ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কিয়ের সাদা রাত্রি বইটি থেকে কিছু অংশ শেয়ার করার ছোট একটি প্রচেষ্টা...........
“আপনি হয়ত জানেন না, এই সাংকৎ পিতেরবুর্গ শহরে কিছু অদ্ভুত জায়গা আছে। যে- সূর্য এই নগরীর অবশিষ্ট সবখানে কিরণ ছড়ায় তা ওইসব অদ্ভুত জায়গাগুলোতে ভুলেও উকি মারে না। তবে অন্য একটা সূর্য, একটা নতুন সূর্য আছে সেইসব দূরবর্তী কোণগুলোর জন্য, সেই সূর্য একটু ভিন্ন রকম, একটা অদ্ভুত আলো ফেলে সবকিছুর উপর।সেই দূরবর্তী কোণগুলোতে জীবন অন্য রকম, এক জগৎদূরবর্তী বলে মনে হয়, আমাদের চারপাশের জীবনের সঙ্গে তা কোনোভাবেই মেলে না; এমন ধরনের জীবন কেবল কিছু রুপকথার অদ্ভুত রাজ্যেই থাকতে পারে, তা আমাদের এই খুব সিরিয়াস সময়ের মধ্যে আদৌ এই গ্রহের জীবন নয়। সেই জীবন একটা বিশুদ্ধ কাল্পনিক আর অতিশয় ভাবময় কিছুর অদ্ভুত মিশ্রণ, আর একই সঙ্গে ( হায় ) তা বিবর্ণ রকমের গতানুগতিক আর সরল, যদি অবিশ্বাস্য রকমের তুচ্ছ না বলা হয় তাকে।”
“ঈম্বর ! কী ভূমিকা বটে। কী শুনতে হয় শেষ পর্যন্ত কে জানে ?”
“ নাসতিয়েনকা ( মনে হয় আপনার নামটা বলে আমার কখনো ক্লান্তি আসবে না ) সেই অদ্ভুত জায়গাগুলোতে থাকে কিছু অদ্ভুত রকমের মানুষ-তারা সেইসব ড্রিমার, স্বপ্নচারী। আপনি যদি স্বপ্নচারী শব্দটার বিশেষ সংজ্ঞাটি জানেন -স্বপ্নচারী আসলে বাস্তব ব্যক্তি নয়, সে এক ধরনের ক্লীব প্রাণী। এই প্রাণী সাধারণত এমন এক কোণে নিজেকে স্থাপন করে, যেন সে দিনের আলো থেকে নিজেকে লুকিয়ে রাখে। আর একবার যখন সে তার কুঠুরীতে প্রবেশ করে তখন তার সজ্ঞে একেবারে সেঁটে যায় শামুকের মতো। বা এক্ষেত্রে সে ওই মজাদার প্রাণীর মতো যে নিজেই, একার মধ্যেই একটি বাড়ি ও একটি প্রাণী, মানে, যাকে আমরা কচ্ছপ বলি। কেন সে তার বিষণ্ন, জঘন্য, ধোঁয়ায় কালো হয়ে যাওয়া ময়লা সবুজ রঙ করা চারটা দেয়ালের প্রতি আসক্ত ? ভাবতে পারেন ? যখন তার সামান্য কয়েকজন বন্ধুর মধ্যে কেউ একজন তার কাছে আসে, তখন কেন এই হাস্যকর ভদ্রলোক এমন বিভ্রান্তের মতো তাকে গ্রহণ করে ?কেন সে এই অপ্রস্তুত হয়ে যায় ? কেন তার চেহারাসুরত এমন দুমড়ে মুচড়ে যায় আর এমন দেখায় যেন বা সে তার চার দেয়ালের মধ্যে এইমাত্র কোনো অপরাধ করে ফেলেছে। বা সে টাকা জাল করতে বসেছিল? নয়তো বেনামী একটা চিঠিসহ কোনো পত্রিকায় পাঠাবার জন্য পদ্য লিখতে বসেছিল ? ( পদ্যের সাথে ওই বেনামী চিঠিতে সে লিখত যে, পদ্যের প্রকৃত রচয়িতা মারা গেছেন কিন্তু তাঁর বন্ধু হিসেবে এটা তার পবিত্র কর্তব্য যে পদ্যগুলো ছাপা হোক।) কেন ওই দুই বন্ধুর কথা জমে উঠছে না ? কেন তা এত আনুষ্ঠানিকতাক্লিষ্ট ? কেন তাতে কোনো হাসি বা কৌতুক নেই ? কেন ওই অতিথি, যে অন্যান্য পরিস্থিতিতে হাসি ঠাট্টা, রসালো আলাপ, আদিরস বা অন্য কেনে মজাদার বিষয়ে গল্প গুজব করতে খুব মজা পায়, সে এখানে এসে এত ফর্মাল হয়ে যায় ? কেন এই বন্ধুটি, যে স্পষ্টতই তার নতুন পরিচিতি এবং প্রথমবারের পর শেষবারের মতো দেখা করতে এসেছে ( কারণ, এরপরে দ্বিতীয়বার সে আসবে না ) এমন বেগাতিক অবস্থার মধ্যে পড়ে গেল, যার কাছে যে এসেছে তার ভড়কানো দেখে তার জিভ আড়ষ্ট হয়ে গেল? আর সে, মানে গৃহকর্তা, আরাপের দুর্বলতা কাটিয়ে তোলা, আলাপকে প্রাণবন্ত করে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা করল, যৌনতা বা অন্য কোনো হালকা বিষয়ে মন্তব্য করে ভুল করে চলে আসা অতিথি বন্ধুর মন জয় করার বিফল চেষ্টা করে অবশেষে বিভ্রান্ত হয়ে গেল, বুদ্ধির ভারসাম্য হারিয়ে ফেলল ? কেন সেই অতিথি এক সময় হঠাৎ করে তার টুপি হাতে নিয়ে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অস্তিতহীন কাজের কথা স্মরণ করে, বন্ধুর হাতের মধ্যে থেকে নিজের হাত টেনে নিয়ে তরিঘড়ি বেরিয়ে গেল? আর গৃহকর্তা নিজেকে দুঃখিত দেখাবার জন্য, পরিস্থিতিটি সামলে নেয়ার জন্য যাবতীয় কিছু করার চেষ্টা করল। কেন সেই অতিথি বন্ধুটি ঘরের বাইরে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল? আর শপথ করল যে, এই অদ্ভুত লোকটির কাছে আর কক্ষনো সে আসবে না? যদিও এই অদ্ভুত লোকটি আসলে একজন চমৎকার মানুষ। আবার তাই বলে অতিথি বন্ধুটি তার গৃহকর্তার সঙ্গে এমন সামান্য খেলায় মেতে উঠতে পারে না । একটা তুলনা টানা যায়, যদিও সেটা খুব দূরবর্তী তুলনা হবে, গৃহকর্তার চেহারার সঙ্গে যে- ভঙ্গিতে সে কথাবার্তার সময় বন্ধুটির দিকে তাকাচ্ছিল, সেই চেহারার সঙ্গে একটা চপল বিড়ালছানার তুলনা টানা চলে, যে-বিড়ালছানাটি কিছু ছেলেমেয়েদের হাতে যারপরনাই নাস্তানাবুদ হয়ে আতঙ্কে ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে পালিয়ে একটা চেয়ারের তলায় লুকিয়ে গেছে, বাধ্য হয়েছে সেখানে পুরো একটা ঘন্টা কাটাতে, সব পশম খাড়া হয়ে গেছে তার এবং সে হেঁচেছে, করুণ মুখটাকে তার দুই থাবায় বার বার মুছেছে এবং অনেকক্ষণ পর সুস্থির হয়ে জগতের দিকে সবিদ্বেষে তাকিয়েছে, এমনকি মালিক তার জন্য যে সব খাবার দাবার রেখেছে সে সবের দিকেও।"
***********************