরিজ আকারে এই ধরণের পোস্ট করেছেন । যদিও সেগুলো বেশ আগের ঘটনা । ইন্টারভিউ মূলক পোস্ট অনেক দিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×