শ্রেয়সী ছিল আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী। অসম্ভব সুন্দরী পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি উচ্চতার মেয়েটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে আসে সপ্তাহ দুয়েক পরে। দু সপ্তাহ মানে ততদিনে পড়াশোনা অনেকটাই এগিয়ে যায়। সম্ভবত নিজের পশ্চাৎপদতা উপলব্ধি করে প্রথমদিন ক্লাসে অনেকটাই মুষড়ে ছিল। বসেছিল আমার পাশের ডেস্কে। ফাস্ট পিরিয়ডে জয়ন্ত বাবু ক্লাস ছিল; বেশ কয়েকবার বিরক্তি প্রকাশ করেছিল। সঙ্গে বেশ ভাবুক ভাবুক লাগছিল।ওর অন্যমনস্কতায় ও করুণ মুখশ্রীতে আমার মনোযোগে বিঘ্ন ঘটছিল। প্রথম দিকে আড় চোখে দেখলেও, পরে বারে বারে চোখ চলে যাচ্ছিল ওর দিকে। ফাস্ট পিরিয়ড শেষ হতেই, নিজেকে এক পর্যায়ে আর সামলাতে না পেরে আগবাড়িয়ে জিজ্ঞেস করি,
-তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে? উল্লেখ্য আমি শুরুতে কাউকে তুই বলতে পারি না। যাইহোক আমার কথা শেষ না হতেই,
- হ্যাঁরে। বড্ড পিছিয়ে গেছি। কিচ্ছু তো বুঝতে পারছি না।
ক্লাসের নোটপত্র আদান-প্রদানে আমি বরাবরই উদারহস্ত। কাজেই নিজের স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্যের কারণে জানাই,
-আমার কাছে এ পর্যন্ত যা ক্লাস হয়েছে সব লেকচারগুলো আছে। যদি আগ্রহী হও তাহলে আমি তোমাকে সেগুলো শেয়ার করতে পারি।
তৎক্ষণাৎ এক চওড়া হাসিতে ওর মুখের দ্যুতি যেন ঠিকরে পড়লো। সাথে সাথেই জানালো,
-তুই দিবি আমাকে? সত্যিই দিবি তো? বড্ড উপকার হবে তাহলে..
সেই থেকেই শুরু।তার পর থেকে ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।ক্লাসে ডেক্স কারো নামে ফিক্সড ছিল না ঠিকই কিন্তু ও আগেভাগেই পৌঁছে পাশের ডেক্সটা আমার জন্য দখলে রাখতো। বিষয়টা শুরুতে একটু চোখে পড়ার মতো ছিল ঠিকই কিন্তু আমার মন্দ লাগতো না। ওর এই আগবাড়িয়ে করা বন্ধুত্বের সম্পর্কটা পরবর্তীতে প্রগাঢ় সম্পর্কে পরিণত হয়। উল্লেখ্য আরও পরে তা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি, প্রসারিত হয়েছিল দূর বহুদূরে..
বলতে দ্বিধা নেই নিজের দুর্বলতার কারণে আমি আগবাড়িয়ে কোনদিন ওর পরিবার সম্পর্কে জানতে চাইনি। বুদ্ধিমতী মেয়ে শ্রেয়সী সম্ভবত সে কারণে জানতে চায়নি আমার পরিবার সম্পর্কেও। আমার ধারণা, সম্পর্ক গড়ে ওঠে নিজেদের মধ্যে। সেখানে পরিবারের ভূমিকা গৌণ। আর সেই যুক্তিতে তাদের পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামানো অহেতুক সময় নষ্ট বা একপ্রকার বোকামিই বৈকি। উল্লেখ্য ওসব বিষয় নিয়ে মাথা ব্যাথা ছিল না আমার কোনকালেই। ঘনিষ্ঠতার সূত্রে বুঝেছি ধনী পরিবারের সন্তান মেয়েটির চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল,সে ছিল অসম্ভব সাহসী। রাতবিরাতে একাকী এখানে ওখানে আসা-যাওয়া বা যখন-তখন হুটহাট করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে তার জুড়ি মেলা ভার। আর তার এ কাজের দোসর ছিল পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত ফটোগ্রাফি। পৈত্রিক সূত্রের বিষয়টিতে পরে আসছি।
এমনিতেই অসম্ভব অনুরাগ ছিল ফটোগ্রাফির প্রতি। সুযোগ পেলেই যার নেশায় ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তো কাছে বা দূরে কোথাও। সব সময় যে সঙ্গে লোকজন থাকতো তা নয়।আর এটাই ছিল ওর প্রথম দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসে অনুপস্থিতির প্রধান কারণ।আগে আগে ওর কয়েকজন ফটোগ্রাফার বন্ধু সহযোগী হলেও। সম্প্রতি দলবেঁধে ফটোগ্রাফিতে যেতে ও আর তেমন আনন্দ পেত না। এতে নাকি একজন ফটোগ্রাফারের মৌলিকত্ব নষ্ট হয়। নিজের ভালোলাগা মন্দলাগা এতে মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। তাই শেষের দিকে একাকিই বেরিয়ে পড়তো পছন্দমত কোনো জায়গায়। বেশ কয়েক মাস পরে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম বাবা-মায়ের প্রসঙ্গ। জানিয়েছিল, তার উপর ওনাদের নাকি অগাধ আস্থা। ছোট থেকেই ওনারা ওকে কোনো কাজে বাধা দেননি। আর এই স্বাধীনতাই ওকে করে তুলেছিল ফটোগ্রাফির নেশায় নেশাতুর। জানিয়েছিল নেশাটা নাকি ও ওর বাবার কাছ থেকেই পেয়েছিল। আর এ কারণেই বাবার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় একপ্রকার সারাক্ষণ মেতে থাকতো ফটোগ্রাফি নিয়ে।
উল্টোদিকে ফটোগ্রাফি নিয়ে আমার ধারণা ছিল একেবারেই তলানিতে। জীবনে একটা ক্যামেরা কেনার সৌভাগ্য হয়নি যেখানে, ফটোগ্রাফি তো কোন ছার। তবে হ্যাঁ প্রসঙ্গ উঠলে একজন গুনমুগ্ধ শ্রোতার মতো মন দিয়ে ওর কথাগুলো শুনে গেছি। আমার এই অত্যুৎসাহীতার কারণে হয়তো আমাকে ফটোগ্রাফি শেখানোর একটা নেশা মনে মনে বোধহয় ওকে পেয়ে বসেছিল। ক্লাসের ফাঁকে সামান্য সময় পেলেই ও চলে যেতো ওর চেনা ছন্দে। শুধু যে একতরফাভাবে বলে যেত তা নয়। প্রশ্নও করত মাঝে মাঝে। ভালো উত্তর দিতে না পারলে দিদিমণি রেগে যেতেন। ওর কাছে বাহবা পাওয়ার তাগিদ তখন থেকেই মনে মনে তৈরি হয়। কাজেই আমাকেও একটুআধটু ওর ভাষণের পাশাপাশি জার্নাল গুলোতেও পাতা উল্টিয়ে দেখতে হতো। স্বভাবতই অনুমেয় পড়াশোনার বাইরেও প্রচুর সময় আমাদের এভাবে অতিবাহিত হতে থাকে ক্যাম্পাসের ভেতরে।
ওর সঙ্গে আমার এই বন্ধুত্বকে বিশেষ শ্রেণিতে চিহ্নিত করতে সহপাঠীদের সময় লাগেনি। প্রথমে আমাদের দেখে একটু আধটু ফিসফিসানি পরে কানাঘুষো কানে আসতে থাকে আমরা নাকি প্রেম করছি। কয়েকজন আরও এক কদম এগিয়ে মুখ টিপে হাসতে লাগলো আমাদের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে। যদিও বিষয়টা ছিল আমার কাছে রীতিমতো উপভোগ্যের। এমন একজন সুন্দরী নারীর সঙ্গে নিজের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় মনে মনে বেশ পুলকিত বোধ করতাম। কিন্তু স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে ব্যবধান যে বিস্তর সে কথা ভেবে নিজেই নিজেকে প্রবোধ দিতে থাকি, আল্টিমেট রেজাল্ট যাই হোক আপাতত যে কদিন পাচ্ছি সেটাই বা কম কিসে।
এরই মধ্যে এক রবিবার ভোরবেলা ওর সঙ্গে বের হতে পারবো কিনা জানতে চাইলে, আমি উচ্ছ্বসিত হই। আগে ওর সঙ্গে ক্যাম্পাসে সময় কাটিয়েছি বড়জোর দুই/তিন ঘন্টা হবে। কিন্তু একটা গোটা দিন এই প্রথম! যা ছিল আমার কাছে কল্পনাতীতও বটে। কিন্তু নিজেকে যতটা সম্ভব সংযত রেখে বলি,
-রবিবার সকাল-সন্ধ্যায় দুটি টিউশনি ছাড়া তেমন কোনো কাজ নাই। সেক্ষেত্রে তোর প্রয়োজনে টিউশনি দুটিকে না হয় অন্যদিন পড়িয়ে দেবো।
আমার সম্মতি পেয়ে ও খুশি হয়। আবারো জানায়,
- একটু বেশি সময় লাগতে পারে অসুবিধা নেই তো?
আমিও তৎক্ষণাৎ উত্তর দেই,
- না না কোন সমস্যা নেই। তোর যতক্ষণ লাগে সময় দিতে পারবো।
মনে মনে বলি বরং কম সময়ের জন্য হলে রীতিমতো কষ্ট পেতাম। যাইহোক পরিকল্পনা মতো পরেরদিন খুব ভোর বেলা ভারি শীতবস্ত্র পরে আমরা ট্রেনে চেপে বসি। ভোরের ট্রেন হলেও যথেষ্ট ভিড় ছিল। মূলত পাইকারি বাজার থেকে কেনা সবজি বিক্রেতাদের ভিড়েই এ সময় ট্রেন ছিল অনেকটাই পরিপূর্ণ।বসার আসনগুলোতে কিছু জায়গা অবশ্য তখনও ফাঁকা ছিল। শীতকাল হওয়ায় সকলেই ছিল মহাকাশচারীদের মতো অবস্থায়। তবে শীতকালের জন্য এমন ভিড় অবশ্য বেশ ভালোই লাগছিল। ট্রেনের ভেতরে লোকসমাগম ও জানালাগুলো বন্ধ থাকায় পরিবেশটি হয়ে উঠেছিল রীতিমতো উষ্ণতম; এক প্রকার আরামদায়ক বৈকি।
ও হ্যাঁ যে কথা উল্লেখ করতে ভুলে গেছি।আগে থেকে ট্রেনের সময় সারণি দেখে বেশ কিছুটা আগেই আমরা স্টেশনে পৌঁছে যাই। বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হয়নি। একেবারে নির্দিষ্ট সময়েই ট্রেন স্টেশনে চলে আসে।আগেই বলেছি যাত্রী ভিড় শুরুতে না থাকলেও ক্রমশ এগিয়ে যেতেই সবজির পাশাপাশি যাত্রীর ভীড় বাড়তে থাকে। পাশাপাশি দুটি সুবিধামতো জায়গা দেখে আগেভাগেই আমরা বসে পড়ি। শ্রেয়সী বসে জানালার পাশে। শুরুতে কিছুক্ষন নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব চললেও একসময় নিজেদের গল্প যেন শেষ হয়ে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকায় সম্ভবত সময় নষ্ট না করতে সে ব্যাগ থেকে একটা ফটোগ্রাফীর জার্নাল বের করে ঘাটতে থাকে।আমি উপায়ন্তর না পেয়ে জানালার বাইরে ছুটে যাওয়া প্রান্তরের দিকে দৃষ্টিপাত করি। যদিও মন পড়েছিল শ্রেয়সীর দিকেই। আড়চোখে তাই আরেক দৃষ্টি ওর দিকেই নিমগ্ন রাখি। জীবনে প্রথম কোনো নারীকে এমন সঙ্গ পাওয়া;ফলে প্রতিটি মূহুর্তই এসময় আমার কাছে দারুণ রোমাঞ্চকর মনে হতে থাকে। ট্রেন কখন থামছে কোথায় থামছে এসবে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অদ্ভুত এক রোমাঞ্চকর অনুভূতির সঙ্গে ওর শরীরের একটা মিষ্টি ঘ্রাণ মিশেমিশে এসময়ে মাদকতার ন্যায় আমাকে আবিষ্ট করে ফেলে।এমন সময়ে চতুর্থ ব্যক্তিকে জায়গা করে দিতে আমি আরও ওর শরীরের দিকে ঝুঁকে পড়ি। গায়ের সঙ্গে গা ঘেঁষে আরও নিবিষ্ট হয়ে বসে থাকি। জানিনা আমাকে কিছুটা সুযোগ দিতেই বা প্রকৃতই অন্যমনস্কতা যে কারণেই হোক আমার এমন আচরণে সামান্যতম ভ্রুক্ষেপ না করে জার্নালের একের পর এক পাতা ওল্টাতে থাকে। অস্বীকার করবো না ওর এই আপাত ভ্রূক্ষেপহীনতা কিছুটা আমাকে প্রলুব্ধ করে তোলে। মনে মনে কিছুটা প্রশ্রয় পেয়ে যাই। ফলস্বরূপ বাকি রাস্তাটা ওর স্পর্শ নিয়ে আমি মুদ্রিত নয়নে হৃদয় দিয়ে অনুভব করি এক অনির্বচনীয় সুখানুভূতি। স্বভাবতই এ কারণে দেড় ঘন্টার রাস্তা কখন যে শেষ হল খেয়াল ছিল না। লোকজনকে নামতে দেখে কনুইয়ের গুঁতো দিয়ে বলে,
- কিরে এভাবে বসে থাকবি?ট্রেন তো প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে।
আমি ঘুম ঘুম চোখে কিছুটা আড়মোড়া খেয়ে অবাক চোখে বাইরে তাকিয়ে সলজ্জিত হয়ে বলি,
-সেই ভোররাতে উঠেছি তো একটু ঘুম এসে গেছিল।
-হ্যাঁ সে ঠিক বুঝেছি,বলে একটা রহস্যময়ী হাসি দিয়ে আমার নাকটি আলতো করে চেপে আবারো বললো,
-পাক্কা দেড়ঘণ্টাতেও বাবুর মন উঠলো না, আরও সময় চায়,বলে সামনে এগোতে ইশারা করে।
ট্রেন থেকে নামতেই বুঝতে পারি যথেষ্ট বেলা উঠে গেছে। এতটা বেলা হয়েছে দেখে ম্যাডামের মুড বিগড়ে গেলো। বিরক্তির সাথে ক্যামেরার ব্যাগের পাশাপাশি গায়ের সোয়েটার গুলোকেও খুলে একে একে আমার দিকে ছুড়ে দেয়। এতক্ষণে ওর গোটা শরীরে যেন বস্তা মোড়ানো ছিল। কাঁধের ব্যাগ থেকে হালকা একটা জ্যাকেট বের করে গায়ে চাপিয়ে নিল। দুহাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করে নিজেকে হাল্কা শীতের উপযোগী করে তোলে।জ্যাকেটের কোনো বোতাম না লাগানোয় বুকের সামনের দিকটা ছিল সম্পূর্ণ অনাবৃত। হলুদ রঙের জ্যাকেটকে দু-দিকে ঠেলে রেখে বড়বড় উন্নত স্তনযুগল যেন ঠিকরে বেরোচ্ছিল।এমন বুকের অধিকারী হওয়ায় আলাদা অহংবোধ বোধহয় শ্রেয়সীর মতো শহুরে নারীদের মনের মধ্যে বোধহয় কিছুটা কাজ করে। ডেনিম ব্লু জিন্সের উপরে হাল্কা ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবীতে পরীর মতো শ্রেয়সী তাই স্টেশন রোড ধরে হাঁটার সময় অগণিত মানুষের দৃষ্টি শুষে নিচ্ছিল।
স্টেশন রোডকে পিছনে ফেলে আমরা এবার হুগলি নদীর গা ঘেঁষে হাঁটতে থাকি। শুরুতেই দৃষ্টি যায় দূরে রক্তিম দেবের দিকে। মূলত ওনার দর্শনার্থী হতেই আমাদের আজ এখানে আগমন হহ্যহহ্য আমার সঙ্গে। উনি অবশ্য ততক্ষণে নদীর ওপারে যথেষ্ট উপরে অবস্থান করছেন। কাজেই কতকটা বেলা হওয়ায় কিছুটা নিরাশ হই। অবশ্য সে নিরাশা ছিল শ্রেয়সীর তাগিদেই।প্রভাতের সূর্যোদয় দেখতে না পেয়ে বেচারী খুবই বিষণ্ণ হয়ে পড়ে। কিছুটা ব্যর্থ মনোরথ হয়ে আরো একটু অগ্রসর হতেই একটা কটু গন্ধ নাকে আসে। মনে মনে ভাবতে থাকি আশেপাশে কোথাও কোনো মৃত জন্তুর গলিত দেহাবশেষ থেকেই সম্ভবত গন্ধটা আসছে।শ্রেয়সীকে দ্রুত পা চালাতে বলে আরও কিছুটা অগ্রসর হতেই বুঝি আমার অনুমান অকাট্য নয়। তবে মৃত জন্তুর নয় হুগলি নদীর তীর ঘেঁষে অনেকটা জায়গা জুড়ে মৎস্যজীবীরা মাছ শুকাচ্ছেন। যেখানে লোটে মাছের প্রাধান্য বেশি। যদিও অন্যান্য মাছও কম বেশি ছিল সেখানে। এমন দুর্গন্ধের সঙ্গে হাজার রকমের মাছি মিলে স্থানটিকে চূড়ান্ত অস্বাস্থ্যকর করে তুলেছিল। এমন একটি স্থান যে কারোর ভালোলাগার কথা নয়। স্বভাবতই ভালো লাগেনি আমারও। কিন্তু এরই মধ্যে একটা ঘটনা বিষয় আমাকে বেশ ভাবিয়ে তোলে। এত অস্বাস্থ্যকর পরিবেশেও মানুষগুলোর কাজের প্রতি একাগ্রতা দেখে আমি বেশ অবাক হই। এত দুর্গন্ধের মধ্যেও লোকগুলো মনেপ্রাণে কাজ করছে ভেবে মনের বিরক্তি ভাব আপ্রাণ অবলোকনের চেষ্টা করি। তবে লৌকিকতার খাতিরে নিজের বিরক্তভাবকে গোপন রাখলেও মনে-মনে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এখান থেকে বের হওয়ার জন্য। যদিও এতকিছুর পরও তাড়াতাড়ি স্থানটি ছেড়ে বেরোতে পারিনি। অবশ্য আমার কিছু করার ছিল না। শ্রেয়সী ক্যামেরা নিয়ে আপন মনে দুর্গন্ধযুক্ত বিভিন্ন রকম মাছেদের ছবি তুলতে থাকে। অগত্যা ওকে সময় দিতে আমিও পিছন পিছন ঘুরতে থাকি। অবশেষে একসময় ওর ছবি তোলার পর্ব শেষ হয়। সাথে সাথে আমরাও এখান থেকে বের হই।
সেদিন খালিপেটে আরো ঘন্টা দুয়েক ঘোরাঘুরি করে কিছুটা শ্রান্ত হয়ে অবশেষে একটি ঘুমটি দোকান থেকে সকালের প্রাতরাশ সেরে নিই। বুঝতে পারি সকালের হাঁটাহাঁটিটা অনেকটাই বেশি হয়ে গেছে। উল্লেখ্য এতোটা হেঁটেও শ্রেয়সীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন চোখে পড়লো না। হয়তো বা এমন হাঁটাচলায় অভ্যস্ত হওয়ায় চোখে মুখে কোনো ক্লান্তি ধরা পড়েনি। অগত্যা কিছুটা বাধ্য হয়ে নিজের ক্লান্তিকে গোপন করে ওকে অনুসরণ করতে থাকি। ক্রমশ বেলা গড়িয়ে দুপুর হতে থাকে। পরের দিকে একটা সময় মন সায় দিলেও শরীর যেন আর পেরে উঠছিল না। বুঝতে পারি মধ্যপ্রদেশে ভয়ঙ্কর খাবারের জন্য টান ধরেছে। ওদিকে শীতের দুপুর হলেও মাথার উপর রোদ্র ছিল বেশ চড়া। এমন সময় সামনে একটি ভাতের হোটেল পাওয়ায় দুজনে ঢুকে পড়ি। ভেতরে ঢুকে বুঝতে পারি হোটেলটি তেমন পরিচ্ছন্ন নয়। কিন্তু আশেপাশের অন্যান্য যে হোটেলগুলিকে ইতিপূর্বে দেখেছি সেগুলোকে এর চেয়ে সুবিধার বলে মনে হলো না। কাজেই একপ্রকার বাধ্য হয়ে উদরপূর্তি করার মতোই সামান্য সব্জি ভাত খেয়ে বেরিয়ে আসি।
পেটে ভাত পড়তেই আবার শক্তি ফিরে পাই। নতুন উদ্যোমে আবারো দুজন হাঁটতে থাকি। ওকে পাশে নিয়ে এভাবে হাঁটতে খুবই ভালো লাগছিল। আগেও বলেছি পথ চলতি মানুষের কৌতূহলী দৃষ্টি ছিল শ্রেয়সীর দিকে। অবশ্য ও সবে ওর কোনো ভ্রূক্ষেপ ছিল না। ওর এই আপাত ভ্রূক্ষেপহীনতা আমাকে রীতিমতো অহং করে তোলে। এমন একজন সুন্দরীকে পাশে নিয়ে হাঁটার জন্য নিজেকে মনে মনে খুব সৌভাগ্যবান মনে হতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে একটা বিষয় লক্ষ্য করি বিকেলের পড়ন্ত বেলায় কপোত-কপোতিদের ভিড় ক্রমশ বাড়তে থাকে। মনে মনে প্রলুব্ধ হতে থাকি শ্রেয়সীকে নিয়ে যদি এমন করে একটু প্রেম উদ্যানে বসার সুযোগ পেতাম .. যদি এমন পরিবেশে কানে মুখ ঠেকিয়ে বলতে পারতাম,
-ওগো প্রিয়তমা জন্ম-জন্মান্তর আমি শুধু তোমাকেই চাই...পরক্ষণেই আমার যাবতীয় শক্তি নিঃশেষ হয়ে যায়। এত আগডুম বাগডুম চিন্তা না করাই ভালো।এতে হয়তোবা হিতে বিপরীত হতে পারে। শ্রেয়সীকে হয়তো চিরদিনের জন্য হারাতেও হতে পারে।
জানিনা উপরওয়ালা হয়তোবা আমার পার্থনা অলক্ষ্যে মঞ্জুর করেছিলেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই এপ্রিল, ২০২৩ বিকাল ৫:২৭