শামচুল হক
সোহাগীর বয়স খুব বেশি নয়, তেরো চৌদ্দ হবে। জন্মের পরে বাবাকে চোখে দেখেনি। ছোট বেলা থেকেই মায়ের সাথে শহরে বাস। চারচালা ঘরে কখনও শুয়েছে কিনা সোহাগীর মনে পড়ে না। রাস্তের পাশে পলিথিনের নিচে মা মেয়ের রাত কাটতো। নয় দশ বছর বয়সের সময় হঠাৎ জ্বর হয়ে মা মারা যায়। অনাথ অবস্থায় দশ জনের কাছে হাত পেতে দিন কাটত। আরো একটু বড় হলে বদমাইশদের কবলে পড়ে যায়। কিছু বুঝে উঠার আগেই সব শেষ। এরপর থেকে রাস্তার আরো দশটি মেয়ের মতই পয়সার বিনিময়ে ব্যবহৃত হতে থাকে। পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ নেই। শেফালী, চামেলী, কল্পনা এরাই এখন তার বিপদ আপদের সাথী। ওদের সাথেই রাতদিন কাটে। ওদেরও যে পেশা সোহাগীরও সেই পেশা।
রাত দেড়টার সময় সোহাগী একটি অন্ধকার গলির মুখে দাঁড়িয়ে খরিদ্দারের জন্য অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ পুলিশ এসে হামলা করে। পুলিশের হাতে ধরা পরার আগেই দেয়াল টপকে ভিতরে চলে যায়। মুহুর্তেই উধাও হয়ে যাওয়ায় পুলিশ তাকে ধরতে পারে নাই। কিন্তু ধরতে না পারলেও এই এলাকায় যে সে লুকিয়ে আছে এটা বুঝতে পেরেছে। তার অস্তিত্ব এই এলাকায় আছে মনে করেই টহল পুলিশ ঘনঘন হুইসেল দিতে থাকে ।
পুলিশ ঘনঘন হুইসেল দেয়ায় সোহাগী ভয় পেয়ে যায়। দেয়ালের ভিতর থেকে বের হওয়ার সাহস পায় না। খিদেও লেগেছে। সন্ধ্যায় খাওয়া হয়নি। হাতে কোনো টাকা পয়সা ছিল না। গত রাতে যা রোজগার করেছিল তা দিয়ে দুপুরে এক প্লেট ভাত আর একটু আলু ভর্তা কিনে খেয়েছে। অর্ধেক পেটেও ভরেনি। ক্ষুধায় পেট চো চো করছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। ক্ষুধার্ত থাকা সত্বেও পুলিশের ভয়ে বের হতে পারছে না। তার পেটের ক্ষুধা তো পুলিশ বুঝবে না। পুলিশ ধরেই আগে কুত্তার মত পেটাবে তারপর টেনে হিঁচড়ে থানায় নিয়ে যাবে। ক্ষুধার্ত দেহে পেটন সহ্য করার মত তাগত নেই। শক্তিমান পুলিশের দুই পেটনে মারাও যেতে পারে। তার চেয়ে মশার কামড় খেয়ে এখানে বসে থাকাই ভালো, কষ্ট হলেও পুলিশের পেটনের সম্ভাবনা নেই।
প্রায় দেড় ঘন্টা থাকার পরও পুলিশ এলাকা ছাড়ছে না। বাড়ির দেয়ালের পাশে রাখা একটি ভাঙা ময়লা ড্রামের আড়ালে লুকিয়ে আছে। পুলিশ কয়েকবার দেয়ালের উপরে উঠেছিল কিন্তু অন্ধকারে সোহাগীর অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি। ড্রামের নিচেই দুর্গন্ধময় নর্দমা। মশা জেকে ধরেছে। পুলিশের ভয়ে বেশি জোরে মশা তাড়াতেও পারছে না, আবার মশার কামড়ে টিকতেও পারছে না। পুলিশ দু'একটি পেটন দিয়ে ছেড়ে দিলে অসুবিধা ছিল না কিন্তু যদি জেল হাজতে পাঠিয়ে দেয় তাহলে আর উপায় থাকবে না। নিজের কেউ নেই। জেলখানা থেকে বের করবে কে? সারা জীবন জেলেই পঁচতে হবে।
এভাবে আশংকার নানারকম ভাবনা ভাবতে ভাবতে অনেক সময় পার হয়ে যায়, তারপরও পুলিশের হুইসেল বন্ধ হয় না। সোহাগী অস্থির হয়ে উঠে। মনে মনে ভাবে-- আর কতক্ষণ বসে থাকা যায়। এভাবে বসে থাকলে আজকের রাতে কোন রোজগারই হবে না। রাতে না হয় কিছু না খেলাম সকালে তো কিছু খেতে হবে। সকালে কিছু না খেলে ক্ষুধার্ত দেহে হাঁটার ক্ষমতাও থাকবে না। এই বয়সে ভিক্ষা চাইলেও কেউ ভিক্ষা দেয় না, হাত পাততে দেখলেই দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। উঠতি বয়সের রাস্তার মেয়েদের এমন দশা-- রাতের অন্ধকারে শারীরিক সম্পর্কের কারণে কেউ গ্রহণ করলেও দিনের আলোতে আর গ্রহণ করে না। ভাগারের ময়লা আবর্জনার মত মনে করে। সারা দিন না খেয়ে পড়ে থাকলেও কেউ জিজ্ঞেস করে না। রাস্তার কুকুরগুলোর যত না মূল্য আছে রাস্তার পতিতাদের তাও নেই। কুকুরের চেয়েও হেয় জ্ঞান করে রাস্তার পতিতাদের।
অনেক অপেক্ষার পর পুলিশের হুইসেল বন্ধ হলো। সোহাগী মনে করল হয়তো পুলিশ চলে গেছে। কিন্তু দেয়াল টপকাতে গিয়ে থেমে গেল। পুলিশের দল রাস্তার ঐ পাশে দাঁড়িয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। রাস্তাটি প্রশস্ত হওয়ায় আবছা অন্ধকারে চোখে দেখে নাই। দেয়ালের উপরে উঠেই আবার তাড়াতাড়ি নিচে নেমে যায়। সোহাগী দেয়াল টপকে যে বাড়িতে ঢুকেছে সে বাড়িটি দেয়াল ঘেরা ছাদ পিটানো একতলা বিল্ডিং। বিল্ডিংয়ের সামনের দরজা কিছুটা খোলা। সদর দরজা খোলা থাকায় সোহাগীর মনে হলো ঘরের ভিতরে হয়তো মানুষ জেগে আছে। কিন্তু অনেকক্ষণ বসে থাকার পরও কোন মানুষের সারা শব্দ পেল না। আস্তে আস্তে দেয়ালের পাশ দিয়ে পিছনে চলে গেল। প্রথম রুমের পরের রুমের জানালার একটি পাল্লা খোলা। ঘরে লাইট জ্বালানো। খোলা জানালা দিয়ে বাইরে আলো পড়ছে। আস্তে আস্তে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। উকি দেয়ার সাহস পেল না। ঘরের ভিতরে কোন সারাশব্দও নেই। উঁকি দেয়ার অপেক্ষায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। একটা পর্যায়ে সাহস করে জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। রুমে লাইট জ্বললেও কোন লোক নেই। পরের রুমের জানালাও খোলা। পা টিপে টিপে ওই জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ভিতর থেকে মুমুর্ষ লোকের কাতরানোর শব্দ ভেসে আসছে। একজনের কাতরানো ছাড়া আর কারো কোনো সাড়া শব্দ পেল না। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। অনেক অপেক্ষার পর সাহস করে জানালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল। অগোছালো বিছানায় একজন লোক শুয়ে শুয়ে কাতরাচ্ছে আর পানি পানি করছে। সোহাগী খোলা জানালা দিয়ে লোকটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল। বিছনার পাশেই টেবিল। টেবিলে পাউরুটি, কলা, আঙুর, আপেল সাজানো। ঘরে আর কোন লোক দেখা যায় না। পাউরুটি দেখে সোহাগীর ক্ষুধা দ্বিগুন বেড়ে গেল। একটুকরা পাউরুটি পেলে খেয়ে একটু পানি পান করে রাত কাটাতে পারতো। দুপুরের পর থেকে পুরোই না খাওয়া।
জানালা ছেড়ে সামনের গেটের কাছে চলে এলো। দরজা অল্প ফাঁক হয়ে আছে। একটু ধাক্কা দিলেই হয়তো খুলে যাবে। ভিতরে ঢুকতেও সাহস পাচ্ছে না। যদি চোর মনে করে ধরে মারধোর দেয়। দরজা দিয়ে না ঢুকে বিল্ডিংয়ের পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। রান্না ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে সেখানেও লোক নেই। তার মনে হলো লোকটি একাই আছে। হয়তো কোন অসুখ-বিসুখ করেছে। আস্তে আস্তে আবার সামনে চলে এলো। দেয়ালের উপর মাথা উঁচু করে রাস্তার দিকে তাকালো। তখনও পুলিশের দল টহল দিচ্ছে। ঘরের সদর দরজা খোলা থাকলেও বাহির দেয়ালের গেট ভিতর থেকে তালা বন্ধ।
সোহাগী আস্তে আস্তে বাহিরের দরজা ঠেলে রুমের ভিতরে চলে গেল। কারো কোন সারা শব্দ পেল না। ভিতরের রুম থেকে শুধু ঐ একজনেরই কাতর কণ্ঠ অনবরত ভেসে আসছে। লোকটির পানি পানি উচ্চারণ রুমের বাইরে থেকেও শুনেছে, রুমের ভিতরে এসেও ঐ একই কথা শুনতে পাচ্ছে। মনে হয় রুমে আর কেউ নেই। থাকলে অবশ্যই পানি দিত। ভিতর রুমের দরজা ঠেলা দিতেই খুলে গেল। খাটের উপর চিৎ হয়ে শুয়ে সেই লোকটি কাতারাচ্ছে আর পানি পানি করছে। আস্তে আস্তে কাছে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটি চোখ বন্ধ করে আছে। একবারও চোখ খুলছে না। চোখ বন্ধ রেখেই পানি পানি করছে।
ক্ষুধার্ত সোহাগীর কাছে এই মুহুর্তে অন্য কোন জিনিষের প্রতি লোভ নেই। সে বার বার পাউরুটির দিকেই তাকাচ্ছে। এক টুকরো পাউরুটি পেলেই তার কিছুটা হলেও ক্ষুধা মিটবে। মুখে পানি পানি করলেও লোকটি চোখ খুলছে না দেখে সোহাগী পাউরুটি চুরি করার মোক্ষম সুযোগ মনে করল। ইচ্ছা করলে সোহাগী অনেক কিছুই চুরি করতে পারতো কিন্তু ক্ষুধার্ত দেহে একটুকরো পাউরুটি ছাড়া আর কিছু নেয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। দ্রুত পাউরুটির প্যাকেটটি হাতে নিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না, লোকটি আবার পা--নি পা--নি করে উঠল। পাউরুটিটা ওড়নার আঁচলে পেচিয়ে দু'হাত দিয়ে বুকের উপর আকড়ে ধরে থমকে দাঁড়ালো। তার ভিতরে মনবিকতা জেগে উঠল। ক্ষুধার্ত হয়েও নিষ্ঠুর হতে পারল না। লোকটির দিকে ফিরে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, লোকটির আসলেই এই মুহুর্তে কেউ নেই। তাকে পানি দেয়া দরকার। পানি খাওয়াতে গিয়ে চোর হিসাবে ধরা পরলেও বলতে পারবো, আপনার কাতরানো দেখেই আমি পানি দিতে এসেছি।
সোহাগী বোতল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে লোকটির মুখের কাছে ধরল, লোকটি চোখ বন্ধ করেই পানি খেল। পানি খাওয়ার পরও লোকটি কাতরাচ্ছে। পানির গ্লাসটি টেবিলে রেখে ভয়ে ভয়ে লোকটির কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠল। প্রচন্ড জ্বর। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সোহাগী রাস্তার মেয়ে, রাস্তায় থাকে, রাস্তায় বড় হয়েছে, পরিবার সম্পর্কে বা কোন মানুষের সেবা সম্পর্কে তার কোন ধারনা নেই। জ্বর হলে কি করতে হয় সে জানে না। তবে বেশি জ্বর হলে যে মাথায় পানি ঢালতে হয় এইটা সে জানে। রাস্তার মেয়েদের কারো জ্বর হলে তারা সবাই মিলে মাথায় পানি ঢেলে মাথা ধুয়ে দেয়, তাতে জ্বর কমে যায়। সেই কথা চিন্তা করেই সোহাগী লোকটির অসহায় অবস্থায় মাথায় পানি ঢালার সিদ্ধান্ত নিল।
পাশের রুম থেকে একটা পলিথিন এনে লোকটির মাথার নিচে বিছিয়ে দিল। গোসলখানা থেকে এক বালতি পানি এনে মগ ভরে ভরে মাথায় ঢালতে লাগল। লোকটি খুব আরাম বোধ করল। মাথায় পানি ঢালা অবস্থায় ঘুমিয়ে গেল। সোহাগী পানি ঢালা বন্ধ করে গামছা দিয়ে মাথা মুছে দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
(ক্রমশঃ)
ছবি ঃ ইন্টারনেট
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ৯:৫৯