somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমার নানাবাড়ি....

০৩ রা ডিসেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

:: আমার নানা বাড়ি ::

নানাবাড়ি কথাটা শুনলেই আমার একটি চিত্র ভেসে ওঠে মনে। সন্ধ্যা নামে রোমান্টিক একটা নদী। তার তীরে সুপারী গাছ ধরে দাড়িয়ে চোখ মুচছেন আমার নানু। আর আমরা লঞ্চ এর দুই তলার একদম পেছনে দাড়িয়ে কাদছি ফেলে আসা নানাবাড়ি জন্য। আমি জানি যতক্ষন এ লঞ্চটা দেখা যাবে সামান্য একটুও, নানু ঠায় দাড়িয়ে থাকবেন সে নদী তীরের জায়গাটায়।

নানাবাড়ি নিয়ে আমার অসম্ভব আবেগ কাজ করে। জানিনা বর্তমানের শিশুদের মনে সেটা কাজ করে কিনা। মনে হয় না। কারন গত সপ্তাহে যখন বরিশাল বেড়াতে যাচ্ছিলাম তাসিনকে বল্লাম- বাবা, আমি আমার নানাবাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি। তাসিন বলে- বাবা নানা বাড়ি তো নানাবাড়ি।এটা কি আর আবার বেড়াবার জায়গা নাকি।

আমার মেজাজ বিগড়ে গেলো তবু শান্তভাবে বল্লাম বাবা, নানাবাড়িইতো সবচে ভালো বেড়াবার জায়গা। আমার শৈশবকালে নানাবাড়ি ছিলো আমার জন্য অপার আনন্দ আর অসীম রহস্যের জায়গা। সারা বছর অপেক্ষায় থাকতাম কবে ডিসেম্বর মাস আসবে, আর পরীক্ষা শেষ হবে। আব্বা ছুটি নিতেন ২-৩ দিনের জন্য। তারপর একদিন বিকেলের দিকে সদরঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করতাম।

তখনকার লঞ্চগুলো ছিলো কাঠের। নাম মনে পড়ে একটার-সাত্তার খান। আর ছিলো সামাদ নামে বিশাল এক সরকারী জাহাজ কিন্তু সেটা আমার নানাবাড়ি রুটে চলতো না। আমরা উঠতাম হুলারহাট লাইনের লঞ্চ এ। লঞ্চে উঠেই শাড়ি পেচিয়ে একটা জায়গায় রুমের মতো বানানো হতো । নদীর দিকটা থাকতো খোলা। তখনতো কবিন ছিলোনা ডেকই ভরসা। কিংবা কে জানে কেবিন হয়তো ছিলো আমার সীমিত আয়ের সরকারী কর্মচারী বাবার সামর্থের বাইরে ছিলো তা।

তবে আমরা ডেক এ ই জেকে বসতাম। বড় বিছানা করা হতো। তোষক বালিশ সব বিছিয়ে বসে পড়তাম সবাই। রেডিও চালিয়ে দিয়ে আব্বা মন দিতেন ইত্তেফাক এ। আর আমরা লঞ্চ এর রেলিং ধরে নদীর দৃশ্য দেখতাম। কত লঞ্চ নৌকা হুশহাশ বেড়িয়ে যেতো আমাদের পাশ দিয়ে। একটু পরই টিফিন ক্যারিয়ার খোলা হতো। ভাত, ডিম ভুণা, মুরগীর মাংশ, আলু ভর্তা, ডাল ভূনা দিয়ে ভাত খেতাম সবাই মিলে। আম্মা সাথে আনা বোম্বাই মরিচও খেতেন আর হা হু করতেন ঝাল এ। রাত ১২ টার দিকে আরেক আনন্দ। অনেক দুরে চোখে পড়তো বিন্দু বিন্দু আলোর রেখা বিশাল এলাকাজুড়ে। আমরা নির্নিমেশ সে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকতাম। অনেকটা সময় পড়ে সে আলো জ্বলজ্বল করতো আর তারপরই আমাদের লঞ্চ ছুয়ে ফেলতো সে আলোর রেখা তার মানে আমরা চাদপুর।

চাদপুর থেকে লঞ্চ ছাড়ার পরই আম্মা বললেন- আল্লাহ আল্লাহ করো। লঞ্চ এখন 'পাড়ি দেবে' মানে ভয়াল মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে লঞ্চ বরিশালের কোন শাখা নদীতে পড়বে। আমরা আল্লাহকে ডাকতে ডাকতে ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম ভাংতো শেষরাতে আব্বার ডাকে- ওঠো, ওঠো আমরা শিকারপুর পার হয়ে এসেছি। আমরা ধরমর করে উঠে পড়তাম। তারপর সব গোছাতে গোছাতে লঞ্চ চলে আসতো ' হক সাহেবের হাট' লঞ্চ ঘাটে। আমরা নেমে পড়তেই কয়েকটি টর্চের আলো আমাদের চোখ ধাদিয়ে দিতো। আমার নানাবাড়ির কাজের লোক হাবিব, জলিল আর ইউনুস এসেছে আমাদের নিতে। দুজন আমাদের ছোট ভাইবোনদের কোলে তুলে নেয়, আরেকজন মালপত্র নেয়। তার পর গ্রামের রাস্তা ধরে মাইলখানেক দরের নানাবাড়ির দিকে হাটা শুরু হতো।

আব্বার কথা শুনে বুঝতাম ফজরের আযান হয়ে গেছে তবু কেমন যেন ছমছম করতো শরীর। এই যে দুপাশে কলাগাছের ঝোপ তার মাঝ থেকে যদি কোন ডাকাত ঝাপিয়ে পরে আমাদের ওপর? কিছুই হতোনা আমরা ঠিকমতো পৌছাতাম। নানা তখন অনেকটা এগিয়ে এসেছেন আমাদের নিতে। নানুও বের হয়ে এসেছেন সামনের পুকুর পাড় এ।
আমরা নানা নানুকে সালাম করে বাড়িতে ঢুকতাম একটু পরেই চলে আসতো চা, মুড়ি আর আমাদের জন্য হরেক রকমের পিঠা। এগুলো খেয়ে নানুর লেপের মধ্য ঢুকে যেতাম।

আহারে কি যে সুন্দর ছিলো সে দিনগুলো আর কি যে রহস্যময়। নানাবাড়ির কাজের ছেলে হাবিব এর কাছ থেকে নানা গুপ্ত বিদ্যা অর্জন করেছি। ফুলি বুয়া চেপে ধরতেন মাঝে মাঝে বুকের মধ্যে। কি এক গোপন রসহ্যের গন্ধ দিতেন। বাড়ির পেছনে ছিলো বিশাল এক বট গাছ। তার ওপরে অনেক শুকনের বাসা ছিলো। আমাদের কাজের লোকগুলো মাঝে মাঝে নানার চোখ এড়িয়ে সে বাসা ভাংতো লাকরির জন্য। একেকটি বাসায় অন্তত ২০ কেজি লাকরি পেতো ওরা। আমরা গেলে নানা একটি পুকুর সেচ এর ব্যাবস্থা করতেন। সন্ধ্যার পর শুরু হতো গানের তালে তালে দোন দিয়ে পানি সেচা। আটজন লোক দুটি দোন দিয়ে পালা করে পুকুর সেচতো। চলতো সারা রাত। আমরা বাড়ি আছি সে সাহসে ওরা নানার গাছের রস নামাতো নিশুতি সে রাতে। তারপর শীতে কাপতে কাপতে আমরা খেতাম সে রস।

রাত কি কম রহস্যময় ছিলো? জানালা সব বন্ধ করে রাখতো নানা তবু ওপরের ফাক দিয়ে কোন গাছে চোখ গেলেই মনে হতো তিন চোখের কেউ তাকিয়ে আছে। হিসু এলে নানা নানু দুজনই সাথে দাড়িয়ে থাকতে হতো। সন্ধ্যার পর ভুলেও দক্ষিনের সেগুন বাগানটার দিকে তাকাতাম না। বিশ্বাস করুন আর নাই করুন অধুনা যে আমাজানের ছবি দেখি তার চে ঘন বন ছিলো আমার নানার বাড়িতে যদিও এখন আর তা নেই। সে বনে দিনে গেলোও গা ছমছম করতো, রাতেতো প্রশ্নই ওঠেনা।

এবার আমার নানাবাড়ির বর্ননা দেই। আমার নানাবাড়িটা লম্বায় প্রায় কোয়াটার কিলোমিটার আর চওড়ায় কয়েকশ গজ। এই পুরো এলাকায় একটা মাত্র ঘর। বাড়ির চারদিকে বেড় বা খাল দিয়ে সীমানা করা। বাড়ির চার দিকে চারটা পুকুর আর পেছনে ছিলো ঘন বন। নারকেল গাছ আছে ১৫০ এর মতো খেজুড় গাছও প্রায় সমান। বাড়িতে ঢুকতেই ছিলো পানের বরজ, তেতুল গাছ আর নারকেল গাছের সারি। এসব কিছুই রাতের বেলা নিয়ে আসতো অপার রহস্য।

এবার কয়েকজন বেড়াই বাংলাদেশ বন্ধু নিয়ে গেলাম নানাবাড়ি। জায়গাজমি সব ঠিক আছে কিন্তু সে বন নেই, পুকুরগুলোও মজে গেছে। এতবড় বাড়ি দেখাশুনার জন্য মাত্র ১ জন কাজের লোক। মুল বাড়ি তালা মারা। আমার মা এবং খালা বছরে ২-১ বার যান। ব্যস এরপর আবার তালা..।

কে জানে আমার শেষ বয়সে হয়তো এ বাড়িটিকেই আবা ছোটবেলার মতো জমজমাট করে আমি থাকবো আমার স্ত্রী রুমাকে নিয়ে। তখনো কি ভয় পাবো জানালার ফাক দিয়ে কোন গাছ দেখে? হয়তি পাবো। আমি যা ভীতু....

(ও আচ্ছা বলি আমার নানাবাড়ি বরিশালের চাখার এর বলার গ্রাম এ)
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×