মরীচিকা (পর্ব-২৭)
অবশ্য রাংতামোড়া উপহারটি খুঁজে পেতে শুরুতে ওর একটু অসুবিধা হচ্ছিল। আমি দূরে ঢেউ গুনলেও অপেক্ষার প্রহর যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছিল না। ব্যাগে অনেকগুলো চেন ছিল। বেশ কিছুক্ষণ ধরে শেলী এ চেন ও চেন খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে সুন্দর একটা মলাটবদ্ধ গিফট আমার দিকে এগিয়ে ধরলো,
- এই যে মশাই আপনার জন্য।
শেলী 'তুমি' বলে সম্মোধন করলেও মাঝে মাঝে 'আপনি' বলে একটু বিশেষ সম্মান দেওয়াটা ওর পুরানো স্বভাব। কাজেই আমি সে কথায় কান না দিয়ে,
-আমার জন্য! কিন্তু কি আছে ভিতরে?
-তার জন্য তো একটু কষ্ট করে মলাটটা খুলতে হবে মশাই।
বহুদিন আগে শুনেছিলাম ভালোবাসার মানুষকে কোন জিনিসের বিনিময়ে ধন্যবাদ জানানোর প্রয়োজন হয় না। স্বভাবতই খুশি হয়ে মলাটটা খুলতে লাগলাম।
-কি আমাকে একটা থ্যাংকস দেবে না?
- হ্যাঁ নিশ্চয়ই দেবো! ধন্যবাদ ম্যাডাম আপনাকে। তবে জিনিসটি কি দেখার একটা কৌতূহল ছিল কিনা, বলে একটা হাসি উপহার দিলাম। বেশ কিছুক্ষণ পরে মলাটের একটার পর একটা ভাজ খুলে অবশেষে উদ্ধার করলাম বিদেশি সুদৃশ্য সিগারেটের একটি প্যাকেট। উপরে বড় বড় করে লেখা 'মালবারো'। অসম্ভব সুদৃশ্য প্যাকেটটার দিকে আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলাম। অস্বীকার করবো না যে সিগারেটের প্যাকেট যে গিফট হতে পারে এটা আমার কল্পনাতেও আসেনি। আমি উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম বিদেশী প্যাকেটটা হাতে নিয়ে। পাশে বসে স্মিতহাস্যে শেলী তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। মনে হল যেন তৃপ্ত নয়নে উপভোগ করতে লাগলো আমার মুগ্ধতাকে, আমার চোখে-মুখের ভাষাকে।
সিগারেট সেবনের অভ্যাসটি অবশ্য আমার অনেক দিনের পুরানো । মনে পড়ে আমি তখন সবে স্কুল ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি সে সময়ে আমার এই বিশেষ প্রশিক্ষণের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরবর্তী ক্লাসের মাঝে টানা তিন মাস ছুটি। বাড়িতে অগ্রিম পড়াশোনা নিয়ে কোনো চাপ ছিল না। এ সময় দিনের বেশিরভাগ সময় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েই অতিক্রান্ত হত। সিগারেটে আমার হাতে খড়ি হয় এই সময়ে। পরে অবশ্য আমার কলেজ বন্ধুদের কাছে শুনেছিলাম ওদের কারো কারো খাণ্ডবদহনের হাতে খড়ি নাকি আরো ছোট বয়সে হয়েছে এবং ধূম্র সেবন নিয়ে প্রত্যেকেরই নাকি এক একটি স্মরণীয় ঘটনা আছে। তবে আমার মত বাবার হাতে ধরা পড়ার ঘটনা ওদের কারো স্মৃতিতে ছিল না। বয়সন্ধির ওই সময়ে সিগারেট সেবনের মধ্য দিয়ে নিজের পৌরুষত্ব জাহির করার যে সুযোগ এসেছিল তাতে যে বেশ রোমাঞ্চ অনুভব করতাম সে কথা অস্বীকার করতে পারব না। এ সময় আমার একজন গুরু ছিল। কত রকম ভঙ্গিমায় সিগারেট খাওয়া যায় ও ধোঁয়া ছাড়া যায় নিত্যনতুন কলাকৌশল তার কাছ থেকে দেখে পুলকিত হতাম। প্রথমদিকে দিনে একটা দুটো খেলেও পরে সংখ্যাটি ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে।নিজেই বুঝতে পারছিলাম যে অভ্যাসটি বন্ধ না করলে যেকোন দিন বাড়িতে ধরা পড়তে পারি।ফলে সদ্য হাতেখড়ি রোমাঞ্চের পাশে কেমন যেন একটা অপরাধপ্রবণতায় ভুগতাম। মা-বাবার সামনে একেবারে স্বাভাবিক হতে পারতাম না। শরীর বা মুখ থেকে সিগারেটের গন্ধ বার হতে পারে বা ওনারা বুঝতে পারেন সেই আশঙ্কা মনের মধ্যে সর্বক্ষণ গ্রাস করেছিল।
এ সময় কোন একদিন কোন বইয়ের ফাঁকে একটি কাগজে মুড়িয়ে দুটি সিগারেট লুকিয়ে রেখেছিলাম। যার কথা পরে আমি বেমালুম ভুলে যায়। বেশ কিছুদিন পর ঈষৎ লাল হয়ে যাওয়া কাগজে মোড়া সিগারেট দুটি আমার পড়ার টেবিলে প্রকাশ্য স্থানে স্থানান্তরিত হওয়ায় সিগারেট দুটিকে মুহূর্তে চিনতে পারি এবং বুকের মধ্যে একটা শীতল স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে। বুঝেছিলাম আমার পিতৃদেব কোনভাবে গোপন ডেরা থেকে ওটি উদ্ধার করেছেন। তবে অমূল্য সম্পদটি নষ্ট না করে যাতে আমি সেবন করে যথাযথ মূল্য দেই তাই প্রকাশ্যে স্থানে রেখেছেন। এভাবে সিগারেট আবিষ্কার করাতে মহামান্য পিতৃদেবের সামনে দুই-তিন দিন খুব অস্বস্তিতে থাকলাম। মনে হলো উনি মুখে বললে বা আমাকে একটা শাস্তি দিলে বোধ হয় বেশি খুশি হতাম। অবসান হতো মনের গ্লানির । কিন্তু উনি ও রাস্তায় গেলেন না। ঘটনার কথা যখন ভুলতে বসেছি। ভেবেছি হয়তো উনি এ যাত্রায় বিষয়টি আর সামনে আনবেন না। হঠাৎ একদিন কাছে ডেকে বললেন,
-আমার বিশ্বাস ছিল যে তুমি আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলো না। ভুল মানুষ মাত্রই করে। তেমনি তুমিও একটা ভুল করেছ। যাক যা হয়ে গেছে
তা ভেবে আর লাভ নেই। আশা করি এখন থেকে তুমি আমার বিশ্বাসের মূল্য দেবে।
কোন বাবা-মা যদি সন্তানকে এমন করে কথা বলে, আশা করি যে কেউ প্রতিউত্তরে রা করতে পারবে না। সেদিন আমার বাবার সামনে আমিও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে পায়ের বুড়ো আঙ্গুল ঘষতে ঘষতে নিরবে এক প্রকার ক্ষমা প্রার্থনা করে গেছি।
পরে কলেজে পড়াকালীন অফ পিরিয়ডে বা বিশেষ আড্ডার সময়ে ধূমপান নিয়ে বাবার কথা মনে করে বন্ধুদের সমস্ত রকম অনুরোধ সযত্নে এড়িয়ে গেছি। তবে পাশে থেকে ওদেরকে অবশ্য ধূমপানে মদত দিয়ে গেছি। যদিও বিশেষ অনুরোধে মাঝে মাঝে দু-একটি টানও যে দিতাম না তা নয়। কিন্তু নিজে কোন দিন এ সময়ে সিগারেট ধরাই নি। কেমন যেন বাবার কথা বারে বারে চোখের সামনে ভেসে উঠতো।
স্নাতকোত্তর গিয়ে অবশ্য আমার পুরানো বন্ধু সিগারেট আবার আমার জীবনে ফিরে আসে। এর তার কাছে একটা দুটো খেতে খেতে জীবনে প্রথম সদর্থক ভাবে পয়সা দিয়ে কেনার সিদ্ধান্ত নেই। কারণ আগে কিনতাম চুরি করে। উল্লেখ্য এসময় খেতাম হয়তো দু-একটি সিগারেট। কিন্তু ক্রয় করার উদ্দেশ্য ছিল বন্ধুদেরকে সরবরাহ করা। বেশকিছু অত্যাধুনিক লাইটারও এ সময়ে আমি কিনেছিলাম। সুন্দর সুন্দর লাইটারের প্রতি আমার একটা আকর্ষণ এ সময় চলে আসে। সিগারেটের মধ্যে আমাদের পছন্দের ছিল মূলত উইলস ও গোল্ড ফ্লেক। তবে পছন্দ না করলেও চার্মস সিগারেট কেউ না কেউ অফার করলে ফেরাতাম না। কাজেই নিম্নবিত্তের বিনোদনে এই সমস্ত ব্রান্ডের মাঝে কুলীন মালবারোর মত সুদৃশ্য প্যাকেট পেয়ে সেটি না খেয়ে বরং সেটা সংরক্ষণ করার কথা ভেবেছিলাম। মুখ ফুটে সে কথা বলাতে, হাসতে হাসতে শেলী প্যাকেটটি হাতে নিয়ে একটি সিগারেট বার করে,
-নাও আমি নিজে বার করে দিয়েছি। এবার তুমি লাইটার বার করো, বলে আমার ঠোঁটে একটিকে দিল গুঁজে।
আমি পকেট থেকে লাইটার বার করে জীবনের প্রথম অন্য স্বাদের সিগারেটে টান দিলাম। প্রথম বিদেশি সিগারেট খাওয়ার অনাবিল আনন্দে চোখ বুজে সুখানুভূতি উপভোগ করতে লাগলাম। পড়ে যতবার ডেটিং করেছি একটি করে মালবারো বরাদ্দ থাকত। সর্বশেষে খালি প্যাকেটটিকে বহু দিন সযত্নে রেখেছিলাম। পরে সাংসারিক ব্যস্ততার কারণে প্যাকেটটি যে কোথায় মিলিয়ে গেছে তা আর খুঁজে পাইনি।
আমার ধারণা ছিল মেয়েরা ধূম্র সেবন একেবারেই পছন্দ করে না। কাজেই ডেটিংয়ের দিনগুলিতে অত্যন্ত সজাগ থাকতাম। লক্ষ্য ছিল কোন ভাবেই যেন শেলীর কাছে ধরা না পরি। তবে আমার এই লুকিয়ে চুকিয়ে সিগারেট খাওয়াটা ও সম্ভবত বুঝতে পেরেছিল। কেমন যেন একটা হাসি হাসি ভাব আমাকে বেশ সন্ধিগ্ধ করে তুলত। যদিও মুখ ফুটে প্রকাশ করেনি কোনদিন। এহেন শেলীর মালবারো উপহার আমার ধারনাকে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রতিপন্ন করে। বেশ কয়েকবার কথা প্রসঙ্গে ও জানিয়েছিল ধূম্র সেবন নাকি পুরুষের সপ্রতিভকে নিঃসন্দেহে বাড়িয়ে দেয়। ওর বাবা ছিল নন-স্মোকার ।বাবার এই অতি ভাল মানুষীকে ও বড্ড ম্যাড়মেড়ে বলে মনে করত। মুখ ফুটে বলতে পারেনি বাবাকে সে কথা কোনোদিন। কিন্তু মনে মনে স্বপ্ন ছিল কাছের মানুষটি যেন বাবার মতো না হয়। সে যেন নিয়মিত সিগারেট সেবন করে। পোড়া সিগারেটের নিকোটিনের গন্ধ ছিল ওর খুব প্রিয়। কেমন যেন উদাসীন ভাবে তাকিয়ে থাকতো স্মোকিং এর সময়। আমি মুখে ধোঁয়া নিয়ে কখনো মাথার উপরে কখনো বা চুলের মধ্যে বিভিন্ন রকম রিং এঁকে দিতাম। নতুন নতুন আকৃতির রিং করার স্বপ্নে আমি নেশাতে বুঁদ হয়ে থাকতাম।
আমি বেশ কয়েকবার জ্বলন্ত সিগারেট ওর দিকে এগিয়ে ধরেছি। তবে সুখটান দিতে ওর ভয়ানক আপত্তি ছিল। এটা নাকি মেয়েদের মুখে একেবারেই শোভা পায় না। পৃথিবীতে কিছু কিছু জিনিস উপরওয়ালা পুরুষের জন্য নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন।ধূমপান তেমনই পুরুষের এক্তিয়ারভুক্ত একটি বিষয়। নিজের আচরণের মধ্যেই বিশ্বাসের পরিচয় দিয়েছিল।তাই দিনের পর দিন পাশে বসে থাকলেও একটি বারের জন্যও কোন দিন সুখটান দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেনি। বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে আমরা নিজেরা কতইনা আবেগপ্রবন হই। তুলে ধরি নিজেদের সরল মানসিকতাকে। আর তখনই কল্পনার সঙ্গে বাস্তব জগতে নিজেদের মধ্যেকার ব্যবধানকে প্রলম্বিত করে তুলি। শেলীরও তেমনি বিশেষ মুহূর্ত গুলোকে আমি কখনো বাস্তবের শেফালী ম্যাডামের সঙ্গে মেলাতে পারিনি।
রূপনারায়ণের চড়ে বসে এভাবেই স্রোতের মতো পার হয়ে যেত রাংতামোড়া আমাদের জীবনের সোনালী দিনগুলি। মাঝে মাঝে শেলী ইট দিয়ে বাঁধানো পাড় ধরে হেলতে দুলতে নেমে যেত নদীর জলস্তর পর্যন্ত। দুই হাতে আঁজলা কেটে জল তুলে বলতো,
-এই জলের মতই আমি তোমার কাছে ধরা দিয়ে বাকি জীবন নিশ্চিন্তে কাটাবো নীল।
নিচ থেকে টলতে-টলতে উপরে এসে আমার হাতে যখন সেই আজলা কাটা জল দিত তখন তা কমে দাঁড়াতো একেবারে যৎসামান্য। আমিও কিছুটা রসিকতার সুরে পাল্টা বলতাম,
-তুমি ইচ্ছা করলেও নিজেকে সম্পূর্ণ উজাড় করে যে আমার হাতে ধরা দিতে পারব না । এই যেমন তোমার হাতের জলের পরিমাণই তার প্রমান দিচ্ছে। দুহাত ভরে জল নিয়েছিলে কতটা কিন্তু বাস্তবে যখন দিচ্ছ আমাকে সেটি কমতে কমতে একেবারে সামান্য পরিমাণে এসে দাঁড়িয়েছে। কাজেই আগামীতে তুমি আমাকে ধরা দেবে বললেও সে ধরার মধ্যে আমি কতটা পাব তা কেবল ভবিষ্যতই বলবে।
-না না! তুমি এর মধ্যে জলের পরিমাণ খুঁজতে যেও না। আমি যে তোমাকে সঁপে দিয়েছি এটাকেই সিংহভাগ ধরবে।
তার চোখে মুখের সাময়িক দুশ্চিন্তা আমাকে মুগ্ধ করতো। কেবল মনে হতো মেয়েদের হৃদয়টা বোধহয় ঝরনার মতই। যার নাগাল পেতে হাজার মাইল অতিক্রম করতে হয়। কিন্তু একবার সন্ধান পেয়ে গেলে সে ঝর্নার স্নিগ্ধতা মনকে শীতল ছায়া দান করে অনন্ত কাল ধরে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য:-পোস্টটি উৎসর্গ করা হল প্রিয় মা.হাসান ভাইকে। সঙ্গত কারণেই আজকের পোস্টে কোন সাসপেন্স রাখা হলো না।
মরীচিকা (পর্ব-২৫)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২০ সকাল ৯:১৯