আজ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। আজ হতে ৩৪ বৎসর পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে সকল গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থগিত করে বাকশাল কায়েম করেন। বাকশাল এমনই এক ভয়ংকর একনায়কতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি যে, বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট বাঘা বাঘা আওয়ামী লীগ নেতারাও এর দায়িত্ব নিতে আগ্রহি নন। তোফায়েল আহমদের মত নেতাকেও চ্যানেল আইয়ের তৃতীয় মাত্রায় বলতে শুনেছি, “বাকশাল পুরোটাই বঙ্গবন্ধুর নিজস্ব সিদ্ধান্তের ফসল”। অনেক আওয়ামী লীগ সমর্থক নেতা যেমন বাকশালের বিরোধীতা করেছেন, তেমনি বর্তমানে গনতন্ত্রের গান গাওয়া অনেক বড় বড় নেতা, সাংবাদিক, কালামিস্ট, বুদ্ধিজীবি সেদিন বাকশালে যোগ দিয়েছিলেন। যদিও পক্ষ বিপক্ষের সকলেই আজ নির্দ্বিধায় বঙ্গবন্ধুর উপর বাকশালের সব দায়িত্ব চাপিয়ে দেন। বাকশাল কেন এত ভয়ংকর শাসন ব্যবস্থা ছিল? বাকশাল ব্যবস্থা সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশ ওয়াকর্স পার্টির এলিট ব্যুরোর সদস্য হায়দার আকবর খান রনোর রাজনীতির কথা প্রসঙ্গে গ্রন্থ হতে উল্লেখ করছি:
বাকশাল ব্যবস্থাটা কি? এক কথায় এক ব্যক্তি নির্ভর এক দলীয় একনায়কত্বমূলক ব্যবস্থা। এর দ্বিতীয় কোন আর মানে থাকতে পারে না। এই ব্যবস্থার অধীনে এক ব্যক্তিবাদে আর কারো কোন গনতান্ত্রিক অধিকার নেই, না পার্টির অভ্যন্তরে, না দেশ পরিচালনের ক্ষেত্রে, সে কেন্দ্রীয় পর্যায়েই হোক আর স্থানীয় পর্যায়েই হোক। প্রথমে পার্টির ক্ষেত্রেই দেখা যাক। বাকশালের গঠনতন্ত্র পাঠ করলে এটা সুস্পষ্ট যে, এখানে অভ্যন্তরীন গনতন্ত্র বলতে কিছুই নেই। গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার নামে শুধু মাত্র কেন্দ্রিকতাই আছে। দলের চেয়ারম্যানই সর্ব ক্ষমতার অধিকারী। তবে মজার ব্যাপারে এই দলের চেয়ারম্যান কিভাবে নির্বাচিত হবেন, গোটা গঠনতন্ত্রের কোথাও সেটা উল্লেখ নেই। শেখ মুজিব হবেন দলের চেয়ারম্যান ও সর্বক্ষমতার অধিকারী, এটাই মোদ্দা কথা। শেখ মুজিব নেই, তার দলের (বাকশাল) অস্তিত্বও নেই। ... ... ... ... ... ...
.. ... ... চেয়ারম্যানের পরেই সবচেয়ে ক্ষমতা সম্পন্ন হচ্ছে, একজন সাধারণ সম্পাদক সহ ১৫ জন সদস্য বিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি। চেয়ারম্যান সাধারণ সম্পাদক সহ ১৫ জনকেই মনোনীত করবেন। ( বাকশাল গঠনতন্ত্রের দশম ধারার ২ উপধারা)।কেন্দ্রীয় কমিটির এক তৃতীয়াংশ চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত হবেন ( দ্বাদশ ধারার ৪ (ঙ) উপধারা)। কোন সংগঠন, সংস্থা বা কমিটির কোন সদস্য পদ শুন্য হলে, তদস্থলে চেয়ারম্যান নতুন সদস্য নিয়োগ করবেন (চতুর্বিংশ ধারা ২ উপধারা)। দলীয় কাউন্সিলে চেয়ারম্যান ৫০ জন পর্যন্ত মনোনয়ন করতে পারবেন (দ্বাদশ ধারার ১ (চ) উপধারা)। কাউন্সিলে প্রতিনিধি প্রেরণের ব্যাপারে বিভিন্ন জেলা ও অঙ্গ সংগঠনের কোটা চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত কার্যনির্বাহী কমিটি ঠিক করবে (দ্বাদশ ধারার ১ (গ) উপধারা)। তাছাড়া বিভিন্ন সরকারী বা আধাসরকারি দফতর বা প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেশন, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা এবং সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীসমূহের প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যাপারে দলের চেয়ারম্যানের ইচ্ছাই প্রধান (দশম ধারার ১০ উপধারা ও ষোড়শ ধারার ২ (খ) উপধারা)। চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলে গঠনতন্ত্রের যে কোন ধারা পরিবর্তন, সংশোধন ও পরিবর্ধন করতে পারবেন এবং একমাত্র চেয়ারম্যানই গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা দান করতে পারবেন (দ্বাবিংশতি ধারার ১ ও ২ উপধারা)। ... .
.. ... বাকশাল ব্যবস্থায় দলের সদস্য প্রাপ্তির ব্যাপারটিও দলের চেয়ারম্যানের ইচ্ছাধীন। কারণ কার্যনির্বাহী কমিটির হাতেই সদস্যপদ প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। (ষষ্ঠ ধারা ৫ (গ) উপধারা)। এই ব্যবস্থায় সরকারী ও আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীবৃন্দ এবং পুলিশ মিলিটারি সদস্যরাও দলের সদস্য হতে পারবেন। কিন্তু কে সদস্য হতে পারবেন আরে কে পারবেন না তা সম্পূর্ণ রূপে চেয়ারম্যানের ইচ্ছাধীন (দশম ধারার ১০ উপধারা)। এইসব ক্ষেত্রে কোথায় প্রাথমিক ইউনিট করার অধিকার দেওয়া হবে এবং প্রাথমিক ইউনিটের সদস্য সংখ্যা কত হতে পারবে, তা ঠিক করবে চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত কার্যনির্বাহী কমিটি
অতএব, বোঝাই যাচ্ছে বাকশাল নিতান্তই একনায়কতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতির অপর নাম। কিন্তু প্রশ্ন হল কেন বাকশাল হল? আমার বিশ্বাস, শেখ মুজিব যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিনে এই দেশে তার সমকক্ষ কেউ ছিল না। তার জনসমর্থন এমনই বিশাল ছিল, যে তার সিদ্ধান্তের বিরোধীতা করা নগন্য সংখ্যাক ব্যক্তির পক্ষেই হয়ত সম্ভব ছিল। তবে কেন তার এরূপ এক রাজনৈতিক কাঠামোর প্রয়োজন পড়ল? স্বাধীনতার ঠিক এক যুগ পরে আমার জন্ম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার বাকশালকে আমি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করছি।
----------------------------------------------->>>
ভৌগলিক দিক দিয়ে জালের মত ছড়িয়ে থাকা নদী নালা আমাদের এক অঞ্চলকে পৃথক করেছে অন্য অঞ্চল হতে। গ্রাম, গঞ্জের গন্ডি পেরিয়ে বৃহৎ সমাজ ব্যবস্থার সাথেও আমরা পরিচিত নই। ছোট্ট জগতের মাঝে নিজেকে প্রত্যেকেই রাজা মনে করি। সামগ্রিক ভাবে আমরা বাঙালিরা কেউই নিজেকে অন্যের থেকে কোন অংশে ছোট ভাবতে রাজি নই। বিধায় কোন ক্ষেত্রেই অন্যের মতামতকে গুরুত্ব দেবার প্রয়োজন বোধও করি না। ব্যতিক্রম শুধু একজন; শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির হাজার বছরের জাতীয় ইতিহাসে শেখ মুজিবের মত ব্যক্তিত্ব একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। কারন আমরা একজনকেই নিজের থেকে বড় ভেবেছি, একজনের মতামতকেউ হুকুম জেনেছি। অধীর আগ্রহে বাঙালি প্রখর সূর্যালোকে ঘন্টা ব্যাপি দাঁড়িয়ে রয়েছে, শুধু একজনের মুখে স্বাধীনতার ঘোষণা শুনবার জন্যে। তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশ এককালে পূর্ব পাকিস্তান থাকলেও মনস্তাত্বিক ভাবে আমরা কখনই পাকিস্তানি ছিলাম না। ফলাফল যে মুসলিম লীগের আহ্ববনের সাড়া দিয়ে, আমরা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে নেমেছিলাম, ভারত বিভাগের দুই বৎসর পূর্ণ না হতেই, সেই মুসলিম লীগ হতে সৃষ্টি হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ। সাধারন বাঙালি যেমন মন থেকে নিজেকে পাকিস্তানি মানতে পারেনি, শেখ মুজিবও তেমনি নিজেকে কখনই সমগ্র পাকিস্তানের নেতা বলে চিন্তা করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। তবে শেখ মুজিব নিজে যেমন কোন বিপ্লবী ছিলেন না, তেমনি তার দল আওয়ামী লীগও কোন বিপ্লবী দল ছিল না। শেখ মুজিব প্রথম সারির রাজনীতির মাঠে খেলা শুরু করেন, তার রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরে। ছয়দফা তাকে জনপ্রিয় করে তোলে এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি জনসাধারণের মাঝে নিজেকে এক অবিংসবাদিত নেতা হিসেবে দেখতে পান।
শেখ মুজিব ছিলেন নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিবিদ। তিনি কোন গেরিলা নেতা ছিলেন না কখনই। নির্বাচন, আন্দোলন, হরতাল, ধর্মঘট, মিছিল, মিটিং, এগুলোকেই কেন্দ্র করে ছিল তার রাজনৈতিক কর্মকান্ড। তার সবথেকে বড় অস্ত্র ছিল বিশাল জনসমর্থন। জনগনের মাঝে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দি। বিধায় ব্যাপক জনসমর্থনের অস্ত্র নিয়ে, একটা রাজনৈতিক পদ্ধতিতে তিনি হয়ত চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে। এজন্যই হয়তো সাতই মার্চের ভাষণে, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” ঘোষণা দেবার পরও আমরা তাকে দেখতে পাই গোলটেবিল বৈঠকে অংশ নিতে। শেখ মুজিব যদি তার রাজনৈতিক পথে চলতে সক্ষম হতেন তবে হয়ত সমগ্র পাকিস্তানের শাসক রূপে তিনি অবলীলায় ছয় দফা বাস্তবায়ন করতে পারতেন, যার ফলশ্রুতি হত রক্তপাতহীন স্বাধীন বাংলাদেশ। আর এই ছোট্ট বিষয়টা পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের আঁচ করতে কোন সমস্যাই হয়নি। ফলে আমাদের উপর নেমে আসে ২৫ মার্চের কালরাত্রি। শেখ মুজিব ও সমগ্র বাংলাদেশীর সামনে একটাই রাস্তা খোলা ছিল, আর তা হল যুদ্ধের।
শেখ মুজিব গ্রেফতার হলেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। নয় মাস যুদ্ধের পরে স্বাধীন হল বাংলাদেশ। দেশে ফিরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলেন শেখ মুজিব। মাত্র নয় মাস পরেই যুদ্ধ বিধ্বস্ত একটি দেশ চালাতে হবে এমন ধারণা হয়ত তখন শুধু শেখ মুজিব কেন, কোন বাংলাদেশীরই ছিল না। বিধায় ছিল না কোন প্রস্তুতি। প্রশাসন, শিক্ষা, পুলিশ, সেনাবাহিনী সর্বত্রই ছিল যোগ্য লোকের অভাব। বেশির ভাগ ব্যক্তিই তার যোগ্যতার চাইতে বড় দায়িত্ব কাঁধে পেলেন। ফলাফলে, ভেঙ্গে পড়ল সমগ্র ব্যবস্থা। আইন-শৃঙ্খলা, দ্রব্যমুল্য সব কিছুর অবস্থা তখন নাজেহাল। সেই সাথে তিনি আভাস পেলেন বিদেশী ষড়যন্ত্রের।
এহেন পরিস্থিতিতে শেখ মুজিবের শুরু করতে হয় আর একটি যুদ্ধ। সেটা হল দেশ চালাবার যুদ্ধ। আর যুদ্ধে যেটা একেবারেই অচল, তা হল গনতন্ত্র। আমরা চিন্তা করতে পারি কি, যুদ্ধ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে সেনাপ্রধান সৈন্যদের থেকে ভোট নিচ্ছেন আক্রমন করা হবে কি হবে না! এহেন পরিস্থিতি যেমন হাস্যকর, তেমনি ভয়ংকর। বিধায় গনতন্ত্র স্থগিত করা ছাড়া, শেখ মুজিবের আর কোন উপায় ছিল বলে মনে হয় না। হয়ত, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে এলে তিনি আবার দেশকে ফিরিয়ে নিতেন গনতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। কিন্তু সে কথা বলে আর লাভ কি? ইতিহাস তাকে সে সুযোগ দেয় নি। সেই সাথে তার ভুলও ছিল। একাত্তর পরবর্তী শেখ মুজিবের সব থেকে বড় ভুল ছিল তার চারিদিকে গড়ে উঠা কুচক্রি মহলকে চিনতে না পারা। তাজউদ্দিন আহমদ মন্ত্রী সভার বাইরে এবং খন্দকার মোশতাক মন্ত্রী সভায় থাকাটাই এর সবথেকে বড় প্রমান।
দুঃখের বিষয় আমরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে এখনও শিখলাম না। ইতিহাসের ঘটনাগুলোকে ব্যবহার করে সাময়িক সুবিধা লাভই আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাদের মূল লক্ষ্য। যার ফলশ্রুতিতে আজ রাজনীতিবিহীন এক আজব ও অস্থির পদ্ধতিতে আমাদের দেশ পরিচালিত হচ্ছে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০০৯ বিকাল ৩:৩৩