
“ওমর খৈয়াম” এর নাম শুনলেই আমাদের তার লেখা “রুবাইয়াৎ” এর কথা মনে পরে। তবে তিনি আমাদের আসে পাশের কেউ ছিলেন না। তার সাথে আমাদের দুরুত্ব একটু বেশি বলা যায়। কিন্তু তার লেখা কবিতা ও নানা উক্তি আমাদের জীবনের একটা অংশ হয়ে দাড়িয়েছে। বিশেষ ভাবে সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে ওমর খৈয়াম আবেগের অন্য নাম। আমাদের বিদ্রোহী কবি “কাজী নজরুল ইসলাম” রুয়াইয়াৎ এর কিছু অনুবাদ করেছিলেন। এই বিষয়ে একটা মজার তথ্য একটু পরে দিচ্ছি। তবে আমি বইটি পড়ার সময় শুধু নজরুল কে মনে করেছি। হ্যা, আমি নজরুলের লেখার একটু বেশি ভক্ত। সেসব পরের কথা, এখন ফিরে আসা যাক রুবাইয়াৎ প্রসঙ্গে।
.
“ওমর খৈয়াম” পারস্যের কবি, বর্তমানে ইরান। তার লেখা সব কবিতাই চতুষ্পদ কবিতা। এর মানে হচ্ছে চার লাইনের কবিতা। তবে এই চার লাইনে তিনি বর্ননা করেছেন প্রেম দ্রোহ আর বিরহ। সেই সাথে তিনি ভণ্ডামী সংস্কার ও মিথ্যা বিশ্বাসের উপর দিয়েছে কড়া আঘাত। যা হয়ত সেই সময়ে অনেক কঠিন ছিল।
তবুও তিনি লিখেছেন। কারণ প্রচলিত একটা কথা রয়েছে ‘যদি তুমি এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে পড়ো। আর এক জীবনে হাজার জীবন বাঁচতে চাও, তাহলে লেখো।” তাই তিনি লিখেছেন এবং ইতিহাসে অমর হয়ে আছেন। হয়ত সে কারণেই আজ তাকে নিয়ে অনেক লেখা হয়, গবেষণা হয়।
.
কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়াও ফিটজেরাল্ড, কান্তি ঘোষ, সৈয়দ মুজতবা আলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সিকান্দার আবু জাফর, নরেন দেবসহ আরো অনেকে রুবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম অনুবাদ করেছেন। কথিত আছে, কান্তি ঘোষের রুবাই অনুবাদেই প্রথম এর জোয়ার তৈরি হয়, নরেণ দেব তা আরও জনপ্রিয় করে তোলেন, তদুপরি, কোথায় যেন একটু অভাব থেকেই যাচ্ছিল। সৈয়দ মুজতবা আলীর মতে, ‘ওমরই ওমরের সর্বশ্রেষ্ঠ মল্লিনাথ এবং কাজীর অনুবাদ সকল অনুবাদের কাজী।
.
উপরে একটা মজার তথ্যের কথা বলে ছিলাম, সেটাই এখন দিচ্ছি। সৈয়দ মুজতবা আলী ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত ও কাজী নজরুল ইসলাম অনূদিত রুবাইয়াৎ এর ভূমিকা লিখেছিলেন। তিনি বলে ছিলেন যে নজরুল এতটাও ফার্সি জানতেন না। অনেকের ধারণা তিনি ইংরেজ কবি অ্যাডওয়ার্ড ফিটসজেরাল্ডের অনুবাদ থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে। আর এখানেই ভুল করেছেন অনেকে।
কারণ নজরুলের শিক্ষা জীবন নিয়ে আমরা সবাই জানি তার ইংরেজি শিক্ষায়ও খুব বেশি নয়।
নজরুলের অনুবাদ করা খৈয়ামের রুবাইয়াৎ একটু খেয়াল করে পড়লেই বুঝবেন যে নজরুল ইংরেজি অনুবাদের ধারে–কাছে দিয়েও যাননি। নজরুলের অনুবাদ সম্পূর্ন রূপেই আলাদা। আমি পড়ার সময় এটা বুঝেছি। তবে নজরুল কিন্তু কোন ভাবে ছন্দ মেলানোর চেষ্টা করেনি। তাই যখন পাঠক পড়বেন তখন একটু অন্যরকম লাগতে পারে। আপনি ভাবতে পারেন এভাবে পড়া যায় নাকি। এখানেই নজরুল যে কাজটি করেছেন তা হচ্ছে মুল অর্থ ঠিক রাখা। যাতে করে ফার্সির সাথে এর পার্থক্য খুব বেশি না থাকে।
.
নজরুলের হাতেই ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াৎ-এর সার্থক অনুবাদ হবে, সেটিই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু নজরুলের নিজস্ব ভাষ্য হলো, ‘ওমর খৈয়ামের ভাবে অনুপ্রাণিত ফিটসজেরাল্ডের কবিতার যাঁরা অনুবাদ করেছেন, তাঁরা সকলেই আমার চেয়ে শক্তিশালী ও বড় কবি। কাজেই তাঁদের মতো মিষ্টি শোনাবে না হয়তো আমার এ অনুবাদ। যদি না শোনায়, সে আমার শক্তির অভাব-সাধনার অভাব, কেননা কাব্য-লোকের গুলিস্তান থেকে সঙ্গীতলোকের রাগিণী-দ্বীপে আমার দীপান্তর হয়ে গেছে। সঙ্গীত-লক্ষ্মী ও কাব্য-লক্ষ্মী দুই বোন বলেই বুঝি ওদের মধ্যেই এত রেষারেষি। একজনকে পেয়ে গেলে আরেক জন বাপের বাড়ি চলে যান। দুই জনকে খুশি করে রাখার শক্তি রবীন্দ্রনাথের মতো লোকেরই আছে। আমার সেই সম্বলও নেই, শক্তিও নেই। কাজেই আমার অক্ষমতার দরুন কেউ যেন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ওমরের উপর চটে না যান।
.
নজরুল লিখেছেন, ‘ওমরের কাব্যে শারাব-সাকির ছড়াছড়ি থাকলেও তিনি জীবনে ছিলেন আশ্চর্য রকমের সংযমী। তাঁর কবিতায় যেমন ভাবের প্রগাঢ়তা, অথচ সংযমের আঁটসাঁট বাঁধুনী, তাঁর জীবনও ছিল তেমন।...তিনি মদ্যপ লম্পটের জীবন (ইচ্ছা থাকলেও) যাপন করতে পারেননি। তাছাড়া ও-ভাবে জীবনযাপন করলে গোঁড়ার দল তা লিখে রাখতেও ভুলে যেতেন না। অথচ, তাঁর সবচেয়ে বড় শত্রুও তা লিখে যাননি।
.
রুবাইয়াৎ নিয়ে অনেক কথা হতে পারে। হবেও অনেক কথা, কিন্তু নজরুল যেটা করে গিয়েছেন সেটা অমর। তিনি হয়ত ইতিহাসের পাতায় রুবাইয়াৎ এর ক্ষেত্রে নাম নাও পেতে পারেন। তবে আমার কাছে ব্যক্তিগত ভাবে তিনিই সেরা। যদিও আমি অন্য কারো অনুবাদ পড়িনি। তবুও একটু না হয় পক্ষপাত দুষ্ট হলাম।
শেষ করি –
‘নগদ যা পাও হাত পেতে নাও
বাকির খাতা শূন্য থাক
দূরের বাদ্য লাভ কি শুনে
মাঝখানে যে বেজায় ফাঁক।’’
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০২১ রাত ৮:০৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



