somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মরীচিকা ( পর্ব - ৯ )

২২ শে নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



এমন সময় প্রেসিডেন্টসাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে উপস্থিত শিক্ষকদের দিকে তাকালেন । এক্কেবারে সামনে ছিলাম আমি । প্রেসিডেন্টসাহেব আমার দিকে তাকাতেই,
-হ্যাঁ স্যার! আপনি বা দিদিরা যখন বলছেন ,তখন এমন বিপদের দিনে ওনার সঙ্গে যেতে আমার কোন আপত্তি নেই। বরং ওনাকে সাপোর্ট দিয়ে ওনার বাবাকে যদি সুস্থ করার ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে নিজেকে ধন্য বলে মনে করব।
প্রেসিডেন্টসাহেব অত্যন্ত খুশি হলেন । সাথে সাথে আমার পিঠ চাপড়াতে লাগলেন। ড্রাইভারকে বললেন তৈরি হতে, যত দ্রুত সম্ভব । আমি একটু ড্রেস বদল করতে রুমে চলে এলাম । মিনিট পাঁচেকের মধ্যে নিজেকে তৈরি করে যখন আবার ঘটনাস্থলে গেলাম , দেখলাম শেফালীম্যাডাম সেই ভেজা ড্রেস পড়েই দাঁড়িয়ে আছেন । কয়েকজন দিদিমণি ওনাকে পোশাক বদলের পরামর্শ দিলেও আজকে ওনার কোন কিছুতেই মুড নেই বলে ড্রেস বদল করতে রাজি হলেন না । কাজেই আমি গাড়িতে এসে বসতেই গাড়ি স্টার্ট নিল ।

রাতের বেলা গ্রামের রাস্তা প্রায় জনশূন্য । আঁকা-বাঁকা গ্রাম্য পথ ছেড়ে এক সময় আমরা মেইন রোডে উঠলাম। এবার হঠাৎ করে গাড়ির বেগ অত্যন্ত বেড়ে গেল । দূর থেকে ঝাকে ঝাকে ধেয়ে আসা গাড়ির হেডলাইট গুলোকে যেন ছুটন্ত তারা বলে মনে হল। এরকম তারাগুলি পাশ দিয়ে হুস -হাস করে ছুটতে লাগল। আমরা দুজন গাড়ি পিছনের সিটে বসলেও এখনো পর্যন্ত আমাদের মধ্যে কোন কথা হলো না । উনি সামনে ড্রাইভারের সিটের পিছনে মাথা ঠেকিয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ অন্ধকারে আশপাশ দেখতে দেখতে আমি শেফালীম্যাডামের মানসিক অবস্থার উন্নতির অপেক্ষা করতে লাগলাম। অবশেষে কোন এক সময় আমিই নীরবতা ভঙ্গ করলাম।
-আচ্ছা, আপনার বাবা এই মুহূর্তে ঠিক কোথায় আছেন?
যথারীতি মাথা না তুলে উত্তর দিলেন,
- বুঝতে পারছি না, বাবা এখন ঠিক কোথায় আছেন। তবে পাশের বাড়ির কাকু ফোন করে বলেছিলেন ,বাবা অসুস্থ আমরা ওনাকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।
- তাহলে আমাদের আগে বাড়িতে যাওয়াই ঠিক হবে ।
- হ্যাঁ আমিও সেটাই ভাবছি । তবে বাড়ি থেকে শুনে গাড়িটা নিয়ে তখন না হয় আমরা হসপিটলে যাব।
- হ্যাঁ, সঠিক সিদ্ধান্ত আপনার । আগে বাড়িতে যাওয়াই ঠিক হবে। পরে অবস্থা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। আপনি বোধহয় পরে আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি ,ম্যাডাম ।
- হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। পরে অনেকবার ফোন করেছি, কিন্তু আর লিংক পাইনি। চৌধুরীবাবু, আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ দেব, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা।
- না না! ম্যাডাম! এ কি কথা বলছেন ! আপনার বাবা অসুস্থ। আপনার বিপদের দিনে সামান্য সঙ্গে থেকে সঙ্গ দেওয়া ছাড়া কিই বা আমি করলাম ? আর তাছাড়া এই অসময়ে আপনাকে একাকী ছেড়ে দেওয়াটাও সহকর্মী বা শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বিবেকে বাঁধলো । যে কারনে প্রেসিডেন্টসাহেবের চোখের ভাষাতেই চলে এলাম।
-হ্যাঁ আমিও সেটা লক্ষ্য করেছি । আপনি না এলে হয়তো আমাকে একাই আসতে হতো। তবে বোম্বাই রোডের একটি সুবিধা আছে । ছয় লেনের রাস্তা সারাক্ষণ প্রচন্ড ব্যস্ততার মধ্যে থাকে। যতই রাত হোক না কেন একবার বোম্বে রোডে উঠতে পারলে আর ভয় থাকে না । যদিও এত রাতে বাইরে বার হবার অভিজ্ঞতা আগে কখনো হয়নি । তবে এই রোডের সুনাম আছে ।
- সহমত, আপনার সঙ্গে যে ব্যস্ততম হওয়ায় বোম্বে রোড তুলনায় অনেকটা নিরাপদ। তবে বিপদ তো আর কাউকে বলে আসে না ।

কথা বলতে বলতে আমরা ক্রমশ এগোতে লাগলাম। গাড়ি বিদ্যুৎ গতিতে চলতে থাকলো । অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে মনে হল শেফালীম্যাডাম প্রাথমিক ধাক্কা সামলিয়ে অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছেন । সেই সন্ধ্যা থেকে পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষিধে চি চি করছে। সাধারনত বাইরে বার হলে আমি বরাবরই কাছে কিছু বিস্কুট রাখি । আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সঙ্গের প্যাকেটটা খুলে অফার করতেই, এই প্রথম স্মিত হাস্যে ম্যাডামকে কথা বলতে দেখলাম।
-আপনার কাছে কি সব সময় বিস্কুট থাকে?
-তা বলতে পারেন। আসলে ছাত্রাবস্থায় আমি দু-তিনটি বিস্কুট ও একটু জল খেয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিতাম। সেই অভ্যাসটি আজও রয়ে গেছে।
-খুব ভালো অভ্যাস। বাইরের হাবিজাবি খাবারের চেয়ে দুটো বিস্কুট অনেক অনেক নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকরও বটে।
এমন সময় দেখলাম ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে,
-দাদা, এবার একটু আস্তে চালান ।
বুঝলাম আমরা ওনার বাড়ির খুব কাছে চলে এসেছি। আরো কিছু পরে একটি বড় মিষ্টির দোকানের সামনে এলে,
- দাদা ,বামদিকে চলুন।
ড্রাইভার গাড়িটাকে বাম দিকে নিয়ে চলল। মেইন রোড ছেড়ে গাড়ি আবার পাড়ার রাস্তায় ঢুকলো। যথেষ্ট সরু রাস্তা। সাইকেল, রিক্সার জন্য এগোনো বেশ কঠিন হতে লাগলো। আরো দুই/তিন মিনিট পরে একটা পিংক কালারের দোতলা বাড়ির সামনে চলে এলাম । অমনি ম্যাডাম বেশ কিছুটা জোরেই বলে উঠলেন,
- ব্যাস! ব্যাস ! গাড়ি থামান, এটা এটা ।
আমার বুঝতে বাকি থাকল না, ম্যাডাম এর সম্পূর্ণ কথা মানে এটাই ওনাদের বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে এক ছুটে উনি বাড়ি চলে গেলেন । আমরা দুজনে গাড়িতে বসে রইলাম। দু -এক মিনিটের মধ্যে আবার উনি চলে এলেন।
- বাবাকে আবার ইস্টার্ন বাইপাসে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে । বাড়িতে পাশের বাড়ির এক কাকিমা ও দিদি আছে।
উনি গাড়িতে উঠে বসতেই আবার গাড়ি স্টার্ট নিল।সাবধানে পাড়ার রাস্তা ছেড়ে আবার আমরা বোম্বে রোডে উঠলাম । নতুন করে ওনাকে আবার বেশ চিন্তিত হতে দেখলাম । আবার উনি দুটি সিটের মাঝে মাথা ঠিকে থাকলেন । পাশ দিয়ে হুশ - হাস করে ছুটে যাওয়া গাড়ির হেডলাইটে এবার আমি ওনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। অস্বীকার করবো না যে এর আগে যতবার শেফালীম্যাডামের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলেছি, কেন যেন দুই-একবার উনার সঙ্গে চোখাচোখি হলেও বাকি সময়ে আমাকে খুব নার্ভাস লাগতো। যার ফলে আমি আর ওনার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারতাম না। সে ক্ষেত্রে বাকি কথাগুলি হত কেবল নিয়ম রক্ষার। কিন্তু আজ প্রথমবার অনবরত হেডলাইটের ঝলকানিতে আমার মনের সমস্ত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঘুঁচে গেল। সমুদ্রের ঢেউ যেমন একটি তীরে মিশতে না মিশতে নুতন একটি দৃশ্যপটে চলে আসে , আমিও তেমনি মুহুর্মুহু গাড়ির হেডলাইটের ঝলকানিতে ওনার রূপে মোহিত হতে লাগলাম। স্নিগ্ধ মুখশ্রীর এক অপার শান্তি আমার অন্তরকে তোলপাড় করে তুলল । তবে মনের ছন্দপতন হতেও সময় লাগলো না । যখন উনি বাবার চিন্তায় বিভোর আর তখনই আমার মন স্বপ্নের রাজকন্যাকে হাতের নাগালে পেলেও অসহায় অবস্থায় ওনার রূপকে দংশন করতে বিবেকে কুঠারাঘাত করতে লাগলো । কাজেই একসময়
নিজেই মুখ ঘুরিয়ে নিলাম । এসময়ের ঠিক গাড়ি বিদ্যাসাগর সেঁতুতে উঠল । এবার ম্যাডামকে মুখ তুলে বাইরের দিকে তাকাতে দেখলাম ।
-কোথায় এলাম আমরা?
-দ্বিতীয় হুগলি সেঁতু।
- তাহলে তো আর বেশি বাকি নেই ।
-হ্যাঁ , সেটা বলতে পারেন ।

অবশেষে প্রায় সওয়া চার ঘণ্টার মাথায় আমরা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছালাম। ঘড়িতে তখন রাত পৌঁনে এগারোটা বেজে গেছে । ড্রাইভার আমাদের নামিয়ে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি ঘুরিয়ে নিল । ম্যাডামের বাবাকে আগেও একবার এখানে নিয়ে আসাতে সবকিছু ওনার জানাশোনা ছিল । কাজেই আমাদের আর ঘুরতে হলো না । সরাসরি মেল ওয়ার্ডের সামনে চলে এলাম। এখান থেকে প্রথমবার কল করতেই অপর প্রান্তে,
- মাম, তোরা চলে এসেছিস?
-হ্যাঁ মা! এই জাস্ট নামলাম। তোমরা কোথায় আছ?
- এইতো মেল ওয়ার্ডে।
-আমরাও মেল ওয়ার্ডে চলে এসেছি।
মেল ওয়ার্ডের সামনে অত রাতেও রোগীর পরিজনদের বেশ আনাগোনা দেখলাম । এরই মধ্যে একটি স্থানে কিছুটা খোঁজার পরে ব্যাগপত্র সমেত এক ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলাকে দেখলাম। ম্যাডাম পরিচয় করিয়ে দিলেন ,
- আমার মা ও কাকু।
আমি নমস্কার করে সহকর্মীর পরিচয় দিতেই ,
- হ্যাঁ বুঝেছি । তোমার কথাতো ও বাড়িতে এর আগেও বলেছে । তোমরা মুখার্জি না ?
মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে,
- না ,মাসিমা ! আপনি অন্য কারো সঙ্গে আমাকে গুলিয়ে ফেলছেন । আমরা মুখার্জী নই ,চৌধুরী।

বিশেষ দ্রষ্টব্য:- শেফালীম্যাডামের সঙ্গে এই পর্বটি যথেষ্ট বড়। সঙ্গত কারণে এদিকে দুটি পর্বে ভাগ করা হলো।

সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা অক্টোবর, ২০১৯ সন্ধ্যা ৭:১০
৪৮টি মন্তব্য ৪৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেঘ ভাসে - বৃষ্টি নামে

লিখেছেন লাইলী আরজুমান খানম লায়লা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩১

সেই ছোট বেলার কথা। চৈত্রের দাবানলে আমাদের বিরাট পুকুর প্রায় শুকিয়ে যায় যায় অবস্থা। আশেপাশের জমিজমা শুকিয়ে ফেটে চৌচির। গরমে আমাদের শীতল কুয়া হঠাৎই অশীতল হয়ে উঠলো। আম, জাম, কাঁঠাল,... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×