somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হারিকেন - দ্য ডিভাইন উইন্ড (৩)

০৪ ঠা অক্টোবর, ২০০৭ দুপুর ১২:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পর্ব দুই - কাঁদো বাংলাদেশ কাঁদো
======================

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

যুদ্ধের পর একটা শহর যেমন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, ২৯ শে এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ের পর চট্টগ্রাম শহর ঠিক তাই ছিল। পথের পাশে পড়েছিল ইতস্তত বিক্ষিপ্ত লাশ, রাস্তা জুড়ে ছিল উপড়ে পড়া গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি, ঘর-বাড়িগুলো দুমড়ানো-মুচরানো, আর লাশের পচা গন্ধ থেকে থেকে বাতাসটাকে ভারী করে তুলছিল। মানুষ যত না ঝড়ে মারা গিয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশী মরেছিল জলোচ্ছ্বাসে। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত থেকে ৪-৫ মাইল অভ্যন্তরের প্রায় সব মানুষই বোধহয় নিহত হয়েছিল ২৫-২৬ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে। মানুষ তিনতলায় আশ্রয় নিয়েও পানির হাত থেকে বাঁচতে পারে নি।

প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক এ ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারিয়েছিল। সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল উপকূলবর্তী এলাকা ও চরাঞ্চলগুলো। কুতুবদিয়া, মহেশখালী, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী এসব এলাকায় অনেক জনবসতি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। বাঁশখালীতে আমাদের দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয় পরিবারের সবাই নিহত হয়েছিলেন।

ঝড়ের পর অনেক দিন চট্টগ্রাম শহরে কোন বিদ্যুত ছিল না। রাত নামলে শহরটা হয়ে যেত এক ভূতের নগরী। অন্ধকারে হেঁটে বেড়াতাম এ-গলি, ও-গলি। শহরটাকে মনে হত শয্যাশায়ী, মূমুর্ষ কোন আপনজন প্রচন্ড ব্যথায় ছটফট করছে। মানুষের লাশগুলো দু’একদিনের মধ্যেই সৎকার করা হয়েছিল। কিন্তু গরু-ছাগলের মত অবলা জীবগুলোর সৎকারের ভার কেউ নেয় নি। লাশগুলো পথের পাশেই ফুলে-ফেঁপে উঠছিল। কে করবে ওদের জন্য, মানুষ বাঁচানোই তখন দায় হয়ে পড়েছে। স্বজনহারা গৃহহীন, খাদ্যহীন, বস্ত্রহীন নর-নারী তখন পিলপিল করে আসছে ফুটপাতে, রেলস্টেশনে। কাঁদো মানুষ কাঁদো। একদিকে দেখছি নির্লজ্জ কিছু সাংবাদিক আব্রুহীন নারীর ছবি তুলছে তাদের চমৎকার রিপোর্টের সাবজেক্ট হিসেবে, অন্যদিকে কিছু মানুষ অবলীলায় গায়ের জামা, মানিব্যাগ তুলে দিচ্ছে মায়ের সম্মান রক্ষার্থে। পতেংগায় শুনলাম ঢাকা থেকে তামাশা দেখতে আসা কিছু মানুষকে স্থানীয় লোকেরা তাড়া করেছিল। ছবি চাই না, ত্রাণ চাই।

মাঝে মাঝে কর্ণফুলী ব্রীজের পিলারের নীচে গিয়ে বসে থাকতাম। কর্ণফুলীর ঢেউ তখনও প্রমত্তা সমুদ্রের মত। ঝড়ের সময় কোটি টাকা দামের ক্রেন ‘শক্তিমান’ নোংগর ছিঁড়ে ব্রীজটাকে আঘাত করে দুই ভাগ করে ফেলেছে। ফলে যানবাহন চলাচল বন্ধ। ক্রেনটাও একপাশে অনেকদিন ডুবে ছিল। দুঃখের মধ্যেও সবচেয়ে মজার ঘটনা ছিল ঝড়ের সময় বিমান বাহিনীর কিছু দামী ফাইটার প্লেন বাইরে রাখা ছিল, ঝড়ের পর ওগুলোকে খেলনা প্নেনের মত দুমরানো-মুচড়ানো অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল। হায় রে বিমান বাহিনী! এইটুকু কমন সেন্সও নাই।

এত দুর্যোগের মাঝেও যাদের কথা না বললেই নয়, তারা ছিল ভিনদেশী। গালফ ওয়ার থেকে দেশে ফেরার জন্য উন্মুখ ৭ হাজার সৈন্যের বিশাল একটা মার্কিন বাহিনীকে আমেরিকার বদলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হল দুর্গতদের সাহায্যের জন্য। ‘অপারেশন ডেজার্ট স্টর্ম’ হয়ে গেল ‘অপারেশন সী এঞ্জেল’। এটা ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম বৃহৎ একটি ত্রাণ কার্যক্রম। লেফটেন্যান্ট জেনারেল হেনরী স্ট্যাকপোল জাপানের ওকিনাওয়া থেকে এসে যোগ দিলেন অপারেশন কমান্ডার হিসেবে। আসলেই দেবদূত ছিল ঐ সেনাগুলো। আমাদের মত স্কুল ছাত্রদের যাদের পড়াশোনা কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তাদের কাজ ছিল মন্ত্রমুগ্ধের মত প্রায় প্রতিদিন ঐ সেনাদের কাজ-কর্ম দেখা। তখন বিশুদ্ধ পানির খুব অভাব ছিল। সাগরের পানি এসে পুকুর, জলাশয়ের সব পানি দূষিত করে ফেলেছিল। আমরা অবাক হয়ে দেখতাম, সেনারা পুকুরের ময়লা পানি একটা বিশাল যন্ত্র দিয়ে সাকশন করে আবার কিছুক্ষণ পরেই পরিষ্কার পানি পুকুরে ফেলত। মানুষ খালি তাজ্জব হয়েই দেবদূত-দের কাজ-কর্ম দেখত। আমার এখনো মনে হয়, ঐ সময় মার্কিন সৈন্যরা না আসলে এত তাড়াতাড়ি দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ২৯ শে এপ্রিলের ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে জেনারেল স্ট্যাকপোল ২০০৫ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন।

ঝড়ে যে গাছের পাতাগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল, আমার জানালা দিয়ে সে গাছ গুলো দেখতাম, আর ভাবতাম এ শহর কি আবার আগের মত সেই প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পাবে? একদিন বিস্মিত হয়ে দেখলাম মরা গাছে আবার সবুজ, কচি পাতা ধরেছে। তিন মাসের মধ্যেই গাছগুলো সতেজ হওয়া শুরু করল, প্রকৃতি তার ক্ষতে নিপুণ হাতে প্রলেপ লাগিয়ে দিল। ছয় মাস পর এ শহরকে দেখে আর বোঝার উপায় রইল না এর উপর দিয়ে কি ঘটে গিয়েছে। আমরাও স্বজন হারানোর বেদনা, দুর্যোগ সব কিছু ভুলে আবার স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। প্রকৃতি এক বিশাল বিস্ময়, তার চেয়েও বোধহয় বেশী বিস্ময়কর আমাদের জীবন!

(দ্বিতীয় পর্ব শেষ)
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে অক্টোবর, ২০০৭ বিকাল ৪:২৭
১৮টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×