মরীচিকা (পর্ব-২৮)
নতুন সংসারটা নিয়ে শেলীর ভাবনার শেষ ছিল না। লক্ষ্য ছিল সংসারটিকে তিলে তিলে গড়ে তুলবে। কথা প্রসঙ্গে সংসারের বিভিন্ন খুঁটিনাটি জিনিসের কথা প্রায়ই বলতো। আমি বরং অতদূর স্বপ্ন না দেখে বর্তমানকে নিয়ে ভাববার কথা বললে,
-নাগো না! এখন থেকে না ভাবলে শুরুতে ভয়ানক সমস্যা হবে।
-তুমি কি সারাক্ষণ কেবল এসব নিয়ে চিন্তা করো?
-হ্যাঁ গো সোনা! ঠিক তাই। আমার সারাদিন কাটে শুধু তুমি তুমি, তুমি তুমি করে। বলেই,
ব্যাগ থেকে চার-পাঁচটি লিস্ট বার করে আমার হাতে ধরিয়ে দিল। ওর সমগ্র চোখে মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি।আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম ওর চোখ-মুখের দিকে। নিজেকে খুব সাহসী লাগলো। আলতো করে ডান হাতটা চেপে ধরতেই চোখে মুখের ভাষা বদলে গেল। বহুদিনের স্বপ্ন ঠোঁট দুটি এগিয়ে ধরল। নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না, আমি ঠিক দেখছি তো? কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘোর কেটে গেল। চারপাশটা একটু তাকিয়ে নিলাম। এমনিতেই দুপুরবেলা; আশপাশে একটা জনপ্রাণীকেও দেখলাম না। দূরে মাঝিরা নৌকায় জাল টানছে। বুকের মধ্যে যদিও দুরু দুরু হচ্ছে তবুও বাহ্যিক নিশ্চিন্তমনে খোলা আকাশের নিচে শেলীর ঠোঁটের আহ্বানে সাড়া দিলাম। সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ প্রবাহিত হলো। এক অপার্থিব ভালো লাগার মুহূর্তে নিজেকে হারিয়ে ফেললাম।
নিজেকে কিছুটা সংযত করে এবারে শেলীর বাড়িয়ে দেওয়া লিস্টে চোখ বুলালাম। দেখেই তো আমার চোখে ছানাবড়া খাওয়ার উপক্রম। আমার যে উপার্জন সেই উপার্জনে শেলীর চাহিদা মেটানো যে বাস্তবে সম্ভব নয় সে কথা ভেবে এবং সেদিনে লিস্টের আনুমানিক মূল্যমান নিরূপণ করে সারা শরীরে শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো। হঠাৎ আমার চনমনে ভাবটি অদৃশ্য হতেই,
-নীল! হঠাৎ তুমি এমন গুটিয়ে গেলে? বলে আমার থুতনি ধরে নাড়া দিতে লাগলো।
-না না! এইতো বেশ আছি।
-হ্যাঁ! আমি ঠিক বুঝেছি। তুমি আমার হাতের লিস্ট দেখে আকাশ-কুসুম ভাবছো।
-না না আমি ওসব ভাবছি না, বললেও নিজের চোখ ও মুখের অভিব্যক্তিকে স্বাভাবিক করতে পারেনি।
-তাহলে শোনো, তোমাকে সারপ্রাইজ দেবার জন্য গত কয়েকদিন আগে থেকে লিস্টগুলো করেছিলাম। তুমি কি এখনও বোঝনি যে তোমাকে সারপ্রাইজ দিয়ে আমি একটা আনন্দ পাই?যখন একলা থাকি, যখন আমার হাতে যথেষ্ট অবকাশের সময় থাকে, তখন কেবল তোমার কথাই ভাবি আর মাথায় চলে আসে হাবিজাবি চিন্তাভাবনা।লক্ষ্য থাকে তোমাকে নতুন নতুন সারপ্রাইজ দেওয়ার। বুঝলে হে মশাই। কাজেই অহেতুক আতঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।তোমাকে ঘাবড়ে দেওয়া আমার উদ্দেশ্য হলেও তুমি যে এতটা মুহ্যমান হয়ে পড়বে তা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। এদিক দিয়ে আমি একশো শতাংশ সফল হা হা হা হা হা...
উল্লেখ্য সেদিন শেলীর সারপ্রাইজের কাছে নিজের অসহায় আত্মসমর্পণ করে প্রতিদানে বোকা বোকা হাসি দেওয়া ছাড়া আমার বিকল্প কোনো উপায় ছিল না।ভালোবাসার মধ্যে কত বিচিত্রতা, কত রকমের জটিলতা বা চতুরতা যে থাকতে পারে তা ভেবে বেশ পুলকিত হলাম। আসলে মেয়েরা বোধহয় তাদের কাছের মানুষকে এভাবে ঝালিয়েই নেয়। তবে এই ধরনের পরাজয়ের মধ্যে একটা মধুরতা আছে; আছে নির্ভরশীলতা যা সম্পর্ককে শক্ত ইমারতের উপর দাঁড় করিয়ে দেয়। পরাজয় যদি সুখানুভূতিতে পূর্ণ হয় তবে তা আগামীর বীজমন্ত্র হয়ে এমন মিষ্টি-মধুর ধরা খাওয়ার আগ্রহকে শত গুণ বাড়িয়ে দেয়।
উচ্চ-প্রাথমিকের একটি প্রশিক্ষণ নিতে ইংরেজির শিক্ষিকা হিসেবে শেলীকে পনেরো দিনের জন্য ভুবনেশ্বরে যেতে হয়েছিল। যে সময়ে একটা দিনও চোখের আড়ালে থাকাটা ভাবতে পারতাম না সেখানে দীর্ঘ পনেরো দিনের জন্য ভুবনেশ্বর চলে যাওয়াটা আমার কাছে ছিল যেন কল্পনারও অযোগ্য। বাস্তবে খবরটি জানার পর প্রচন্ড অসহায় বোধ করছিলাম। ও যে খুব আগ্রহী ছিল তা নয়। কিন্তু বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশ পালন করতেই এক হিসেবে ও প্রশিক্ষণ নিতে মনস্থির করে। মাঝের পনেরো দিন কি করে কাটবে তা ভেবে আমি এক প্রকার দিশেহারা হয়ে পড়ি। চলে যাওয়ার আগের দিন রাতে ডাইনিং রুমে ওর সঙ্গে শেষ বারের মত দেখা হয়েছিল। আলাদা করে কথা বলার তেমন সুযোগ ছিল না। ও উপস্থিত দিদিদের উদ্দেশ্যে জানায়,
-তোমাদের সঙ্গে আমার আবার বেশ কিছু দেখা হবে না।
ডাইনিং রুমের সবাই বিষয়টি আগে থেকেই জানতো। একসঙ্গে বেশ কয়েকজন বলে উঠলো,
- দিদিমণি সাবধানে যাবেন।
মিলিদি জিজ্ঞাসা করল,
-দিদি ওখানে আপনার প্রশিক্ষণ কত দিনের?
-প্রশিক্ষণ পনেরো দিনের। তবে ওখান থেকে সরাসরি হোস্টেলে আসবো না। কয়েকদিনের জন্য একটু বাড়িতে যাব। তারপরে হোস্টেলে ফিরব।
রমেনদা জিজ্ঞাসা করল,
-দিদিমণি তাহলে আগামীকাল সকালেই কি রওনা দিচ্ছেন?
-হ্যাঁ রমেনদা! আপাতত সেরকমই প্লান আছে।
-বেশ! সাবধানে থাকবেন দিদি।
-ধন্যবাদ তোমাদের সকলকে। তোমরাও সাবধানে থেকো।
সমগ্র কথোপকথন কালে আমি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলাম। এক সময় কোন সাড়াশব্দ না হতেই মুখ উঁচু করে দেখি শেলী রুমের দিকে একপা বাড়িয়ে। চোখাচোখি হতেই যেন অপেক্ষায় ছিল। মিষ্টি একটি হাসি উপহার দিয়ে বলল,
-আসি তাহলে।
আমি অস্ফুটে উচ্চারণ করলাম,
-সাবধানে যাও। যদিও সে শব্দের প্রাবল্য উপস্থিত কারো কর্ণগহবরে প্রবেশ করেছে বলে মনে হলো না। আর হবেই বা কেমন করে,কারো কান পর্যন্ত পৌঁছে যাক তা যে আমার ইচ্ছেও ছিল না। উল্লেখ্য আমার দুই ঠোঁট ও চোখের ভাষা বুঝতে শেলীর অবশ্য অসুবিধা হলো না। অত ভিড়ের মধ্যেও পাল্টা এক জোড়া ঠোঁট শূন্যে আমাকে উপহার দিল। আসন্ন বিরহের সাগরে নিমজ্জনের আগে সান্ত্বনা স্বরূপ এক জোড়া উড়ন্ত কিস উপহার পেলেও কোন এক অজানা আশঙ্কায় আমার মনোজগতে তোলপাড় শুরু হলো। সেবার মেরিনা বিচে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছিলাম অসংখ্য ছোট-বড় ঢেউ কিভাবে একটার পর একটা আছড়ে পড়ছে বেলাভূমির উপরে। কোন কোন ঢেউ মাঝ সমুদ্রে মিলিয়েও যাচ্ছে। যেগুলি পরিণতি পাচ্ছে, তারা আবার ফেনিল জলরাশির আকারে বেলাভূমির উপরিভাগে অপূর্ব ছান্দিক নৃত্যের তালে তালে যেন মিতালী করছে। মনোরম সেই দৃশ্য মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে নিজের ভাবজগতে যে এভাবে পাল্টা আঘাত হানবে, তা ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। তাই আজ শেলীর সাময়িক প্রস্থানে যখন বিরহ যন্ত্রণায় কাতর হলাম তখন আমার মনোজগতে আছড়ে পড়া ঢেউয়ে খড়কুটোর মতো যাবতীয় সান্ত্বনা সব উড়ে গেল। আশঙ্কার চোরা স্রোতগুলির যেন দলাপাকিয়ে সুনামির ন্যায় আমার হৃদয়ে আছড়ে পড়তে লাগলো। আমি ব্যাকুল হয়ে পাগলপ্রায় হয়ে উঠলাম।
শেলী ভুবনেশ্বরে রওনা দিতেই আমিও দিন দুয়েকের জন্য বাড়িতে চলে আসি। ওর অনুপস্থিতিতে মনে কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। ছুটে চলে এলাম বাড়িতে। ভেবেছিলাম বাড়িতে সবার সঙ্গে থাকলে হয়তো মানসিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে। কিন্তু না, মানসিক অবস্থার এতোটুকু পরিবর্তন হয়নি।একটা অস্থিরতা সারাক্ষণ তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। যে কারণে দুদিন কাটতে না কাটতেই হাঁপিয়ে পড়ি। তৃতীয় দিন সকালে আবার হোস্টেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। সেদিন বাড়ি থেকে একটু বেলা করে বার হওয়াতে হোস্টেলে পৌঁছাতে বেশ রাত হয়ে গেছিল। সবে হাত মুখ ধুয়ে নিজের রুমে বসেছি। এমনিতে শেলী না থাকায় মুডটিও একেবারে স্বাভাবিক ছিল না।হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক শব্দ। এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখি রমেনদা দাঁড়িয়ে।
-মাস্টারদা গতকাল বিকালে শেফালী ম্যাডাম এসেছিলেন।
-হ্যাঁ! শেফালী ম্যাডাম এসেছিলেন?
অস্বীকার করবো না যে শেলীর অকস্মাৎ আগমনে আমার চোখ মুখ ছানাবড়া হয়ে যায়। মনে মনে আমার অবর্তমানে শেলীর আগমনে নিজের দুর্ভাগ্যকে দায়ী করতে থাকি। যাই হোক ক্ষনিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠলেও আমার বিস্ময়ান্বিত অভিব্যক্তিতে রমেনদাও ততটাই চোখ বড় বড় করে বলতে লাগল,
-হ্যাঁ দাদা। ওনাকে কাল হঠাৎ ফিরে আসতে দেখলাম।
-বল কি? উনি প্রশিক্ষণে যাননি?
-আমি জিজ্ঞেস করছিলাম সে কথা। কিন্তু উনি মুখে কোন উত্তর দিলেন না। আমিতো জানি উনি ভুবনেশ্বরে গেছেন। সেদিন রাতে বললেনও সে কথা। যে কারণে ওনাকে দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম । তবে আপনার খোঁজ নিচ্ছিলেন দাদা। আপনি বাড়ি গেছেন বলাতে একটা চিঠি দিয়ে গেলেন আপনাকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে।
রমেনদা আবারো বললো,
- মাস্টারদা উনি কি প্রশিক্ষণে যাননি?
- আমি কি করে বলবো? তুমি যেখানে আমিও সেখানে।
- হ্যাঁ তাতো ঠিক! আপনিই বা জানবেন কি করে? তবে দাদা কিছু একটা হয়েছে। যাওয়ার সময় বড় বড় দুটো লাগেজকে সঙ্গে নিতে দেখলাম।
রমেনদা হাত বাড়িয়ে চিঠিটি আমার দিকে এগিয়ে ধরলো। আমি নিয়ে সেটি টেবিলে রাখলাম। ইচ্ছে করছিল রমেনদা শেলী সম্পর্কে আরও কিছু খবরা-খবর দিক। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে,
-ঠিক আছে দাদা। তুমি তাহলে এসো এখন।
আমার মন পড়েছিল চিঠিটির উপরে। অথচ রমেনদাকে দেখলাম পা ঘষাঘষি করতে,
- তুমি কি কিছু বলবে?
-মাস্টারদা চলে যাওয়ার সময় ওনাকে খুব স্বাভাবিক মনে হয়নি।
-হতে পারে। ওনার বাবা ও দিদি তো খুব অসুস্থ। ওনাদের নিয়ে উনি খুব চিন্তায় আছেন। হয়তো তেমন কোন খবর পেয়ে ভুবনেশ্বর থেকে সবকিছু ছেড়ে আসতে বাধ্য হলেন। যাক তুমি ভেবো না, আমি সময় পেলে বিষয়টি খোঁজ নেব।
-হ্যাঁ দাদা আমিও ঠিক এটাই বলছিলাম। খোঁজ খবর পেলে আমাকেও একটু জানাবেন প্লিজ। খুব ভালো মানুষ ছিলেন ম্যাডাম। আমাদের খুব ভালোবাসতেন। ওনার চলে যাওয়ার দৃশ্যটি বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।
রমেনদা চলে যেতেই আমি চারপাশটা আরো একটু ভাল করে তাকিয়ে নিলাম। নাহ! আশপাশে কারো কোন সাড়াশব্দ বা চিহ্ন নেই। এবার টেবিলের উপর রাখা এনভেলপটা হাতে নিয়ে বারকয়েক চোখ বুলিয়ে নিলাম। জীবনের প্রথম লাভ লেটার কিনা! নিজের বয়সটা এক্কেবারে ভুলে গেলাম। মনে হল যেন বয়সন্ধির প্রথম প্রেম। প্রথম যুদ্ধ জয়ের সাফল্য। সমস্ত শরীরে শিহরণ খেলে গেল।কম্পিত হাতে যতটা কম ছিঁড়ে এনভেলপ থেকে চিঠিটা মুক্ত করা যায় সেই চেষ্টাই করলাম। উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি দলিলের খামটিকেও সযত্নে সংরক্ষণ করা। একসময় চিঠিটি মুক্ত করলাম। কিন্তু চিঠিটি খুলে অবাক হলাম শতগুণ।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:- আজকের পোস্টটি ব্লগে আমার অন্যতম প্রিয় বন্ধু, গ্রীক দেবতা অ্যাপোলো সদৃশ কবি ও গল্পকার নীল আকাশ ভাইকে উৎসর্গ করলাম।
মরীচিকা (পর্ব-২৬)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২০ সকাল ৯:১৬