somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বড় গল্পঃ দ্য আনএক্সপেক্টেড ব্রাইড (পর্ব দুই)

১১ ই জানুয়ারি, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রথম অংশ


তিন

অরিন নোরার দিকে কিছুটা সময় কেবল অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো । একটু আগেই নোরা হলে ফিরেছে । একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা অরিনকে বলবে কি না সেটা নোরা কিছু সময় ভাবলো । তারপর মনে হলে এ আর এমন কি ! বরং বলেই দেওয়া যাক ।
যখন সব টুকু বলে শেষ করলো অরিনের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল যে নোরা হয়তো ওর সাথে ঠোট্টা করছে । কিন্তু যখন বুঝলো যে নোরা মোটেই ঠোট্টা করছে তখন চিৎকার দিয়ে উঠলো ।
অরিনের উত্তেজনা যেন আর শেষই হয় না । নিজেকে কোন মতে শান্ত করে বলল, কিভাবে হল এই সব ?
নোরার নিজেরও জানা নেই কেমন করে এসব কিছু হল । নোরা কেবল জানে যে এই আদনান চৌধুরী ওকে ডিনারে আমন্ত্রন জানিয়েছে । তার ধারনা হয়েছে যে নোরা তার বড় কোন উপকার করেছে । এখন কি যে উপকার করেছে সেটা সে জানে না । আদনান চৌধুরী সেটা এখনও বলে নি । দেখা যাবে নোরাকে সে যখন বলছে সেটা নোরা করেই নি । তখন কি হবে ?
নোরা ঠিক করেছে আগে ডিনারটা খেয়ে নিক । পরেরটা পরে দেখা যাবে ।
অরিন বলল, আচ্ছা তোকে কি একাই ডেকেছে ? দেখ তোর সব কাজের সঙ্গী তো আমিই । আমি যদি সাথে যাই । কেমন হয় ?
নোরা হেসে ফেলল । যেখানে ও নিজেই জানে না কেন ওকে ডিনার করাতে চাচ্ছে, হয়তো যেকোন সময় তার অফিস থেকে কেউ ফোন করে বলবে, শুনুন মিস নোরা আমাদের একটা ভুল হয়েছে । আমরা আসলে অন্য কাউকে আপনার সাথে গুলিয়ে ফেলেছিলাম । আপনি সেই মানুষটা নন । আপাতত আপনাকে আমরা ডিনার খাওয়াতে পারছি না !

কিন্তু সেটা আর হল না । শুক্রবার যাওয়ার কথা ছিল । শুক্রবার সকালে ওর ফোনে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন এসে হাজির । ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো, গুড মর্নিং মিস নোরা । আপনি কেমন আছেন ?
নোরা জিজ্ঞেস করতেই যাচ্ছিলো কে বলছেন তবে শেষ মুহুর্তে আর করলো না । মানুষটাকে সে চিনতে পেরেছে । আদনান চৌধুরীর সেক্রেটারি কামাল ।
নোরা বলল, বলুন কামাল সাহেব !
কামাল বলল, আপনি কি একটু আপনার হলের গেটে একটু আসবেন ?
-এখন ?
-জি । আজকে রাতে আপনার ডিনারের সিডিউল আছে ! মনে আছে নিশ্চয়ই ।
-জি মনে আছে ।
-আপনি একটু দয়া করে নিচে নেমে আসুন । স্যার আপনার জন্য কিছু উপহার পাঠিয়েছে ।
-উপহার ?
-জি । মানে আজকে আপনি কোন ড্রেস পরে যাবেন সেই ড্রেস !

নোরা এবার সত্যিই বেশ অবাক হল । ডিনারে দাওয়াত দিয়েছে সেটা না হয় বুঝা যাচ্ছে । কিন্তু তাই বলে একেবারে ড্রেস পাঠিয়ে দিবে ! এটা আবার কেমন কথা ! তবে নোরা কিছু বলল না । কামালের কথা মত নিচে নেমে এল । কামাল নোরার হাতে একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিল । তারপর বলল, এখানে দুইটা ড্রেস রয়েছে আজকের ডিনারের জন্য । আপনার যেটা ইচ্ছে সেটাই পরবেন ।
-আর অন্যটা ?
-ওটাও আপনার । স্যার নিজে পছন্দ করে কিনেছেন !

নোরা হঠাৎ কামালকে বলল, আচ্ছা আপনার কি মনে হচ্ছে না যে আপনার স্যার একটু অস্বাভাবিক আচরন করছেন ?
কামাল প্রথমে ঠিক বুঝতে পারলো না নোরা ঠিক কি বলতে চাইছে । তারপর বলল, আসলে আমি নিজেও খানিকটা কনফিউজড । তবে এর পেছনে একটা যুক্তিযুক্ত কারন আছে ?
-কি সেই কারন ?
-আমি বলতে পারবো না । স্যার আপনাকে নিজেই বলবেন । ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় গাড়ি এখানে এসে থামবে । আপনাকে নিয়ে যেতে । ঠিক আছে ?
-আচ্ছা !

ব্যাগটা নিয়ে নোরা হলের ভেতরে চলে গেল । তবে ব্যাগটা সে খুললো না । খুলে দেখলোও না যে ভেতরে কি ধরনের পোশাক দেওয়া আছে । ব্যাপারটা ডিনার পর্যন্ত ঠিকই আছে । কেউ যদি কাউকে ডিনারে আমন্ত্রন জানায় তাহলে সেটা গ্রহন করা যায় । কিন্তু এই ভাবে কারো কাছ থেকে উপহার গ্রহন করাটা নোরার একদমই পছন্দ না । ও যাা আছে সেটা পরেই ও ডিনারে যাবে বলে ঠিক করলো ।

সন্ধ্যা বেলা নোরা একটা সাদা রংয়ের কামিজ পরলো । সাদা লেগিংসের সাথে সাদা ওড়না । নোরা দেখতে খুব সুন্দরী না হলেও ওর চেহারার মাঝে একটা কোমল স্নিগ্ধ ভাব আছে । প্রথম দেখাতেই মানুষের পছন্দ হয়ে যাওয়ার মত । আর সাদা পোশাকে ওর ভেতরের এই মায়াময় ভাবটা আর বেশি ফুটে ওঠে ।

গেট দিয়ে যখন বের হল কামাল ওকে দেখেই চোখ কপালে তুলে বলল, কি ব্যাপার আপনি স্যারের দেওয়া ড্রেসটা পরেন নি কেন ?
নোরা খুব স্বাভাবিক ভাবে সেই ড্রেসের ব্যাগটা কামালের হাতে দিয়ে বলল, কারন আমি এটা পছন্দ করছি না ।
-মানে ? আপনার ড্রেস পছন্দ হয় নি ?
-আমি ব্যাগটা খুলেই দেখি নি । আমমি উনার ডিনার প্রোপোজাল গ্রহন করেছি । কিন্তু এই উপহার গ্রহন করি নি ।
-স্যার খুব রাগ করবেন । আসলে সব কিছু স্যারের মন মত না হলে স্যার খুব রাগ করেন ।
-সেটা আমার দেখার ব্যাপার না । আমি তার এম্লোয়ী নই । তার রাগের ধার ধারবো কেন ?

কামাল কিছু সময় কেবল নোরার দিকে তাকিয়ে রইলো । কেউ যে তার স্যার সম্পর্কে এমন ভাবে কথা বলতে পারে সম্ভবত এটা তার ধরনার বাইরে ছিল । নোরা বলল, গাড়িতে কি উঠবো নাকি ফেরৎ যাবো !
-এ্যা !! না না উঠুন প্লিজ ! আপনাকে না নিয়ে গেলে আমার খবর আছে ! চলুন প্লিজ ! তবে স্যার যদি কিছু জিজ্ঞেস করে ড্রেস সম্পর্কে তাহলে বলবেন যে আপনি ইচ্ছে করে সেটা পরেন নি ! ঠিক আছে !
নোরা এই কথার কোন জবাব দিল না । নিজেই গাড়ির দদরজা খুলে ভেতরে গিয়ে বসলো । কামাল উঠে এল একটু পরেই । তবে তার সাথে নয় । কামাল বসলো সামনে সিটে ।

নোরা এর আগে প্যানপ্যাসিফিকে এসেছে একবার । তবে কোন ডিনার প্লান করার জন্য নয় । ওদের ডিপার্টমেন্ট থেকে একটা বিদেশী সেমিনার এটেন করতে । ভাল স্টুডেন্ট হওয়ার কারনে তাহমনিনা ম্যাম ওকেই সিলেক্ট করেছিলো ম্যামের এসিস্ট্যান্ট হওয়ার জন্য । সেই একবারই শেষ । আর এর ভেতরে ঢোকা হয় নি ।

আজকে যখন গাড়িটা ভেতরে প্রবেশ করলো নোরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো স্যুট টাই পরা এক মাঝ বয়সী ভদ্রলোক ওর দিকে এগিয়ে এল । ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ওয়েলকাম ম্যাম ! আমি এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার রকিবুল হাসান । আসুন ! স্যার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন ।
নোরার একটু অস্বস্থি লাগা শুরু করেছে । সত্যিই এমনটা ও আশা করে নি । আর নোরা যে আসবে এই লোকটা কিভাবে জানলো ! ওকে চিনলোই বা কিভাবে ?
অবশ্য ওর সাথে কালাম রয়েছে । তাকে দেখেই চিনতে পেরেছে হয়তো । একটা বড় লবি পার করে ডান দিকে ওরা হাটতে লাগলো । ম্যানেজারের আগে আগে হাটতে থাকা এক বেয়ারা একটা বড় দরজা খুলে দিল । সেটা দিয়ে নোরা প্রবেশ করলো । তবে ম্যানেজার কিংবা কামাল কেউ ই ওর সাথে এল না ।

নোরা ভেতরে তাকিয়ে দেখলো ভেতরে বেশ বড় একটা রুম । ওর হলের ক্যান্টিনের সমান । পুরো রুমের ভেতরে কেবল একটা টেবিল পাতা রয়েছ । টেবিলের দুই পাশে দুটো চেয়ার । আর কিছু নেই । পুরো রুমটা একেবারে ফাঁকা !

একটা চেয়ারে আদনান বসে আছে । ওর দিকে চোখ পড়তেই আদনান উঠে দাড়িয়ে এগিয়ে এল । নোরা বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো । আজকেও আদনান স্যুট পরে নি । ক্যাজুয়াল ড্রেস পরেছে । ওর মত সাদা রংয়ের একটা গেঞ্জি পরেছে । সেই সাথে গাঢ় নেভিব্লু রংয়ের প্যান্ট । পায়ে একটা লোফার । একবার চোখ পড়লে সহজে চোখ সরানো যায় না । নোরা জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা দুর করে দিল । বারবার নিজেকে বোঝালো যে নিজের বাউন্ডারী কোন ভাবেই যেন পার না করে ! এটা কেবলই একটা ডিনার আর এর পরে হয়তো আর কোন দিন এই ছেলের সাথে ওর দেখাও হবে না ।

আদনানের সামনে আসতেই নোরা বড় করে এক দম নিল । নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, সরি আপনার পাঠানো ড্রেসটা পরি নি ।
আদনান হাসলো । তারপর বলল, আমি জানি । বুঝতে পারছি কেন পরেন নি । ইটস ওকে । এই সাদাতে আপনাকে চমৎকার লাগছে ।

তারপর নোরাকে আরও অবাক করে আদনান নোরার বসার চেয়ারটা টেনে দিল । নোরার কাছে সত্যিই ব্যাপারটা স্বপ্নের মতই মনে হল। এমন একটা স্বপ্নের ডিনার যে কোন মেয়েই স্বপ্ন দেখে । তাও আবার আদনান চৌধুরীর মত কারো মানুষের কাছ থেকে ।

নোরা বলল, এতো বড় হলরুমে আমরা কেবল দুজন ?
-আই ডোন্ট লাইক টু বি ডিস্টার্ব । পুরোটা বুক করা হয়েছে ।
-কেবল আমার জন্য ?
-হ্যা মিস নোরা । কেবল আপনার জন্য ।
-আসলে আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না । আমি ....
আদনান হাসলো । তারপর বলল, বুঝতে পারবেন যথা সময়ে । এতো তাড়াহুড়ার কিছু নেই । আসুন আমরা খাওয়া দাওয়া শুরু করি । কি অর্ডার দিবো ।
এই বলে একটা হাত তুললো । কার দিকে হাত তুললো কে জানে নোরা দেখতে পেল সেই রকিবুক হাসান এসে হাজির হল মেনু কার্ড নিয়ে । ওর দিকে কার্ডটা বাড়িয়ে দিল ।
নোরা কি অর্ডার দিবে সে কিছুই জানে । কার্ডে যা যা খাবারের নাম লেখা আছে তার বেশর ভাগই ওর অচেনা । কোন দিন নামই শুনে নাই ।
আদনান বলল, সিলেক্ট করতে সমস্যা হচ্ছে ?
নোরা একটু লজ্জিত ভাবে হাসলো । তারপর বলল, আসলে এই ধরনের খাবার খেয়ে আমি অভ্যস্ত নই । বুঝতেই পারছেন ।
আদানান হাসলো । তারপর রকিবুল হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, দেশীর ভেতরে কিছু চমৎকার আইটেম নিয়ে আসুন । আমরা চেষ্টা করে দেখি ।
-সিওর স্যার !

রকিবুল হাসান চলে যেতেই আদনান বলল, তারপর আপনার পড়াশুনা কেমন চলছে ? বুকস্টোরের ঐ চাকরিটা ভাল লাগে ?
নোরা বলল, আসলে পড়াশুনা ভালই চলছে । আর ঐ চাকরিটা সত্যিই আমি খুব পছণ্দ করি । সারাটা সময় বইয়ের ভেতরে থাকাটা একটা আনন্দের ব্যাপার ! চাকরিটা আসলে আমি করি টাকার জন্য নয় । সারাটা সময় বইয়ের ভেতরে থাকতে পারছি এই জন্য ।
আদনান বলল, আপনি বই অনেক পছন্দ করেন, তাই না ?
-অনেক ।
-আমাদের বাসায় বেশ বড় একটা লাইব্রেরি আছে ।
-তাই নাকি ? আপনিও খুব বই পড়েন বুঝি । ঐদিন তো দেখলাম অনেক বই কিনলেন ।
-আসলে আমি খুব একটা বই পড়ি না ।
-তাহলে ঐদিন যে দেখলাম যে অনেক বই নিলেন !

আদনান হঠাৎ ই কোথায় যেন হারিয়ে গেল । কিছু যেন ভাবছে । নোরার মনে হল ও এমন কিছু বলেছে যেটা আদনানকে অন্য কোথায় নিয়ে গেছে । ও কি এমন কথা বলে দিল !!
আদনান তারপর বাস্তবে ফিরে এল । নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, সরি অন্য কিছু ভাবছিলাম । হ্যা যা বলছিলাম । একদিন আপনাকে আমাদের লাইব্রেরিটা দেখাবো । দেখবেন কত বই আছে । বেশির ভাগই পড়া হয় নি ।
নোরা এই প্রশ্নটা করতে গিয়েও করলো না । অবশ্য একটু পরেই খাবার চলে এল ।

নোরা যা যা খাবার খেল তার বেশির ভাগই পছন্দ হল না । অদ্ভুত সব স্বাধ খাবার গুলোর । কিন্তু মুখে কিছু বলল না । চুপচাপ খাবার খেয়ে গেল । ডিনার শেষ করে নোরা আদনানকে বলল, এবার কি বলবেন আমি আপনার ঠিক কি উপকার করেছিলাম যার কারনে আমাকে এতো চমৎকার একটা ট্রিট দিলেন ?
আদনান বলল, শুনবেনই ?
-হুম । আমি এই চিন্তাই রাত দিন ধরে করছি । কিছুতেই বের করতে পারছি না ।
আদনান বলল, আমি না বলে বরং আপনাকে দেখাই । কি বলেন ?
-দেখাবেন ?
-চলুন । আশা করি একটু দেরি হলে আপনার খুব একটা সমস্যা হবে না । বেশি সময় লাগবে না ।
নোরা কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । তবে ব্যাপারটা না জেনে গেলে ওর মনে কোন দিন শান্তি আসবে না । তাই সে রাজি হয়ে গেল । আদনানের সাথে আবারও গাড়িতে গিয়ে বসলো । ঠিক মিনিস বিশেক পরে গাড়ি থেকে নেমে নোরা বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গেল । একটা তিনতলা বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আছে ওরা । কাউকে বলে দিতে হল না, নোরা ঠিকই বুঝতে পারছে যে এটা আদনানদের বাসা । ওকে এখানে কেন নিয়ে এল সে ? কি দেখাবে ?

চার

নোরা কিছুটা সময় বাড়ির সামনে দাড়িয়ে রইলো চুপ করে । ওর মাথায় এখনও ঠিক ঢুকছে না ঠিক কি দেখাতে নোরাকে আদনান এই বাসায় নিয়ে এল !
নোরার চোখে বিস্ময়টা আদনানের চোখ এড়ালো না । সে নোরাকে অভয় দিয়ে বলল, ভয় পাবেন মিস ! আপনি ভেতরে গেলেই বুঝতে পারবেন আসলে ঠিক কি কারনে আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি । আসুন আমার সাথে !

নোরা আর কিছু না বলে আদনানের পেছন পেছন হাটতে লাগলো । ওর মাথার ভেতরে আসলেই কিছু ঢুকছিলো না । আদনান চৌধুরীকে সম্পর্কে সে যা যা শুনে এসেছে আসলে তার কিছুই মিলছে না । বাজারে আদনান সম্পর্কে যা যা খবর ঘুরে বেড়াচ্ছে তার কিছুই সে মিলাতে পারছে না । অনেক খবরের মাঝে একটা খবর হচ্ছে আদনান চৌধুরী তার ধারে কাছে একদমই মেয়েদের ঘেষতে দেয় না ।
অন্য সব স্থানে মেয়েদের বেলাতে একটু ছাড় থাকলেও তার বেলাতে ঠিক উল্টো । তার অফিসের মেয়েদের কোন ভুল পেলেই তার জীবন অতিষ্ঠ করে ছেড়ে দেয় ।
এই নিয়ে অনেকের ধারনা জন্মেছে আদনান চৌধুরী ঠিক স্বাভাবিক না । অনেকে মনে করে সে সমকামী ! কি হাস্যকর একটা মনভাব সবার ।

কিন্তু দেখা হওয়ার পর থেকে নোরা কেবল অবাকই হচ্ছে । আদনান চৌধুরী তার প্রতি কোন কারনে খুব নমনীয় আচরন করছে । এটাতে সে অবশ্যই তার এম্লোয়ী কামালকে পর্যন্ত অবাক হতে দেখেছে সে । এটার পেছনের কারন টা কি নোরা সত্যিই বুঝতে পারছে না । আজকে হয়তো জানা যাবে ।

বিশাল ড্রয়িংয়র ভেতরে প্রবেশ করলো ওরা । নোরা দেখতে পেল দুজন মেইড ছুটে এল ওদের দিকে । আদনান অবশ্য ওদের দিকে ঠিক তাকালোও না । নোরাকে দোতালাতে নিয়ে গেল । একটা ডান দিকের কোনার দিকের একটা ঘরের দরজার সামনে এসে থামলো । দরজা সাবধানে খুলল । নোরা ভেতরে ঢুকে চোখ বুলালো চারিদিকে । ঘরটা খুব বেশি বড় নয় । দেওয়া সাদা রং করা । ঘরে খুব বেশি আসবার পত্রও নেই । একটা টেবিল রয়েছে । সেখানে নানান ঔষধ রাখা । তার পাশে দেওয়ালের সাথে সেট করা একটা টিভি । সেটা এখন বন্ধ । তার পাশে দুইটা টুল । দুই টুলের একটা ফাঁকা অন্যটাতে এতো সময় এক কম বয়সী নার্স বসে ছিল । ওদের দেখেই উঠে দাড়িয়েছে । আর উল্টো দিকে একটা সিঙ্গেল খাট । সেখানে এক মাধ বয়সী মহিলা শুয়ে আছে ।

মহিলার চেহারার দিকে তাকাতেই নোরার হঠাৎ করেই সব কিছু মনে পড়ে গেল । এই মহিলাকে সে আগেও দেখেছে । একবার মহিলার দিকে আরেকবার আদনানের চেহারার দিকে তাকালো সে । এই ভদ্রমহিলা যে আদনানের মা সেটা বলে দিতে হল না । আদনান বলল, কিছু মনে পড়ছে কি ?
নোরা মাথা নাড়ালো । তার মনে পড়ছে ।
মাস খানেক আগের কথা । বনানীতে একটা কাজে যেতে হয়েছিলো ওকে । সেখান থেকে ফেরার সময়ই রাস্তার পাশে এই মহিলাকে দেখতে পায় সে । কেমন উদ্ভান্তের মত হাটছিলো । এমনিতে ঢাকা শহরে পাগলের কোন অভাব নেই । পারত পক্ষে নোরা এই সব দিকে খুব বেশি একটা নজর দেয় না । কিন্তু সেদিন নজর না দিয়ে পারে নি । কারন ছিল মহিলার শরীরের পোশাক । ভদ্র গোছের পোশাকের দিকে তাকিয়ে ছিল সে । পা খালি । মুখটা কেমন শুকনো মনে হচ্ছিলো । ও কাছে এগিয়ে গেল । ওকে দেখেই মহিলা ওর চেহারার দিকে বেশ কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । মনে হল যেন ওকে চেনার চেষ্টা করছে ।
নোরার মনে হল মহিলা সম্ভবত কিছু খেতে চাইছে । মুখটা শুকনো ছিল । সকাল থেকে সম্ভবত কিছু খায় নি । নোরার কি মনে হল নোরা বলতে পারবে না, নোরা মহিলার হাত ধরলো । তারপর তাকে পাশের একটা ফার্স্ট ফুডের দোকানে নিয়ে গেল ।

নোরার সাথে সাথেই ভদ্রমহিলা শান্ত ভাবে হেটে সেই দোকানে ঢুকলো । নোরার কিনে দেওয়া খাবারও খেল একেবারে চুপচাপ । যেন কোন শান্ত বাচ্ছা তার মায়ের কথা মত সব করছে । নোরা তারপর মহিলাকে একজোড়া স্যান্ডেলও কিনে দিল পাশের এপেক্স থেকে । নোরার বুঝতে আসলে অসুবিধা হচ্ছিলো না যে মহিলার মাথায় কিছু একটা সমস্যা আছে । সে স্বাভাবিক নয় ।

নোরারও কেন মহিলার উপর এমন মায়া জন্মালো সেটা নোরা নিজেও জানে না । বিশেষ করে নোরার দিকে যখন সে তাকিয়ে ছিল সেই দৃষ্টিতে আদ্ভুত মায়া ছিল । নোরা চাইলেও সেটা পাশ কাটিয়ে যেতে পারছিলো না । এই ভাবে মহিলাকে রাস্তায় রেখে চলে যেতে মন চাইলো না ওর । তখন মনে হল যে ওর পরিচিত একটা বৃদ্ধাশ্রম আছে । সেখানেই মহিলাকে রেখে আসবে । কিন্তুদিন সেখানেই থাকুক অন্তত ।

কিন্তু সেটা আর করতে হল না । নোরা যখন সিএনজির জন্য দাড়িয়ে আছে তখনই একটা কালো গাড়ি এসে থামলো ওর সামনেই । গাড়ি থেকে হুড়মুড় করে কিছু মানুষ নামলো । সবাই কোট টাই পরা । তাকিয়ে আছে মহিলার দিকে ।
একজন ফোনে কাকে যেন বলছে, জি স্যার ম্যাডাম কে পাওয়া গেছে । আমাদের সামনেই আছে ।

একজন নোরার দিকে এগিয়ে এসে বলল, উনার মাথায় একটু সমস্যা আছে । কাউকে ঠিক চিনতে পারে না । বাসা থেকে বের হয়ে গেছে আজকে সকালে ! আমরা খুজে খুজে হয়রান !

নোরা একটু স্বস্থিবোধ করলো । নোরা বলল, আমারও ওনার চেহারা দেখে তাই মনে হয়েছিলো । ওনাকে এক বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যাচ্ছিলাম ।
-তার আর কোন দরকার হবে না । আপনাকে অনেক ধন্যবাদ !
নোরা তখন বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বলল, খালাম্মা আপনি উনাদের সাথে যান । আপনাকে বাসায় নিয়ে যাবে !
বৃদ্ধা তখন নোরার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, তুই যাবি না আমার সাথে ?
নোরা হাসলো । তারপর বলল, আমি আসবো পরে । আপনি যান !
-আসবি কিন্তু ! আর ফাঁকি দিবি না !
নোরা আবারও হাসলো । তারপর বলল, আচ্ছা আসবো ! আপনি চিন্তা করবেন না ।

নোরা এইবার বুঝতে পারলো কেন আদনান চৌধুরী নোরার প্রতি এতো নমনীয় । নোরা না জেনেই আদনানের মায়ের উপকার করেছিলো । এটারই প্রতিদান সে দিতে চাচ্ছে । আদনান বলল, আপনাকে খুজে পেতে একটু সমস্যা হয়েছে । তবে খুজে পেয়েছি শেষ পর্যন্ত !
নোরা বলল, আমাকে খোজার জন্য এতো কিছু করার দরজার ছিল না । আমি বাদ দিয়ে অন্য কেউ হলে সেও এমনটা করতো !
-মোটেও করতো না । আর আপনাকে খুজে বের করার পেছনে আরেকটা কারন কি জানেন?
-কি ?
আদনান একটু সময় মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল, গত এগারো বছর পরে আমার মা কথা বলেছে । আপনাকে যে দুইটা কথা সে জানতে চেয়েছে সেই দুইটাই ছিল তার ১১ বছর পরে বলা কথা !
নোরা খানিকটা অবাক চোখেই তাকিয়ে রইলো আদনানের দিকে । মানুষটার চোখে কেমন পানি টলমল করছে ।
আদনান বলল, আমি আসলে .....

নোরা বলল, আপনাকে কিছু বলতে হবে না আর । আমি বুঝতে পারছি । তা এরপর আর কথা বলেছিলো ?
-না আর বলে নি অবশ্য ।

তখনই ভদ্রমহিলা জেগে উঠলো । নোরার দিকে সরাসরি তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । একভাবে তাকিয়েই রইলো কেবল । নার্স মেয়েটি বলল, স্যার রাতের ঔষধ খাবার সময় হয়ে গেছে ।
আদনান বলল, আচ্ছা । আমরা যাচ্ছি তুমি খাওয়াও । মিস নোরা আসুন । আপনাকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসি !
নোরা দরজার দিকে পা বাড়ালো । যখনই দরজার বাইরে পা দিতে যাবে তখনই কিছু একটা মেঝেতে পরা আওয়াজ শুনতে পেলো । তাকিয়ে দেখলো একটা ঔষধের বোতল মেঝেতে পরে আছে ।
আদনান আবারও ঘরের দরজার কাছে এল । নোরাকে বলল, কিছু খেতে চায় না । অনেক কষ্ট করে খাওয়াতে হয় !
নোরার সাথে সেদিন খুব শান্ত ভাবে খেয়েছিলো । কোন প্রতিবাদ করে নি । নোরার হঠাৎ কি মনে হল । সে আদনানকে বলল, আমি কি চেষ্টা করে দেখবো ?
আদনান যেন এই কথাটাই বলতে চাচ্ছিলো তবে বলতে পারছিলো না অস্বস্তির কারনে । বলল, শিওর !

সবাইকে অবাক করে দিয়ে আদনানের মা খুব স্বাভবিক আর বাধ্য মেয়ের মত নোরার হাত থেকে ঔষধ খেয়ে নিল । রাতে নোরা তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন ! নোরা যখন আবার রুম থেকে বের হয়ে এল দেখতে পেল ড্রয়ং রুমে আদনানের সাথে আরেক ভদ্রলোক বসে আছে । ওকে দেখেই বলল, তুমিই তাহলে নোরা ?
-জি !
-আমি আদনানের বাবা !
-আসসালামু আলাইকুম আংকেল !
-ওয়ালাইখুম আসছালাম ! বস রাতের খাবার খেয়ে যাও ।
নোরা হাসলো । বলল, আংকেল আমি খেয়েই এসেছি ।
-ও আচ্ছা আচ্ছা ! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম । বয়স হয়ে তো অনেক কিছু মনে থাকে না । যাই হোক । তোমার একটা ঋণ আমাদের উপর রয়েই যাবে । যাক সে কথা । আদনান ওকে বাসায় পৌছে দিয়ে আয় ।

যখন গাড়িট গেট দিয়ে গাড়িটা বের হচ্ছিলো নোরা বাড়িটার দিকে ফিরে আরেকবার তাকালো । ওর কেন যেন মনে হতে লাগলো এই বাসায় ওকে আরও অনেক অনেক বার আসতে হবে !


ছবি উৎস



সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ২:২৭
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×