তখন বাংলা লায়নের মডেম কিনেছি । সেই সময়ে ইন্টারনেট এতো চমৎকার ছিল না । বিশেষ করে ওয়াইফাইয়ের ব্যাপারটা ছিল না এখনকার মত । ব্রডব্যান্ড প্রোভাইডারেরা তখন সার্ভিস দিত ৮০ কিলোবাইটের প্যাকেজ । জিপিতে নেটে তখন পাওয়া যেত ৩০/৪০ কিলোবাইট পার সেকেন্ড স্পিড । সেই সময়ে বাংলালায়ন আর কিউবি দ্রুত গতির ইন্টারনেট নিয়ে এল । সেই সময়ের কথা বলছি । পিসিতে এই মডেম লাগিয়ে মনে হল যেন আকাশ হাতে পেয়েছি । ইউটিউবে ভিডিও দেখতে পাচ্ছি কোন প্রকার বাফারিং ছাড়াই । কদিন এভাবেই কাটতো । তখনও ইন্টারনেট থেকে আয়ের ব্যাপারটা এতো জনপ্রিয়তা পায় নি । তবে ভাসা ভাসা শোনা যাচ্ছে । ব্লগ থেকে আয় করা যায় কিভাবে এই কথা রুমমেটের কাছ থেকে শুনে আমি গুগলে সার্চ দিলাম ব্লগ লিখে ।
বাংলায় এই টার্ম সার্চ দিলে কি আসবে সেটা সবারই জানা । সামু এসে হাজির হল । কদিন ঘুরে বুজলাম যে এই সাইট থেকে টাকা পয়সা আয়ের কোন উপায় নেই । কিন্তু একটা তীব্র আগ্রহ জন্মে গেছে ততক্ষনে । চট জলদি একটা একাউন্ট খুলে ফেললাম । তবে তখনও কিছুই লেখা লেখি করা হয় নি । কারণটা হচ্ছে কিবোর্ডে তখনও বাংলা লেখার হাত একদমই আসে নি । আমার মনে আছে যে আমার সামুর প্রথম দিকের বেশ কিছু পোস্ট আমি লিখেছি ভার্চুয়্যাল কিবোর্ড দিয়ে । মানে হচ্ছে মাউস টিপে টিপে লিখলাম একেকটা অক্ষর । কত সময় লাগতো সেটা বুঝতেই পারছেন ।
তারপর আরেকটা বুদ্ধি এল । আমার তখন ছিল নোকিয়া ২৭০০ ক্লাসিক । সেই মোবাইলের নোটপ্যাডে আমি অনেক কিছু লিখে রাখতাম । আমি তখন সেই নোট প্যাডে বাংলা লিখতাম । সেই লেখা পিসিতে নিয়ে তারপর সেটা পেস্ট করতাম সামুতে । এইভাবে প্রচুর লেখা সামুতে পোস্ট করেছি । এভাবে আস্তে আস্তে অবশ্য সামুর রাইটিং বক্সে লেখার একটা অভ্যাস হয়ে গেল । লেখার গতি বেড়ে গেল অনেক গুনে । তারপর মোবাইলে লেখা কমে গিয়ে সামুর রাইটিং বক্সেই লেখা হতে লাগলো । সামুর রাইটিং বক্সে লিখতে লিখতে এমন একটা অভ্যাস হয়ে গেল যে এর পরের সময়ে আমার সব লেখা তা সেটা যেখানের জন্যই হোক না কেন, লেখা যদি ১০/১২ লাইনের বেশি হয় তা আমি সব সময় লিখেছি সামুর এই বক্সে । তখন থেকে আমার সব বাংলা লেখা এই সামুর রাইটিং বক্সেই । সামুতে লেখা প্রকাশ করি কিংবা না করি লেখা হয়েছে এখানেই। এই লেখায় একটা শান্তি আর আরাম আছে যা অন্য কোথাও আমি পাই নি । সত্যি বলতে কি সামুতে দশ বছরের লম্বা সময় টিকে থাকার পেছনে এই রাইটিং বক্স অন্যতম একটা কারণ ।
সামুতে আমি মূলত ছিলাম পাঠক হিসাবেই । সেই সময়ে আমি ঘন্টার পর ঘন্টা পোস্ট পড়েছি । বেশি ভাগই গল্প আর ফিচার । কী দারুন সব লেখা আসতো তখন । একটার পর একটা পোস্ট আসতেই থাকতো । তখন নতুন । কি বলে কি বলবো সেই ভয়ে মন্তব্য করতাম না । আমি পড়ে শেষ করতে পারতাম না । সত্যিই বলতে কী আমি আমার প্রেমিকার পেছনে এতো সময় কোন দিন দেই নি যতটা সময় না আমি সামুর পেছনে দিয়েছি । যদি কোন প্রেমিকার পেছনে আমি এই এতো সময় দিতাম নিশ্চিত ভাবে সে আমাকে ছেড়ে যেত না কোন দিন ।
সামুতে আর আগের মত মানুষ আসে না । এই যে আমি এখন সামুতে লিখছি প্যারা করে । গ্রামের বাসায় এসেছি গতরাতে । এখানে মোবাইল নেট ছাড়া উপায় নেই । আর মোবাইল নেট দিয়ে আমি সামুতে ঢুকতে পারছি না । আমাকে টর ব্রাউজার দিয়ে ঢুকতে হচ্ছে । অনেকেই এই কারণে সামুতে আসতে পারে না । আমি যখন কোন গল্পের লিংক আমার ফেসবুক পেইজে শেয়ার দিই তখন ইনবক্সে অনেকে এই অভিযোগ করে যে তারা সামুতে আমার লেখা পড়তে পারছে না । নিজের একটা ওয়েবসাইট রয়েছে, সেটা মূলত বানানো হয়েছে এই সামুতে পাঠক না আসতে পারার কারণে । গতবারও এই সমস্যার কথা বলেছিলাম যার সমাধান আজও হয় নি । এটার সমাধান যতদিন না হবে ততদিন সামুর অবস্থার পরিবর্তন হবে না । আমার লিস্টেই এমন কয়েকজন রয়েছে তারা সামুতে আসে না ঠিক এই কারণে ।
দেখতে দেখতে সামুতে দশ বছর কাটিয়ে দিলাম । দশ বছর অনেক লম্বা সময় । এই সময়ে কত মানুষকে সামুতে দেখলাম আসতে, চলে যেতে । সামুর সাথে জার্নি আমার সব সময় চমৎকার ছিল । সামু নিয়ে অভিযোগ যে নেই সেটা বলছি না তবে ভাল লাগার পাল্লাই সব সময় ভারী । কত চমৎকার মানুষ রয়েছে সামুতে । সেই সাথে কিছু বিরক্তিকর মানুষও অবশ্য রয়েছে । সব স্থানেই থাকে । সব মিলিয়ে সামু চমৎকার । এখনও যখনই আমি ল্যাপটপ বা পিসি চালু করি তখনই যে ট্যাবটা ওপেন সাথে সাথে সেটা হচ্ছে সামহোয়্যারইণ ব্লগ । গত কয়েক বছরের এই নিয়মের কোন ব্যতীক্রম হয় নি । লেখা পড়ি কিংবা না পড়ি, কিছু লিখি কিংবা না লিখি ট্যাব ঠিকই চালু থেকেছে সব সময় । সামু খোলা না থাকলে মনে হয় যেন কিছু একটা মিসিং রয়েছে ।
এবার নিজের ব্লগ সম্পর্কে বলা যাক কিছু । সামুর এই দশ বছরে আমি মোট ১২৫১টা পোস্ট করেছি যার বেশির ভাগই গল্প । এছাড়া ফান পোস্ট রয়েছে । অল্প কিছু ফিচার । প্রতি বছর গড়ে ১২৫টা পোস্ট করা হয়েছে । আগে অবশ্য প্রচুর পোস্ট করতাম । তখন প্রতিদিন একটা পোস্ট না করলে পেটের ভাত হজম হত না যেন । মাসে ২৮ থেকে ৩০টা পোস্ট করা হতই । এমনটা চলেছে প্রথম কয়েক বছর । তারপর সেটা কমে গেছে । আগের মত আর সময় পাওয়া যায় না । জীবনের অন্য জল গড়িয়েছে । অন্য অনেক কিছুর দিকে মন দিয়ে হয়েছে ।
আমার করা কমেন্টের সংখ্যাও খুব বেশি না । দশ বছরে প্রায় ২৩ হাজার মন্তব্য করা হয়েছে । আগে আসলে আমি অন্যের ব্লগের মন্তব্য করার অভ্যাস কম ছিল । আমি মূলত পাঠক ছিলাম গল্প আর ফিচার পোস্টের । কেবল এই পোস্টেই তখন কমেন্ট করা হত । তবে এখন আরও বেশি কিছু পোস্ট নিয়মিত পড়ছি । আসলে তখন এতো এতো পোস্ট আসতো যে এই গল্প আর ফিচার পোস্টই যথেষ্ঠ ছিল দিন পার করে দেওয়ার জন্য । এখন অবশ্য তেমনটা আর নেই । এখন প্রায় সব পোস্টই পড়ি । যেগুলো ভাল লাগে সেগুলোতে কমেন্ট করি ।
সামুর ব্লগারদের মাঝে একটা মনভাব খুব আছে যে আমার পোস্টে মন্তব্যে না করলে আমিও মন্তব্য করবো না । আমার পোস্টে মন্তব্য করলে আমিও করবো তোমার পোস্টে মন্তব্য । এমন মনভাব কোন দিনই আমার ছিল না । সবারই কিছু না কিছু পছন্দের ব্লগার থাকে । আমারও আছে । তেমনি ভাবে কিছু অপছন্দের ব্লগারও থাকে । আমারও আছে। তবে সেটা সংখ্যাতে একদমই কম। সব সময় পছন্দের ব্লগারদের পোস্ট পড়ার চেষ্টা করি । খুজে খুজে পড়ি । ঠিক তেমনি আমি সেই অপছন্দের ব্লগারদের পোস্টে ঢুকিও না । এছাড়া অন্য সবাই আমার কাছে একদম সমান । সামুর পাতা স্ক্রল করি, ব্লগারদের পোস্ট পড়ি, ভাল লাগলে সেখানে মন্তব্য করা লাইক দিয়ে বের হয়ে আসি ।
সামুতে এই দশ বছরে আমার ব্লগটা ২৯ লাখ ৭৬ হাজার বারের বেশি হিট হয়েছে। এটা সামুতে এখনও পর্যন্ত একক ব্লগ হিসাবে সর্বোচ্চ হিট। বলা চলে, আই এম হিটম্যান । । তবে এই হিটের একটা বড় অংশ এসেছে ফেসবুক থেকে । আমার প্রায় সব পাঠক এখনও সেখানেই ।
শেষ কথা আর কি বলবো ! সামুতে আরও লিখে যেতে চাই । যতদিন সামু টিকে আছে এবং যতদিন আমি টিকে আছি । এমন একটা ইচ্ছে যে একদিন পোস্ট দিয়ে ঘুমাবো পরদিন হয়তো আর ঘুম থেকে উঠলাম না । এমন ভাবে জীবের শেষ দিন পর্যন্ত সামুতেই লিখে যেতে চাই ।
দশ বছ পরে সামুতে এসে এখনও একটা অনুভূতি হচ্ছে আমি এখনও ইমন জুবায়ের ভাইয়ের শূন্য স্থান পূরণ করতে পারি নি । তার লেখা সব সময় আমি মিস করি । এখনও মিস করি । সামুতে কত ব্লগার এলো গেল কিন্তু তার মত আর কেউ আসে নি কোন দিন । আর কোন দিন আসবেও না ।
সামু টিকে থাকুক । সেই সাথে আমিও টিকে থাকি
আসেন শেষ করার আগে আপনাদের একটা পছন্দের গান শোনাই ।
Photo by Abdullah Hussain from Pexels
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুলাই, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৩