somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কালো জাদুর 'ভুডু ডল'

১৪ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১২:২১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভুডু শব্দটার সাথে আপনারা সবাই পরিচিত। অন্তত যারা ভুতের গল্পটল্প পড়েন বা ভুতের মুভি দেখেন তারা জানেন। আমি প্রথম কবে এই ভুডু পুতুল সম্পর্কে জেনেছিলাম সেটা আমার স্পষ্ট মনে নেই। কেবল মনে আছে যে একটা মুভির দৃশ্য ছিল যেখানে আগুনের পাশে এক তান্ত্রিক গোছের এক লোক একটা পুতুলের গায়ে পিন ফুটাচ্ছেন আর দুরে এক লোক ব্যাথায় চিৎকার করছে। সেই সময়ে আমি অবশ্য বেশ ভয় পেয়েছিলাম এই দৃশ্য দেখে। আমার মনে হয়েছিল এই ভাবে যদি আমার পুতুল কেউ বানায় আর আমাকে কষ্ট দেয় তখন কী হবে! অবশ্য পরে বুঝেছি যে এসব আসলে সম্ভব না বাস্তবে।

ভুডু ডলের উৎপত্তি পশ্চিম আফ্রিকা থেকে। বর্তমান বেনিনের ফন জনগোষ্ঠীর মধ্যেই এদের শিকড় পাওয়া যায়। ভুডু শব্দটা এসেছে ফন ভাষার শব্দ “ভোডুন” থেকে। ভোডুন শব্দের অর্থ “আত্মা” বা “দেবতা”। এই ধর্মটা মানুষ ও আধ্যাত্মিক জগতের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের উপর জোর দিয়ে থাকে।

আটলান্টিক দাস বাণিজ্যের সময় এই ভুডু ধর্ম ক্যারিবিয়ান অঞ্চল, বিশেষ করে হাইতি এবং উত্তর আমেরিকার লুইজিয়ানায় ছড়িয়ে পড়ে। হাইতিতে ভুডু ধর্ম স্থানীয় টাইনো জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস এবং রোমান ক্যাথলিক ধর্মের সঙ্গে মিশে আলাদা একটা সংমিশ্রিত রূপ লাভ করে। এই প্রক্রিয়ায় পুতুল বা মূর্তির ব্যবহার ধীরে ধীরে ভুডু ধর্মের আচারের অংশ হয়ে ওঠে।

এক সময়ে লুইজিয়ানার নিউ অরলিন্সে ভুডু নিয়ে ব্যবসা বানিজ্য শুরু হয়। সেই সময়ে ভুডু ডল পর্যটকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভাল যে ধর্মে পুতুলের ধারণা কিন্তু কেবল ভুডুতেই নয় আরও অনেক ধর্মের আছে। প্রাচীন অ্যাসিরিয়ান ধর্ম (খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ), আক্কাদিয়ান ধর্ম (খ্রিস্টপূর্ব ৮ম-৬ষ্ঠ শতাব্দী), এবং গ্রিকো-রোমান মিশরের (খ্রিস্টীয় ১ম-২য় শতাব্দী) নানান ধর্মে এই মূর্তি বা পুতুলের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। ইউরোপের মধ্যযুগে “পপেট” নামে পরিচিত এক ধরনের পুতুল কালো জাদুর জন্য ব্যবহৃত হত। এটি পরবর্তীতে ভুডু ডলের ধারণার সঙ্গে মিশে যায়।

ভুডু ডল সাধারণত হাতে তৈরি করা হয়। কাপড়, খড়, কাঠ, মাটি বা মোম দিয়ে সাধারণত এই পুতুল তৈরি করা হয়। তবে স্থান কাল পাত্র এবং উদ্দেশ্য ভেদে কখনো কখনো পশুর হাড়, পালক বা ধাতব বস্তুও যোগ করা হয়। পুতুলের সঙ্গে নির্দিষ্ট ব্যক্তির চুল, নখ, রক্ত বা ব্যবহৃত কাপড়ের টুকরো সংযুক্ত করা হয়। মূলত সেই ব্যক্তির সঙ্গে পুতুলটির আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপন করানোর জন্যই এই ব্যক্তিগত জিনিসগুলো যোগ করা হয়। বিক্রির জন্য যে পুতুলগুলো তৈরি হয় সেগুলো অবশ্য নানান রংঢংয়ের হতে পারে। এগুলোর প্রধান উদ্দেশ্যই থাকে পর্যটক আকর্ষণ করা। এই পুতুল বিভিন্ন উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। যেমন, স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার বা সুরক্ষা, প্রেমের সম্পর্ক তৈরি, কারো ক্ষতি করা, এবং দেবতা বা আত্মার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য।



গল্প বা মুভিতে আমরা যদিও এই ভুডুকে একটা ভয়ানক বস্তু হিসাবেই দেখে এসেছি কিন্তু বাস্তবে ভুডু ধর্মে পুতুলের ব্যবহার প্রধানত আধ্যাত্মিক এবং ইতিবাচক উদ্দেশ্যে। হাইতিয়ান ভুডুতে, “পোয়াঁ” (pwen) নামে পরিচিত এই পুতুলগুলো লোয়া (দেবতা বা আত্মা) বা কোনো ব্যক্তির প্রতিনিধিত্ব করে। এগুলো রোগমুক্তি, সুরক্ষা বা পূর্বপুরুষের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করা হয়। যেমন, কবরস্থানে পুতুল ঝুলিয়ে মৃতদের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করা হয় বা উল্টো করে ঝুলিয়ে ক্ষতিকর প্রভাব বন্ধ করা হয়। রোগমুক্তির জন্য, পুতুলের নির্দিষ্ট অংশে তেল বা ভেষজ প্রয়োগ করা হতে পারে। তবে আমরা কেবল এই খারাপ দিক সম্পর্কেই জানি বেশি, বিশেষ করে পিন বা সুচ ফুটিয়ে ব্যথা বা মৃত্যু ঘটানো। ২০২০ সালে লুইজিয়ানার ভুডু হাই প্রিস্ট রবি গিলমোর স্পষ্ট করেন যে এই ধরনের প্রথা এই ভুডু ধর্মের অংশ নয়। প্রকৃতপক্ষে, ভুডু ধর্মে ক্ষতি করার জন্য পুতুল ব্যবহার ঘটে না বললেই চলে। প্রেম বা সম্পর্কের জন্য পুতুলে নির্দিষ্ট মন্ত্র বা প্রতীক ব্যবহারের প্রচলন রয়েছে। তবে এটার ব্যবহারও কম।

ভুডু ডল নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়া এবং কালচারে ব্যাপক ভুল ধারণা রয়েছে। হলিউডের মুভি যেমন “হোয়াইট জম্বি” (১৯৩২) এবং “আই ওয়াকড উইথ এ জম্বি” (১৯৪৩) ভুডু ধর্মকে অন্ধকার ও ভয়ঙ্কর ভাবে দেখানো করেছে। এই মুভিতে ভুডু ডলকে অভিশাপ বা প্রতিশোধের হাতিয়ার হিসেবে উপস্থাপন করেছে। ভুডু ধর্ম হাইতি এবং ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে ব্যাপকভাবে পালিত হয়। সেখানে এটি কোনো কাল্ট বা অবৈধ কিছু নয়। মুভিতে যেমন ভাবে দেখানো হয় তেমন কিছুই নয়। ভুডু ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সঙ্গীত, নৃত্য, প্রার্থনা ছাড়াও নানান রকম আচার ব্যবস্থা রয়েছে। এই আচার ব্যবস্থার ভেতরে ভুডু ডল ছোট একটাআ অংশ মাত্র। আরেকটি সাধারণ ভ্রান্তি হলো ভুডু ডল শুধু ক্ষতি করার জন্য ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে, এটি প্রধানত নিরাময়, সুরক্ষা বা আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া, ভুডু ডলকে শয়তানি বা অশুভ হিসেবে দেখা হয়, যা ভুডু ধর্মের ভালো ও মন্দ উভয় দিক বিবেচনার দর্শনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। ভুডু ডলের ব্যবহার উদ্দেশ্যের উপর নির্ভর করে এবং এটি খ্রিস্টান বা ইসলামের মতো অন্যান্য ধর্মের সঙ্গে তুলনীয়।

নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে, কারো ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে ভুডু ডল ব্যবহার বিতর্কিত এবং ভুডু ধর্মে এটি নিষিদ্ধ। বাণিজ্যিকভাবে এটিকে “কালো জাদু” হিসেবে উপস্থাপন করা আফ্রো-ক্যারিবিয়ান ঐতিহ্যের প্রতি সাংস্কৃতিক অপব্যবহার হিসেবে সমালোচিত। এছাড়া বৈজ্ঞানিকভাবে, ভুডু ডলের প্রভাব প্রমাণিত নয়। অন্যান্য ধর্মের মতই এর কার্যকারিতা বিশ্বাস ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবের উপর নির্ভর করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভুডু ডলের কোনো প্রত্যক্ষ সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় ব্যবহার নেই। তবে, পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে, বিশেষ করে সিনেমা, টিভি বা ইন্টারনেটের মাধ্যমে ভুডু ডল সম্পর্কে কৌতূহল বা ভ্রান্ত ধারণা আমাদের দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা ভুডু মানেই খারাপ কিছুই মনে করি। গ্রামীণ এলাকায় কখনো কখনো “তাবিজ” বা “পুতুল” ব্যবহারের প্রচলন থাকলেও, এগুলোর সাথে ভুডু ধর্মের কোন সংযোগ নেই।


ভুডু নিয়ে ইমন জুবায়ের ভাইয়ের একটা পোস্ট খুজে পেলাম। এখানে দেখতে পারেন।

ছবি সুত্রঃ লিংক এক।
লিংক দুই।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই মে, ২০২৫ দুপুর ১২:২১
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ইউনূস সরকার- অন্তবর্তীকালীন, আপদকালীন না কি গণশত্রু রাষ্ট্রযন্ত্র?

লিখেছেন রাবব১৯৭১, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সকাল ৮:৫০

ইউনূস সরকার –অন্তবর্তীকালীন, আপদকালীন না কি গণশত্রু রাষ্ট্রযন্ত্র?
আজকের বাংলাদেশ এক অস্থির, আতঙ্কিত ও শোষণমুখর সময় পার করছে। রাজনৈতিকভাবে যে সরকার বর্তমানে রাষ্ট্রক্ষমতায়, তারা নিজেদের পরিচয় দিচ্ছে ‘অন্তবর্তীকালীন’ সরকার হিসেবে। আবার... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রিয় কন্যা আমার- ৮০

লিখেছেন রাজীব নুর, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ দুপুর ১:২৬



প্রিয় কন্যা আমার-
সেদিন খুব সাহসের একটা কাজ করে ফেলেছি। আমি এবং তোমার মা সাতার জানি না। তুমিও সাতার জানো না। বিকেলে আমরা তূরাগ নদীর পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। তোমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ১৬ বছরে রাজনৈতিক স্পেস না পাওয়া জামায়াতের এমন সমাবেশ ‘অবিশ্বাস্য’:

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৪:৩৯





বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আজকের জাতীয় সমাবেশকে ‘অবিশ্বাস্য’ আখ্যায়িত করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। তিনি মনে করেন, এ সমাবেশ বাংলাদেশের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিয়মিত জোয়ার ভাটার ঢেউ আর সুনামির ঢেউ আলাদা

লিখেছেন অপলক , ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৬:৩১



সব কিছু একটা রিদমে চলে। সেই রিদম ভেঙ্গে গেলে ধ্বংস বা পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। তখন শুধু সময়ের অপেক্ষা করতে হয়। নিয়মিত জোয়ার ভাটার ঢেউয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশ এবং জীব বৈচিত্র একটা সমন্বয়ের... ...বাকিটুকু পড়ুন

“নুহাশ পল্লীর যাদুকর“

লিখেছেন আহেমদ ইউসুফ, ১৯ শে জুলাই, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:৪৮

এইখানে শুয়ে আছে স্বপ্নের কারিগর
আবেগের ফেরি করে, হৃদয়ে ঝড় তুলে
থেমে গেছে এক যাদুকর।
নুহাশ পল্লীতে মিশে আছে একাকার।

হিমুর চোখে জল, মিসিরের শোকানল
শুভ্রর শুদ্ধতা, রুপার কোমল মন,
আজও ঠিক অম্লান।

হাজারো ভক্তের মনে
মিশে আছ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×