somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রহস্যঃ কী হলেছিলো মেরি সেলেস্ট জাহাজটির সাথে?

০৬ ই মে, ২০২৫ সকাল ১০:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১৮৭২ সালের নভেম্বর মাসের এক শীতের সকালবেলা। সমুদ্রপথে যাত্রা পথে ব্রিটিশ ব্রিগেন্টিন জাহাজ ‘দেই গ্রাটিয়া’র নাবিকরা একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করল। তারা তাদের সামনে একটা জাহাজকে এলোমেলো ভাবে চলতে দেখতে পেল। জাহাজের ডেকে কোন মানুষ ছিল না। দূর থেকে দেখলে মনে হবে যেন কোন বাচ্চা ছেলে জাহাজ চালকের সিটে বসে জাহাজটা চালাচ্ছে। গ্রাটিয়ার ক্যাপ্টেন ডেভিড মোরহাউস দুরবিন দিয়ে ভাল করে খেয়াল করতেই জাহাজটাকে তিনি চিনতে পারলেন। আটলান্টিক মহাসাগরের নীল জলরাশির মাঝে এলোমেলো চলতে থাকা এই জাহাজটির নাম ‘মেরি সেলেস্ট’। এটি নিউ ইয়র্ক থেকে ইতালির জেনোয়া শহরের দিকে যাত্রা শুরু করেছিল। এতোদিনে সেটা ইটালীতে পৌছে যাবার কথা ছিল। কিন্তু এই জাহাজ পর্তুগালের কাছে আজোরেস দ্বীপপুঞ্জের কাছে কেন ঘোরাঘুরি করছে? তারা জাহাদের ডেকে উঠলেন। তখন বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলেন যে সব জিনিস আগের মতই আছে কিন্তু এর ক্রু, ক্যাপ্টেন এবং যাত্রীরা—সবাই নিখোঁজ। কোনো সংঘর্ষের চিহ্ন নেই, কোনো লড়াইয়ের প্রমাণ নেই, এমনকি জাহাজের মালপত্রও অক্ষত অবস্থায় আছে। একটা লাইফবোট ছাড়া আর কিছুই হারিয়ে যায়নি। সব কিছু ঠিক আছে কেবল জাহাজে করে যারা এসেছিল তাদের কোন খোজ নেই। তারা যেন একেবারে শূন্য মিলিয়ে গেছে।

১৮৬১ সালে কানাডার নোভা স্কটিয়ায় মেরি সেলেস্ট জাহাজটা তৈরি হয়েছিল। প্রথমে এটার নাম দেওয়া হয়েছিল "অ্যামাজন"। কিন্তু পরে নাম পরিবর্তন করে মেরি সেলেস্ট রাখা হয়। মাঝারি আকারের জাহাজটা ব্যবসা-বণিজ্যের জন্য উপযোগী করেই তৈরি হয়েছিল। মূলত জিনিসপত্র পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হতো। ১৮৭২ সালে এটি নিউইয়র্ক থেকে ১৭০১ ব্যারেল অ্যালকোহল নিয়ে যাত্রা শুরু করে। জাহাজের ক্যাপ্টেন ছিলেন অভিজ্ঞ নাবিক বেঞ্জামিন স্পুনার ব্রিগস। তার সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী সারাহ ব্রিগস এবং তাদের দুই বছরের কন্যা সোফিয়াও জাহাজে করে জেনোয়াতে যাচ্ছিল। এছাড়া জাহাজে আরও সাতজন ক্রু ছিল। সবাই ছিল বেঞ্জামিনের মত সবাই অভিজ্ঞ নাবিক।
৪ নভেম্বর, ১৮৭২, মেরি সেলেস্ট নিউ ইয়র্কের স্ট্যাটেন আইল্যান্ড থেকে যাত্রা শুরু করে। সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। জাহাজের লগবুকে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনার উল্লেখ ছিল না। ৫ ডিসেম্বর, ব্রিটিশ জাহাজ দেই গ্রাটিয়া মেরি সেলেস্টকে দেখতে পায়।

জাহাজটা দেখে মনে হচ্ছিল যেন জাহাজের সব ক্ররা ভেতরে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। সমুদ্রের পানির আওয়াজ ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই। ডেভিড মোরহাউস পুরো জাহাজ ঘুরে দেখলেন জাহাজে কেউ নেই। ক্যাপ্টেন ব্রিগস, তার পরিবার, ক্রু—সবাই যেন গায়েব হয়ে গেছে। জাহাজের কেবিনে খাবারের প্লেট, পানির পাত্র, এমনকি ব্যক্তিগত জিনিসপত্র সব কিছু ঠিক রয়েছে। জাহাজের কার্গো, অ্যালকোহলের ব্যারেলগুলো, সবকিছু অক্ষত রয়েছে। কোনো লুটপাট বা ধ্বংসের চিহ্ন নেই। তবে জাহাজের পালটা একটু ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। কিন্তু এটা এমন বড় কোন ক্ষতিও না যে এর কারণে জাহাজ ছেড়ে সবাইকে চলে যেতে হবে। হারিয়ে যাওয়া জিনিসের মধ্যে ছিল কেবল একটা লাইফবোট। এছাড়া জাহাজের কম্পাস কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত ছিল। লগবুকের শেষ এন্ট্রি ছিল ২৫ নভেম্বরের, যেখানে জাহাজটি আজোরেস দ্বীপপুঞ্জের কাছে পৌঁছেছে, এমন কথা লেখা ছিল। তারপর জাহাজে কী হয়েছে সেটার ব্যাপারে আর কোনো তথ্য নেই।

দেই গ্রাটিয়ার ক্রুরা মেরি সেলেস্টকে জিব্রাল্টারে নিয়ে যায়। তদন্ত শুরু হয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জাহাজটি পরীক্ষা করে দেখে। তারা এই রহস্যের সত্যতা জানার চেষ্টা করে। কিন্তু তদন্তে কোনো স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায়নি। ক্যাপ্টেন ব্রিগস এবং তার দলের কী হয়েছিল, তা নিয়ে অসংখ্য গল্প উঠে আসে। কেউ বলে, জলদস্যুরা জাহাজ আক্রমণ করেছিল, কিন্তু কোনো লুটপাটের চিহ্ন না থাকায় এই তত্ত্ব খুব একটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। কেউ কেউ মনে করে, জাহাজে বিষাক্ত গ্যাস বা অ্যালকোহলের বাষ্পের কারণে ক্রুরা পালিয়ে গিয়েছিল। তবে এই তত্ত্বও প্রমাণিত হয়নি, কারণ জাহাজে কোনো বিষাক্ত গ্যাসের চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

আরেকটি জনপ্রিয় তত্ত্ব হলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ। কেউ কেউ মনে করে, একটি বিশাল ঝড় বা সামুদ্রিক ঘূর্ণি (waterspout) জাহাজের ক্রুদের নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু জাহাজের অক্ষত অবস্থা এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে যায়। কিছু লোক আবার এটাকে অতিপ্রাকৃত ব্যাপার মনে করে—কেউ বলে এটি এলিয়েনদের কাজ, কেউ বলে সমুদ্রের কোনো অভিশাপ। এই ধরনের তত্ত্বগুলো অবশ্য বেশিরভাগ মানুষের কাছে কল্পনাপ্রসূত মনে হয়।

আরেকটি আকর্ষণীয় তত্ত্ব ছিল মিউটিনি বা বিদ্রোহ। কেউ কেউ মনে করে, ক্রুদের মধ্যে কোনো বিবাদ বা অসন্তোষের কারণে তারা ক্যাপ্টেন এবং তার পরিবারকে হত্যা করে লাইফবোটে পালিয়ে যায়। কিন্তু জাহাজে কোনো রক্ত বা সংঘর্ষের চিহ্ন না থাকায় এই তত্ত্বও দুর্বল হয়ে পড়ে। আরেকটি তত্ত্বে বলা হয়, ক্যাপ্টেন ব্রিগস হয়তো ভুলবশত মনে করেছিলেন যে জাহাজটি ডুবে যাচ্ছে। হয়তো অ্যালকোহলের ব্যারেল থেকে বাষ্প বের হওয়ার কারণে তিনি বিস্ফোরণের ভয় পেয়েছিলেন এবং তড়িঘড়ি সবাইকে লাইফবোটে করে জাহাজ ত্যাগ করতে বলেছিলেন। কিন্তু বিশাল সমুদ্রে শুরু লাইফবোটে তারা টিকে থাকতে পারেনি।

জিব্রাল্টারের তদন্তে আরেকটি বিষয় উঠে আসে—দেই গ্রাটিয়ার ক্যাপ্টেন মোরহাউসের ভূমিকা। কিছু লোক সন্দেহ করেছিল যে মোরহাউস এবং তার ক্রুরা মেরি সেলেস্টের ক্রুদের সঙ্গে কোনো ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল। কারণ, মোরহাউস এবং ব্রিগস একে অপরকে চিনতেন। তারা নিউইয়র্কে একই সময়ে ছিলেন এবং সম্ভবত একসঙ্গে খাবারও খেয়েছিলেন। তবে এই সন্দেহের পক্ষে কোনো শক্ত প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
মেরি সেলেস্টের রহস্যের ঘটনা থেকে "ভূতুড়ে জাহাজ" বা "ফ্লাইং ডাচম্যান" এর মতো গল্পের জন্ম হয়েছে। শার্লক হোমসের স্রষ্টা আর্থার কোনান ডয়েল মেরি সেলেস্টের ঘটনা নিয়ে একটি কাল্পনিক গল্প লিখেছিলেন। এর ফলে মানুষের মধ্যে এই রহস্যের প্রতি আগ্রহ আরও বাড়িয়ে দেয়। আধুনিক যুগে এই ঘটনা নিয়ে ডকুমেন্টারি, বই এবং এমনকি টিভি শো তৈরি হয়েছে।

বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এই ঘটনার ব্যাখ্যা করার জন্য বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা করার চেষ্টা করেছেন। কেউ কেউ বলেন, সমুদ্রের তলদেশে ভূমিকম্প বা গ্যাস নির্গমনের কারণে জাহাজের ক্রুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এই তত্ত্বগুলোর কোনোটিই চূড়ান্তভাবে প্রমাণিত হয়নি। আরেকটি তত্ত্বে বলা হয়, জাহাজের কম্পাসের ত্রুটির কারণে ক্যাপ্টেন ভুল পথে চলে গিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তারা হারিয়ে যান। যদিও এই তত্ত্বও হালে খুব ভাল পানি পায় নি।

মেরি সেলেস্টের রহস্যের আজও কোন সমাধান হয় নি। ক্যাপ্টেন ব্রিগস, তার পরিবার এবং ক্রুদের কী হয়েছিল, তা হয়তো আমরা কখনো জানতে পারব না। কিন্তু এই রহস্য আমাদের মনে ঠিকই কৌতূহল জাগিয়ে রাখে, আমরা এর রহস্যের সমাধান বের করতে আগ্রহ বোধ করি। এটাই হয়তো মানব মনের আসল চরিত্র। তারা সব কিছু জানতে চায়, সব রহস্যের সমাধান বের করতে চায়। হয়তো একদিন সত্যি সত্যি কেউ এই রহস্যের সমাধান বের করে ফেলবে। সমুদ্রের গভীরে, কোথাও হয়তো মেরি সেলেস্টের রহস্য লুকিয়ে আছে, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।




(লেখাটা আমার ফেসবুকে কয়েকদিন আগে প্রকাশিত। লেখাটা লিখতে কয়েকটি ইউটিউব ভিডিও কয়েকটি ওয়েব সাইট আর গ্রক এ আইয়ের সাহায্য নিয়েছি।)
ছবি উৎস
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই মে, ২০২৫ সকাল ১০:৫১
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনূস সরকার- অন্তবর্তীকালীন, আপদকালীন না কি গণশত্রু রাষ্ট্রযন্ত্র?

লিখেছেন রাবব১৯৭১, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:৫০

ইউনূস সরকার –অন্তবর্তীকালীন, আপদকালীন না কি গণশত্রু রাষ্ট্রযন্ত্র?
আজকের বাংলাদেশ এক অস্থির, আতঙ্কিত ও শোষণমুখর সময় পার করছে। রাজনৈতিকভাবে যে সরকার বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায়, তারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘অন্তবর্তীকালীন’ সরকার হিসেবে। আবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রিয় কন্যা আমার- ৮০

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১:২৬



প্রিয় কন্যা আমার-
সেদিন খুব সাহসের একটা কাজ করে ফেলেছি। আমি এবং তোমার মা সাতার জানি না। তুমিও সাতার জানো না। বিকেলে আমরা তূরাগ নদীর পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। তোমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ১৬ বছরে রাজনৈতিক স্পেস না পাওয়া জামায়াতের এমন সমাবেশ ‘অবিশ্বাস্য’:

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৯





বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আজকের জাতীয় সমাবেশকে ‘অবিশ্বাস্য’ আখ্যায়িত করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি মনে করেন, এ সমাবেশ বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিয়মিত জোয়ার ভাটার ঢেউ আর সুনামির ঢেউ আলাদা

লিখেছেন অপলক , ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩১



সব কিছু একটা রিদমে চলে। সেই রিদম ভেঙ্গে গেলে ধ্বংস বা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা করতে হয়। নিয়মিত জোয়ার ভাটার ঢেউয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীব বৈচিত্র একটা সমন্বয়ের... ...বাকিটুকু পড়ুন

“নুহাশ পল্লীর যাদুকর“

লিখেছেন আহেমদ ইউসুফ, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৮

এইখানে শুয়ে আছে স্বপ্নের কারিগর
আবেগের ফেরি করে, হৃদয়ে ঝড় তুলে
থেমে গেছে এক যাদুকর।
নুহাশ পল্লীতে মিশে আছে একাকার।

হিমুর চোখে জল, মিসিরের শোকানল
শুভ্রর শুদ্ধতা, রুপার কোমল মন,
আজও ঠিক অম্লান।

হাজারো ভক্তের মনে
মিশে আছ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×