আমি একজন স্বীকৃত তেলের ডিলার। পাশাপাশি একজন গুপ্তচরও বটে।আমার পরিচয় নিয়ে যাদের এলার্জি আছে তাদেরকে এই ব্লগে কমেন্ট না করার জন্য অগ্রিম ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম। উল্লেখ্য যে মৌলিকত্বের অন্বেষণকারীরা ভুল করেও এই ব্লগে ঢুঁ মারবেন না। নিরাশ হবেন।এটা ছাইপাশ লেখার ব্লগ।
মরীচিকা (পর্ব-২৯)
চিঠিটা খুলে আমার স্বপ্নভঙ্গ হলো। এতক্ষণে যাকে ঘিরে মনের মধ্যে নানা দোলাচল তৈরি হয়েছিল মুহূর্তে সব উধাও হয়ে গেল। জীবনের প্রথম প্রেমপত্র যে এরকম অতিসংক্ষিপ্ত হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি। চিঠিতে লেখা ছিল কেবল একটি শব্দ'স্যরি'। চিঠিটি হাতে পেয়ে এক রকম অনুভূতি হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে চিঠিটি উন্মুক্ত করার পর আমার মনে আবার হাজার প্রশ্ন দেখা দিল। আগে তো জানতাম শেলী ভুবনেশ্বরে বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে গেছে। তাহলে কেনই বা মাঝপথে এভাবে চলে এলো? আর এলোই যদি তাহলে আমিই বা কি করলাম, যেখানে আটঘাট বেঁধে এমন চিঠি লিখতে হলো? অথচ ছোট্ট একটি শব্দের মধ্যে রহস্য উন্মোচন তো হলোই না উল্টে তা শতগুণ বাড়িয়ে দিল। মনে প্রশ্ন জাগলো, তবে কি আমার সঙ্গে সম্পর্ক করে ও নিজেকে মাপতে চেয়েছিল? আর সেই মাপজোকের হিসাব-নিকাশে সন্তুষ্ট হয়ে নিজেকে সাবধানে সরিয়ে নিয়েছে। অথবা আমি যেমন ভাবছি তেমন কিছু নয়, হয়তো বা স্থায়ী চাকরি পেয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে- এমন হাজারো প্রশ্নের উত্তর নিরন্তর খুঁজতে লাগলাম।নাহ! আমার ভাবনা কেবলই সারা হয়। সমাধান সূত্র অধরাই থেকে যায়। তবে জীবনের প্রথম ব্রেকআপ যে ঘটেছে সে বিষয়ে একপ্রকার নিশ্চিত হলাম। কারণ যা-ই থাকুক আমার দিক থেকে যে ব্রেকআপ হয়নি এটাই ছিল আমার বড় সান্ত্বনা।
শেলীর অন্তর্ধানের পর মানসিক দিক থেকে যথেষ্ট ভেঙে পড়লেও প্রত্যহিক জীবনে নিজেকে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলাম। দুশ্চিন্তা একটা ছিল। রমেনদা কিম্বা মিলিদির চোখকে কতটা ফাঁকি দিতে পারবো-সেটা নিয়ে আমায় যথেষ্ট সংশয় ছিল। আমার দিক থেকে মনে হয়েছিল আমি ওদের দুজনকে ফাঁকি দিয়ে নিজের মানসিক অবস্থাকে গোপন করতে পেরেছি। এ সময় যতটা বেশি সম্ভব স্কুলের কাজে নিমগ্ন রাখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোন কিছুতেই মনের অস্থিরতা যেন কাটাতে পারছিলাম না। সকালে ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত মনের সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে গেছি। মন না চাইলেও পুরানো স্মৃতি গুলো সব যেন চোখের সামনে ভেসে উঠতো। তাই অবসর সময়ে চোখের সামনে রাখা মাসিক পত্রিকা প্রতিযোগিতা পরিপ্রেক্ষিত বা প্রতিযোগিতা উত্তরণের পাতাগুলো একটার পর একটা উল্টে পাল্টে গেলেও কি যে লেখা আছে তা ছাইপাঁশ কিছুই যেন মনোজগতে ঢুকতো না। মন চলে যেত দূরে কোন অচিনপুরীর দেশে।বেহিসাবি মনে লাগাম পরাতে না পারার যন্ত্রনা আমাকে আরো বেশি অস্থির করে তুলতো।
ক্রমশ আমার না পাওয়ার যন্ত্রনা একটু একটু করে ফিকে হতে থাকে। আমি আমার মত করে ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করি আমার দৈনিন্দিন অবসরের সময় গুলোকে।যার একটা বৃহৎ অংশ এখন কম্পিটিশন সাকসেস বা কম্পিটিশন মাস্টার্সের মত ইংরেজি পত্রিকা গুলোও দখল করেছে। সাপ্তাহিক কর্মসংস্থানের পাশাপাশি এমপ্লয়মেন্ট নিউজেও এখন থেকে নিয়মিত চোখ বোলাতে লাগলাম। প্রায়ই রবিবারগুলি কোথাও না কোথাও চাকরির পরীক্ষার্থী হিসেবে অংশ নিতাম।সারা সপ্তাহে স্কুল আর স্কুল এবং রবিবারে চাকরির পরীক্ষা- এসব নিয়েই আমার ব্যস্ততা যা আমাকে যথেষ্ট পরিতৃপ্তি দিয়েছিল। মনে মনে বেশ জেদি হয়ে উঠলাম।কোন এক অদৃশ্য কারণে শেলী যদি নিজের মতো করে চলতে পারে,অতীতে কোনো কিছু যদি তার কাছে প্রাধান্য না পায়, তাহলে আমাকেও বা তাকে নিয়ে এতটা ভাবতে হবে কেন, নিজের মনকে নিজেই যেন প্রবোধ দিতে লাগলাম।
বেশ কয়েক মাস এভাবে চাকরি উপযোগী পড়াশোনার পর একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল যে পড়াশোনাটা যদি এমনি চালিয়ে যেতে পারি তাহলে জীবনে বিকল্প কিছু করা অবশ্যই সম্ভব। এমনই এক রবিবার পরীক্ষা দিয়ে ফিরে হাতে-মুখে জল দিয়ে সবে নিজের ঘরে বসে একটা পত্রিকার পাতা উল্টাচ্ছি, এমন সময় বাইরে ঠক ঠক শব্দে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখি রমেনদা দাঁড়িয়ে।
-আরে! রমেনদা যে। দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে এসো।
-মাস্টারদা আপনার সঙ্গে একটু ব্যক্তিগত কথা ছিল।
-বেশতো! কি কথা?নির্দ্বিধায় বলতে পারো।
-দাদা কয়েকদিন ধরে ভাবছিলাম। আপনাকে বলব বলব করেও ঠিক সময় করে উঠতে পারছিলাম না। এখন যদিও আপনি প্রচন্ড ব্যস্ত। কোন রবিবারে তো আর আপনাকে আর আগের মতো হোস্টেলে থাকতে দেখিনা।আবার ছেলেদের কাছ থেকে খবরও পেয়েছি যে আপনি সারাক্ষণ ঘরে পড়াশোনা করেন। আজ সকালে আপনি চলে যেতেই ঠিক করলাম যতো রাত হোক আজ আপনি ফিরলে আপনার সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করব।
-হ্যাঁ তা তো বুঝলাম। এখন তোমার আলোচনার বিষয়টি কি, দ্রুত বলে ফেল দেখি। আমার ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে।
-দাদা আপনি তো জানেন দেশে আমার দুটো বাচ্চা আছে। মা ওদের দেখাশোনা করে। আমি প্রায়ই দেশে গিয়ে ওদের জন্য জিনিসপত্র কিনে দিয়ে আসি। সংসার চালানোর প্রয়োজনীয় হাত খরচাও দিয়ে আসি।কিন্তু সাম্প্রতিককালে মা বার্ধক্য জনিত কারণে এক্কেবারে শয্যাশায়ী হয়ে গেছে। আমার বড় ছেলেটাই মায়ের এই অসময়ে দেখাশোনা করছে। সারাক্ষণ একটি আতঙ্কে থাকি এই বুঝি মায়ের কোন খারাপ খবর এলো বলে।
-মাসিমার এই সমস্যাটা কতদিন ধরে চলছে?
-আগে থেকেও সমস্যা ছিল। তবে দুর্বল শরীরে মা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সংসারটা টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু গত এক সপ্তাহ থেকেই একেবারে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছে। ছেলেটার উপরে প্রচণ্ড চাপ যাচ্ছে। বাড়ির যাবতীয় কাজ কারবার, রান্নাবান্না সহ মায়ের দেখা শোনা সব একহাতে ওকে করতে হচ্ছে। যে কাজটি করার কথা আমার, অথচ আমার অনুপস্থিতিতে ওকে বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে।
-তোমার পারিবারিক অবস্থার কথা শুনে সত্যিই খুব খারাপ লাগছে।
রমেনদা আবার বলতে লাগল,
-মাঝে মাঝে ভাবি স্কুলের কাজটি ছেড়ে দিয়ে আবার গ্রামে ফিরে যায়।
-না না তুমি আবার গ্রামে ফিরে যাবার কথা ভাবছো কেন? বরং তোমার পরিবারকে নিয়ে কি করে এখানে একসঙ্গে থাকা যায়, তেমন কিছু তোমাকে ভাবতে বলবো। তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। এসময়টা তোমার এখন মায়ের পাশে থাকাটা খুব জরুরি।সেটা না করতে পারার যন্ত্রণা তোমাকে অস্থির করে তুলেছে। তবে সভাপতি মহাশয়কে বিষয়টি অবগত করে কিছুদিন ছুটি নিতে পারো কিনা একবার দেখতে পারো। বাড়িতে তোমার এই সঙ্গ দিতে না পারাটা সমস্যাটিকে বৃহত্তর করে তুলেছে বলে আমার ধারণা।
- হ্যাঁ দাদা আপনি এক দিক দিয়ে হয়তো ঠিকই বলছেন তবে ছুটি প্রসঙ্গে বলি, সভাপতি মহাশয়কে ইতিমধ্যে জানিয়েছি। কিন্তু উনি এক-দু দিনের বেশি ছুটি দিতে রাজি হলেন না।
- ও উনি রাজি হলেন না! তাহলে তো বেশ সমস্যায় ফেলে দিলে দেখছি।
রমেনদা চলে যাচ্ছিল। ইতিমধ্যে বেশ কিছুটা দূরে চলেও গেছে। হঠাৎ একটি কথা মনে আসাতে ডাকতে পিছন ফিরে দাঁড়ালো।
-আচ্ছা রমেনদা! সেবার তো বলেছিলে স্বামী-শশুরের ভিটে ছেড়ে আসতে তোমার মা রাজি হচ্ছেন না।এবার যেহেতু উনি খুবই অসুস্থ, কাজেই চিকিৎসার জন্যেও তো ওনাকে এখানে নিয়ে আসাটা খুবই জরুরি। আমার মনে হয় একটু বুঝিয়ে বললে এবার আর উনি না করবেন না।
-ঠিক আছে দাদা, আপনি বলছেন যখন তখন আর একবার না হয় মাকে বলে চেষ্টা করে দেখব ।
-দেখো রমেনদা জন্ম-মৃত্যুকে আমরা কেউ অস্বীকার করতে পারি না।সে কথা মাথায় রেখেই বলবো মাসিমা আবার সুস্থ হন। আবার আগের মতো হাঁটাচলা করে বেড়ান এবং আরো দীর্ঘ জীবন লাভ করুন, কামনা করি। হ্যাঁ যেটা বলার, তোমার দুইছেলে সহ মাসিমাকে যদি এখানে আনতে পারো তাহলে সমস্যাটি সমাধান হবে বলে আমার মনে হয়।
-মা সুস্থ থাকাকালীন রাজি হয়নি। আর ওনার অসুস্থতার সুযোগে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করাটা ঠিক হবে কিনা সেটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছি দাদা।
-ঠিক আছে তুমি তাহলে এসো। দেখি তোমার জন্য তেমন কিছু সমাধান সূত্র বার করতে পারি কিনা।
-ধন্যবাদ দাদা।
রমেনদা চলে যেতেই বিষয়টি নিয়ে আমি আবার ভাবনায় বসলাম। অনাত্মীয় এই মানুষটি ছিল হোস্টেলে আমার অন্যতম আপনজন।সুতরাং মানুষটির চলমান সংকট থেকে কিভাবে উদ্ধার করা যায় সেই চিন্তায় ডুবে থাকলাম। অথচ মাসিমাকে স্বামী-শ্বশুরের ভিটে থেকে যে উৎখাত করা যাবে না সে চিন্তাও মাথার মধ্যে মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। দেখতে দেখতে দুই-তিন দিন অতিক্রান্ত হল। প্রত্যেক বেলায় খাওয়ার সময় রমেনদার সঙ্গে দেখা হয়। শুকনো মুখে যন্ত্রের মত একটা নিষ্প্রাণ হাসি বিনিময় করে সামান্য খোঁজখবর নিয়ে কোনোক্রমে ডাইনিং রুম ছেড়ে চলে আসি। মায়ের খোঁজ খবর প্রসঙ্গে একটিই কথা,
-না দাদা অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। যেমন ছিল তেমনই আছে।
সে সময় টেলি-যোগাযোগ এতটা উন্নত হয়নি। বিদ্যালয়ে একটি ল্যান্ডলাইন ছিল। রমেনদার সঙ্গে কথা বলে জেনেছিলাম ওদের গ্রামের একটি মুদির দোকানেও একটি ল্যান্ডলাইন ছিল। দুই প্রান্তের দুটি ল্যান্ডলাইন ছিল ওদের খবরাখবর আদান-প্রদানের প্রধান মাধ্যম। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত এস টি ডি, আই এস ডি বা লোকাল ফোন বুথের অনুমতি পাওয়া তখন যেমন ঝঞ্ঝাটের ছিল তেমনি কলরেটও ছিল বেশ চড়া। সে তুলনায় ডোমেস্টিক ফোনের কানেকশন পাওয়া বেশ সহজ ছিল। আর এ কারণেই গ্রামের ডোমেস্টিক ফোন অনেকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত। রমেনদার গ্রামের মুদির দোকানের ফোনটি ছিল এমন একটি আধা বাণিজ্যিক ফোন। জরুরী ফোন করা ও প্রয়োজনীয় খবরা-খবর সরবরাহ করার জন্য প্রত্যেক বার গ্রামে গিয়ে তাকে ভালো একটি অ্যামাউন্ট পরিশোধ করতে হত।
ঘটনার পরে আরো বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। কোন সমাধান সূত্র মাথায় আসছে না। সেদিন সন্ধ্যাবেলায় টিফিন করতে গিয়ে রমেনদাকে দেখে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হলো। কেবলি বলে মনে হচ্ছে আমি হয়তো ওর সমস্যাটার প্রতি আন্তরিক নই বলে বিষয়টি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করছি না। ওর করুণ চাহনি আমাকে যেন আরও বেশি বিব্রত করে তুলেছিল। কাজেই তেমন কিছু ভাবনা চিন্তা না করে মাঝপথে বলে ফেলি,
-যদি সময় পাও তাহলে আর রাতের দিকে একবার আমার ঘরে আসতে পারবে?
-ঠিক আছে দাদা। খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে আপনার সঙ্গে গিয়ে দেখা করে আসবো।
রমেনদাকে আসার কথা বললেও তখনো ভেবে উঠতে পারিনি যে ঠিক কি কথা বলব।এদিকে ওর আগমনের সম্ভাব্য সময় যত এগিয়ে আসছে ততই নিজের অস্থিরতা বাড়ছে।নিজে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছি। তবে আশায় আছি যে একটা সন্তোষজনক সমাধান সূত্র নিশ্চয়ই বার হবে।মাথার উপরে দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দ যে নিজের হৃদপিন্ডের প্রতিধ্বনি বলে মনে হচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে এতটা তাড়াহুড়ো করে আসতে বলাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। আরো একটু সময় নেওয়া দরকার ছিল। আপন মনে যখন এসব ভেবে চলেছি, ঠিক তখনই বাইরে দরজায় আবার ঠক ঠক শব্দে মুখ-গলা শুকিয়ে গেল।পাংশু মুখে এক পা দু পা করে এগিয়ে গেলাম দরজা খুলতে।
মরীচিকা (পর্ব-২৭)
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মে, ২০২০ সকাল ৯:১৪