সমগ্র সংকলনে ছোট-বড় মিলিয়ে ২৬ টি গল্প আছে। বইটির সম্পাদক আমাদের সবার প্রিয় হাসান মাহবুব ভাইয়ের এ এক অনন্য সৃষ্টি। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে শ্রদ্ধেয়া জানা আপুকে। উৎসর্গে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
শুরুতেই কৃতজ্ঞতা জানাই শ্রদ্ধেয় মা. হাসান ভাইকে, যার অবদান ব্যতীত রিভিউ কার্যটি আমার পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব ছিল। ১৫২ পাতার সংকলনটির দক্ষিণা মাত্র আড়াইশো টাকা। যারা এখনো পর্যন্ত বইটি ক্রয় করতে পারেন নি বা করেননি তাদেরকে অনতিবিলম্বে বইটি সংগ্রহ করার অনুরোধ রইলো ।
৫,
চোখাচোখি - মোহাইমিনুল ইসলাম বাপ্পী
প্যারাসাইকোলজিক্যাল গল্পে ড.জিব্রান একজন সাইকিয়াটিস্ট। ওনারই পেশেন্ট সুমনের সঙ্গে কেস টেকিং নিয়ে এই গল্পের বিন্যাস। আর পাঁচটা ছেলের থেকে সুমন একটু আলাদা প্রকৃতির। অন্য ছেলেরা যেখানে মেয়েদের শারীরিক বৈশিষ্ট্য বা খাঁজ গুলোকে লক্ষ্য করে সুমনের লক্ষ্য সেখানে মেয়েদের কেবল চোখের দিকে। এ প্রসঙ্গে ডাক্তারবাবুর যুক্তি ছিল মানুষের মস্তিষ্ক সব সময় ডিস্টিংক্টিভ ফিচারের প্রতি আকৃষ্ট হয় । পুরুষ হোমো স্যাপিয়েন্স থেকে নারী হোমো সেপিয়েন্স এখানে আলাদাকারি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে পড়ে। যেটা সাইকো বায়োকেমিক্যাল।যদিও রেটিনা- কর্নিয়া এসবের মধ্যে তেমন পার্থক্য থাকে না। আর এ কারণেই তার চক্ষু প্রীতি একটু অস্বাভাবিক বৈকি।
নিজের চক্ষু প্রীতির সমর্থনের সুমন আরও বলতে থাকে, বিভিন্ন ভঙ্গিমায় চোখের ছবি দেখে ফেসবুকে একটি মেয়ের প্রতি সে প্রেমাসক্ত হয়ে পড়েছিল। কিন্তু যেদিন তারা সামনাসামনি সাক্ষাৎ করে, সেদিন মেয়েটির চোখকে ওর কাছে জীবন্ত বলে মনে হয় নি। বাড়ি ফিরে সে তাকে আনফ্রেন্ড করে দেয়। যদিও মেয়েটি সুন্দরী, শিক্ষিতা এবং মার্জিত স্বভাবের ছিল। এক্ষেত্রে ডাক্তারের যুক্তি ছিল,সুমন শুধু তার চোখের প্রেমে পড়েছিল। তার ঠোঁটের , চিবুকের বা শরীরের নয়।
সুমন আবার বলতে লাগল ,এবার সে প্রেমে পড়েছিল এক বোরকাওয়ালির নাম আদৃতা ।আশ্চর্যজনকভাবে উভয়ের পছন্দ অপছন্দের মধ্যে অদ্ভুত রকমের মিল ছিল । যেমন ছিল উভয়েরই চোখের গঠনেও। এক সেমিনারে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। প্রথমে ফোন নম্বর দেওয়া -নেওয়া ,পরে প্রেম। বিয়ের আগে চেহারা দেখতে সুমনের ইচ্ছা না থাকলেও আদৃতা একদিন উপযাজক হয়ে খুলতে থাকে মুখের আবরণ, হাতের দস্তানা প্রভৃতি। কি আশ্চর্য! চোখের চারদিকে কিছুই নেই ,একদম ফাঁকা! এ যেন শুধু একটি অবয়ব। হলো ওম্যান! বোরকার ভিতর তার কোন শরীর নেই। ডাক্তারবাবু প্রথমে এক ধরনের ক্লাস্টার সি পার্সোনালিটি ডিসঅর্ডার বলে বিষয়টি চিহ্নিত করেন এবং কগনিটিভ থেরাপির ও সামান্য ওষুধ খেলে বিষয়টি ঠিক হবে বলে ব্যবস্থাপনা করেন । কিন্তু যখন জানতে পারেন সুমনের সঙ্গে আদৃতা পাশেই আছে। তখন পরোখ করেন পাশের চেয়ারের উপরে শূন্যে ভেসে আছে এক জোড়া চোখ। এক অদ্ভুত আতঙ্ক তার চোখে-মুখে ফুটে ওঠে।
সাহিত্য সমাজের দর্পণ। গল্পকাররা চলমান সমাজে বিভিন্ন ঘটনা তাদের গল্প-উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলেন । সে দিক থেকে আলোচ্য গল্পে সুমনের ফেসবুকে মেয়েটির চোখের প্রতি আসক্তিতে ডক্টরের সাইকোলজিকাল ব্যাখ্যাটি নিঃসন্দেহে সদর্থক বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু যখন আদৃতাকে পাশের চেয়ারে বসে শূন্যে ভেসে আছে এক জোড়া চোখ- প্রসঙ্গটি এল তখন বিষয়টা অনেকটা হরর মুভি মতো লাগলেও গল্পটা যে বাস্তবতা হারিয়েছে তা বলা বাহুল্য।
৬,
চন্দ্রমোহিয়ান - মিথি মারজান
শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি আমাদের প্রত্যেকেরই জীবনে কমবেশি জড়িয়ে আছে। আলোচ্য গল্পে লেখিকা ওনার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি মাখা চন্দ্রমোহিয়ানকে অত্যন্ত সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন । কখনো ছোটবোন জুঁথিকে নিয়ে মাঝরাতে চন্দ্রালোকিত জোসনা গায়ে মাখা, কিংবা জানালার পর্দা সরানোকে কেন্দ্র করে খুনসুটিতে মেতে ওঠা। আবার কখনো বা মাঝরাতে ঘুমন্ত আব্বুকে চাঁদ দেখতে ডেকে তোলার মতো ঘটনা পরিবেশিত হয়েছে। নির্জন জলরাশিকে দুটি খণ্ডে বিভক্ত করে চলমান জাহাজের ডেকের উপর মাঝ রাতে চন্দ্রমহিয়ায় মোহিতো লেখিকা তার রূপে যখন উল্লসিত,আনন্দাশ্রু যখন চোখের বাঁধ মানলো না । তখন পরম মমতায় বাবার কান্দুনিবুড়ির জন্য স্মাইলিং এর মধ্যে এক অপার্থিব শান্তি খুঁজে পাওয়া যায়।
কথায় বলে, উত্তরসূরী শেখায় নিতে অঙ্গীকার এক নতুন ভোরের। কথাটির যেন সার্থক প্রতিফলন ঘটেছে গল্পের একেবারে শেষে যখন তিন বছরের মেয়ে একদিন বাবা- মাকে মাঝরাতে চাঁদ দেখানোর জন্য চিৎকার করে ওঠে। আর তখনই যেন পৃথিবীর সমস্ত চাওয়া পাওয়া গুলো এখন অনির্বচনীয় মিলনে একসূত্রে গাঁথা হয়ে যায়।
গল্পটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমারও শৈশব ও কৈশোরের কিছু ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কিছুক্ষণ চোখ মুদে স্মৃতি রোমন্থন করতে লাগলাম। পাশাপাশি এক অসম্ভব পারিবারিক সংহতি বোধের চিত্র ফুটে উঠেছে । আমরা প্রত্যেকে দোষে -গুণে মানুষ । জীবনের বিভিন্ন সময়ে প্রয়োজনে আমাদের আপনজন ছেড়ে দূর দেশে পাড়ি জমাতে হয়। কিন্তু এমন কিছু অমলিন স্মৃতি থেকে যায় যা হৃদয়ের মণিকোঠায় ভাস্বর হয়ে থাকে আজীবন।
গল্প বেশ কিছু টাইপো চোখে পড়লো- কৈশোর/কৈশর ,পাহারাদার/পাহাড়াদার, সখ্যতার/সখ্যেতার , পারতাম না/পারতামনা
৭,
মেমোরি ইরেইজ- সুমন কর
চলমান সমাজের অবক্ষয়তার এক সার্বিক চিত্র তুলে ধরেছেন লেখক আলোচ্য গল্পটির মাধ্যমে। গল্পের শুরুতেই তিনি তুলে ধরতে চেয়েছেন যে তিনি কাউকে চিনবেন না, কিন্তু সবাই ওনাকে চিনবে।এমন ইরেজ মেমোরি নিয়ে উনি যখন দুদিন পরে বাসায় পৌঁছালেন মায়ের একটার পর একটা প্রশ্নের উত্তরে নির্লিপ্ত থাকায় বিরক্ত হয়ে মা স্থান ত্যাগ করলে, পরে তিনি বাথরুমে শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ স্নান সেরে যেন স্মৃতিতে জমে থাকা হৃদয়ের ময়লাটুকু ধুয়ে মুছে সাফ করেন।
দ্বিতীয় পর্বে তিন অফিসে গিয়ে দেখেন, অসম্পূর্ণ ফাইলটি তার টেবিলে যথারীতি পড়ে আছে।সময়ে কাজ শেষ করতে না পারার জন্য উনার চাকরিটি চলে যায়। হতোদ্যম হয়ে নিকটবতী একটি পার্কে বসে তিনি আবিষ্কার করেন,
" পাড়ার ছোট্ট পার্ক ঘাস নেই আছে ধুলো,
ঘাসের অভাব পড়োয়া করেনা সবুজ বাচ্চাগুলো।" ( কবীর সুমনের বিখ্যাত গানটি)
উনি বুঝতে পারেন পার্কে যারা জীবন যাপন করে তাদের চেয়ে তো উনি অবশ্য অনেক সুখ -স্বাচ্ছন্দে ছিলেন। তবে সেখানে নিজের সঙ্গে নিজেকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হচ্ছে। কিন্তু সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারছেন না-এটা এক ধরনের প্রতারণা নয় কি? আর এই বিবেক নামক বস্তুটির হাত থেকে রেহাই পেতেই ওনাকে মেমোরি ইরেইজ এর উপায় অবলম্বন করা। কিন্তু যেই মুহুর্তে আবার সব স্মৃতি ফিরে আসবে শুরু হবে আবার বেঁচে থাকার অভিনয় বা নাটক প্রভৃতি।
অত্যন্ত উচ্চমার্গ সম্পন্ন গল্পটি সাধারণ পাঠকদের ভালো নাও লাগতে পারে। আমার কাছেও গল্পটি একটু একটু নিরস লেগেছে। বিশেষ করে মায়ের সঙ্গে তার সংলাপ কালে মায়ের অভিব্যক্তি ও উনার মুখে কিছু সংলাপ বসিয়ে মেমোরি ইরেইজ এর মত চমৎকার বিষয়টি আরও বেশি টাচিং করা যেত।
৮,
অ- প্রস্ফুটিত- সায়েমা আক্তার
এটা একটা ট্রাজেডিক প্রেমের গল্প। বছর দুয়েক আগে পাশের বাড়ির শানুকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল রমিজ। দুজনের পরিবার বিয়ে মেনে নেয়নি। গ্রাম্য সালিশে তাদেরকে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দেয়। বাধ্য হয়ে তারা লোকালয় থেকে বহুদূরে এক নির্জন স্থানে ঘর বাঁধে। বিয়ের এক বছরের মাথায় রমিজ সুখবর শোনে যে সে বাবা হতে চলেছে। আরো এক বছর পরে যেদিন শানুর প্রসব ব্যথা শুরু হয় সেদিন অমাবস্যা ছিল। ঘরে ছিল না আলো দেওয়ার মতো ন্যূনতম কেরোসিন টুকুও। এমতাবস্থায় রমিজ মিয়া ছোটেন গঞ্জের ক্লিনিকে ও কেরোসিনের সন্ধানে। বাজারে গিয়ে শোনেন ফার্মেসির দোকানে থাকা আপদ বিপদে একমাত্র ভরসা ভ্যানটি নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব গঞ্জে চলে গেছেন, ফিরবেন পরের দিন সকালে। অগত্যা সামান্য কিছু ওষুধ ও বন্ধ একটি দোকানের ডাকাডাকির পর সামান্য কেরোসিন নিয়ে পিচ ঢালা অন্ধকারের মধ্যে যখন বাড়ি ফেরেন ততক্ষনে স্ত্রীর শ্বাসবায়ু উবে গেছে।
অথচ তাদের কত স্বপ্ন ছিল। একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হবে যার নাম আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলেন, পুতুল। কিনেছিলেন তার জন্য হরেক রকম খেলনা ও জামা কাপড়ও। কিন্তু সমস্ত স্বপ্নকে অধরা রেখে প্রস্ফুটিত না হয়েই চলে গেল পুতুল। চলে গেল রমিজের ভালবাসা; তার আদরের শানু।
গল্পটা আরো বেশি টাচি হতে পারতো। গল্পের বর্ণনায় আবেগের চেয়ে ঘটনার বর্ণনা বেশি বলে মনে হয়েছে। আরেকটি বিষয় চোখে পরলো- গল্পের শুরুতে লেখক যেখানে বলেছেন পৌষের মাঝামাঝি হালকা শীত । অন্যস্থানে বলেছেন, তার ওপরে শীত পড়ছে। বিষয়টি বেমানান লাগলো।তৃতীয়তঃ গল্পের সময় কাল হিসেবে তাদের বিবাহিত জীবন দু বছর দেখালেও শানু সুখবর দিচ্ছে ঠিক এক বছর পরে। আর তার প্রসব যন্ত্রণা সে ক্ষেত্রে আরও এক বছর পরে ; যেটা ও বেশ বৈসাদৃশ্য লাগলো।এ ক্ষেত্রে গাইনোকলজিস্ট সময় কালটি মেনে চলাই কাম্য ছিল।
উৎসর্গ;-পোস্টটি উৎসর্গ করা হল আমাদের সবার প্রিয় শ্রদ্ধেয় মা. হাসান ভাইকে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা এপ্রিল, ২০১৯ রাত ১১:৪২