ঢাকা শহরে আমি এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আছে । এখানে এসে আমি একটা জিনিস শিখে নিয়েছি সেটা হচ্ছে এখানে মানুষ কেউ কারো নয় । আস্তে আস্তে আমিও এমনই হয়ে গেছি । নিজেকে নিয়েই থাকি । এবং অন্যের কাছ থেকে সাহায্যের আশা খুব একটা করি না । কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু মানুষের আচরণ আমাকে প্রথমে মুগ্ধ এবং পরে অবাক করে !
গতকাল ক্যাম্পাসে গিয়েছিলাম একটা কাজে । আমি আর আমার বন্ধু । আমাদের সার্টিফিকেটের আসল কপি তুলত । লিপি অফিসে ছুটি নিয়ে এসেছে । ক্যাম্পাসের কাজ শেষ করে লিপি বলল, তানভীর চল একটু বাংলা বাজার যাই । এদিকে হয়তো আর আসা হবে না । দুইটা বইয়ে একটু সমস্যা আছে । বদলিয়ে নিয়ে আসি !
লিপি আর আমার ভেতরে একটা মিল হচ্ছে আমরা দুজনেই বই ভালোবাসি । আমরা দুনিয়ার অন্য সব কিছুতে দ্বিমত থাকলেও বই কেনা আর বই পড়া নিয়ে আমাদের দ্বিমত নেই । আমরা কেবল বইকেনার জন্য মাঝে মাঝে শহরের এ মাথা থেকে অন্য মাথায় গিয়ে হাজির হই ! যখন পড়াশোনা করতাম তখন প্রায় দিনই আমরা বাংলা বাজারের বইয়ের শোরুমে ঘোরাঘুরি করতাম । এখানে বই গুলো একটু বেশি ছাড়ে কেনা যায় !
দুইটা প্রকাশনীর দুইটা বইয়ে সমস্যা । পৃষ্ঠায় লেখা ছাপে নি । ওদের ওখানে নিয়ে গেলেই ওরা বদলে দেয় । প্রকাশনীর শো রুম খুজতে শুরু করলাম । শেষ এসেছিলাম ২০২০ সালের দিকে । এর ভেতরে আর যাওয়াই হয় নি । একটা অবশ্য আফসার ব্রাদার্সটা পেয়ে গেলাম জলদিই । কিন্তু অন্য আরেকটা প্রকাশনি খুজে পাচ্ছিলাম না ঠিক । এর ওর কাছে জানতে চাইলাম এটা কোন দিকে !
এমন সময়ে একজন ৫৫/৬০ বছর বয়সের একজন লোকের সাথে দেখা হল । তিনি মার্কেটের নিচে বসে ছিলেন । আমাদের দেখে জানতে চাইলেন কী খুজছি আমরা !
প্রকাশনির নাম বললাম । আমরা ভেবেছিলাম যে হয়তো কেবল দিক বলে দিবেন যে ঐ দিকে যাও । কিন্তু আমাদের খানিকটা অবাক করে দিয়ে তিনি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম । তারপর আমাদের নিয়ে গিয়ে সেই প্রকাশনির সামনে নিয়ে গেল !
কিন্তু তখনও প্রকাশনিটা খোলে নি । সকালের দিকে গিয়েছিলাম । তখন এগারোটার কিছু বেশি বাজে । তিনি জানালেন যে কিছু সময়ের ভেতরেই এটা খুলে যাবে ।
লিপি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী করবা ?
বললাম, আবার আসবো এই বইয়ের জন্য? তারপর চল কিছু সময় শো রুমে ঘুরি । তারপর পাল্টে নিয়ে যাই ।
আমরা বাতিঘর প্রকাশনিতে গেলাম । সেখানে বই পছন্দ করলাম । কয়েক টা কিনলাম । আধাঘন্টা সময় কাটলো সেখানে । তারপর আবারও সেই প্রকাশনির সামনে গিয়ে হাজির হলাম । কিন্তু কপাল খারাপ যে তখনও দরজা খোলে নি । লিপি আধা বেলা ছুটি নিয়ে এসেছে । ফিরে গিয়ে আবার যেতে হবে অফিসে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল, চল আজকে আর হবে না । নীলক্ষেতের যে দোকান থেকে বইটা কিনেছি সেখান থেকে পাল্টে নেবো নে !
আমরা চলেই যাচ্ছিলাম তখনই আবার সেই লোকটার সাথে দেখা হল । তিনি জানতে চাইলেন যে আমাদের কাজ হয়েছে কিনা !
জানালাম যে একটা হয়েছে অন্যটা হয় নি । আমরা চলেই যাচ্ছিলাম কিন্তু তিনি আমাদের প্রায় জোর করে বসালেন চেয়ারে । তারপর বললেন, আরে দাড়াও তোমরা । আজই হয়ে যাবে । ঐ প্রকাশনির মালিক আমার ভাগনে হয় । ওকে এখনই ডেকে নিয়ে আসছি !
এক ছোকড়াকে ডাক দিলেন । তারপর জানতে চাইলেন প্রকাশক কোথায় আছে ? কখন আসবে এই সব !
আমাদের সামনেই ফোন দিলেন তাকে ।
যখন দেখলেন যে আসতে দেরি হবে তখন আমাদের বইটা হাতে নিয়ে নিজেই গেলেন কয়েকটা বইয়ের দোকানে । জান্নাত নামে একটা বইয়ের দোকান আছে । সেখানে গিয়ে আমাদের বইটা রেখে নতুন আরেকটা বই আমাদের দিয়ে দিলেন ! এই সব কিছু তিনি নিজ উদ্যোগেই করলেন আমাদের জন্য ।
তিনি কথায় কথায় জানালেন যে এই মার্কেটের সভাপতি তিনি । সব কিছু দেখার দায়িত্ব তো তারই ! আমরা এসে ফিরে যাবো এটা তো তিনি হতে দিতে পারেন না !
ফেরার সময় আমি অনেক বার তাকে ধন্যবাদ দিলাম । এই ব্যাপারটা আমার কাছে একটু নতুনই । আমি ঢাকা শহরে দেখেছি মানুষ নিজের দায়িত্ব টুকু যার জন্য তাকে বেতন দেওয়া হয় সেই কাজ টুকুই ঠিক মত করেন না যেখানে একজন সম্পর্ক অপরিচিত মানুষের জন্য সে একে ওকে ফোন দিল নিজ দায়িত্বে বই পাল্টে দিল ! আর কোন দিন তার সাথে আমাদের দেখা হবে কিনা সেটা নিশ্চিত নয় ! যদি বাংলাবাজারে আবার বই কিনতে না যাই তাহলে তার দেখা পাওয়ার কোন সম্ভবনা নেই । তবে আমি ঠিক করে রেখেছি যে পরে আবার যেদিন যাবো সেদিন নিজ উদ্যোগেই সভাপতির সাহেবের সাথে দেখা করবো তার কুশল জিজ্ঞেস করে আসবো !
গতকালের বাংলাবাজার থেকে কেনা বই । একদম উপরের বইটা সভাপতি সাহেব বদল করে দিয়েছেন ! নিচের তিনটা কেনা !
আরেকটা এই রকম ঘটনা উল্লেখ করি । ব্যাংকে গিয়েছি টাকা পাঠাতে । আমি ব্যাংকে যাওয়া লাইনে দাড়ানো ঠিক পছন্দ করি না । বেশির ভাগ সময়েই আমি বিকাশেই টাকা পাঠাই বাসায় ! কিন্তু এই এমাউন্টটা একটু বড় ছিল । বিকাশে পাঠাতে গেলে চার্জ হিসাবে অনেক গুলো টাকা কেটে নিবে । গেলাম ব্যাংকে । আমি ঢুকে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম । কোন দিকে যাবো ভাবছি এমন সময় একজন গার্ড আমার দিকে এগিয়ে এল । জানতে চাইলো আমি কী করবো । বললাম যে টাকা পাঠাবো । সে আমার টোন শুনেই বলল, বাড়ি কোথায় ? আমি বললাম । তারপর সে জানালো যে তার বাসাও আমাদের জেলাতেই ।
ব্যাস এরপর সব কিছু আমার জন্য একদম সহজ হয়ে গেল । সে নিজেই একটা ফরম এনে দিল । সেটা ফিলাপ করতেই সে টাকার পরিমানটা জানতে চাইলো । আমি বললাম । সেটা শোনার পর সে বলল যে এতো পরিমান টাকা পাঠাতে তো একটা এন আইডির কপি লাগবে । এটা হচ্ছে নিয়ম । একটা নির্দিষ্ট পরিমান টাকার ক্রস করলেই সাথে প্রেরকের এনআইডি লাগে !
এনআইডি সাথে ছিল । কিন্তু ব্যাংক থেকে বের হয়ে আবার ফটোকপি করতে মন চাইলো না । কিন্তু উপায়ও নেই । যেতেই হবে । তবে যেতে হল না । সেই গার্ড সাহেবই আবার নিজ উদ্যোগে আরেকটা ফরম এনে দিলেন । বললেন যে এটা ফিলাপ করে পাঠিয়ে দিন তাহলে এনআইডি লাগবে না !
আমি টাকা জমা দিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে আসার সময় গার্ড সাহেবকে ধন্যবাদ দিয়ে বের হয়ে এলাম ।
বাইরের দেশে এই সব ঘটনা খুবই স্বাভাবিক । সেখানে মানুষজন অন্য মানুষকে আন্তরিক ভাবেই সাহায্য করে। কয়েকদিন আগে খায়রুল আহসান ভাইয়ের মেলবর্নের গল্প পড়ে বেশ পুলকিত হয়েছিলাম । সেখানে মানুষ কত ভাবেই না সাহায্য করছে । এই সব গল্প আমার ভাল লাগে সব সময় ।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০২২ সকাল ১১:০১