শ্রীমতি পাঁচটি শহরের নাম বলতে বলায় বেশ ফ্যাসাদে পড়ি। চিন্তা করি, যদি ওর মনের সঙ্গে না মেলে তাহলে বাসর রাতে আরো একবার হেনস্থা! মনে মনে প্রমাদ গুনি।আমি দার্জিলিঙে ইতিপূর্বে বেশ কয়েকবার গেছি। শহর দার্জিলিঙে নতুন কিছু দেখার নেই উপরন্তু ঘিঞ্জি বলে এমন একটা জায়গায় হানিমুন করতে যাব- এ কথা কল্পনাতেও আনিনি। কাজেই আমি আমার পছন্দমত প্রথম শহর হিসাবে নৈনিতালের নাম বলি। দ্বিতীয় নামটি সঙ্গে সঙ্গে না বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। খানিক বাদে দ্বিতীয় শহর, শিমলা বলতেই দেখি বউয়ের মুখে চওড়া হাসি! বাকি নামগুলো শোনার আর প্রয়োজন বোধ করেনি। শূন্যে দু হাত ছুড়ে দিয়ে কিছুটা অস্ফুটে চিৎকার করার ঢঙ্গে বলে উঠে,
-আর বলতে হবে না। আর বলতে হবে না। আমার মনের সঙ্গে মিলে গেছে। শিমলা হবে আমাদের সেই কাঙ্খিত গন্তব্যস্থল।
বউয়ের মুখে 'মনের কথা' শুনে আমি বেশ পুলকিত হই। বলতে অস্বীকার করবো না মনে মনে দারুণ অনুপ্রেরণা পেয়ে যাই। এই প্রথম একজন নারী হৃদয়কে ভালো লাগাতে পেরেছি বলে মনে মনে উৎফুল্ল হই। বিষয়টা ছিল আমার কাছে দারুণ তৃপ্তির। এতদিনের ম্যাড়মেড়ে জীবনে নতুন উদ্যমে চলার একপ্রকার অক্সিজেন পেয়ে যাই।ফলোতো ঘটনার কদিনের মধ্যেই আমাদের সিমলা ট্রিপের সকল আয়োজন সম্পন্ন করে ফেলি।
শিমলা সম্পর্কে আমার মোহগ্রস্ততার অবশ্য একটি কারণ ছিল। সেই কবে থেকেই মনে মনে কৌতুহল ছিল শহরটার প্রতি। আমি তখন স্কুলে পড়তাম। সম্ভবত নবম শ্রেণীতে হবে।ইতিহাস ক্লাসে মাস্টার মহাশয় সেদিন বলেছিলেন, ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কান্ডারী ছিলেন এলান অক্টোভিয়ান হিউম। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উদ্দেশ্যে একটা খোলা চিঠি লিখে তৎকালীন ভারতের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অসন্তোষের কারণ সমূহ সরকারের সম্মুখে তুলে ধরার জন্য একটা মঞ্চ তৈরির পরামর্শ দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য তাঁরই খোলা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এখানে একটা ঘটনা আছে।মাস্টার মহাশয় বলেছিলেন, ভারত ও ভারতীয়দের মঙ্গলসাধন করা হিউম সাহেবের যত বেশি না উদ্দেশ্য ছিল তার চেয়ে অনেক বৃহৎ উদ্দেশ্য ছিল এদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে যেকোনো ধরনের অস্থিরতা বা র্ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্ত করা। ভারতে উচ্চপদে চাকরি করার সুবাদে তিনি নাকি লক্ষ্য করেছিলেন এদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে গভীর অসন্তোষের প্রতিধ্বনি। মূলত এই উদ্দেশ্যে উদ্বেগ প্রকাশ করে ব্রিটিশ সরকারকে সাবধান করতে একটি চিঠি লিখেছিলেন তৎকালীন ভারতের বড়লাট লর্ড ডাফরিন সাহেবকে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রক্ষাকবচ হিউমের বিশেষ এই চিঠিকে সেফটি ভাল্ব তত্ত্ব বলা হয়। উল্লেখ্য সেসময় এই ডাফরিন সাহেব তখন গ্রীষ্মবকাশের ছুটি কাটাচ্ছিলেন শিমলা শহরে।যেটা নাকি অলিখিতভাবে ব্রিটিশ প্রশাসকদের কাছে গ্রীষ্মকালীন রাজধানী শহরের মর্যাদা পেয়েছিল। গ্রীষ্মকালে ওনারা ভারতের রাজধানী পরিচালনা করতেন শিমলা শহর থেকে। অপরূপ রূপবৈচিত্র্যে ভরপুর শিমলার কথা সেদিন ইতিহাস শিক্ষকের মুখ থেকে শুনে মনে মনে রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম।
শিমলার পর্ব নিশ্চিত হতেই বউয়ের চোখে মুখে একটা গদগদে ভাব লক্ষ্য করি। এই প্রথম যেন দুজনের অভিমুখ এক হলো। নতুবা এতক্ষণ পর্যন্ত ও চলছিল উত্তর মেরুতে আর আমি ছিলাম দক্ষিণ মেরুতে। যাইহোক বাসররাতে বিড়াল মারার কথা ভুলে গিয়ে এবার হৃদয়ে প্রবাহিত হওয়া হাজার ওয়াটের প্রেমের ফল্গুধারায় ওকে আকর্ষণ করার মোক্ষম সময় বিবেচনা করে জিজ্ঞেস করি,
-তোমার নামটি একবার শোনাবে?
বৌ এবার চোখ মোটা মোটা করে পাল্টা আমাকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
-কেন তুমি কি আমার নাম না জেনে বিয়ে করেছো?
আমি ঢোক গিলতে বাধ্য হই,
- আসলে তোমার সুন্দর নামটি তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম।
বৌ এবার বেশ কঁকিয়ে উঠে,
- তো মশাই আমার মতো কটা বৌ আছে তোমার যে নাম মনে করতে পারছ না।
মনে মনে বলতে থাকি লেজেগোবরে আর কাকে বলে এর নাম বাসররাত!
আমার প্রেমের ফল্গুধারায় তখন ফিউজ উড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। মনে মনে আরও বলতে থাকি এমন ঘটবে জানলে কি আর বিয়ের ফাঁদে পা দিতাম। যাইহোক দুজনেই চুপচাপ। মনে প্রেমের প্লবতা তখন হাজার ওয়াট থেকে নাইট ল্যাম্পে পরিণত হয়েছে।ভাবছি রাতটুকু সামলে আগামীকাল সকালেই অফিসের জরুরী তলব ভিত্তিতে কাজে বেরিয়ে যাব। এমন সময় হঠাৎ কি মনে করে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে,
-আমার নাম শ্বেতা।
আমিও একশো আশি ডিগ্রিতে ঘুরে গেলাম।তার মুখ থেকে নাম বের করতে পারাটা নিঃসন্দেহে আমার জয়লাভ। কাজেই পাল্টা হাসি উপহার দিয়ে,
-আচ্ছা শ্বেতা তুমিতো টসে জিতে গেছ বা পরে নিজের পছন্দমত জায়গায় হানিমুন করতে যাবে বলে সিদ্ধান্তের কথা জানালে। সবকিছুতেই তো তোমারই জয়লাভ হয়েছে। তাহলে শুরুতে কেন ওভাবে সিনক্রিয়েট করলে যে টসে হেরে গেলেও তুমি তোমার পছন্দ মতো জায়গায় যাবে বলে আমার উপর শর্তারোপ করলে?
আমার প্রশ্ন শুনে শ্বেতা আরেক প্রস্থ হেসে নেয়। খানিকক্ষণ পর নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে জানায়,
-টসে জিতলে আমি তো আমার পছন্দ মতো জায়গায় যাবোই। কিন্তু টসে হেরে গেলেও যাতে আমার পছন্দ মতো জায়গায় যাওয়ার সুযোগ নষ্ট না হয় তার জন্য তোমার উপর শর্তারোপ করেছিলাম। অর্থাৎ তুমি বাপু যাই করো না কেন জায়গা নির্বাচনটি যেন আমার হাতেই থাকে এটাই আমার লক্ষ্য ছিল।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম শ্বেতার বুদ্ধির পরিশীলন দেখে। বুঝতে পারি এই মেয়ে বাকি জীবনে আমাকে যে আঠারো ঘোল খাইয়ে ছাড়বে তা একপ্রকার নিশ্চিত... মনে মনে বিলাপ করতে থাকি, বউকে বশে রাখব বলে গুরু ধরেছিলাম। কিন্তু যা অবস্থা এখন নিজেই হয়ে গেলাম বশীভূত। অথচ কতইনা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম প্রায় ছয় মাস ধরে বন্ধু পিন্টুর কাছ থেকে। হায়রে! আমার সব চেষ্টাই বিফলে গেল।ডাহা ফেল! ডাহা ফেল!
দার্জিলিংয়ের পাহাড় পছন্দ না করে সিমলা যাওয়ার পেছনেও শ্বেতার একটা যুক্তি ছিল। ওর এক মাসতুতো দাদা দার্জিলিংয়ের একটি হোটেলে ম্যানেজারি করে। স্থানীয় একটি নেপালি মেয়েকে বিয়ে করে দাদা ওখানে সেটেল্ড হয়েও গেছে। দাদার বিয়েতে দার্জিলিংয়ে গিয়ে বেশ কিছুদিন কাটিয়েও এসেছিল সে সময়ে। কয়েকজনের সঙ্গে নাকি বন্ধুত্বও গড়ে ওঠে। শ্বেতার ধারণা দার্জিলিঙে গেলে দাদার আত্মীয়-স্বজন কারো না কারো সঙ্গে দেখা হতে পারে, যাতে করে কিনা গোটা হানিমুনটাই মাটি হয়ে যাবে। তাই দার্জিলিং নৈব নৈব চ।
আমি বলেছিলাম,
-এত বড় শৈলশহর দার্জিলিং; এত লোকের বসবাস, কে কাকেই খুঁজে বেড়াবে বা কে কাকেই বা চিনবে- এই ভয়ে তুমি দার্জিলিঙে যেতে চাইছ না?
কিন্তু শ্বেতা আমার কোনো কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে।ওর ধারণা হানিমুন করতে হবে এমন একটা শহরে যেখানে কোনো তৃতীয় ব্যক্তির দেখা মিলবে না। কিম্বা দেখা হওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনা যেন না থাকে। ওর সব সিদ্ধান্তকেই আমাকে হজম করতে হয়। বুঝতেই পারি প্রথম রাতেই আমার অবস্থা রীতিমত চতুষ্পদ প্রাণীর মতোই। মনকে প্রবোধ দেই,মনুসংহিতার রচয়িতা মনু আজ বেঁচে থাকলে হয়তো এভাবেই বলতেন,
-ছেলেরা কৈশোরে মায়ের অধীনে, যৌবনে বউয়ের অধীনে আর বার্ধক্যে কন্যা বা পুত্রের অধীনে বন্দি।
যাইহোক মনের মধ্যে যে চিন্তাই খেলুক তাকে বাড়তে না দিয়ে বরং বাধ্য স্বামীর মতো হানিমুনের পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে তৎপর হলাম।
চলবে....
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই অক্টোবর, ২০২২ রাত ১১:৪৩