সেবার শিক্ষাবর্ষের মাঝামাঝি সময়ে বাংলার শিক্ষক শ্রীযুক্ত বংশীবদন পানিগ্রাহী মহাশয় চলে যাওয়াতে আমাকে প্রভিশনাল রুটিনে নবম শ্রেণির ক্লাস দেওয়া হয়েছিল । পরপর কয়েকদিন প্রভিশনাল ক্লাসে গিয়ে ক্লাসটির প্রতি আমার একটা আকর্ষণ তৈরি হয় ; যে কারণে বিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলকে ক্লাসটিকে পাকাপাকিভাবে আমাকে দেওয়ার প্রস্তাব দিই । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভালো ছাত্রদের পড়াতে বেশ উপভোগ করতাম ঠিকই তবে একটি দুশ্চিন্তাও তৈরী হয়েছিল । যিনি এই ক্লাসে বাংলা পড়াতেন শ্রদ্ধেয় বংশীবদনবাবু সবার কাছে বংশীবাবু নামেই পরিচিত ছিলেন । এহেন বংশীবাবু ছিলেন ছাত্রদের অত্যন্ত কাছের মানুষ। তিনি স্কুলে একটি নাটকের দল তৈরি করেছিলেন । ' ছন্দম' নামক নাট্যদলটি এলাকায় নাটক পরিবেশন করে ইতিপূর্বে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছিল । সারাবছর ছাত্রদের নিয়ে তিনি নাটকের মহড়ার পাশাপাশি আবৃত্তির প্রশিক্ষণও দিতেন । ফলে শ্রেণিকক্ষের বাইরেও তিনি নিজের একটি সত্ত্বা তৈরি করতে পেরেছিলেন । অন্যত্র স্থায়ী চাকরি পাওয়ার কারণে এই বিদ্যালয়ে ওনাকে ইস্তফা দিতে হয়। বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে হলেও সেদিন ছাত্ররা তাদের প্রিয় স্যারকে বিদায় দিতে যতটা কেঁদেছিল বংশীবাবুও নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারেননি। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুহুর্মুহু চোখ মুছে ছাত্রদের আবেগের কাছে ধরা না দেওয়ার চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা করতে পারেননি । তাই এক্কেবারে শেষে যখন সব ছাত্ররা ওনার পায়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল তখন উনিও নিতান্ত শিশুর মত আচরণ করে ওদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন । এরকম একজন শিক্ষকের স্থলে নিজেকে কতটা বিকল্প হতে পারব সে দুশ্চিন্তা প্রথম থেকেই ছিল । পাশাপাশি ছিল ছাত্রদের গুণগত মান নিয়ে একটি বাড়তি চাপও । গোটা বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীর ছাত্রদের মেধা ছিল সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট । ইতিপূর্বে বিভিন্ন শিক্ষকদের বাঘা বাঘা প্রশ্নে ওরা ঘায়েল করেছে- স্টাফরুমে সে আলোচনা প্রত্যক্ষণ করেছি । কাজেই নতুন করে রাত জেগে পড়াশোনা করে নিজেকে আরো পালিশ করতে লাগলাম ।
অস্বীকার করবো না যে একেবারে প্রথম দিকে ক্লাসটিকে ম্যানেজ করতে আমায় একটু সমস্যা হয়েছিল । বছরের শুরুতে নতুন ক্লাস ও নতুন শিক্ষক উভয়ই যতটা সংযত থাকে ; মিড সেশনের শিক্ষকের প্রতি ছাত্রদের একটু ঝালিয়ে নেওয়ার প্রবণতা থাকে । পাঠ্য বিষয় সম্পর্কিত তো বটেই ; সিলেবাস বহির্ভূত বহু প্রশ্ন করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে রীতিমতো বিব্রত করাটা এ সময়ে ওদের একটা বিনোদনেরই অংশ হয়ে দাঁড়ায় । আমার ক্ষেত্রে, ওদের এরকম বাউন্সারগুলোকে অত্যন্ত সহজ ও সরল ভাবে গ্রহণ করেছি ; তবে সবগুলো যে সহজে হজম করতে পেরেছি তা নয় । চেষ্টা করতাম ওদের একজন প্রকৃত বন্ধু হওয়ার । তবে এখানে আবার একটু সমস্যা দেখা যেত । বেশি বন্ধুর মত মেশার ফলে ওরা পরিমিতবোধ হারিয়ে ফেলে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে টানাটানি করত । আমায় লক্ষ্য ছিল ওদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা । এরকম ক্ষেত্রে আমার হঠাৎ গাম্ভীর্য ও বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে বাকি ছাত্ররা অবশ্য সংশ্লিষ্ট ছাত্রটিকে মৃদু ধমক দিতো , যেটি আমারও লক্ষ্য ছিল । যাই হোক অল্প দিনের মধ্যেই এক এক করে সব ছাত্রদের নাম মুখস্ত করে ফেললাম । ভালো ছেলেদেরকে সব শিক্ষক মহাশয়রা নাম ধরে ডাকেন । তাদের মধ্যে আলাদা করে কোনো প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় না । কিন্তু যারা পড়াশোনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল তাদের নাম ধরে ডাকলে যে হাতেনাতে ফল মেলে সেটা নিজ অভিজ্ঞতায় দেখেছি । কয়েকদিনের মধ্যে এরকম দুর্বল বা পিছিয়ে পড়া ছেলেদেরকে চিহ্নিত করি এবং আমি আমার পরিকল্পনা মাফিক কাজও শুরু করি। ফলে অল্প দিনের মধ্যেই তারা যেমন একদিকে তাদের বিশৃঙ্খলা বন্ধ করল, অপরদিকে তাদের পাঠের প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠলো।
শান্তনু দে নামের একটি ছাত্রের ক্ষেত্রে আমার কোনো পরিকল্পনা কাজ করলো না । প্রথম কয়েকদিনেই দেখেছি পড়াশোনার মাঝে বারবার বাইরে তাকিয়ে থাকতে বা অমনোযোগী হতে । বিষয়টা লক্ষ্য করলেও আমি ওকে শুরুতে ঘাটাইনি । এর ফলে পরের দিকে প্রবণতাটা এত বেড়ে গেল যে গোটা ক্লাসে সারাক্ষণই সে বাইরে তাকিয়ে থাকতো । দুই- একবার নোটিশ করলে চোখ ফিরিয়ে নেই ঠিকই কিন্তু পরক্ষণেই আবার যা তাই । সহপাঠীদের সঙ্গে তেমন কথা বলে না বা এমনি ক্লাসে কোন দুষ্টুমি করে না। কিন্তু সমস্যা একটাই সারাক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থাকা । স্টাফরুমে ওর প্রসঙ্গ উঠতেই সবাই এক বাক্যে এমন পাগল বা পাগলাচণ্ডী বলে বিষয়টি উড়িয়ে দিলেন যে আমি আর দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন করার সাহস পেলাম না । স্বভাবতই সহকর্মীদের এমন উত্তরে নিশ্চেষ্ট না হয়ে বিকল্প কি করা যায় সে চিন্তা মাথায় চেপে বসেছিল । কদিন পরে এরকমই একদিন ক্লাসে গিয়ে প্রথমেই ওর বাইরে তাকানোতেই এক পা দু পা করে এগিয়ে যাই। এক্কেবারে সামনে গিয়ে বেঞ্চে দুহাত দিয়ে সামান্য ওর দিকে ঝুঁকে প্রশ্ন করি,
- বাবা ! বাইরে কি আছে ?
ওকে মুখে কিছু বলতে হয়নি। কিন্তু বাকি ছাত্ররা সমস্বরে হৈ হৈ করে উঠলো । একজন তো উঠে দাঁড়িয়ে বলেই ফেলল,
- স্যার ! ও পাগল স্যার ! একা একা কথা বলে। আমাদের কারো সঙ্গে মেশে না ।
বাকিরা তখনো হেসে যাচ্ছে । আমার একটা ছোট্ট প্রশ্ন যে ওদের এতটা হাসির কারণ হবে সেটা আমি কল্পনা করতে পারিনি । কিছুক্ষণ চুপচাপ প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকলাম । আমার আকস্মিক নীরবতা দেখে ছাত্রদের কোলাহল মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল । এবার আমি বাকিদের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলাম ,
- আমি শান্তনুকে ছোট্ট একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছি । কিন্তু এর মধ্যে তোমরা এমন অট্টহাসির কি কারন খুজে পেলে ?
কেউ কোন উত্তর দিচ্ছে না। সিমেন্টের মেঝেতে কেবল পা ঘষাঘষির শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই । বেশ কয়েক জন আবার ব্যাগে মাথা গুঁজে বসে আছে । বিষয়টিকে আর না খুঁচিয়ে এবার আমি পঠন-পাঠনে চলে যাই । ঘন্টা পড়লে শান্তনুকে স্কুল শেষে আমার সঙ্গে দেখা করার কথা বলে আসি ।
বিকেলে ছুটির পরে নিজের রুমে অপেক্ষা করছিলাম শান্তনুর আগমনের । প্রায় দেড়ঘণ্টা অপেক্ষা কালে হাতের কাছে থাকা বিভিন্ন বইয়ের পাতা উল্টে যাচ্ছি , কিছুই পড়ছি না বা চোখে দেখছিও না। কেবল একটি অস্থিরতায় যেন নিজেকে আড়াল করার আপ্রাণ চেষ্টা করছি । একসময় নিজের উপর বিরক্ত হলাম যে একটা ব্যতিক্রমী ছেলের সঙ্গে আলাদাভাবে কথা বলতে চেয়ে নিজেকে কেন এভাবে চাপের মধ্যে ফেললাম বা কিই বা আমি তার জন্য করতে পারি - এমন সব হাবিজাবি চিন্তা করে । সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত আমি অপেক্ষায় থাকলাম । সন্ধ্যার পর প্রতিদিনকার মত ডাইনিং রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম । গিয়ে দেখি সেখানে দু- চার জন ছাত্র ছাত্রীর সঙ্গে শেফালী ম্যাডামও বসে আছেন । চোখাচোখি হতেই একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে উনিই প্রথম জিজ্ঞাসা করলেন ,
- চৌধুরীবাবু ! কেমন আছেন ?
- ভালো আছি ; ম্যাডাম ! আপনি কেমন আছেন ?
- আছি ,মোটামুটি !
- মেসোমশাই কেমন আছেন ?
- বাবাকে নিয়েই তো খুব টেনশনে আছি । শরীরের যা অবস্থা ; কখন যে কি হয়, কিছু বলার নেই ।
- কেন, এখনো কি উনি হসপিটালে আছেন ?
- না ! হসপিটালে নয় ; বাড়িতেই আছেন । তবে এত সব বিধিনিষেধ ! এরই মধ্যে বেঁচে থাকা ।
- শুনে খুব খারাপ লাগছে ; ম্যাডাম। কিন্তু কি আর করা যাবে ! আপনাকে সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া আর তো কিছু করার নেই ।
- হ্যাঁ ! ঠিকই বলেছেন। তবে বাবা-মায়ের অসুস্থতা ঠিক চোখে দেখে থাকা যায় না ।
- আপনি হয়তো শুনেছেন কিনা জানিনা ; তবে আমার বাবাও খুব অসুস্থ । আপনার বাবা যখন অসুস্থ ছিলেন সে সময় ওনারও হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে।
- হ্যাঁ ! আপনার বাবার ও হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে ? কবে হয়েছিল ওনার ? এখন কেমন আছেন ?
- না! না ! আপনি এতটা বিচলিত হবেন না। বাবা এখন বাড়িতে আছেন এবং অনেকটাই সুস্থ বলা যেতে পারে । তবে ঐসময় নার্সিংহোমে ভর্তি করতে হয়েছিল । ঘটনাটা ঘটেছিল যেদিন আপনার বাবার জন্য হসপিটালে আপনার কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলাম ; কথা ছিল সেদিন বিকেলে আসবো , ঠিক তার পরের দিন । সেই যে আটকে গেলাম ,তারপর থেকে বাবাকে নিয়ে নার্সিংহোম ডাক্তার ওষুধপত্র ছুটি করানো সব ঠিকঠাক বুঝে, বাড়িতে বুঝিয়ে দিয়ে পরে স্কুলে জয়েন করি ।
- হায় ! রাম ! এর মধ্যে তাহলে এতো কিছু ঘটনা ঘটে গেছে ; অথচ আমি কিছু জানতে পারলাম না ।
- আসলে আপনাকে জানানোর মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। তাছাড়া আপনি নিজেও তো অনেক দিন অনুপস্থিত ছিলেন ।
- হ্যাঁ ! ছিলাম ঠিকই .... আচ্ছা চৌধুরীবাবু ,আগামীকাল দুপুরে আমার একটা জরুরী কাজে যাওয়ার আছে। ওখান থেকে আটান্ন গেটে মাসির বাড়ি যেতে হবে। হোস্টেলে ফিরতে একটু রাত হতে পারে । আপনি কি আটান্ন গেটে বিকেল পাঁচটা নাগাদ একটু আসতে পারবেন ?
-হ্যাঁ ! ম্যাডাম ,আপনি বলছেন যখন তাহলে নিশ্চয়ই যাবো। তবে একটুখানি চিন্তা রয়ে গেছে ক্লাস অ্যাডজাস্টমেন্টের ব্যাপারটি নিয়ে । আপনি দুপুরে যেখানে যাওয়ার যান এবং কাজ মিটিয়ে আসুন । আমি এদিকে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষককে বলে ম্যানেজ করে ততক্ষণে পৌঁছে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করব ।
আমি এতক্ষণ ধরে শেফালী ম্যাডামের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম । ইতিমধ্যে টিফিন করতে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের সংখ্যাটি বেশ বেড়ে যায়। তাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে কান পাতা দায় হয়ে পড়ে। আগেই রমেনদাকে খাবার দিতে বলেছিলাম। হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে ,
- মাস্টারদা ! খাবার তো নিয়ে এলাম , কিন্তু বসবেন কোথায়? চারিদিকেই তো ছেলেমেয়েরা জায়গা দখল করে রেখেছে।
আমিও ওর কথার সঙ্গে সংগতি রেখে তাকিয়ে দেখলাম বাস্তবিক কোথাও একটিও সিট খালি নেই। অস্ফুটে বললাম ,
- তুমি আমার হাতে দাও । আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেয়ে নিচ্ছি ।
সেদিন সন্ধেবেলা একপ্লেট মুড়ির সঙ্গে গরম গরম কয়েকটি বেগুনি দেখে মুহুর্তেই খিদেটা কয়েকগুণ বেড়ে গেল । অদ্ভুত একটি প্রশস্তি মনের মধ্যে খেলে গেল। একমুঠো মুড়ির সঙ্গে সদ্য ভাজা গরম বেগুনিতে কামড় বাসাতেই জিহ্বার অগ্রভাগটা এক্কেবারে ঝলসে গেল । তবুও না ফেলাতে ,গরমবেগুনি গলাধঃকরণের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাসনালীকে জানান দিয়ে যাচ্ছিল। যার পরিণতিতে দুচোখ আর্দ্রতায় ভরে গেল ।
আমি আর সামলাতে পারলাম না নিজেকে ; সোজা মেঝেতে বসে পড়লাম । মুড়ি বেগুনি ছিটকে পড়ল চতুর্দিকে ; আমার হাতের শুধুই প্লেট । ছেলেরা চিৎকার করে উঠল । রমেনদা ছুটে এসে আমার হাত ধরে দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে করতে ,
- কি হয়েছে আপনার ? শরীর খারাপ লাগছে ?
- না ! ঠিক বুঝতে পারেনি যে বেগুনিটা এতটা গরম ।
আমার কাহিল অবস্থা দেখে সবাই যখন ব্যস্ত, তার মধ্যে একজনকে দেখলাম অনেকটা নির্লিপ্ত ; শেফালী ম্যাডাম ! মুখে একটা দুষ্টু হাসি নিয়ে,
- আহারে ! জিহ্বটা পুড়ে গেছে একেবারে ; খুব লেগেছে না আপনার ?
আমি সরল মনে বোকার মত একটা হাসি দিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই,
- তবে পোড়া জিহ্ব নিয়ে রাতে কিছু না খাওয়াই ভালো । আসি এখন ,আগামীকাল আবার দেখা হবে ...
আমার বোকা বোকা হাসি এক্ষেত্রে আবারো উত্তর হলেও বুঝতে পারলাম না যে উনি আমার ভালোর জন্য বলেছেন না রসিকতা করেছেন ।
চলবে ...