দুজনের মধ্যে কার কথা ভাবছিল কে জানে ? হয়তো অঞ্জনা নিজেও জানেনা, নিজের অজান্তেই ভেবে যাচ্ছিল ।...
হঠাৎ এক ফোটা চোখের জল নাক বেয়ে ঠোটে এসে লাগলো --- সে কি, ও যে কাঁদছে ! ...এমনি করে কত কান্না কেঁদে যায় রোজ, কত অশ্রু বয়ে যায় --- দেখার মত কেউ নেই, কোনো মানুষ নেই যে ওর চোখ মুছিয়ে দেবে, আছে কেবল একটা বিস্তির্ন নীল আকাশ, যা ওর সকল অশ্রু টেনে নিয়ে নিজের অশ্রু করে ঝড়িয়ে দেয় এই নিষ্ঠুর জগৎটার বুকেই । তখন সবাই দেখে কিন্তু জানতে পারেনা কেউই যে, এ অঞ্জনার চোখের জল । আর জানলেইবা কী হবে ? আজ ছয়টা দিন ধরে যে ওর পেটে এত ব্যথা, যেন কোনো ঘূণ পোকা ছিদ্র করে চলেছে ওর নাড়ি-ভুরিতে, সে কি জানেনা ওরা ? কতবারতো বলেছে, কই কেউতো নিয়ে যায়নি ডাক্তারের কাছে ! কই বলেনিতো বাবা ভুলেও একবার --- "মা, খুব ব্যথা হচ্ছে ? যা, শুয়ে পড়গে, সব ঠিক হয়ে যাবে ।..." এই কয়টা দিন ধরে যে ওর শরীরে কয়েক ফোটা জল ছাড়া আর ঢোকেনি কিছুই সে কথা কি জানেনা ওরা ? কতবারতো ওদের সামনেই করেছে বমি, তবুও রাঁধতে হচ্ছে ওকেই, দিতে হচ্ছে ভাত বেড়ে, মাজতে হচ্ছে বাসন, এমনকি অফিসে যাওয়ার আগে ধোঁয়ার জন্য শার্ট ফেলে যেতেও ভুলেননা বাবা ! পরীক্ষাও ঘনাচ্ছে, একটু চিকিৎসা চায়, ভালোবাসা চায় --- এ চাওয়া কি খুব বেশি কিছু চাওয়া ?
যতই ভাবছে, কাঁদছে ততই, যেন ওর চারপাশের সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে, অন্ধকার ঠিক নয়, অন্ধকারের চেয়েও শূণ্য, আকাশ, শিউলি ফুলের গাছ, বাড়ি-ঘর, রোদ্র, উঠোন সবকিছু শূণ্য হয়ে আসছে !
হঠাৎ বেজে উঠলো মোবাইল ফোনটা, অচেনা নম্বর, হতে পারে যে কেউ, ক্ষণেকের মধ্যে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে ফোনটা ধরলো, ও, এযে নিখিল । সম্পূর্ণ স্বাভাবিক স্বরেই বলল এবার অঞ্জনা --- এতোদিন পর মনে পড়লো আমার কথা ?
--- কেন, তুই কি ক্যাকটাস যে বার বার নাড়া দিয়ে উঠবে মনে কাটার ঘা লেগে ? ওসব ন্যাকামো ছেড়ে বল কি করছিস ?
--- এইতো, বসে আছি ।
--- প্রিপারেশান কেমন নিলি ?
--- আমি পরীক্ষা নাও দিতে পারিরে...
--- কেন ? তোর পেট খারাপ হলো নাকি !
--- হাঁ রে, আজ ছ'দিন ধরে ভীষন ব্যাথা, যা খাই তা-ই বমি করি ।
--- ডাক্তার কী বলল ?
--- নারে, ডাক্তার দেখাইনি ।
--- কেন ?
এবারে নিশ্চুপ থেকে গেল অঞ্জনা । নিখিলই বলল --- এসব কেন করিস বল ? যা তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে ।
---হুম
---তা রান্না-বান্না কে করছে ?
--- আমিই, জানিসইতো মায়ের মেন্টাল প্রোবলেম, আর বাড়িতে মেয়ে মানুষ বলতে তো মার আর আমিই ।
--- কেন, তোর না দুটো ভাই আছে?
---ধ্যেৎ, ছেলেরা কি আবার রাঁধে নাকি ?
---বাহ্ ! কি সুন্দর কথা !
--- আমার ফিলিংসগুলো কেউ বোঝেনারে নিখিল ।
এটুকু বলতেই অঞ্জনার চোখ দিয়ে আবার শুরু হল জল পড়া, কিন্তু নিজের সম্পূর্ণ ক্ষমতা লাগিয়ে কণ্ঠস্বর এমন রাখলো যাতে নিখিল টের না পায় কিছু ।
--- তোকে আর বলার মত কথা নেই আমার কাছে, ডাক্তার দেখা, সুস্থ হয়ে ওঠ ।
---হুম ।
---রাখছি ।
---রাখ ।
আর বাঁচতে চায়না অঞ্জনা, মরে যেতে চায়, কতদিন ধরে চেয়ে আসছে । চায়না আর এ যন্ত্রণাময় জীবন । মরে যাবার জন্য কত চেষ্টাই না করেছে সে, কখনো নিজেই নিজের হাতে টিপে ধরেছে গলা, কখনো কেটে দিয়েছে হাত । গলায় দড়ি দেওয়ারও চেষ্টা করেছিল একদিন, শাড়ি পাকিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে বিছানায় টুলও তুলে নিয়েছিল । কিন্তু টুলে চড়ে পাখার সাথে বাঁধতে যাবে শাড়িটি, ঠিক তখনই হঠাৎ ভেঙে পড়েছিল কান্নায়, কেমন এক অদ্ভুত রকমের ব্যথা অনুভব করলো । মনের কোনো এক গহিন অঞ্চল থেকে আসছিল সে ব্যথা, কিংবা হয়তো ব্যথা নয়, একটা আশা --- বাঁচার । এরই জন্যে মরতে পারেনি সেদিন, তা না হলে সেদিনই মরে যেতে পারতো । কি ভালো হত মরে যেতে পারলে --- আজ আর এতো দুঃখ, এতো এতো যন্ত্রণা সইতে হতোনা ।
খচ্ করে কেটে দিল হাত, চকচকে একটা ব্লেড দিয়ে । রক্ত ঝড়তে আরম্ভ করলো, কিন্তু কোনো ব্যথা যেন নেই, ব্যথা হয়না, এটা ওর অনেকদিনের অভ্যাস । মরে যাওয়ার এক চেষ্টা । মরতে পারেনি আজও, কিন্তু রক্তের লাল রঙ দেখে চোখের জল বর্ণহীনতার জন্য লজ্জা পায়, দুঃখ যেন লাঘব হয় ।
খচ্, খচ্, খচ্ : আবারো পুঁচ, একসাথে কয়েকটা । চোখ আর এই ক্ষতগুলো যেন কোনো ঘন সবুজ নিভৃত পাহাড়ী অরণ্যের দুটো ঝর্ণা, নেমেছে প্রতিযোগীতায় । প্রতিযোগীতা টিকলোনা খুব বেশিক্ষণ, মনের ঝর্ণা, হৃদয়ের ঝর্ণার কাছে হার মেনে নিল । কিন্তু হায়, আজও হলনা মরে যাওয়া !
দুপুরটা কেটে গেল এভাবেই, সন্ধ্যায় রাঁধতে হল আবারো ওকেই । পেটে ব্যথা ছিল, সাথে এখন হাতেও । দেখায়না কাউকে, জামা পরেছে লম্বা হাতাওয়ালা । সবাইকে খাইয়ে যখন শুতে গেল অঞ্জনা, মেসেজ দেখলো নিখিলের, "কিরে, কী বলল ডাক্তার ?" মেসেজটা দেখা মাত্রই সারা মন জুড়ে কেমন এক ক্রোধের হাওয়া বইল --- সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল মোবাইল ।
তারপর কত রাত অব্দি যে প্রার্থনা করলো তার ঠিক নেই । " হে ঈশ্বর আমাকে নিয়ে যাও, আমি যেন আর না জাগি, নিয়ে যাও ঈশ্বর, নিয়ে যাও" ।
ঈশ্বর ডাক না শুনে নিজের অস্তিত্ব না থাকার প্রমাণ দিলেন প্রতিবারের মত আরো একবার । সকালে উঠে বাসন নিয়ে পুকুরে গেল, কিন্তু মাজলোনা সে, একটা একটা করে ব্যুমেরাং এর মত মাঝপুকুরে ছুঁড়তে লাগলো বাসন । আহা, কি আনন্দ, কি হাসি, জীবনে হাসেনি এমন করে আর কোনোদিন । কিন্তু বাসন শেষ হয়ে যেতেই শুরু হল কান্না, এ কান্না আর দশদিনের কান্না নয়, নীরবে-নির্জনের নয় । কান্না রীতিমত জোড়ালো, জগৎটাকে জানান দিয়ে ।
এ লীলা থামেনি আর, এখনো সে কখনো কাঁদে, কখনো হাসে, হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে । কাঁদতে কাঁদতে মাথা আছড়ায় । হয়তো এ কান্না-হাসি কেবলই কান্না-হাসি নয় বরং মরে যাওয়ারই অভিনব এক প্রচেষ্টা । কিন্তু বাঁচতে দিক আর না-ই দিক, মরে যেতে ওকে দেবেনা কেউ, সেজন্যেই এখন ওর হাত-পা বেঁধে রেখে ওর জীবনটাকে ধরে রাখা হয়েছে ।