বেশ অনেক দিন আগে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছি ঢাকা ফিরবো বলে।পাশের আসনে এক বৃদ্ধ ধপাস করে বসলেন। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছলেন। আমি গান শুনছিলাম। উনার ঠোঁটের নড়াচড়া দেখে বুঝলাম আমাকে কিছু বলছেন। কান থেকে হেডফোন সরিয়ে উনার কথা শোনার চেষ্টা করলাম। প্রথমটুকু শুনিনি বুঝতে পেরে উনি আবার শুরু থেকেই বললেন। জানতে চাইলেন যে বিমানে ভাত খেতে দেবে কিনা। আমি বললাম, চাচা এটা সল্প দুরত্বের ফ্লাইটতো এখানে শুধু বিস্কুট জাতীয় কিছু একটা দেবে। আপনি কি ঢাকা যাবেন? জিজ্ঞেস করতেই উত্তর দিলেন, "না বাবা। আমার ছেলে ঢাকায় যাবে। বিমানের টিকেটের টাকা দিতে চাইনি বলে দুপুরে ভাত খায়নি।" বললাম, এখন তো বিমানেই যাচ্ছে তো ভাত খায়নি কেন? চাচা বললেন, "এখন খাইতে গেলে নাকি বিমান মিস করবে। তাই না খেয়েই চলে আসলো।
আমি দুর থেকে ছেলেটিকে দেখলাম। লম্বা হ্যাংলাপাতলা একটি ছেলে। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। চাচাকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম ছেলেটি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। পড়ার বিষয় জেনে একটু অবাক হলাম যে এই সাবজেক্টও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হয়? স্থানীয় সরকারি কিংবা রংপুর কারমাইকেল কলেজইতো ভাল ছিল। আজকাল এমন অনেক ছেলেপেলে দেখি স্থানীয় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে পড়া যায় এমন সব সাবজেক্ট পড়তে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা টিউশন ফি গুনছে। মাস কয়েক আগে আমাদের এলাকার এক ছেলে পরিবারের অবস্থা ভাল নয় একটা চাকরি লাগবে এই অনুরোধে ফোন করেছিল। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্স করেছে জেনে অবাকই হলাম। একাধারে বলছে পারিবারিক অবস্থা ভাল নয় অন্যদিকে বাংলা পড়তে যাচ্ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। অথচ আমাদের টাংগাইলের সা'দত বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের দুইজন শিক্ষককে চিনি যারা খুব উচ্চমানের। অন্তত ওই ছেলে যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে সেখানে ওই মানের বাংলার শিক্ষক একজনও নেই। তাহলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটা কি ফ্যাশন হয়ে গেল? বাবার সামর্থ্য আর নিজের ভবিষ্যত না ভেবে কোন রকম একটি বিষয় নিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটাই বোধহয় আজকাল কারো কারো কাছে আভিজাত্য। পছন্দের বিষয় আর সেশন জটের ভয়ে যারা পড়ছে তাদের কথা আলাদা। তবে প্রথম সাড়ির ১৪/১৫ টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিগুলোর অবস্থা খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। ভাল শিক্ষকতো দুরের কথা পর্যাপ্ত ক্লাসরুমই নেই।
যাই হোক কৌতুহলবশে মুরুব্বিকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার বুঝি বেশ টাকাপয়সা আছে? উনি বললেন না বাবা। আমার বড় ছেলে কুয়েতে থাকে। সেই ওর পড়ার খরচ আর আমাদের সংসার চালায়। বললাম কুয়েতে কি করেন উনি। চাচা বললেন, আমাদের এলাকার একজনের দোকানে কাজ করে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চাচার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ডিপার্চার গেটের দিকে এগুলাম। মনে মনে সেই কুয়েতপ্রবাসী ভাইটির জন্য কষ্টই হচ্ছিল। ঘর্মাক্ত বাবা কিংবা বড় ভাইয়ের কষ্ট না বুঝে বিলাসীতা করা এই অনুজের জন্য শংকা হচ্ছিল, এই বিমান যাত্রা কতদিন চলবে এই ভেবে। লেখাপড়াটা নাহয় কোন ছোটখাটো কলেজেই হত কিন্তু বিবেকটা বড় হলে সমস্যা কোথায় ছিল?
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০২০ দুপুর ১২:৫৫