পর্ব ১
মনে পড়ে যায় ২১ বছর আগে দেখা সদ্য ভূমিষ্ট মৃত পুত্রের মুখ। টিউটরের মাঝে খুঁজে পান হারিয়ে ফেলা ছোট্ট বাবুকে। তাঁর মনে হতে থাকে বেঁচে থাকলে বাবুটি এই বয়সের এ রকমই দেখতে হতো যেন ঠিক তাঁর ছোট মেয়েটির মতো। মা কোন কিছু চিন্তা ভাবনা না করে সে দিনই মনে মনে টিউটরকে ছেলের আসনে ঠাঁই দিয়ে ফেললেন।
টিচারের নাম মনন। বাসা ঢাকায়। এখানে হলে থাকে। প্রথম দিন থেকেই পড়ানো শুরু করে দিল। সপ্তাহে আসে ৬ দিন। পড়ায় খুব মনোযোগ দিয়ে। সন্ধির অস্থির লাগে এত এটেনশন। প্রিয় কার্টুন আর দেখা হয় না। স্কুলের ড্রেস চেঞ্জ করার আগেই টিচার হাজির। দু'বেণী দুলিয়ে রাগে গাল ফুলিয়ে পড়তে বসা। পড়ায় ভুল হলে বেণী ধরে টান খাওয়া। সব কিছু অসহ্য। ফল শ্রুতিতে শবেবরাতের দিনে দোয়া করা-" আল্লাহ আমার টিচারের মৃত্যু দাও। আর যেন না আসে।" আল্লাহ আংশিক দোয়া কবুল করেলন। টিচারের এক্সিডেন্ট হলো। ছাত্রীতো মহাখুশি। মুখে হাসি নিয়ে কার্টুন দেখে, পড়তে বসে না। মনন ক্লাশমেটদের কাছে চিরকুট পাঠায় এক্সিডেন্টের কথা জানিয়ে। মা ব্যাস্ত হয়ে পড়েন দেখতে যাবার জন্য। সাথে নিতে চায় সন্ধিকে। সন্ধি যায় না।
মা-বাবা হলে দেখতে গেছে টিচারতো আহ্লাদে আটখানা। একদিন হসপিটাল থেকে ড্রেসিং শেষে ফেরার পথে সন্ধিদের বাসায় এসে হাজির। এসেই শুরু করলো ঢং করা - চিৎকার করে সন্ধিকে ডাকাডাকি, এতদিন কি পড়েছে তার হিসাব নিলো, নখ কেন এত বড় হয়েছে তার কৈফিয়ত চাইলো। রাগে পিত্তি জ্বলে গেল সন্ধির। মনে হলো একটা হাতুড়ি দিয়ে ব্যাথার জায়গায় ঠাস্ করে একটা বাড়ি দেয়। কিন্তু উপায় নেই মা-বাবা পশ্রয় দিচ্ছে। সহ্য করতেই হবে।
বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। একদিন সকালে বিধ্বস্ত অবস্থায় হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে মনন হাজির। জানা গেল দুই গ্রুপ ছাত্র সংগঠনের মধ্যে মারামারি। রাজনীতি করতো সক্রিয় ভাবেই। তাই জান আর ব্যাগ নিয়ে পালিয়ে এসেছে। সন্ধি আবারো বিরক্ত। এই সকাল বেলা পড়তে বসতে হবে! পড়ে আর মনে মনে হাসে -" এবার কেমন মনন? তাড়াটা খেলি কেমন?"
এ ভাবেই কেটে গেল ২/৩ বছর। বয়:সন্ধিকালের পুরো সময়টা সব মেয়েদেরই বোধহয় দ্বিধায় কাটে। সন্ধি খেয়াল করে হঠাৎ করেই তার চারপাশের অনেক মানুষেরই চাহনি, কথা বলার স্টাইল বদলে গেছে। তার কাছে খুব কু-রুচিপূর্ণ মনে হয় সবাইকে। এর মাঝে টিচার আগের মতোই- আপু আপু বলে ডাকে, সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে, পড়ায় ভুল হলে আগের চেয়েও বিশী বকা দেয়। সন্ধির মনে পরিবর্তন এলো। টিচার যখন পড়ায় তখন খুব বিরক্ত লাগে ঠিকই। কিন্তু চলে গেলে মন খারাপ হয়ে যায়। চার বোনের মাঝে অতি আদরে এবং পূর্ণ স্বাধীনতা পাওয়া সন্ধি তার মনের এ বায়বীয় অবস্থার নাম যে কি তা বুঝতেও পারলো না বা তখন কোনদিন ভাবার প্রয়োজনও বোধ করেনি। মনন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে গেল। যাবার সময় বেশ মন খারাপ করে গেল। সন্ধির তেমন প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না।
প্রায় এক বছর বসে থাকার পর মননবিসিএস দিয়ে চাকরিতে ঢোকে। চিঠি আদান-প্রদান চলতো। মনন মন খারাপ করে চিঠি লিখতো সেই কষ্টকর ট্রেনিং -এর গল্প বলে। এর মাঝে সন্ধির এস এস সি রেজাল্ট হয়ে যায়। রেজাল্ট বেশ ভাল। ঠিক হয় সন্ধি ঢাকায় ভর্তি হবে। অবশেষে হলিক্রসে ভর্তি। বোনদের, বন্ধুদের ছেড়ে এসে খুব মন খারাপ থাকতো সন্ধির। মননের পোস্টিং তখন রাজেন্দ্রপুর। ঢাকায় আসলেই সন্ধিদের বাসায় দেখা করে যেত। সন্ধি হঠাৎ করেই বুঝতে পারলো সে দশ বছরের বড় মননকে খুব বেশী পছন্দ করতে শুরু করেছে। কিন্তু মননের আচরনে বোঝা যায় ও সন্ধিকে শুধু বোনের মতই দেখে। তাই আত্নগ্লানিতে দগ্ধ মেয়েটি ক্ষমা চেয়ে মননকে চিঠি লেখে আর ভয়ে রেডি হতে থাকে মনন কি স্টেপ নেয় তা দেখবার জন্য। কি করবে- মাকে বলে দেবে নাকি নিজেই এসে বেণী ধরে ( কলেজে নিয়মিত দু'বেণী করে যেতে হতো) দেবে এক থাপ্পড়। আর ভাবতে পারে না সন্ধি।
চলবে...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


