ভুমিকা শুনে প্রেমের কাহিনী মনে হতে পারে। সুন্দরীর হাসিমুখ... রাঙ্গা রাজকন্যার মত দুটি লাল ঠোঁট। দুই চোখের তারায় বিদ্যুতের ইশারা। ফাঁপা, ফোলা একমাথা পিঙ্গল কেশ। ভন সেনডেন নিশ্চয় মেয়েটির প্রেমের ফাঁদে পা দিয়েছেন-
ফাঁদ ঠিকই। তবে তা প্রেমের ফাঁদ নয়। ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও তাতে নেই। ভন সেনডেন সুন্দরী গুপ্তচরীর চাতুরীর কাছে হার মেনেছেন।
বার্লিনের পুলিশ কমিশনার রিচটোফনের মুখে সাদা লম্বা দাড়ি। তিনি বললেন এ ব্যাপারে স্টেনহাওয়াই আমাদের ভরসা। একমাত্র ওই এ বিপদ থেকে বাঁচাতে পারে। প্রশংসা শুনে স্টেনহাওয়া একটু বিব্রত এবং লজ্জিত হল। সে বলল- আমি নিশ্চয়ই চেস্টা করব। কিন্তু ব্যাপারটা কেমন করে ঘটল, তা সবার আগে ভালভাবে জানা দরকার।
ভন সেনডেন চেয়ারের উপর মাথা হেলিয়ে শুয়ে আছেন। বিপদ থেকে উদ্ধার না পেলে কি হবে তাই ভেবে তিনি অস্থির। কাইজার কি কোনো দিন মুখ দেখবেন তার? কি শাস্তি কপালে লেখা আছে, কে জানে ! পদচ্যুতি? কিংবা আরো কঠোর কিছু-
ভন সেনডেন জার্মানির নৌবাহিনীর প্রধান। বার্লিনে কে না তাকে চেনে? কিন্তু অমন জবরদস্ত মানুষটা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছেন। তার সামান্য ভুলভ্রান্তির জন্য নৌবাহিনীর একটি গোপন রিপোর্ট গুপ্তচরী সুকৌশলে নিয়ে পালিয়েছে। অথচ এটি কাইজারকে দেখানোর কথা তার। রিপোর্টে এমন সব তথ্য আছে যা শত্রুর হাতে গেলে জার্মানির রীতিমত বেকায়দায় পরতে হতে পারে।
এডমিরাল ব্যাপারটা খুলে বলতে চেষ্টা করলেন-'পরশুদিন সন্ধ্যায় আমার বাড়িতে একটি নৈশভোজের আয়োজন হয়েছিল। বার্লিনের অনেক গণ্যমান্য লোক, নানা দেশের কূটনীতিবিদ সকলকেই প্রায় নেমতন্ন করি। মহামান্য কাইজার নিজে আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে এক দম্পতিকে আমি মটেই চিনতাম না। বার্লিনে তারা সম্পূর্ণ নতুন। এক ফরাসী ব্যারন আর তার স্ত্রী। দূতাবাসের একজন অফিসারের অনুরোধে আমি তাদের নেমতন্ন করি। ভদ্রমহিলার কাইজারকে দেখার কুব ইচ্ছে। এমন সুযোগ জীবনে হয়ত আর নাও আসতে পারে।'
'তারপর?' স্টেনহাওয়া মুখ তুলে তাকাল
ভন সেনডেন সোজা হয়ে বসলেন। 'নৌবাহিনীর গোপন রিপোর্টটা তখন আমার কাছে। ইচ্ছে ছিল নৈশভোজের পর কাইজারের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করব। নিভৃতে তার হাতে তুলে দিতাম।'
স্টেনহাওয়া ফের বললেন- 'কাইজার ভোজসভায় কখন এলেন?'
-'অনেক পরে। প্রায় সকলে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। তবু আমি পকেটের রিপোর্টটি দেখিয়ে বারবার বলেছি, মহামন্য কাইজার নিশ্চয় আসবেন। তাঁর সঙ্গে আমার জরুরী কথা আছে।'
--'খুব ভালো করেছিলেন এডমিরাল।' স্টেনহাওয়া মন্তব্য করলেন, রিপোর্টটি না দেখালে মনে হয় আপনাকে এই ঝামেলায় পড়তে হত না।
-তা ঠিক। ভন সেনডেন নিজের ত্রুটি স্বীকার করে হাসলেন। ফের শুরু করলেন- হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম। 'কাইজার এলেন অনেক পরে। তখন ভোজসভা প্রায় শেষ। নিমন্ত্রিতেরা চলে যাবার পর আমার রিপোর্টটার কথা মনে পড়ল। অদ্ভুত। সেটা তখন পকেটে নেই। অবশ্য একটু চিন্তা করতেই খেয়াল হল আমার, কাইজার এলেন না ভেবে আধঘণ্টা আগে আমি সেটা পাশের ঘরে দেরাজে রেখে আসেছি।'
-কিন্তু দেরাজেও সেটা নেই। এই তো? স্টেনহাওয়া মুচকি হাসল
-ঠিক তাই। কিন্তু ব্যাপারটা যেন ভেল্কি মশায়। এত লোকজন। দেরাজে চাবি। তবু এরই ফাঁকে কে টুপ করে চাবি খুলে রিপোর্টটা হাতিয়ে সরে পড়ল।
স্টেনহাওয়া এক মুহূর্ত ভাবল। আচ্ছা ঘরের মধ্যে কাউকে সন্দেহজনকভাবে ঢুকতে কিংবা বেরিয়ে আসতে দেখেছেন?
-ঠিক সন্দেহজনকভাবে বলা যায় না। ভন সেনডেন ধীরে ধীরে বললেন- তবে আমাদের এক অফিসার বলছিলেন বটে। ওই ফরাসী ব্যারনেস মহিলাটিকে তিনি পাশের ঘরের দরজার সামনে কয়েক সেকেন্ড দারিয়ে থাকতে দেখেছেন।
ব্যারনেস না ছাই। মেয়েটা আসলে ধুড়িবাজ। একটা গুপ্তচরী ছাড়া কিছুই নয়। রিচটোফেন তাঁর দাড়িতে হাত বুলালেন।
০২.
স্টেনহাওয়ার আর একটি মুহূর্তও দেরি করলেন না। প্রায় ৩৬ ঘন্তা কাবার। সুন্দরী গুপ্তচরী এতক্ষণে কোথায় কে জানে? এই মুহূর্তে সে হয়ত প্যারিসের মাটিতে পা দিয়েছে। কিংবা অন্য কোথাও।
বার্লিনের হোটেলে খোঁজ করতেই ম্যানেজার ঘাড় নাড়ল। হ্যাঁ... এক ফরাসী দম্পতি তার ওখানে কদিন ছিল বটে। কিন্তু তারা তো গতকাল সকালেই বার্লিন ছেড়ে চলে গেছে। অগত্যা স্টেশনে। স্টেনহাওয়া প্রায় ঝড়ের মত ছুটলেন। এডমিরাল বলেছেন, মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। সঙ্গী পুরুষটা একটু হলেও রুপবান। কুলিদের কেউ নিশ্চয় ওদের ট্রেনে তুলে দিয়েছে, যদি কোনো সুত্র মেলে। আশায় বুক বেঁধে স্টেনহাওয়া অন্ধকারেই পা বাড়াল।
সুত্র মিলল। অনেক জিজ্ঞাসাবাদের পর স্টেশনের একজন কুলি হদিস দিল। গতকাল সকালে এক দম্পতিকে সে ফ্রাঙ্কফুর্ট এক্সপ্রেসে তুলে দিয়েছে, হ্যাঁ তার মনে পরেছে এবার। স্বামী- স্ত্রী দুজনেরই চেহারা দেখবার মত। আর তারা বিদেশী।
সোজা ফ্রাঙ্কফুর্ট। শহরে কত হোটেল, ঘরবাড়ি। কিন্তু কোথায় সেই দুইজন। কে তাদের সন্ধান দেবে?
শহরের পথে পথে সমস্তদিন ঘুরে বেড়াল স্টেনহাওয়া। ক্লান্ত দেহ, এমনিভাবে অন্ধকারে পথ হাতরে কতদূর যাওয়া চলে?
কিন্তু অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই আলো জ্বলল। সন্ধ্যের মুখে একটা অভিজাত হোটেলের সামনে স্টেনহাওয়া হঠাৎ এক দম্পতিকে দেখতে পেল। নিঃসন্দেহে বিদেশী। এবং এডমিরালের বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। নিঃশব্দে সে তাদের অনুসরণ করল।
হোটেলের এক বেয়ারা বলল- ওরা বার্লিন থেকে এসেছে মশাই। মনে হয় নতুন বিয়ে করেছে। দুটিতে সবসময় একসঙ্গে- খালি গুজগুজ, ফুসফুস। চোখে চোখে কি হাসি, পিরিতে একেবারে মজে আছে।
স্টেনহাওয়ার মনে খটকা লাগলো। সে ভুল করেনি তো? বিয়ের পর যারা হানিমুনে বেরিয়েছে তাদের পিছনে ধাওয়া করে লাভ কি? কিন্তু এখন আর পিছিয়ে পড়বার উপায় নেই। এতদুর যখন এগিয়েছি তখন একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে।
হঠাৎ সুযোগ মিলল। পুরুষটি একলাই বেরিয়ে গেল। মেয়েটি বাথরুমে। কিন্তু দরজায় চাবি দিতে ভুল করেছে। বিড়ালের মত স্টেনহাওয়া নিঃশব্দে ভিতরে ঢুকল। পাশাপাশি দুটো রুম, একটাতে ওরা শোয়, অন্যটি বসার। জিনিসপত্র বলতে একটি বর ট্রাঙ্ক। টেবিলের ওপর টুকিটাকি আরো কিছু। স্টেনহাওয়া নিজের চাবির সাহায্যে ট্রাঙ্কের তালা খুলবার চেস্টা করল। কিন্তু হল না। মাথা চুলকে সে একটা উপায় ভাবতে লাগল। তারপর থেকে একটা কপিং পেন্সিল আর এক টুকরা ব্লটিং পেপার বের করে সে তালার মুখের একটা ছাপ তুলে ফেলল।
ঘর থেকে বেরোল স্টেনহাওয়া। আবার সুজোগের প্রতীক্ষায় থাকতে হবে। কিন্তু তার আগে এই ছাপের সঙ্গে মিল করে একটি চাবি তৈরি করা দরকার। সে হোটেল থেকে বেরিয়ে বাজারের পথ ধরল।
নৈশ আহারের পর সেই বেয়ারা বলল- আর কি ভাবছেন স্যার ! চখাচখি তো কাল সকালেই উড়ল।
-তার মানে? ওরা চলে যাচ্ছে?
-তাই তো শুনলাম। ম্যানেজারকে টাকাকড়ি মিটিয়ে দিয়েছে। এবার নাকি দেশে ফিরবে।
অসম্ভব ! এক মুহূর্ত স্টেনহাওয়ারের মুখের চেহারাই বদলে গেল। আজ রাতেই যা হোক একটা কিছু করতে হবে। আর সময় নেই।
তখনও ওরা ঘুমায়নি। দরজা খোলা। সামান্য একটু ছদ্মবেশ নিয়ে স্টেনহাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। ওরা কথা বলছে। একটু পরেই পাশের ঘর থেকে আসবে, দরজা বন্ধ করে শুয়ে পরবে। স্টেনহাওয়া অন্ধকারে আত্মগোপন করে নিঃশব্দে দাড়িয়ে রইল।
প্রায় দু ঘণ্টা কাটল। ওরা চুপ- হয়ত ঘুমিয়েছে। স্টেনহাওয়া পকেট থেকে একটা পেন্সিলটর্চ আর চাবিটা বের করল। না, সেনডেনের ভুল হয়নি। ট্রাঙ্ক খুলতেই রিপোর্টের খামখানা চোখের সামনে ভেসে উঠল।
কিন্তু দরজার কাছে এগোতেই সে ভুত দেখার মত চমকে উঠল। কখন ওদের ঘুম ভেঙ্গেছে? পিস্তল উঁচিয়ে মেয়েটি তার সঙ্গে মোকাবিলার জন্য তৈরি। মুহূর্তেই সে নিজের পিস্তলটা বের করল- ওতে সুবিধা হবে না ম্যাডাম, স্টেনহাওয়া সাপের মত হিসহিস করল।
অদ্ভুত। কথায় যেন মন্ত্রের মত কাজ হল। মেয়েটি পিস্তল রেখে মিষ্টি হাসল। অপূর্ব মোহিনী হাসি। স্টেনহাওয়ারের মনে হল মেয়েটির চাউনি কেমন যেন। সমস্ত শরীর শিরশির করছে তার। মেয়েটি তাকে অঙ্গুলি সঙ্কেত করে কাছে ডাকল। আর এক মুহূর্ত নয়, ওর দৃষ্টিতে যাদু-সান্নিধ্যে সমর্পণ। স্টেনহাওয়া প্রায় দৌরে বেরিয়ে এল।
সকালে সে চা পান করছিল। এখন আর ছদ্মবেশ নয়। খানিকটা দূরে সেই দম্পতিও বসে। ওরাও চা খাচ্ছে। কিন্তু দুজনেই খুব গম্ভীর। কেউ একটি কথাও বলছে না। হোটেলের বেয়ারা বলল- কি দেখছেন স্যার? কাল রাতে দুজনে একচোট হয়ে গেছে। এত পিরিত-ভালোবাসা তোদের, এখন আবার পেঁচার মত মুখ কেন? স্টেনহাওয়া কিছুই বলল না। মুচকি হাসল।
০৩.
ভন সেনডেন চেয়ারে বসেছিলেন। দুদিনে তার দুর্দিনের চেহারা। ঝড়ে বিপর্যস্ত ধানক্ষেতের মত অবস্থা।
-পেয়েছো সেটা? সেনডেন আকুল আগ্রহে শুধোলেন। স্টেনহাওয়া পকেট থেকে খামতা বের করল। দেখে নিন সব ঠিক আছে কি না?
-সব ঠিক আছে। এডমিরাল আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। এবার বল কেমন করে উদ্ধার হল জিনিসটা?
বলতে গিয়ে স্টেনহাওয়া ইতস্তত করল। গুপ্তচরীর সুন্দর মুখটি মনে পরছে তার। অদ্ভুত ! নিশীথ রাত্তিরে দেখা সেই অদ্ভুত হাসিটা সে কিছুতেই ভুলতে পারছে না কেন?
(বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে)void(1);
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে অক্টোবর, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:৩৯