গুটিসুটি মেরে বসে থাকা আর চলে না। এদেশে ভারতীয় ছবি আসবে। তা কী মানা যায়? কক্ষনো না। ভারতীয় আগ্রাসন বন্ধ করতে হবে। তা না হলে এদেশের চলচ্চিত্র শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে। না খেয়ে মরবে লক্ষাধিক লোক-ঠিক এমনই ভাবনা এফডিসির তথা চলচ্চিত্র অঙ্গনের কিছু মানুষের, কিছু নির্মাতার, কিছু শিল্পীর। কোনমতেই তারা ভারতীয় ছবি এদেশে আসা সমর্থন করেন না। তাতে নাকি আমাদের ছবির আরো বেহাল দশা হবে। দেশে অশ্লীল ছবি নির্মিত হয়েছে একসময়। পরিবার পরিজন নিয়ে ছবি দেখাতো দুরের কথা, বাংলা ছবির নাম শুনলেই নাক সিটকানো শুরু হতো। এখনো পত্রিকার পাতা খুললে দেখা যায় অমুক জেলায় অমুক হলে কাটপিস লাগিয়ে ছবি প্রদর্শিত হচ্ছে। বলা প্রয়োজন, অশ্লীলতার দাপটে যখন ঢাকাই ছবির বেহাল দশা, সুরূচিপূর্ণ শিল্পী, নির্মাতারা যখন কিছু মন্দ লোকের দাপটে না খেয়ে মরার দশা, সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র বিকাশ একেবারেই যখন বন্ধের পথে; ভারতীয় ছবি আসলে এর চেয়ে কী বেশী খারাপ অবস্থা হবে ঢাকাই চলচ্চিত্রের?
প্রথমেই শিল্পীদের প্রসঙ্গে যাক। এক শাকিব খানের কাছে আমরা কী পাচ্ছি? শাকিব নির্ভর চলচ্চিত্র গড়ে ওঠার পিছনে দায়ী কারা? কী এমন অভিনয় উপহার দিচ্ছেন শাকিব আমাদের দর্শকদের? ৩০/৩৫ লাখ টাকার পারিশ্রমিক নেয়ার মতো যোগ্যতা কী শাকিবের আছে? যদি থাকে তাহলে ভারতীয় ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শাকিব খানের ছবিও টিকে থাকবে। এতে শাকিবদের ভয় পাবার কী আছে? ঢাকাই চলচ্চিত্রের কোন নায়িকা কী আজও পর্যন্ত কোন আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে (স্বাধীনতা পরবর্তী) জায়গা করে নিতে পেরেছে? কেন পারেনি? কারণ কোন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশী ছবি গ্রহণযোগ্য নয় বলে স্বাধীণতার এত বছর পরও বাংলা চলচ্চিত্রকে থাকতে হয়েছে অন্ধকার কুঠুরীতে। মুক্ত বাণিজ্যে বিশ্বাসী নয় বলে, নিজের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে নিজেরই কোন জ্ঞান না থাকার ফলে তথাকথিত চলচ্চিত্র ধারকরা এখন ভারতীয় ছবির বিরোধীতা করছেন, ভয় পাচ্ছেন। কিন্তু কেন? আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে এদেশের মানুষ বেশী আগ্রহী। কিন্তু হালের দেশীয় নির্মাতারা কী দিতে পেরেছে? উদ্ভট গল্প, বেঢপ কিছু নায়িকারূপী মিনি জলহস্তীর নাচন আর নির্মাতার একঘেয়েমীতা ছাড়া কী আর কিছু পেয়েছে আমাদের দর্শক। বিকল্প কিছু আসলে বিকল্প চিন্তা করবে নির্মাতারা-এটাই স্বাভাবিক। অন্তত দেশীয় নির্মাতা-প্রযোজকদের মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য হলেও এদেশে ভারতীয় ছবি আসা উচিৎ-এমনটিই মনে করছেন রুচীশীল দর্শকরা।
ছবির গল্প প্রসঙ্গে বলতে হয়-একই ধরনের গল্প নিয়ে বহু ছবি নির্মিত হয়েছে। ছবির মান শুন্যের কোটায় চলে গেছে। ভালো ও দর্শক গ্রহণযোগ্য ছবির অভাবে এবং পাইরেসীর কল্যানে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। একই নায়ক-নায়িকার ছবি দেখতে দেখতে দর্শক ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠেছে। এক শ্রেণীর দর্শকদের জন্য ছবি নির্মাণের কথা বলে সব শ্রেণীর দর্শকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে, আলু-পটল ব্যবসায়ীরা চলচ্চিত্রাঙ্গনের উচ্চাসনে বসে রয়েছে-এতসব বড় বড় ঘটনা তাদের কাছে ঠুনকো। কথায় আছে পিছন দিক দিয়ে হাতি চলে যাক তা দেখার বিষয় নয়, সামনে দিয়ে ইঁদুর গেলে সেটা ঘোরতর অন্যায়। অদভুত-হাস্যকর যুক্তির আঁধারে তারা উত্তেজিত।
যে প্রসঙ্গ নিয়ে এত তোলপাড় তা হলো, ভারতীয় ছবি এদেশে আসবেনা। কেন আসবে না? যেখানে আমাদের ছবির গল্প বেশীরভাগই ভারতীয় ছবি থেকে চুরি করা। হয়তো পুরনো কোন হিন্দি ছবি কিংবা চার-পাঁচটি দক্ষিণ ভারতীয় ছবি (তামিল, তেলেগু, মালায়ালাম, কান্নাড়া)'র গল্প মিলিয়ে একটি বাংলাদেশী ছবির গল্প বানানো হচ্ছে। শুধু ছবির গল্পই নয়! গানের কথা, সুর, নির্মাণ এমনকি অভিনয়েও চুরি করা হয়। এরকম কেটে কেটে আনার চেয়ে পুরো ভারতীয় ছবি আনলে সমস্যা কোথায়? আছে, সমস্যা আছে। ভারতীয় ছবি আনলে চুরি ধরা পড়ে যাবে। আবার আমাদের নির্মাতাদের সৃজনশীল ও মেধাবী হতে হবে। অত্যন্ত পরিশ্রমের ব্যাপার। সহজে কোন জিনিস মিললে কে চায় এত পরিশ্রম করতে? ভারতীয় ছবি আসলে দর্শক বুঝে যাবে কোন দৃশ্যটা কোন ছবি থেকে চুরি করা-এটা নিয়েই চিন্তিত বোদ্ধারা।
ভারতীয় ছবি আসলে দেশীয় ছবি বন্ধ হবার শঙ্কায় আছেন তারা। ভারতে তো হলিউডের বা বর্হিবিশ্বের ছবি চলছে। তুলনামুলকভাবে ভারতীয় ছবির চেয়ে হলিউডের ছবি বেশ উন্নত। তাই বলে কী ভারতীয় ছবি নির্মান বন্ধ হয়ে গেছে? বরঞ্চ মানসম্মত ও উন্নত ছবির প্রতিযোগীতায় নেমেছে তারা। আবার পোল্যান্ড-এ শাহরুখ খান তথা বলিউডের ছবির জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। কিন্তু পোলিশ ছবিওতো ভালোভাবে চলছে। হলিউডে হৃত্ত্বিক রোশনের 'কাইটস' ছবিটি একদিনে ৬৫ কোটি রূপী আয় করেছে। এতে কী হলিউডের কোন ছবির ক্ষতি হয়েছে? নাকি হলিউডবাসীরা মাথায় হাত দিয়ে বলছে-গেলরে, এবার বুঝি আমেরিকাটা ইন্ডিয়া হয়ে গেল! যদি তাই না হয় তাহলে আমাদের দেশেও ভারতীয় ছবি আসলে সুস্থ ও মানসম্পন্ন ছবি নির্মাণের প্রতিযোগিতা শুরু হবে-এটা কেন যে বুঝতে চাইছেনা আমাদের নির্মাতা-প্রযোজকরা তা বোধগম্য নয়।
দর্শক নিয়ে প্রশ্ন আসলে বলতে হয়, আমাদের ছবির দর্শক কারা? নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণী। তারা ইংরেজী, হিন্দি, তেলেগু, মারাঠি কিংবা ভারতীয় অন্য ভাষা বোঝেনা। তারা টম ক্রুজ, রাসেল ক্রো, শাহরুখ খান, আমির খান কিংবা অক্ষয়ের চেয়ে একজন শাকিব খান, রিয়াজ, কিংবা ফেরদৌস-কেই বেশী পছন্দ করে এবং করবেও। দর্শক নিয়ে শঙ্কায় থাকার কোন কারণ নেই। প্রসঙ্গত বলতে হয়, ভারতীয় ছবির দর্শক কারা হবে? যারা মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর 'থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার'-এর মতো ছবি দেখে, তাদের কাছে লিভ টুগেদার বা পরকীয়া অনেক বেশী প্রিয় (!) এবং এরাই হবে ভারতীয় ছবির দর্শক। এরা এমনিতেও আমাদের বাণিজ্যিক ধারার ছবিগুলোর দিকে আগ্রহ দেখায়না। সুতরাং ঢাকার ছবির দর্শক নিয়ে নির্মাতাদের ভয়ের কারণ কী সেটাও তারা পরিষ্কার করে বলেন নি। বরং উপকার হবে যেটা, কিছু মানুষ হলমুখী হবে। সিনেমার প্রতি আগ্রহ বাড়বে। আমাদের কালচারের সঙ্গে তুলনা করার সুযোগ তৈরি হবে বেশী। এতে করে দেশীয় কালচারেরও উন্নতি ঘটবে।
ভারতীয় ছবিতে যেরকম প্রযুক্তির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, সে ধরণের প্রযুক্তির কথা নিয়ে আমাদের দেশীয় নির্মাতারা প্রশ্ন তুলতে পারেন। তারা বলতে পারেন আমাদের দেশে সেই ধরণের প্রযুক্তি নেই। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, প্রযুক্তির ব্যবহার কী ঢাকার নির্মাতারা জানেন? শেখার জন্য বয়স লাগেনা। চেষ্টা করেছেন কী কখনো? যেখানে একজন নির্মাতা কিংবা প্রযোজকের পেশাই হচ্ছে চলচ্চিত্র নির্মাণ সেখানে এই বিষয়টি নিয়ে যথোপযুক্ত জ্ঞান অর্জনের জন্য কোন চেষ্টা তারা করেছেন কী? আজকে এফডিসিতে যদি ডিজিটাল পদ্ধতির সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয় তাহলে সেগুলো যারা অপারেট করবে তাদেরকে একজন পরিচালক হিসাবে দিক-নির্দেশনা দেবার মতো কম্পিউটার সফটওয়ার সম্পর্কিত জ্ঞান কী নির্মাতাদের আছে? যদি না থাকে তাহলে বাইরের ছবিতে প্রযুক্তির ব্যবহার আছে এবং বাংলাদেশের নেই এমন অভিযোগ করা অরণ্যে রোদন মাত্র। কারণ তারা প্রযুক্তির ব্যবহার জানে। তারা শিখে এসেছে দেশ-বিদেশ থেকে। ঢাকার নির্মাতাদের প্রতি অনুরোধ, নিজে শিখে তারপর সরকারের কাছে আবেদন করুন। এরপর দেখুন সরকার আপানাদের জন্য কী করে। যদি না করে তারপর আন্দোলনে নামুন। এতে করে দেশের আপামর জনসাধারণ আপনাদের সঙ্গেই থাকবে বলে বিশ্বাস।
এফডিসির ৩৫ মি.মি.-এর যে দু-তিনটি ক্যামেরা দিয়ে ছবি নির্মিত হয় তার সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান নির্মাতারা রাখেন? নির্মাতাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি, এখনো বলিউডের ৩৫% ছবি ৩৫ মি.মি. ক্যামেরায় ধারণ করা হয় এবং সেইসব ছবি সুপারহিটও হচ্ছে। প্রযুক্তির সঙ্গে নির্মাতার সৃজনশীলতাও থাকতে হয়। সেটা আছে কী? যাদের আছে তারা ভারতীয় ছবি আসা নিয়ে ততটা উদ্বীঘ্ন নয়। এই মুহুর্তে বাংলাদেশে রেড ক্যামেরা, সিনে আলট্রা, এইচডিভি, পিটু এইচডিভি এবং ভালো মানের ৩৫ মি.মি. ক্যামেরায় চিত্রগ্রহনের কাজ চলছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সিনেমার ক'জন চিত্রগ্রাহক এসব ক্যামেরা সম্পর্কে থিওরিটিক্যালী জ্ঞান রাখেন? গাইতে গাইতে গায়েন হিসাবে (সহকারী চিত্রগ্রাহক) প্র্যাকটিক্যাল জ্ঞান কিছুটা রপ্ত করেছেন-এটা অনস্বীকার্য। তারা কী বলতে চাইবেন, এসব ক্যামেরা সম্পর্কেও জ্ঞান অর্জনের ব্যবস্থা সরকারকেই করে দিতে হবে! যদি তা হয় তাহলে, চলচ্চিত্র নির্মাতাও সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্য থেকেই নির্বাচন করা হবে-এমনটি যদি সরকার পক্ষ থেকে প্রস্তাব আসে সেটা কিন্তু একেবারেই ফেলে দেয়া যাবে কী? যারা প্রকৃত অর্থেই নির্মাতা, যার মধ্যে সৃজনশীলতা থাকবে, তিনি প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকবেন-এটাই স্বাভাবিক। প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হলে একটা উপকারতো হবেই আর সেটা হচ্ছে চলচ্চিত্র থেকে আলু-পটল ব্যবসায়ীদের বিদায় ঘন্টা বাজবে। সেখানে স্থান করে নিবেন শিক্ষিত, চলচ্চিত্র জ্ঞান সম্পন্ন কোন সুস্থ রুচিবান লোক।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে আপনি চোখ বন্ধ করে বসে থাকবেন। এটাতো ঠিক না। একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, চোখ শুধু আপনারই বন্ধ, অন্য সবাই কিন্তু দেখছে। ফলাফল, আপনিই নিজের একগুয়েমীর কারণে দেখা থেকে বঞ্চিত হলেন। মুখে মুখে বিশ্ব সংস্কৃতির দুয়ার খোলা বলে বাস্তবে বন্ধ করে রাখলে ফলতো ভালো হবেই না, বরং সেটা আমাদের জন্য বুমেরাং হয়ে দেখা দেবে। দেশীয় ছবির মান ক্রমান্বয়ে খারাপ হচ্ছে, দর্শক হলবিমুখ হচ্ছে, হল বন্ধ হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকুক-সেটাই কী তথাকথিত চলচ্চিত্রপ্রেমীরা (দেশপ্রেমী!) চাইছেন? তাহলেতো ভারতীয় ছবি না আসলেও একসময় বাংলা বিদঘুটে ছবির দাপটে ঢাকাই চলচ্চিত্র শিল্পই একদিন বন্ধ হয়ে যাবে।
বি: দ্র: লেখাটি পাক্ষিক বিনোদন বিচিত্রা (১-১৫ জুন সংখ্যা) এবং সাপ্তাহিক মিডিয়া ভুবনে প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জুন, ২০১০ বিকাল ৪:০২