ঠিক এখানেই কড়া নাড়ার শব্দ। সাদিক এসেছে। শীতে কাপছে।
তোফায়েল দরজা খুলতেই দেখল- সাদিক শীতে কাপতে কাপতে বলছে- "একটা কম্বল হবে? বড্ড শীত করছে।"
তোফায়েল কম্বল দিতে যাবে, মেয়েটা বলল- " সরি, কম্বল তো দিতে পারব না। একটাই আছে, ওকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম আসে না।"
তোফায়েল যেন খুশি হল। এক গাল গর্বের হাসি হাসল। ছেলেরা সারাজীবন গর্ধোই থেকে যাবে। নইলে কেউ খুশি হয়!
মেয়েটা বোতল দেখিয়ে বলল- "অল্ড মংক আছে, চাইলে খেতে পারেন?"
এক মুহূর্তেই তোফায়েলের সমস্ত গর্ব ধুলিসাত হয়ে গেল। মেয়েটা চাইছে সাদিক থাকুক, তোফায়েল জোর যেন না করতে পারে। মেয়েটার কি এখোনো বিশ্বাশ জন্মায়নি। জোর করলে তো সে অনেক আগেই করতে পারত।
সাদিক মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল -" মন্দ হয় না, কিন্তু এসে থেকেই আপনাদের বিরক্ত করছি।" তারপর তোফায়েল কে উদ্দেশ্য করে বলল- " উনি এতটা সহ্য করবেন কেন?"
তোফায়েল অকারণেই হেসে বলল- "আরে নাহ, কি বলছেন? আসুন। তাছাড়া আপনি যা ভাবছেন তা না।" মেয়েটা হচকচিয়ে গেল। তোফায়েলের দিকে তাকিয়ে রইল। তোফায়েল মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল- " আমরা তো গল্পই করছিলাম।"
অকারণেই সাদিকের সাথে তোফায়েলের এই সখ্যতা মেয়েটা বুঝতে পারল না। সাদিক বিছানায় বসল। তোফায়েল মেয়েটার পাশে, সোফায়। তারপর দুটো প্যাক বানাতে বানাতে অকারণেই তুমুল উতসাহে বলল- "ভালো কথা, আপনাকে কি ও আমাদের প্রথম দেখার গল্প পুরোটা বলেছে?"
মেয়েটা এবারও বুঝতে পারলো না, অকারণেই তোফায়েলের এমন উতসাহের কারণ।
সাদিক একটা গ্লাস টেনে নিয়ে বলল- " হ্যা, আপনাদের গল্প খুব ইন্টারেস্টিং। "
তোফায়েল সিগারেটের প্যাকেট সাদিকের দিকে এগিয়ে দিলো। সাদিক একটা সিগারেট বের করে ঠোটে গুজলো। তোফায়েল লাইটার দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিয়ে সোফায় এলিয়ে বলল- "কী অবাক কান্ড, দেখেছেন! দু'বছর পর আবার আমরা ওমন একটা রাত পেয়েছি।" বলেই মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসলো।
মেয়েটা অবাক হয়ে তোফায়েলের দিকে তাকিয়ে আছে। ও কেন সাদিককে এসব কথা বলছে? ও কি সব বলে দেবে? এবার ভাগ নিতে প্রস্তুত? মেয়েটা নিজের প্যাক হাতে নিয়ে বলল-" আমার ভাগ্যটাই ভালো। ঠিক দুবছর আগে আমাদের যেভাবে দেখা হয়েছে সেভাবেই হানিমুনের শুরু।" বলেই মেয়েটা তোফায়েলের দিকে তাকালো। ওরা দুজন মুখোমুখি। নিস্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছে। মেয়েটা কি এর আগে এতটা কাছে এসেছিলো? মেয়েটা হাসছে, ওর হাসিতে কি মিশিয়েছে? কে জানে? তোফায়েল শুধু বঝতে পারল, ওর বুকটা ব্যাথা করছে। এ ব্যাথা সহ্য করার ক্ষমতা কি তোফায়েলের আছে? নিশ্চয় এ ব্যাথার উতপত্তি পৃথিবিতে নয়, অন্য কোন খানে।
সাদিক মিহি হেসে বলল- "আপনাদের দেখে হিংসে হচ্ছে।"
তোফায়েল দ্বীগুন উতসাহে বলল- "কেন?
"এমন একটা রাত আমার কপালে জুটলো না।"
সাদিকের প্যাক শেষ। শূণ্য গ্লাসটা তোফায়েলের দিকে এগিয়ে দিলো। তোফায়েল গ্লাসে সুরা ঢালতে লাগলো।
মেয়েটা বলল- " শুধু ক্যামেরা নিয়ে ছুটলে হবে? মেয়েদের মনও তো বুঝতে হবে।"
সাদিক অল্পখানিক হেসে বলল- "তোফায়েল সাহেব বুঝি মন বোঝায় খুব পটু!"
মেয়েটা ঠোট উল্টিয়ে বলল- "কচু।"
সাদিক গ্লাস নিজের দিকে টেনে নিলো। তোফায়েল ঢালতে দেরী করছে। শরীর ঘামছে। জ্বর কি এসেছে? না বোধয়। বৃষ্টিতে ভিজেছে অনেক্ষন। শরীর কাপছে। চার/ পাচ প্যাক খেয়ে একটা ঘুম দিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সাদিক দ্রুত প্যাকটা চালান করে শূণ্য গ্লাস ফিরিয়ে দিয়ে বলল - " আপনার মনতো বুঝেছে, আপনি ধরা দিয়েছেন। "
মেয়েটা তোফায়েলের দিকে তাকিয়ে করুন কন্ঠে বলল - " সেখানেই তো আফসোস। "
তোফায়েল কথাটা পড়তে দিল না, টপ করে ধরে বলল - "এখনো চাইলে পার্টনার বদলাতে পারো। "
সাদিক বলল- "কি, বদলাবেন? "
মেয়েটা অন্যমনস্ক কন্ঠে বলল- " না, যেখানে বাঁধা পড়েছি সেখানেই শেষ আশ্রয়, যদি সে চায়?"
"সে চাইবে না কেন? সাধ করে কি কেউ ভাগ দিতে চায়! এটা তো আপনার উপর, আপনি ভাগীদার করবেন কিনা?" সাদিক বলল।
তোফায়েল নিজে একটা সিগারেট জ্বালিয়ে, মেয়েটা কে উদ্দেশ্য করে বলল- " তুমি চাইলে আমি রাজি। ভালোবাসায় এতটা উদারতা দেখানোই যায়।"
ভালোবাসা? হাসল মেয়েটা। একটা রাতের ক্ষণিক কিছু মুহূর্ত, এর নাম ভালোবাসা? মেয়েটা জানে, তোফায়েলের সমস্ত আকুলতা কেবল এই একটি রাতের জন্য। একে ভালোবাসা বলতে বিন্দু পরিমাণ বাধছে না? পুরুষ এতটা নির্লজ্জ? একটু আগেও তো, ও বলেছিল ওর সমস্ত একার চাই। আর এখন ভাগেও রাজি।
মেয়েটার নিজেকে ধরে রেখে বলল - " ভালোবাসা ভাগে কি বিলানো যায়? এতটাই সস্তা? "
সত্যি তো ভালোবাসা কি? এর কোন সঠিক ব্যাখ্যা আছে? হঠাৎ মনে হয় এই শুধুই মায়া। পরক্ষণেই আবার মনে হয়, না... এ মায়ার চেয়েও বেশি কিছু।
তোফায়েল বলল- "না...ভালোবাসা বিলানো যায় না। এর জন্য লড়াই করা যায়।" শেষ কথাটা বলল অবশ্য সাদিককে উদ্দেশ্য করে।
আসলেই কি তোফায়েল মেয়েটাকে ভালোবেসে ফেলেছে? সে সময় আসলে কি তোফায়েল লড়বে মেয়েটার জন্য? ভেবে পেল না মেয়েটা।
সাদিক বলল-" ঠিক, ভালোবাসা সস্তা না। নয়তো ট্রয় ধ্বংস হত না।"
মেয়েটা বলল- "ট্রয়ের ধ্বংস হওয়ার পেছনে কিন্তু পুরুষের ইগো আর লোভ। ভালোবাসা না।"
সাদিক কৌতুহলি হয়ে বলল- "মানে?"
মেয়েটা বলল-" মেনেলাউসের কিন্তু হেলেনের প্রতি খুব গভীর প্রেম ছিলো না, কিন্তু ওর দাসী কে কেউ ভাগিয়ে নিয়েছে এটা ওর ইগোতে বেধেছে। লোকে বলবে কাপুরুষ, বউ ধরে রাখতে পারেনি। তাছাড়া ট্রয়ের প্রতি আগামেমননের লোভ তো ছিলই। "
তোফায়েল বলল- "বেচারা প্যারিস যে জীবন দিল?"
"এর পিছনেও পুরুষের ইগো, অন্যের বউকে ভাগিয়ে নেওয়ার মাঝেও গৌরব আছে।" বলল মেয়েটা।
সাদিক একটা সিগারেট জ্বালালো, বললো- " প্যারীস চাইলে তো হেলেনকে ফেরত দিতে পারতো। সে ক্ষেত্রে গৌরবও থাকত, ট্রয়ও। "
"না থাকতো না।" গলার স্বর দৃঢ় করে বলল মেয়েটা। "সেক্ষেত্রে লোকে বলত ভাগীয়ে এনেছে কিন্তু ধরে রাখতে পারেনি। আর মেনেলাউসের প্রতিশোধ নেওয়ার বিষয়ও তো ছিল। আগামমেননের লোভ তো ছিলই।"
"কিংবা সত্যি সত্যি প্যারিস হেলেনকে এতটাই ভালবেসে ছিলো, যার জন্য জীবন দেওয়া যায়।" গলার স্বর ক্ষীণ করে বলল সাদিক।
সত্যি কি কারো জন্য জীবন দিয়ে দেওয়া যায়? এতটা ভালোবাসা যায়? তোফায়েল কি পারবে, ওর জন্য জীবন দিতে?
মেয়েটা বলে-"সত্যি কি এতটা ভালোবাসা যায়? কারো জন্য জীবন দিয়ে দেওয়া যায়?" তারপর তোফায়েলের দিকে ব্যঙ্গ হেসে বলে - " তুমি পারবে আমার জন্য জীবন দিতে?"
তোফায়েলের পৌরষালিতে কেউ পেটালো যেন, দপদপ করছে। তোফায়েল কণ্ঠনালীতে পৌরষত্ব ধরে বলে-" সময় আসুক, পরীক্ষা দেওয়া যাবে। তুমি কি পারবে, আমার জন্য জীবন দিতে?"
মেয়েটা রঙ্গ হেসে বলে- "না গো, আমি পারবো না, সরি।"
হাসে সাদিকও। তোফায়েল শুধু জ্বলছে।
সাদিক শূণ্য গ্লাস এগিয়ে দেয় তোফায়েলের দিকে। তোফায়েলের সেদিকে খেয়াল নেই। সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। মেয়েটা সাদিকের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে, একটা প্যাক ঢালল। সাদিককে গ্লাস ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল- "কাউকে ভালোবেসে জীবন দেওয়া যায় না। জীবন এত ঠুনকো নয়, যে একটি রাতের আকুলতা পূর্ণ না হয়াই বিসর্জন দিবে।"
মেয়েটার কথায় তীক্ষ্ণতা ছিল, নয়তো তোফায়েলের গায়ে ফুটত না। ক্ষত হত না, তোফায়েলের বুকে।
তোফাইল কণ্ঠস্বর করুন করে বলল- "ভালবাসার মত বাসলে হয়তো দেওয়া যায়। আমরা বাসতে পারি না বলে বলছি দেওয়া যায় না। লাইলী-মজনু তো দিয়েছ।"
সাদিক বলল- "ঠিক।" তারপর মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল- "ভালোবাসা সম্পর্কে আপনার ধারণা ভুল। একটা মেয়ের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য একজন পুরুষ সব করতে পারে, জীবনও দিতে পারে। "
মেয়েটা বলল- "সেটা কি পুরুষের ইগো নয়? বা অন্য কিছু।"
মেয়েটার যুক্তি ধোপে টেকে না। একজন পুরুষ হয়তো ইগোর জন্য জীবন দিয়ে দিতে পারে কিন্তু সামান্য যৌনতার জন্য? নাহ। তবে কি এটা ইগো নয় যে, সে একজনকে আকুলতায় ডেকে যাচ্ছে কিন্তু সাড়া পাচ্ছে না। বারবার নতমুখে ফিরে আসছে, এটাকি পৌরুষত্বে আঘাত করে না?
সাদিক বলল- "মানছি, সব টাইপ পুরুষের ইগো। কিন্তু মেয়েরা যে জীবন দিচ্ছে?"
"মেয়েরা ভালবাসতে জানে বলে।" বলল মেয়েটা।
"এটা ঠিক হচ্ছে না। একপেশে হয়ে যাচ্ছে। আপনি ছেলেদের নতো করে, মেয়েদের উন্নত করে তুলছেন।"
"কারন আমরা আপনাদের চেয়ে উন্নত বলে।" বলেই ফিক করে হেসে দেয় মেয়েটা।
হাসে সাদিকও। কিন্তু তোফায়েলের ঠোঁটে হাসি নেই। ও ঠোটে আদৌ কখনো হাসি ছিল? হলফ করে বলতে পারে না তোফায়েল।
সাদিক বলল- "আমি উঠছি, আপনারা গল্প করুন। নয়তো আপনাদের মধুর রাত, এভাবে নষ্ট হয়ে যাবে। তোফায়েল সাহেব যে কোন মুহূর্তে যুদ্ধের ডাক দিয়ে দিতে পারে।"
হাসছে সাদিক, হাসছে মেয়েটাও। মেয়েটা হাসতে হাসতে বলল- "হ্যাঁ উঠুন, যথেষ্ট বিরক্ত করেছেন।"
সাদিক উঠতে যাবে, মেয়েটা বলল- "কম্বলটা নিয়ে যান।"
দাঁড়িয়ে পড়ল সাদিক।
"কিন্তু আপনাদের তো একটাই কম্বল?"
মেয়েটা বলল- "আপনি নিয়ে যান, আমরা আজ রাতে ঘুমাবো না।" তারপর তোফায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল- "গল্প করেই কাটিয়ে দেব।"
সাদিক কম্বল নিয়ে চলে গেল। ওর শরীর কাঁপছে। জ্বর বোধয় এসেছে। মেয়েটা কি বুঝতে পেরেই কম্বলটা দিয়ে দিল? আসার সময় হাতে আর একটা মোম জ্বালিয়ে এনেছে। একটা ঘুম দিতে হবে, তাহলেই সব ঠিক। কত রাত এরকম জঙ্গলে কেটেছে।
সাদিক চলে যেতেই তোফায়েল উঠে দরজা বন্ধ করে দিল। এখানে কারেন্ট আবার উদয় হল। বাহিরে ঝড় আর নেই কিন্তু বৃষ্টি আছে। তোফায়েল বিছানায় গা এলিয়ে দিল। টিভিতে আবার ডিসকভারির একটা ভিডিও ছারলো।
ভিডিওটাতে বলছে - পুরুষদের মধ্যে নাকি সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রজাতি সাপ। একটা পুরুষ কোবরার আহবানে মাদা সাড়া না দিলে, পুরুষ কোবরাটি মাদাকে মেরে খেয়ে ফেলে। পুরুষত্বের এতটা ইগো?