অস্বীকার করবো না যে গত দু'দিনেই শান্তনুর প্রতি আমার একটা অনুকম্পা তৈরি হয়েছে । তাই দেখা করতে বললেও না আসাতে পরের দিন প্রথম পিরিয়ডে গিয়ে মনে মনে খুঁজতে থাকি ওকে । আমার কৌতূহলী চোখ দেখে ছাত্রদের অনেকেই আমার মনের কথা বুঝতে পারে । আমি মুখে কিছু না বললেও একজন হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললো ,
- স্যার ! শান্তনু আজ ক্লাসে আসেনি ।
- কেন আসেনি বলতে পারবে ?
- না স্যার সেটা বলতে পারব না !
ঘাড় ঘুরিয়ে বাকিদের উদ্দেশ্যে,
- তোমরা কেউ বলতে পারবে শান্তনুর না আসার কারণ ?
কেউ কোন উত্তর দিল না। কয়েকজন শুধু নীরবে মাথা নেড়ে গেল। আমি আবার জিজ্ঞাসা করলাম,
- এখানে শান্তনুর কোন রুমমেট আছে ?
একজন উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
- হ্যাঁ স্যার ! শান্তনু আর আমি একই রুমে থাকি। তবে ও তো কারো সাথে তেমন কথা বলে না। আজ সকালে অবশ্য ওকে বিছানা থেকে উঠতে দেখিনি । ডাইনিং রুমে খেতে যেতেও দেখিনি। আমি সকালে খেয়ে গিয়ে দেখলাম ও তখনো পর্যন্ত ঘুমোচ্ছে।
যাইহোক আমার বাইরে বার হওয়ার তাড়া ছিল । আগে থেকে অ্যাডজাস্ট করা পরপর দুটি ক্লাস করে মুভমেন্ট রেজিষ্টারে নোট দিতে গিয়ে পড়লাম আবার বিরম্বনায় । উল্লেখ্য আমরা হোস্টেলে থাকায় স্কুল চলাকালীন আমাদের বাইরে যাওয়ার তেমন কোনো প্রয়োজন পড়ে না। যে কারণে ইতিপূর্বে কোনদিন রিপোর্ট করার কোনো প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু আজ দ্বিতীয় পিরিয়ডের পরে রিপোর্ট করতে গেলে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষকের চোখা চোখা প্রশ্নের সামনে পড়তে হলো।
- কি ভাইয়া ! কোথাও অ্যাপো-ট্যাপো আছে নাকি ?
- না না স্যার ! ওসব সবার কপালে জোটে নাকি ?
- আমরা কিন্তু নাক দিয়ে ভাত খাইনা ভাই।
-আপনার বিশ্বাস না হয় আমার সঙ্গে চলুন স্যার । গিয়ে দেখতে পারেন কোথায় যাচ্ছি , সহাস্যে বললাম ।
উনিও হাসতে হাসতে বললেন,
- দেখো ভাইয়া বিদেশ বিভুঁইয়ে বলে কথা ! বিপদে পড়লে অবশ্যই সাহায্য চাইতে ভুলো না ।
যথারীতি সহাস্যে আমিও উত্তর করলাম,
- তেমন হলে আপনাকে গুরু মানবো ; হা হা হা । চলুন না গিয়ে দেখে আসবেন আমি কোথায় যাচ্ছি । আমারও একা একা যেতে ভালো লাগছে না ।
- কি কোন কোর্স-টোর্স করছো নাকি?
-ভাবছি এডুকেশনে এম এ করব । তাই যাচ্ছি একটু খোঁজখবর নিতে ।
- গুড ! ভেরি গুড ! যাও খোঁজখবর নাও। সাবধানে এসো ।
ওনার কথা শেষ না হতেই হাত নেড়ে ইশারা করে ঘড়ির দিকে তাকাতে তাকাতে নিজেকে খুব ব্যস্ত দেখিয়ে গেটের দিকে পা বাড়ালাম । কিন্তু হঠাৎ শান্তনুর কথা মনে পড়লো । ফিরে গিয়ে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষক মহাশয়কে ঘটনাটা জানালাম । উনি খোঁজ নেবেন আশ্বাস দেওয়াতে আবার গন্তব্যের দিকে পা বাড়ালাম ।
আটান্ন গেটে পৌঁছাতে আমার প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগেছিল । স্কুল থেকে স্থানটির দূরত্ব খুব বেশি নয় ; তবে সরাসরি কোনো যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় বারবার ব্রেক করে যাওয়াতেই দীর্ঘক্ষন পথে কাটাতে হয়েছিল । স্থানটি সম্পর্কে আগে থেকে জানা ছিল । মূলতঃ একটি পর্যটনকেন্দ্র , বেশ আকর্ষণীয় জায়গা । যদিও চোখে দেখার সুযোগ ইতিপূর্বে ঘটেনি। একদিকে হুগলি নদী অপরদিকে দামোদর ও রূপনারায়ণের মিলনস্থল বা ত্রিবেণী সঙ্গমস্থল এই আটান্ন গেট । রাজ্য সরকার ও হাওড়া জেলা পরিষদের যৌথ উদ্যোগে স্থানটি হাওড়া জেলার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে । সুদৃশ্য নদীর তীরে একাধিক হোটেল, মোটেল, প্রশস্ত রাস্তাঘাট স্থায়ী, অস্থায়ী সারিবদ্ধ একাধিক দোকান - সব মিলিয়ে এলাকাটিকে বেশ আকর্ষণীয় বলেই মনে হলো । শীতের প্রারম্ভ হওয়ায় বেশ কিছু পিকনিক পার্টির উপস্থিতি চোখে পড়লো । মোটামুটি আধঘন্টা থেকে চল্লিশ মিনিট এলাকাটিকে ভালো করে দেখে ঘুরে শেফালী ম্যাডামের দেখা না পেয়ে , অবশেষে বাসস্ট্যান্ড থেকে একটু দূরে নদীর ধারে একটি বেদীর উপরে বসে পড়লাম । দূর থেকে আসা বড় বড় স্টিমার ও জাহাজের ধাক্কায় নদীর একটার পর একটা বড় বড় ঢেউগুলি মনের মধ্যেও মুহুর্মুহু প্রশ্নের পর প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছিল । সেদিন না হয় বাবার অসুস্থতার জন্য বাস্তবে আমার সাহায্যের দরকার ছিল। কিন্তু আজ! আমার সাহায্য কি প্রকৃতই ওনার খুব দরকার ? আর তা যদি না হয়ে থাকে তাহলে কেনই বা এরকম একটি প্রেমের তীর্থক্ষেত্রে আমাকে ডাকলেন । কোন এক শিল্পী গেয়েছিলেন তার ভালোবাসার উদ্দেশ্যে, এই সাগরের ঢেউ দিয়ে তাকে আমি মিলিয়ে দিলাম.... । আজ আমার মনের মধ্যে অনুরণিত হচ্ছে এই গানটি । সদ্য জাগা প্রেম কি তাহলে আজ নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাবে ? না নতুন কোন অধ্যায়ের সূচনা ঘটবে-আমি তার প্রমাদ গুনতে লাগলাম ।
ঢেউ গুনতে গুনতে কিছুটা বোর হয়ে সবে উঠে দাঁড়িয়েছি , এমন সময় দূর থেকে জলপাইরঙের চুড়িদার পরিহিত, চোখে সবুজ রোদচশমা , কাঁধে চেরিকালারের হাল ফ্যাশনের ব্যাগ , পায়ে স্টিলেটোহিলের জুতো পরিহিত এক তরুণীর আগমন দেখে দৃষ্টি ফেরাতে পারিনি। এক্কেবারে থমকে গেলাম। আগেই বলেছি স্থানটি পর্যটন কেন্দ্র হওয়ায় বিভিন্ন হিন্দি গানের উপস্থিতিতে নিজের মৌলিক সত্ত্বাকে বিসর্জন দিয়ে আমি অসহায়ের মত স্বর্গের অপ্সরার দিকে তাকিয়ে রইলাম । ঠিক হাঁটাতো নয় ; যেন ছন্দের তালে তালে নৃত্যরত কোন উর্বশী পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। আমি যথারীতি ওনার পশ্চাৎ গমন নিরীক্ষণ করতে লাগলাম । হঠাৎ উনি পিছন ফিরে তাকাতেই আমার মনের মধ্যে দুন্দুভি বেজে উঠল । এক পা দু পা করে উনি ক্রমশ এগিয়ে আসছেন আমার দিকে।যা দেখে মুহূর্তে সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হলো । একদম সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলেন ,
- চৌধুরীবাবু! কখন এসেছেন?
আমি ওই মুহূর্তে শেফালী ম্যাডামের কথা সম্পূর্ণ ভুলে গেছিলাম । আচমকা নিজের নাম কানে আসাতে সম্বিত ফিরে পেলাম । কিছুটা লজ্জিত হয়ে,
- আ আ জ্ঞে... এই তো এসেছি, তা প্রায় চল্লিশ/পঞ্চাশ মিনিট তো হবেই ।
- আপনি এখানে এসেছেন শেফালী ম্যাডামের সঙ্গে দেখা করতে অথচ এক সুন্দরী মহিলাকে দেখে নিজেকে বেসামাল করে ফেললেন মনে হচ্ছে ?
- স্যরি ম্যাডাম! আসলে আপনাকে এতদিন যেভাবে দেখে এসেছি, আজ আপনার হেয়ারস্টাইল সাজগোজ বা টোটাল ড্রেস আপ বাস্তবিকই আমি আপনাকে চিনতে পারিনি ।
- তাহলে আপনি অস্বীকার করতে পারবেন না যে আমাদের আশেপাশে এমন অনেকে আছেন যারা একটু সাজগোজ করলে বা রূপচর্চা করলে আরও বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেন।
- হ্যাঁ ! সহমত আপনার সঙ্গে । সাজগোজ করলে নিঃসন্দেহে মেয়েদের রূপ বাড়ে বৈকি ।
কথা বলতে বলতে আমরা রূপনারায়ণের তীর ধরে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা নির্জন জায়গায় চলে এলাম এবং একটা বেদি দেখে বসে পড়লাম ।
- আচ্ছা ! ধরুন, আপনি একজনকে ভালবাসেন । যে ভালোবাসা আপনি যেমন প্রকাশ করতে পারছেন না আপনার কাছে কাছের মানুষটির কাছে , তেমনি সেও প্রকাশ করতে করতে পারছে না তার ভালোবাসা আপনার কাছে। কিন্তু দুজনেই আকার-ইঙ্গিতে নিজেদের অনুভূতি বুঝিয়ে দিচ্ছেন । এমতাবস্তায় যদি সুন্দরী কোন রূপসী আপনার সামনে আসে তাহলে আপনি আপনার ভালোবাসা ভুলে তার প্রতি আকৃষ্ট হবেন ? সুন্দরী ললনার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়বেন - এটা কি তাহলে ভালোবাসা হলো মশাই ?
- না না ! তা কেন হবে? তবে বিষয়ের ব্যাখ্যাটা বোধ হয় এমনটি ভাবাটা অপ্রয়োজনীয় ।
- চৌধুরীবাবু ! আমি কিন্তু আপনার কথাতে আমার উত্তর পেয়ে গেছি ।
শেফালী ম্যাডামের বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্নের ধোঁকা খেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে মাথা নিচু করে থাকলাম ; তবে লক্ষ্য ছিল ওনার সাজ পোশাকের প্রতি । হঠাৎ চোখ গেলো ওনার হাতের আঙ্গুলের দিকে । চাপা কলার মত সাদা সাদা আঙ্গুলের অগ্রভাগে নখ গুলোতে সুন্দর করে বাই কালার নেলপালিশ দেওয়া । বেলনার মত দুটো হাত এবং গোলাপি রঙের লিপস্টিক পরিহিত ঠোঁট দুটোকে বাস্তবেই গোলাপের পাপড়ি বলেই মনে হলো ।
- আপনাকে কিছু কথা বলার জন্য এখানে ডেকেছিলাম ।
- হ্যাঁ ! বলুন ।
- বাবার অসুস্থতার সময়ে হসপিটালে আপনার দ্বিতীয়বার না যাওয়ার কারণটি পরিষ্কার হওয়ার পর ধারণা হয় যে আপনাকে নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করা যায় । আর সে কারণেই অনির্বাণ মুখার্জির প্রসঙ্গটি বলাতে আজ তোমাকে এখানে ডাকা । এইরে ! আপনাকে' তুমি ' বলে ফেললাম ।
- না !না! তুমি বলে ঠিকই করেছেন। এটাই বেশি ভালো লাগছে।
- ধন্যবাদ তোমাকে, আমরা স্কুলের গন্ডির মধ্যেই না হয় আপনিটাকে ধরে রাখবো । হ্যাঁ! যে কথা বলছিলাম,
অনির্বাণের সঙ্গে আমার পরিচয় গ্রাজুয়েশনে পড়াকালীন । কলকাতার আশুতোষ কলেজে ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হই। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত গার্লস স্কুলে পড়ায় কোন ছেলেবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় ছিল না । কলেজে গিয়ে তাই স্বপ্ন ছিল ছেলেদের সঙ্গে বেশি বেশি করে বন্ধুত্ব করার । মেয়েবন্ধু ছিল তবে ছেলেবন্ধুর সংখ্যাটা ছিল তুলনায় অনেকটা বেশি। বাড়ি থেকে দৈনিক কলেজে যাওয়ার সমস্যা ছিল ; তাই গোলপার্কের একটি বাড়িতে পেয়িং গেস্ট থাকতাম । টাকাপয়সার ব্যাপারেও ছোট থেকে আমার কোন সমস্যা ছিল না । বাবা জানতেন যে আমি কখনো বাজে খরচ করি না । ছোট থেকেই যখনি যা দরকার পড়েছে বাবা বিনা বাক্যে দিয়ে দিতেন । সদ্য কলেজে ভর্তি হয়ে হঠাৎ যাতে টাকা পয়সার কোন সমস্যা না হয় তাই কোন কোন রবিবার বাড়ি যেতে না পারলে বাবা নিজে এসে টাকা পয়সা দিয়ে যেতেন । যে টাকার সিংহভাগই চলে যেতে আমার কলেজ বন্ধুদের পিছনে। বন্ধুদের পিছনে এই অকাতরে টাকা খরচ করানোয় আমি নতুন একটা সমস্যায় পড়লাম ।
চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ১২:৩২