চাঁদ নিয়ে মানুষের আগ্রহের কোন শেষ নেই । তা সেটা রোমান্টিক হোক কিংবা গুজবই হোক আমরা চাঁদের প্রতি একটা আলাদা আগ্রহবোধ করি সব সময় ! আমরা সেই ছোট বেলা থেকেই চাঁদ মামা চাঁদের বুড়ির গল্প শুনে বড় হয়েছে । একটা বয়স পর্যন্ত সবাই বিশ্বাস করে যে চাঁদে আসলেই একটা বুড়ি আছে যে কিনা চরকা কাটে । তারপর একটু বড় হলে আমরা চাঁদে মানুষের গমন নিয়ে নানান রকম গল্প শুনি । আমাদের এমন অনেক মহান মানুষ রয়েছে যারা এখনও বিশ্বাস করেন না মানুষ চাঁদে পা দিয়েছে । শতকরা ৮ থেকে ১২ শতাংশ মানুষ মুন কন্সোপিরেসিতে বিশ্বাস রাখে । তারা মনে করেন যে মানুষ কখনই চাঁদে যায় নি । খোদ আমেরিকাতে এই বিশ্বাসের পরিমানটা আরও বেশি । আবার আমাদেশে অনেকে বিশ্বাস করে চাঁদে সাইদি মিয়াকে দেখা গিয়েছিলো । আবার অনেক ধর্ম প্রাণ মানুষ এও বিশ্বাস করে নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে গিয়ে আযান শুনতে পেয়েছিলেন এবং তিনি পৃথিবীতে এসে ইসলাম গ্রহন করেছিলাম । চাঁদ নিয়ে এই রকম গুজবের কোন শেষ নেই । তবে এই সব গুজবের শুরুটা কিন্তু ১৯৬৯ সাল থেকে নয় । আপনারা জেনে অবাক হবেন এই চাঁদে মানুষের পা দেওয়ারও ১৩৪ বছর আগেই চাঁদ নিয়ে এক বিশাল এক বিশাল গুজবের সৃষ্টি হয়েছিলো একটি পত্রিকার হাত ধরে এবং মানুষজন তা খুব ভাল ভাবেই বিশ্বাস করেছিলো ।
সালটা ১৮৩৫ । আমেরিকার তখনকার একটি পত্রিকা দি সান (New York Sun) । পত্রিকাটি ১৮৩৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে চালু হয়ে মোটামুটি ১৯৫০ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল । মূলত এটি তখন পেনি পত্রিকা হিসাবে পরিচিত পায় । উনিশ শতকের সেই সময়ে পত্রিকা মূলত ছিল এলিট শ্রেনীর জন্য । দামও ছিল বেশি । পাবলিশার বেঞ্জুমান ডে এই পত্রিকাটি নিয়েই এসেছিলেন সকল সাধারণ মানুষ যাতে তা কিনে পড়তে পারে । তার টার্গেটেড পাঠক এই সাধারণ মানুষই ছিল । দিনে এই পত্রিকার সার্কুলেশন ছিল আট হাজারের মত । পত্রিকা দি পত্রিকা তবে এই সব কিছু বদলে যায় ১৮৩৫ সালের আগস্ট মাসে ।
আগস্ট মাসের ২৫ তারিখ থেকে এই পত্রিকায় সিরিজ আকারে একটা নিউজ প্রকাশ হতে থাকে যার মূল বক্তব্য হচ্ছে সুপরিচিত জ্যোতির্বিজ্ঞানী স্যার জন হার্শেল তার নতুন আবিস্কৃত টেলিস্কোপ দিয়ে চাঁদে প্রাণের অস্তিত্ব খুজে পেয়েছেন । এবং তারা ''এডিনবার্গ জার্নাল অব সায়েন্স'' থেকে নিচের সংবাদটি রিপ্রিন্ট করছে । মূলত এই দুইটা কথাই টার্মই এই হোক্সটাকে সর্ব সাধারণের মাঝে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিলো । এক হচ্ছে জন হার্সেল যে কিনা একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ছিলেন এবং এডিনবার্গ জার্নাল অব সায়েন্স যদিও ততদিনে সেটা প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেছে । কিন্তু এই খবর আমেরিকার সর্ব সাধারণ মানুষের জানার খানিকটা কষ্টসাধ্য ছিল ।
যাই হোক পত্রিকার শিরোনাম হল ''গ্রেট এস্ট্রনোমিক্যাল ডিসকোভারিস'' বাই স্যার জন হার্সেল । মোট ছয়টা পর্ব চাঁদের প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া নিয়ে নানান বর্ণনা সেখানে প্রকাশিত হয় । চাঁদে মানুষের মত চার ফুট লম্বা পাখনাওয়ালা ম্যান ব্যাটের কথা বলা হয়, ছাগল বানর টাইমের প্রাণী, ইউনিকর্ণ, নদী, পাহাড়, সাগড়ের গিরিখাত সহ আরও নানান কিছুর কথা বলা হয় । এছাড়া পত্রিকায় এও বলা হয় যে এই চাঁদে যে কেবল প্রাণ আছে সেটাই নয়, সেখানে সভ্যতার দেখাও পাওয়া গেছে । বাদর মানবেরা উচু মন্দিরও তৈরি করেছে।
source
এই সব গাল গল্প কেবল আমেরিকার মানুষজনই নয় পুরো বিশ্বের মানুষ বিশ্বাস করেছিলো । দেখা যায় প্রথম সংখ্যা প্রকাশের পরে দি সানের সার্কুলেশন আট হাজার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাড়ায় প্রায় পনের হাজারে । এবং সিরিজের শেষ পর্বটি যখন প্রকাশ হয় তখন তা প্রায় বিশ হাজারে গিয়ে ঠেকে । এটিই সেই সময়ে সর্বোচ্চ সংখ্যাক বিক্রিত পত্রিকায় পরিনত হয়। এছাড়া এই সংবাদ প্রকাশের পরে অন্যান্য পত্রিকায় এই সাংবাদ কয়েক বার করে পুনঃপ্রকাশিত হয় । এবং এই সংবাদ কেবল নিউইয়র্কেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিলো । এই সংবাদে প্রকাশিত বর্ণনার ভিত্তিতে বিভিন্ন পত্রিকা নানান রকম ইলাস্ট্রেশন সহ প্রকাশ করতে থাকে । সেই সবের কিছু ছবি এই পোস্টে দেখতে পাচ্ছেন ।
এতো গল্প যার নামে চলছে সেই সয়ার জন হার্সেল কিন্তু এসবের কিছুই জানেন না । তিনি তখন পৃথিবীর অন্য প্রান্তে গবেষণার কাজে ব্যস্ত । এই হোক্স প্রকাশের বেশ কিছুদিন পরে একটা পত্রিকা তার হাতে এসে পৌছায় । তবে এই ব্যাপারে তিনি কোন পদক্ষেপ গ্রহন করেন নি ।
যাই হোক এই হোক্স প্রকাশের পর প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষই এটা বিশ্বাস করে । এই বিশ্বাসের পেছনে অন্যতম কারণ ছিল ধর্মগত বিশ্বাস । সেই সময়ে যারা জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন তাদের বেশির ভাগই ছিল ধর্মীয় ঘরোয়ানার । তাদের ভেতরে একজন হচ্ছে থমাস ডিক । এই হোক্স প্রকাশের আগে থমাস ডিক বিশ্বাস করতেন যে চাঁদে আসলে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে । সেখানে কম করে হলেও চার বিলিয়ন প্রাণ রয়েছে । পত্রিকার সম্পাদক মূলত এই হোক্সটা প্রকাশ করেছিলো টমাস ডিকের এই বক্তব্যকে প্যারোডি করেই । এমনটাই এডিটর রিচার্জ এডামস লকের বক্তব্য ছিল । তবে এই প্যারোডিকে মানুষ যে এই ভাবে বিশ্বাস করে নিবে সেটা হয়তো লকের নিজেরও ধারণা ছিল না । এমন কি তখন ধর্মীয় লোকজনও এটাকে খুব ভাল করে বিশ্বাস করে নিয়েছিল । এমন কি চাঁদে বাইবেল নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা অর্থ সংগ্রহও শুরু করে দিয়েছিলো ।
source
তবে অনেক মানুষ যেমন এই সংবাদ বিশ্বাস করেছিলো ঠিক তেমন ভাবে কিছু মানুষ এই হোক্সটাকে শুরু থেকেই ধোকাবাজি বলে এসেছে । তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী পত্রিকার লোকজন উঠে পড়ে লাগে এইটাকে মিথ্যা প্রমাণের । এদের ভেতরে জেমস গর্ডন বেনেট খুজে বের করেন যে যে সে সায়েন্স জার্লানের কথা উল্লেখ করেছেন সেটা দুই বছর আগেই বন্ধ হয়ে গেছে । এছাড়া বিখ্যাত ছোট গল্পের জনক এডগার এলেন পো এই হোক্সের শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিলেন । তার অভিযোগ ছিল যে তার গল্প ''The Unparalleled Adventure of One Hans Pfaall'' গল্প থেকেই লক এই সংবাদ প্রকাশ করেছে । কারণ গল্পে চাঁদবাসী যেই রকম বর্ণনা দেওয়া হয়েছে পত্রিকাতেও মোটামুটি সেই রকম গল্পই বলা হয়েছে ।
source
তবে মজার কথা হচ্ছে যখন এই সত্য প্রকাশ পেল তখন কিন্তু নিউইয়র্কের মানুষ মোটেই এই সংবাদ কিংবা পত্রিকার উপরে ক্ষেপে যায় নি । বরং এটাকে তারা মজা হিসাবেই নিয়েছে।
আমাদের বর্তমান সময়েও নানান রকম গুজব ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে । বিশেষ করে এখন এই সোস্যাল মিডিয়ার যুগে আগের থেকেও এই গুজব ছড়ানোটা আরও বেশি সহজ । আপনারা নিশ্চিত ভাবেই মনে করতে পারেন যে চাঁদে সাইদিকে দেখতে পাওয়ার ঘটনাটাকে কিভাবে মানুষ বিশ্বাস করেছিলো । সেই সময়ে এমনও শোনা গিয়েছিলো যে এই কথা যারা বিশ্বাস না করবে তাদের নাকি ঈমান চলে যাবে !
চাঁদের গুজব আজকে এই পর্যন্তই । আরো বিস্তারিত জানতে নিচের লিংক গুলোতে ঢু মারতে পারেন । প্রথম বিবির রিলটা দেখতে পারেন ।
তথ্যসুত্রঃ
BBC Reel
The Great Moon Hoax of 1835
The Great Moon Hoax of 1835
Great Moon Hoax
চাঁদের বুকে প্রাণ
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ১১:৫১