somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বৃদ্ধাশ্রম।।।

১৭ ই জুন, ২০১৭ রাত ৯:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

১৭.০৫.২০১৭
মারুফের বাবা প্রতিদিনই প্রায় ফজরেরে আজানের আগেই মারুফকে ডেকে তুলতো।
সেই ছোট বেলা থেকে এখনও পর্যন্ত। মাঝখানে কিছু বছর একসাথে না থাকার কারনে
ডেকে তুলতে পারেনি।ছোট বেলাতে নামাজের আগে ডাক দিত। এখন আজানের আগে ডাকে।
মারুফ আজ আগেই উঠেছে, সে তার বাবাকে ডেকে তুলল।
আজানের আগে ডাকার কারন একটাই তারা বাপ বেটা একান্তে কিছু সময় কাটাতে পারে।
মারুফের মা বেচে নেই। মারুফের বাবা অনেক বেশি বৃদ্ধ।
নিজেই চলতে কস্ট হয় তার। এই বয়সে বরং তাকে বেশি বৃদ্ধ মনে হয়।
শক্তি টা হারায়নি। চলতে পারে একাই।
আগের যুগের মানুষ নাকি ফরমালিন ফ্রী খাবার খেয়েছিল বলে বেশিদিন বাচে, সাথে শরীর শক্ত পোক্ত থাকে।
এখানকার যুগে সেই খাবার মানুষ পাবে কই। ফল, সবজি কোথায় ফরমালিন নেই?
ভেজাল মুক্ত খাবার তো পাওয়াই যায় না। দিনের সাথে সাথে মানুষের বিবেক লোপ পাচ্ছে। প্লাস্টিকের চাল,
নকল ডিম, মরা মুরগী, মুরগির নাড়িভুঁড়ি এসব বিবেক থাকলে মানুষ মানুষকে খাওয়াতে পারে?
আজানের শব্দ ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফেরায় মারুফকে।
ফজরের আজানের "আসসালাতু খয়রুন মিনাল নাউম" এই অংশ শুনে মারুফ হেসে ফেলে।
ছোট বেলায় সে জানতোই না ফজরের আজানের মাঝে এই অংশটুকু থাকে।

মারুফের বাবা উঠেছে। লাইট জ্বেলে, মশারি টা ছেড়ে মারুফ বাবাকে ধরে টয়লেটের কাছে নিয়ে গেল।
মারুফ বাবাকে দরজা আটকাতে দেয় না। এই সময়টা সে দরজার সামনে বাইরে দাঁড়ানো থাকে।
এই কাজটা মারুফের মা করত যদি বাসার কেউ অসুস্থ থাকত, সে বাইরে দরজা ধরে দারিয়ে থাকত।
মারুফের বাবা বের হল। তাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে মারুফ টয়লেট যায়। ফ্রেশ হয়ে ওযু করে বাবার পাশে এসে বসে।
এই সময়টা তারা ছোট বেলার কথা মনে করেই পার করে। মারুফ কি কি করত, মারুফ যেন তার ছোটবেলাকে দেখতে পেত বাবার মুখে।
মুহিনের গল্প করত। তাকে খাওয়াতে তার আর মারুফের মায়ের যে কি কি করতে হত সব বলে যেত।
মারুফ লক্ষ্য করে এই সময়ে তারা বাবার মুখে হাসিটা লেগেই থাকে। এই মুহূর্তগুলো কি টাকা দিয়েও পাওয়া যায়!
নামাযের সময় হয়ে গেছে। নামায পরে আবার তাদের এই আলাপচারিতা চলবে। একি ঘটনা বিভিন্ন ভাবে বারে বারে আসে।
কিন্তু কেন যেন মারুফের বিরক্তি ধরে না। প্রতিদিন সকাল অবধি চলে এই স্মৃতিচারণ। শেষ মুহূর্তে বাপ বেটা দুজনের চোখের কোনেই জল।


১৯৮১ তে মারুফ বিয়ে করে। পরিবারে পছন্দেই। বিয়ের বছর দুয়েক পরেই মারুফ জুনিয়রের আগমন হয়।
বাসা জুড়ে আনন্দের বন্যা। মুহিনের জন্ম এর পরে মারুফ তার বাবা আর মাকে ঢাকায় নিয়ে আসে।
মারুফ আর তার বৌ দুজনেই চাকুরি করে। বাচ্চা হওয়ার পরে মারুফের বৌ কয়েকমাস ছুটিতে ছিল ঠিক,
কিন্তু তার পরে তো মুহিন বাসায় একা হয়ে যাবে, তাই বাবা মাকে স্থায়ী ভাবে নিয়ে আসা।
মুহিনের দাদা দাদু মিলে মুহিনকে বড় করে তোলে। মুহিনের যখন বয়স ১০ তখন মারুফের মা মারা যায়।
মারুফের বাবাই একা দেখাশুনা করত। মুহিনকে স্কুলে নেয়া, নিয়ে আসা, গোসল করানো, খাওয়ানো সব।
মারুফের বাবা আস্তে আস্তে শক্তি হারাতে শুরু করল বয়সের ভারে।
একটা সময় মারুফের বউ মারুফের বাবার উপর বিরক্ত হতে শুরু করল।
হ্যা ৯৮ই হবে,সম্ভবত ৯৮ সালেই প্রথম মারুফকে তার বৌ বলে মারুফের বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দেয়ার কথা। সে নাকি আর নিতে পারছে না।
মারুফ যোগ্য সন্তানের মত তার বৌ এর প্রস্তাব না করে দেয়। বৌ রাগ করে থাকে।
থাকুক ঠিক হয়ে যাবে ভাবে মারুফ।
ঠিক হয় না।
দিন যায়, মাস যায়, মাস পেড়িয়ে বছর যায়, বৌ যেন আর আগের মত নেই। বিরক্ত খুব।

২০০২ সালে তার বৌ আবার প্রস্তাব করে, কিন্তু মারুফ তার সিদ্ধান্তে অনড়। এবার ভাবী(মারুফের বৌ) বুঝি একটু বেশি রাগ করে ফেলে।
বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিতে থাকে। ২০০৩ সালে মুহিনকে নিয়ে বাসাই ছেড়ে দেয়।
মারুফ কিছু দিন অপেক্ষা করে। কিন্তু ভাবী আর আসেনা।
২০০৪ সালে মারুফ বাবাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসে।
ভাবী ফিরে আসে। বাসা যেন আবার আগের মত পরিপূর্ণ হয়।
আবার যেন সুখ ফিরে আসে।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। এক সময় ভাবী এবং মারুফ সবাই কর্ম জীবন থেকে অব্যাহতি নেয়।
মুহিনকেও বিয়ে করায়।
ফুটফুটে একটা বৌ মুহিনের জন্য আনা হয়। মুহিন নিজেই পছন্দ করে বিয়ে করেছে।
যেমন স্মার্ট তেমন সুন্দরি, তেমনি আধুনিক, তারচেয়ে বড় কথা শিক্ষিত।

একটা সময় মুহিন জুনিয়রের আগমন ঘটে। বাচ্চা দেখাশোনার ভার পরে মারুফ আর তার বৌ এর।
বাচ্চা বড় হয়ে যাওয়ার পরে কেমন যেন মুহিনের বৌ এর আচরণ বদলাতে থাকে। মারুফ আর তার বৌ বুঝতে পারে তাদের পুত্রবধুর এই বদলে যাওয়া।
এই বদলে যাওয়া আস্তে আস্তে যেন বারে। সপ্তাহখানেক আগে মুহিন মারুফ আর তার মাকে রেখে আসে বৃদ্ধাশ্রমে।
মারুফ যখন দেখে যেতেই হবে তখন সে তার বাবার সাথে থাকতে চাইল।
মুহিন অবাধ্য ছেলে নয় সে তার বাবা মা কে দাদু যেখানে থাকে সেখানেই রেখে আসে। মারুফ আর তার বৌ এক সাথে থাকতে পারত,
মারুফ নিজেই তারা বাবার সাথে এক রুমে থাকতে চায়।

২৭.০৫.২০১৭ সকাল ৬ টা।
মারুফ আর তার বাবার মুখে হাসি। কিন্তু চোখে জল। নামাযের পরে চেয়ার নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের বাইরে বসে আছে।
মারুফের বউ এসে তাদের পাশে বসে। মারুফের বউ এর মুখেও হাসি হাসি ভাব, কিন্তু চোখে পানি টলটল করছে। রোজার আগে খোকা(মুহিন) তার বাচ্চা নিয়ে ওদের দেখতে আসবে আজ।
রেখে যাওয়ার পরে খোকা বলেছিল সপ্তাহে ২ বার করে আসবে। খোকা কথা রাখেনি। মারুফের তাতে কষ্ট নেই। সেও একি কাজ করেছিল।
তার প্রার্থনা একটাই "খোকাকে যেন এই খানে আসতে না হয়"।
হয়তো কোন একদিন মারুফের বাবাও এভাবেই মারুফের জন্য অপেক্ষা করেছিল আর মনে মনে ভেবেছিল যেন মারুফ এখানে না আসে।
এখানে পানির খুব সমস্যা। খাওয়ার মানও ভাল না। ফ্যানটা যে চলে এটাই অনেক। মুহিন ছোট বেলা থেকে এসি রুমে বর হয়েছে।
এই কস্ট তার সহ্য হবে না।
মাগরিবের পরেও মুহিন আসেনি। একটু পরেই এশার নামায। আজ তারাবিও হবে।
মুহিন আজও কথা রাখতে পারবে না হয়তো। ঠিক মারুফের মত। হয়তো জরুরী কোন কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেছে।
রোজার শুরু হলে অনেক কাজ পরে যায়। এটা সেটা কেনা, সেহরির আয়োজন ব্লা ব্লা। মারুফ জানে এই ব্যাস্ততা রেখে চাইলেই আশা যায়।
কিন্তু যেহেতু মারুফ তার বাবাকে দেখতে আসার মত সময় বের করতে পারেনি আগে, আজ হয়তো মুহিনও পারবেনা।
খোকাকে না দেখার একবুক কস্ট বুকে রেখে চোখের পানি লুকায় মারুফ।
আজ নচিকেতার বৃদ্ধাশ্রম গানটা তার খুব মনে পরছে।
"ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার।
মস্ত ফ্লাটে যায়না দেখা এপার ওপার।
নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামিদামি,
সবচেয়ে কম দামি ছিলাম একমাত্র আমি"

এই গানটা এতদিন কেবল শুনেছে, আজ বুঝতে পারছে। তার বাবা যে কি ভাবে দিন কাটিয়েছে কিছুটা হলেও উপলব্ধি করে আজ।
দীর্ঘ শ্বাস ছারে মারুফ। এশার নামাজের পরে আজ তারাবি আছে। নিজ সন্তানকে না দেখতে পাওয়ার ব্যথা নিয়ে নামাজের উদ্দেশ্যে আগায় মারুফ। আল্লাহ এর কাছে মারুফের প্রার্থনা একটাই, মুহিনকে যেন এখানে আসতে না হয়।

লেখাঃ ১৭.০৬.১৭ রাত ৯টা ৩০ মিনিট।

লেখাটি আমার ফেবুতেও প্রকাশিত হয়েছে।
লিংকঃ fb.me/payel420x





সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১৭ রাত ১০:২১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×